গীতবিতান : অরূপ মাধুরী
বই পড়া চাই, হাতের কাছে পাই, পড়ি।
এমন সব বিখ্যাত বই, অথচ কয়েক পৃষ্ঠা পড়ার পর আর এগোতে পারিনি। মাত্র কয়েক
পৃষ্ঠা পড়তে ভিরমি খেয়েছি বারবার। কোনো কোনোটা শেষ করেছি, তবে শেষ করার
রেহাই-সুখ ছাড়া আর কোন সুখ পেলুম না। কিন্তু ‘গীতবিতান’-এ রবিঠাকুর তুমি
‘অন্ধকারের মাঝে আমায় ধরেছ দুই হাতে। (পৃঃ ৫২)।
বিশ্বসাহিত্যের যে ক'টা বই আমার মনে
বাসা বেঁধেছে, এর বাং মধ্যে নিঃসন্দেহে গীতবিতান প্রথম স্থানে। প্রায় এক কিলো
ওজনের গানে ১০৩৪ পৃষ্ঠার বই এটি। (বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, বৈশাখ আর ১৩৮৯)। ২২৩২
গান সন্নিবেশিত গীতবিতান-এ।
এটি সুরক্ষিত রাখি না বই-এর রেকে বা
আলমারিতে— পড়ে থাকে পড়ার টেবিলে, বিছানায়, হারমোনিয়ামের উপর। যখন মনে হয়
খুলি, পড়ি অথবা গান ধরি। প্রায়ই অবাক হই, অবাক সারিয়ে উঠি। অবাক একারণে যে,
রবিঠাকুর লিখলেন কী করে! মননের কী সীমাহীন ব্যাপ্তি, কী সাবলীল! গীতবিতান-এ
রবীন্দ্রনাথের প্রায় নিরানব্বই শতাংশ গান রয়েছে। তাঁর আর কোনো সৃষ্টি জানি
ছাপিয়ে যেতে পারেনি তাঁর গানকে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথেরও এই মত, তিনি বলেছেন, তাঁর
সব ফুরিয়ে গেলেও তিনি তাঁর গানের জন্যে বেঁচে থাকবেন। জীবন সংবদ্ধ তাঁর গানে।
মানুষের জীবন কি শুধু জন্ম-মৃত্যু-তারিখ-ক্ষণে
বেঁধে রাখা যায়? -জন্ম-মৃত্যু ফ্রেমের অন্তর্গত 7 প্রবাহই তো জানি জীবন। আর এ
প্রবাহ অনায়াসে মেলে তাঁর গানে। সব সময় তাঁর গান শুনে আমার তত ভাল লাগে না, মাঝে
মাঝে ম্যাড়মেড়ে ‘খেরো' মনে হয়। মাঝে মাঝে ভাল লাগে তাঁর 1 গান পড়ে। কেন ভাল
লাগে? তার বিশ্লেষণ কি দেওয়া যায়? * গীতবিতান বলে কথা— শব্দ দিয়ে বাঁধা যায় কি
মনের কথা?
জানা-অজানার দোলাচলে কখন যে আপন হ'ল
গীতবিতান। —বই তো নয়, বই-এর কাঠামো ছেড়ে শব্দাতীত কিছু, আমার হাড়মজ্জায় মিশে
গেছে এতদিনে। এমন অবস্থায়, এই বই সম্পর্কে আমার কথা কোন পরিখায় বাঁধি। 'ধরা
দেওয়ার ধন সে তো নয়...'
কূল হারা কোন্ রসের সরোবরে মূলহারা ফুল
ভাসে জলের 'পরে।
হাতের ধরা ধরতে গেলে ঢেউ দিয়ে তাই দিই
যে ঠেলে—
আপন মনে স্থির হয়ে রই, করিনে চুরি।
ধরা দেওয়ার ধন সে তো নয়, অরূপ
মাধুরী।।
রবীন্দ্রনাথর রূপময় লেখনীতে নানা
ভাবের সমন্বয়ে গান ফুটে উঠেছে। তাঁর সব গান সবার জন্যে নয়, আবার সব গানই সবার
জন্যে, কারণ তাঁর গান যে মানব-মনের উৎকর্ষতায় ভরা।
সাহিত্যের নানা ফরমে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে
ব্যক্ত করেছেন, কিন্তু
‘গানের ভিতর দিয়া যখন দেখি ভুবনখানি
তখন তারে চিনি আমি, তখন তারে জানি।'১৫
জানি, রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি সৃষ্টিতে
অন্তর্মুক্তির আকুতি রয়েছে। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক মুক্তি তো বহিরঙ্গের
ব্যাপার, অন্তর্মনে মুক্তি না পেলে সে কোনো কাজের নয়। তাঁর গানে নানাভাবে স্পষ্ট
মুক্তির বাণী –
গানে গানে তব বন্ধন যাক টুটে
রুদ্ধবাণীর অন্ধকারে কাঁদন জেগে উঠে।।
(৯)
উদারভাবে উদাহরণ দিতে গেলে বিরাট
পরিসরের প্রয়োজন, এখানে তা সম্ভব নয় বলে সংহত হতে হচ্ছে। যা একান্ত প্রয়োজন
তা-ই তুলে ধরছি।
বলা বাহুল্য, বাংলায় অরূপ রতন' পেতে
হলে গীতবিতান পড়া আবশ্যিক। ছন্দ ও চিত্রকল্পের এমন মেলবন্ধন আর কোথায়। বাংলা ও
ইংরিজি ভাষায় অনেক গান পড়েছি, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের পানে যে আভিজাত্য, অথচ
প্রাণময়, একাধিক অর্থবহ চিত্রকল্প- মার কারো গানে পাইনি আজও। তাঁর নমনীয়তা,
কমনীয়তা, তীব্রতাও ল্পিত। তাঁর পরিশীলিত শিল্পবোধ অতুলনীয়! তাঁর গানের মতো
ণসঞ্চারী সাধারণ শব্দের সমাহার আর কোথায় মেলে! অভাবনী র ভাবনালোক, যেখানে স্পর্শ
তাঁর সেখানেই আলো জ্বলে। আলে ঝি তাঁর মুক্তির স্বরূপ —
আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে,
আমার মুক্তি ধূলায় ধূলায় ঘাসে ঘাসে।। (পৃ:
১৪১)
উল্লেখ্য, বাড়িতে গীতবিতান থাকলে
গীতা, বাইবেল-এর প্রয়োজন পড়ে না। পড়ে না ত্রিপিটক , উপনিষেদেরও
--এ-ই বোধ করি।গীতবিতান যথার্থ জীবন
দর্শনের পাঠ বলে মনে করি।
গীতবিতান শিখিয়
বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর
প্রার্থনা
আমি না যেন করি ভয়।
দুঃখতাপে রাখিত চিনা না, দুঃখে যেন
করিতে পরি জয়।। ( ১০০ )
গীতবিতান বুঝি, দৃষ্টির আড়ালের
দৃষ্টি, জীবন সঞ্জীবনী, বাচার রসদ, বাঁচার বোধ, আনন্দের অপরিসীম খোরাক। গীতবিতান
শিখিয়েছে, অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাওয়া, শিখিয়েছে অহংকার থেকে মুক্তি পেলে
অনির্বচনীয় আনন্দের দ্বার খোলে, শিখিয়েছে আত্মজিজ্ঞাসা, শিখিয়েছে পজিটিভিজম—
আছে দুঃখ আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শাস্তি, তবু আনন্দ , তবু অনন্ত জাগে।। (পৃ: ১০৮)
সম্বিত পেয়েছি জেনে যে, দুঃখ নয়—
'আনন্দধারা বহিছে ভুবনে।' আশ্বস্ত হয়েছি বৈরাগ্য উপলব্ধি করে—
ওই আসনতলের মাটির 'পরে লুটিয়ে রব,
তোমার চরণ-ধূলায় ধুলায় ধূসর হব।।
(পৃ: ১৯৪)
জীবনের অলিগলিতে বারবার রবিঠাকুর
এসেছেন। আমার প্রায় ছ'বছর বয়সে প্রথম আমাকে রবি জাপটে ধরেন। জানতাম কি পারে কালি
দুটির রাজা যে তিনি। পূর্ববঙ্গের কোন এক গাঁয়ে এক বাড়ির দাওয়ায় বসেছিলেম বিকেলবেলায়।
চোখের সামনে শুরুর বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর। আর আমি গান ধরেছি, মাত্র দুটি কলি—
পাগলা হওয়ার বাদল-দিনে
পাগল আমার মন জেগে । (৮)
-এ গান তো গান নয়, আমার শৈশবে প্রায়
জপের মালা হয়ে উঠেছিল।
তারপর অনেক বছর পর শিলচরে আমার আর এক আত্মীয়বাড়িতে
আমি প্রথম রবি- সাগরের প্রকৃত বেলাভূমিতে পা দিই যার হাত ধরে, সে দুবেণী-করা চিকন
মেয়ে, ডাগর তার চোখ। কাছে এলে মনে হত আকাশে ওড়ার ডানা বেঁধে দেওয়া আছে তাঁর
কাঁধে। সে আর আর মেয়ের মতো নয়, রবীন্দ্রনাথেরই মানস কন্যা বুঝি। তার কাছে আকাশ
আর মাটির ফারাক বুঝতাম না কোনোদিনও। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ বলে কিছু জানতাম না
তখন। মাঝখানে আর কোনো মানুষের আনাগোনা ছিল না, ছিল এক ছায়ার আনাগোনা— তিনি
রবীন্দ্রনাথ। তিনি গানের পসরা সাজাতেন— ধারায় নামত একের পর এক—
১। আকাশ ভরা সূর্যতারা
২। আমার সোনার হরিণ চাই
৩। আজি বিজন ঘরে নিশীথ রাতে
81আমার জীবনপাত্র উচ্ছলিয়া
৫ । আমার এ পথ তোমার পথের থেকে অনেক
দূে
৬। চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী
91 ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে
৮। যদি প্রেম দিলে না প্রাণে
৯।প্রেম এসেছিল নিঃশব্দ নীরবে
১০।আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে
--এরকম অজস্র গান । আজ প্রশ্ন জাগে সেই
দিনগুলো কি অলীক কল্পনা? দিনগুলো তো ‘সোনার খাঁচায় রইল না’।
সে আর এক জগৎ। আমার মা-এর কণ্ঠে শোনা—'পড়বে
না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে…’। মা এখন
নেই, এখনও শুনি সে-গান, এখনও আসে ভেসে। এ গান শুনেছি অনেকের কণ্ঠে। মা, জানি,
কিছুটা ভুল সুরে গাইতেন তা এখন বুঝি, রবীন্দ্রনাথ
হয়ত এটিই গানের প্রকৃত সুর বলে মেনে নিতেন। মা'র কন্ঠস্বর ছিল মিহি, অথচ সরস,
প্রাণময় গায়কী। ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারতেন ‘ অন্য কোথা, অন্য কোনখানে’।
-রবীন্দ্রসঙ্গীতে অভিষিক্ত আরো একটি
ঘটনা না বলে পারছি না। নাগাল্যান্ডের ডুয়েনসাং শহরে দেখা হয়েছিল দী (দীপঙ্কর
ভট্টাচার্য) সঙ্গে। আমি তখন যুবক, তিনি বয়স্ক। অদ্ভু বৈপরীত্য তাঁর চেহারা ও
স্বভাবে। মুচো মুখ, বড় ধাওয়া-চোখ। কথায় কথায় রবিঠাকুরের কলি আওড়াতেন।
লক্ষণীয়, ওই অঞ্চলে কি বাতাস বইত শি-শি প্রায় সারাক্ষণ। বড় বড় গাছ আর অর্কিড
ফুলে ছাওয়া চতুর। তারই মাঝখানে তাঁর কুটির— টিনের ছাউনি আর সব কাঠ। আশপাশে কোনো
বাড়ি ছিল না। বেশির ভাগই টি বিকেলে তাঁর বাড়ি গেছি এবং গান শোনার জন্যেই যাওয়া।
গীতবিতান টেনে নিতেন কাছে, খুলতেন গান, তবে দেখে গাইতেন না, অন্তত এ গান, চোখ মুদে
গাইতেন—
কার মিলন চাও বিরহী
তাঁহারে কোথা খুঁজিছ ভব-অরণ্যে
কুটিল জটিল গহনে শান্তিসুখহীন ওরে মন।।
দেখো দেখো রে চিত্তকমলে চরণপদ্ম
রাজে-হায়!
অমৃতজ্যোতি কিবা সুন্দর ওরে মন।। (পৃ:
১৭৩)
যে-বিরহ বেদনা সঞ্চারিত হয় এ গানে,
প্রতি বাঁকে, বুঝি, আছে 'পূর্ণের পদপরশ'ও মেলে। দীপঙ্করদা ছাড়া কারো কণ্ঠে এ
গানের নস প্রাণসত্তার প্রকাশ আমার কাছে ধরা পড়েনি।
তবে ধরা অধরার মধ্যে 'গানের ভেলায়
বেলা অবেলায় এগোতে পারি। থামতেও পারি। কারণ, সামনে একটু অরাবীন্দ্রিক ইল দাড়ি
ঝুলে আছে বেশ কিছু সময় ধরে। তাকে নামিয়ে বসালেই এ পরা যাত্রায় আমার লেখার শেষ।
আবার গীতবিতান কি এমনি করে শেষ করা যায়- আগেই বলেছি তার পরিধি জীবনবৃত্তের নানা
খাচ্ছে যে ওতোপ্রোতো জড়িত! যত টানবে ততো বাড়বে। শেষ হয়েও শেষ হবার নয়।
শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে?
আঘাত হয়ে দেখা দিলে, আগুন হয়ে জ্বলবে।।
সাঙ্গ হলে মেঘের পালা শুরু হবে বৃষ্টি
ঢালা,
বরফ-জমা সারা হলে নদী হয়ে গলবে।।
১৯শে মে স্মরণে বাংলাভাষার সংকটময় অবস্থা ও সমাধান
সমরবিজয় চক্রবর্তী
১৯৬১-এর ১৯ মে ১১জন ভাষা শহিদ সম্পর্কে
কমবেশি সচেতন বাঙালিরা অবগত বলে ধরে নেওয়া যায়।আজকাল কলকাতারও নানা জায়গায় এই
দিনটি পালন করা হচ্ছে।ভাষার জন্য একই দিনে এতো সংখ্যক জীবনদান যেখানে একজন তরুণীও
রয়েছেন, এমন নজির কোথাও নেই বলে জানি।যাক ১৯মে’র ব্যাপারে অনেক লেখাজোখা হয়ে গেছে
এবং হচ্ছেও।আতর্জাল খুললেই বিশদভাবে পাওয়া যাচ্ছে।সেই ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটির
চেয়ে স্বাধীন ভারতে বাংলা ভাষার দুঃখজনক অবস্থান এবং উদ্ধারের ওপর আলোকপাত করা
বেশি প্রয়োজনীয় বলে বুঝি এবং এই উদ্দেশ্যেই এই প্রতিবেদন।
প্রয়োজনীয়তার ওপর নির্ভর করে বাঁচা-বাড়া—ভাষার ক্ষেত্রেও
তা।স্বাধীনতাপূর্ব ভারত উপমহাদেশে বাংলার অবস্থান এক, আর স্বাধীনোত্তর
খণ্ডিত ভারতে অন্য।তখন অবাঙালি অঞ্চলে কোথাও কোথাও স্কুল, কলেজে এমনকি
বিশ্ববিদ্যালয়স্তরেও বাংলা পঠন ছিল।অবাঙালি অঞ্চলে কোথাও কোথাও গ্রন্থাগারেও বাংলা বই পাওয়া যেত।অবাঙালির বাংলায় কথা
বলা গর্বের ছিল।ষাটের দশক অবধি, দেখা যায়, দেশের
সর্বত্র এমনকী রাজধানী দিল্লিতেও বাংলার একটি মান ছিল, অবশ্য
প্রাক স্বাধীন ভারতের সেই অত্যুঙ্গ গর্বের জায়গাটি আর পাওয়া যায়নি।বাংলা
ভাষার এখন বিপরীত অবস্থান।এমন কেন হবে, অসুখটা কী তা জেনে নিলে নিরাময়ের ব্যবস্থা
করা যেতে পারে।সুতরাং প্রথমে অসুখের লাক্ষণিক দিকগুলো জেনে নিতে হয়।
আজ বাংলা রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে আঞ্চলিকভাষা। নিজ গুণে যে
রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেয়েছিল বাংলা, আজ সে মর্যাদা নেই। রাষ্ট্রশক্তি পেছনে না থাকলে বাংলা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেতে পারে না।যদিও বাংলা আন্তর্জাতিকস্তরে অন্যতম উন্নত ভাষা,ভারতীয় সংবিধানে অষ্টম তপসিলভুক্ত ‘আঞ্চলিকভাষা’
অবিধা ব্যতিরেকে বাংলার কোনও স্থান দেওয়া হয়নি।তাই এই রেনেসাঁ ভাষা সরকারি বিশেষ
সাহায্য থেকে বঞ্চিত।
তামিল, তেলেগু, মালয়ালম,কন্নড় এবং ওড়িয়া আদায় করে নিয়েছে
ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি, এখন এ’তাদের রক্ষা কবচ।নইলে কার্য-কারণ বশত এই পাঁচটি
ভাষাও হিন্দি আর ইংরেজির কবলে বাংলার মতো বগলদাবা হয়ে থাকত।ইংরেজির প্রভাব থেকে মুক্ত পৃথিবীর কোনও ভাষাই নয়,
জার্মান, ফরাসি, রাশিয়ার মতো ইউরোপের তাবড় ভাষাও শঙ্কিত।আমাদের বাড়তি শঙ্কা
হিন্দিকে নিয়ে।ব্যাপারটা তামিল আগে বুঝেছিল বলে, সর্বপ্রথম ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি
তামিল আদায় করে নেয়, এতে হিন্দির আগ্রাসন থেকে তামিল অনেকটাই নিরাপদে অবস্থান
করছে।সরকারের চরম মদতপুষ্ট হিন্দির থাবা থেকে বাংলা কিন্তু মুক্ত নয়। বাংলা সংবিধানের অষ্টম অনুচ্ছেদেই পড়ে রইল।
বাংলাভাষী কোনও দিন এব্যাপারে সরকারের সংগে বসেছে বলে এই নিবন্ধকের জানা
নেই।রেখেছে।
উল্লেখ্য,বাংলা সাহিত্যে যে
রেনেসাঁস এসে ছিল উনবিংশ শতকে,
বিংশ শতকের
সত্তরদশক অবধি এর প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছে ভারতের প্রায় প্রতিটি ভাষা।হিন্দিভাষার
দৃষ্টান্তই দেওয়া যাক, যারা হিন্দিভাষা-সাহিত্যের ইতিহাস পড়েছেন, তাঁরা নিশ্চিত
লক্ষ করেছেন বাংলা সাহিত্যের প্রভাব হিন্দি সাহিত্যে কত,বাংলা সাহিত্যিকের নাম,বাংলা সাহিত্যমানের
গুণ-কীর্তন হিন্দি সাহিত্যের ইতিহাসে পরতে
পরতে মেলে, তবুও বাংলা ভারতের সংবিধানে আঞ্চলিক
ভাষামাত্র।
দেখা গেছে, যে ভাষা রাজকার্যে ব্যবহার হয়, যে ভাষা বানিজ্যে
ব্যবহার হয় সে ভাষার উপনিবেশিক শক্তি বেশি এবং এভাষাগুলোরই বাঁচা ও উন্নতির
সম্ভাবনা বেশি। স্বভাষীক
গোষ্ঠী ছাড়াও অন্য ভাষীক গোষ্ঠীও যদি সে ভাষা প্রয়োগ করে, তা হলে সে ভাষার বাঁচা-বাড়ার সম্ভাবনা প্রবল। এক সময় বাংলা, বিশেষ করে
পূর্বাঞ্চলে নানা
ভাষীক মানুষের মধ্যে বাক্যালাপে আদান-প্রদানের মাধ্যম ছিল, বাংলা এজায়গা ক্রমশ
হারাচ্ছে।বলতে
দ্বিধা নেই যদিও বৈশ্বিক আদর্শগত দিক থেকে তা অনৈতিক তবে তা বাস্তব সত্য,
কথাটা হলও এই,যে ভাষার
উপনিবেশিক চরিত্র নেই, সে ভাষার স্থায়িত্বও নেই। এক সময় বাংলা সর্বভারতে এবং বাইরে
বৌদ্ধিক মহলে স্থান
পেয়েছিল,আজ তা প্রায় একেবারেই নেই।এক সময় বাংলার বাইরে অনেক অবাঙালিরাও বাংলায় লিখতেন, বিদেশিরাও লিখেছেন,
পত্রপত্রিকা বেরতো ভারতের নানা স্থান থেকে, আজ এসব নেই বললেই চলে,নিজ ভূমেই বাংলা প্রবাসী যেন।
বাংলা পেতে পারে এদেশে দ্বিতীয় সংখ্যাগুরু ভাষার
স্বীকৃতি।দেশে বাংলা দ্বিতীয় সংযোগী ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেয়ে যেতে
পারত—এদিকে এগোচ্ছি না।যা বলার,ব্রিটিশ আমলে
কোনও রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা ছাড়াই ভারতীয়
উপমহাদেশের সকল ভাষার পথীকৃৎ হয়ে ওঠল বাংলা।
এতো সব বাধাবিপত্তি
থাকা সত্বেও বাংলার পক্ষে কিছু ধনাত্মক দিকও রয়েছে—ভারতে রাষ্ট্রশক্তি বাংলার পক্ষে যতটুকু থাকার
কথা ততটুকু না থাকলেও,
ভারতের জাতীয় সঙ্গীত বাংলায়, বাংলাদেশের তো আছেই। সিয়েরা লিয়ন রাষ্ট্রে বাংলা অন্যতম সরকারি ভাষা। আমেরিকায় নির্বাচনী প্রচারে বাংলাদেশী এবং ভারতীয় অভিবাসী বাঙালিদের জন্য বাংলাভাষায় প্রচার থাকছে। শিকাগো, নিউ ইয়র্কে বাংলা নামের সাইন বোর্ড অব্দি আছে দোকানে দোকানে— ঢাকা মিষ্টান্ন ভান্ডার, সুরুচি,গুলশন কাফে ইত্যাদি। লন্ডনের ব্রিক্ লেনে বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড বেশ কয়েকটা দেখলাম।লন্ডন
ও কোভেন্ট্রি মহানগরে পাবলিক গ্রন্থাগারে বাংলার জন্য আলাদা সেকশন দেখলাম।ব্রিটেনে কোনও কোনও শিক্ষায়তনে বাংলা ঐচ্ছিক ভাষা হিসেবে সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত বলে জানলাম,অবশ্য,সৌজন্যে বাংলাদেশ।
তবে বাংলাদেশের
মতো
একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র থাকা সত্বেও আগামি দু’
এক দশক পরে স্বমহিমায় বাংলাভাষা সেদেশেই টিকে থাকবে কি-না, এ’
নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।যেভাবে বাংলাকে ইসলামিকরণ করা হচ্ছে,
আরও কয়েক দশক পরে বাংলা আর
বাংলা চরিত্রে থাকতে পারছে না।এও উল্লেখ্য, যে সমাজে মুক্তচিন্তার অবকাশ নেই বা ক্ষীণ, সে সমাজ তো পঙ্গু, সে সমাজে
কোনও উন্নতিই সম্ভব নয়।বাংলার মতো
বিশ্বমানের ভাষা টিকে থাকাই তো শেষ কথা নয়।
আমাদের চাই সংবধানে অষ্টম তালিকাভুক্ত অবস্থানের
অতিরিক্ত বাড়তি মান,যাতে করে সরকারি বারতি
সুযোগ-সুবিধা বাংলা পেতে পারে,যে ভাবে হিন্দি পাচ্ছে। বাংলাভাষা দ্রুপদী
ভাষার মর্যাদা পেতে পারে কিনা, এনিয়ে ভাষাবিদরা বলবেন।যদি বাংলা ভারতীয় সংবিধানে
ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়,তাহলেও হয়।একরে
নিতে পারলে,বাংলা
আগের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কাও অনেকটাই ফিরে পাবে।বাংলার কেন্দ্রীয়
আর্থিক সহায়তা অনেকগুণ বেড়ে যাবে, একই সাথে বাড়বে বাংলার প্রায়োগিক
ক্ষেত্র, বাড়বে বানিজ্যিক মূল্য।বাঙালি
অবাঙালি অঞ্চলে থাকলেও, বাংলা এবং বাঙালিত্ব বেঁচেবর্তে ভালই থাকবে।মোদ্দাকথা,
ভারতীয় সংবিধানে বাংলাভাষার এক বিশেষ স্থান পাওয়া বাঞ্ছনীয়,আপাতত এ-ই হবে বাংলার
রক্ষাকবচ।
............................................................................................
আপ-এর টক্করে কৃষক আন্দোলনকারীরা কাত
সমরবিজয় চক্রবর্তী
সম্প্রতি পঞ্জাব
বিধানসভা নির্বাচনে কৃষকদের নানা সংগঠন নিয়ে গঠিত রাজনৈতিক
দল সংযুক্ত সমাজ মোর্চা(এসএসএম)র ৯৪
জন প্রার্থীর মধ্যে ৯৩ জনের জামানত বাজেয়াপ্ত হল।এই
চাঞ্চল্যকর এবং তাৎপর্যপূর্ণ খবরের বিশেষ পর্যালোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে কি না?কৃষক
আন্দোলনের বেশ কয়েকটি সংগঠন, যারা
প্রত্যাহার করা কেন্দ্রের তিনটি কৃষি আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে লাইমলাইটে আসে,
তাদের সংযুক্ত সমাজ মোর্চা(এসএসএম) পঞ্জাব বিধানসভা
২০২২-এর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে।বছর
ব্যাপি এই
কৃষক আন্দোলন কেন্দ্রীয় সরকারকে এক কথায় বেকায়দায় ফেলে দেয়।ছেড়ে
দেমা কেঁদে বাঁচির মতো অবস্থা।সংসদে
পাশ করা আইন সরকার আন্দোলনের চাপে সংশোধন করতে বাধ্য হয়,
এর নজির স্বাধীন ভারতে এই একটাই। প্রায়
প্রতিটি বিরোধী দলের সক্রিয় সহযোগিতা ছিল
এই আন্দোলনে।।কৃষি প্রধান এই দেশের কৃষকরা
অসন্তুষ্ট হলে কোনও দলের পক্ষেই ক্ষমতায় থাকা সম্ভব
নয়, নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার সম্ভাবনা।তাহলে প্রশ্ন ওঠে পঞ্জাব বিধানসভা নির্বাচনে এই
কৃষক আন্দোলনের প্রভাব ভোটের বাক্সে পড়েনি কেন?
কৃষকদের বিক্ষোভ নিয়ে
আলোচনা করতে গিয়ে ভাবতে হবে যে, যে কৃষকরা আন্দোলন করেছিল তাদের আর্থিক অবস্থান
কোথায়।এই আন্দোলনকারী কৃষকদের সংগে পশ্চিম বঙ্গ বা পূর্বাঞ্চলের যে কোনো রাজ্যের
কৃষকের কোনও তুলনা চলে না, কারণ পঞ্জাবের মতো বিশাল জমির মালিক এখানে কেউই নয়,এরা
ক্ষুদ্র চাষি। পঞ্জাব, হরিয়ানার কথা আলাদা।প্রধানত এই দুই রাজ্যে এখনও জমির মালিক
চাষি না-ই বললেই চলে।এ-ই এসএসএম-এর লজ্জাজনক পরাজয়ের প্রধান কারণ বলে মনে করি।প্রসংগত, ইউরোপ ও অ্যামেরিকা
থেকে এসে জোতদারদের অনেকে আন্দোলনে সামিল হয়।দেশের বাইরে থেকে তারা জোতদারী
করত।রক্ষণশীল সামন্ততান্ত্রিক সমাজে তা সম্ভব।রাস্তাজূড়ে দিনের পর দিন
খাওয়া-দাওয়া- চিকিৎসার সুবন্দবস্ত ছিল। এমন আলিসান আন্দোলনের আরো একটা দৃষ্টান্ত
কি দিতে পারবে? সাধারণ চাষিদের স্বার্থে মোটেই এই আন্দোলন নয়,তাই সাধারন ভোটাররা
এসএসএম থেকে প্রায় ১০০ডিগ্রি মুখ ঘুরায়।
সংযুক্ত সমাজ মোর্চা প্রধান
বলবীর সিং রাজেওয়াল (৭৯), যিনি কৃষক আন্দোলনের অন্যতম সফল শীর্ষ নেতা,
এসএসএম-এর প্রধান গঠন কর্তা, তিনিও জামানত হারান।কী নিদারুণ উপহাস।
লাল কেল্লার সহিংসতার
মামলায় অভিযুক্ত লখবীর সিং লাখা সিধানা, শুধু তার জামানতের টাকাটা রক্ষা পায়।
এসএসএম-এর আইনি সেলের
আহ্বায়ক এবং সর্বভারতীয় কিষান সভা মহাসংঘের সভাপতি প্রেম সিং ভাঙ্গু পাতিয়ালার
ঘানৌর আসন থেকে দাঁড়িয়ে ছিলেন, পেলেন মাত্র ১৬৮১ ভোট৷
টিকরি সীমান্তে কৃষকদের
চিকিৎসা সহায়তা প্রদানের জন্য এক বছর অতিবাহিত করার পর, ডাঃ সুখমনদীপ সিং ধিলোন
তারন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এমডি করার স্বপ্ন ছেড়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু মাত্র ১৩১৫ ভোট
পেলেন। গুরপ্রীত সিং কোটলি, একজন শিক্ষক এবং কৃষক, যিনি তাঁর ফেসবুক লাইভ
ফিডের মাধ্যমে কৃষকদের আন্দোলন কভার করেন,পেলেন মাত্র 880 ভোট।
নবদীপ সঙ্ঘ এসএসএম-এ যোগ দিতে আপ ত্যাগ
করেন, তার ঝুলিতে পড়ে ১৮৮৭ ভোট মাত্র, অন্যদিকে কলেজ অধ্যাপকা
অনুপার কৌর সান্ধুর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়,তিনি ৯০৯ ভোট পান।
পঞ্জাব বিধান সভা
নির্বাচনে আম আদমি পার্টির জয় কোনো
আকস্মিক ঘটনা নয়, এর মূল নিহিত ২০১৪-এর লোকসভা নির্বাচনে,দলটি প্রথমবারের মতো
পঞ্জাবের রাজনীতিতে প্রবেশ করেই ১৩টি লোকসভা আসনের মধ্যে চারটি জিতে নিল, মোট
ভোটের প্রায় ২৪ শতাংশ পেল।
এরপর, ২০১৭ বিধানসভায় ২০টা সিট
জিতে নিল,অর্থাৎ রুলিং পার্টি কংগ্রেসের পর দ্বিতীয়তে স্থান করে নিল। শিরোমণি আকালি
দল আর বিজেপি জোট তৃতীয় স্থান পেল।পঞ্জাবের মানুষ মাদক, অবৈধ খনন, মদ, ক্যাবল এবং পরিবহন
মাফিয়া থেকে মুক্তির পথ খুঁজছিল।এসএডি-বিজেপি এবং কংগ্রেস এসব মোদ্দা আম জনতার
কাছে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়।আম দিয়ে কাম আঁটি দিয়ে নয়, আপ বুঝিয়ে দিল।
আম আদমি পার্টি
জনসাধারণের হৃদয়ের কথা বুঝতে পেরেছিল।তাদের নির্বাচনী হরডিঙের একপাশে আম্বেদকরের
ছবি এবং আর এক পাশে ভগত সিংহ।আম্ববেদকর
দিয়ে জনজাতিদের মন জেতা আর অন্যদিকে ভগত
সিং বাম সহ সকল পঞ্জাবির কাছে পরম শ্রদ্ধা
ভাজন বলে হৃদয়ে স্পর্শ করা।তাছাড়া কেজরিওয়ালের দিল্লি মডেল, শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল
পরিবর্তন, মহল্লা ক্লিনিক, দুর্নীতি ছাড়া স্বচ্ছ সুশাসনও পঞ্জাবীদের মন কাড়ে। একই সময়ে, ভগবন্ত মান, যিনি তপশীলি
জাতি ভুক্ত, তাঁকে মুখ্যমন্ত্রীর মুখ হিসাবে
ঘোষণা করে অরবিন্দ কেজরিওয়াল আগেই সিংহভাগ ভোটারের মন জয় করে ফেলেন।
প্রকাশ সিং বাদল, ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং, সুখবীর বাদল, মুখ্যমন্ত্রী চরণজিৎ সিং
চান্নি, বিক্রমজিৎ সিং মাজিথিয়া এবং নভজ্যোত সিং সিধুর মতো অকুতোভয় ব্যক্তিদের
পরাজয় থেকে এটা স্পষ্ট যে পঞ্জাবের মানুষ কংগ্রেসি মসনদ পালটে দেবার জন্য মুখিয়ে
ছিল যা হয়েছিল ২০১১তে পশ্চিম বঙ্গে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সিপিএমকে হারিয়ে মমতা
বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভূতপূর্ব জয়, তৃনমূলের জয়।
জাত-পাত আর ডেরা পন্থকের
সমীকরণ এই নির্বাচনে ছিঁড়ে গেছে।
প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সুশাসনে সফল হলে এ বিজয়ের ফল হতে পারে সুদূরপ্রসারী।২০২৪এর
লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিকে ভাবতে হতে পারে।কেজরিওয়ালের সংগে মমতা যদি যুক্ত হন, তা হলে ভারতীয় রাজনীতিতে অন্যমোড়
নেবার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে, তোষামোদের রাজনীতি
কিন্তু শেষ।
21/03/2022,
দৈনিক যুগশঙ্খ
ইউনিফর্ম সিভিল কোড এবং জন্ম
নিয়ন্ত্রণ আইন ব্যতিরেকে গণতন্ত্র অর্থহীন
সমরবিজয় চক্রবর্তী
গণতান্ত্রিক
ব্যবস্থায় সকলের জন্য সমান আইনই প্রযোজ্য নইলে গণতন্ত্রের কোনও মূল্য থাকে
না।প্রতিটি উন্নত দেশে ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোষ্ঠী
নির্বিশেষে আইন কিন্তু সমান।গণতন্ত্র রক্ষার্থে ইউনিফর্ম সিভিল কোডের যেমন প্রয়োজন,তেমনই চাই অভিন্ন জন্ম নিয়ন্ত্রণ আইন, এযে একে অন্যের
পরিপূরক।
অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বা ইউনিফর্ম সিভিল কোডের ব্যাপারে সম্প্রতি এক বিবাহ বিচ্ছেদ মামলার প্রেক্ষিতে দিল্লি হাইকোর্ট এক নির্দেশনা জারি করে।আদালত স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছে, রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের জন্য একটি মাত্র ইউনিফর্ম সিভিল কোড থাকবে এবং তা শীঘ্রই সংসদে আইন হিসাবে
রূপান্তর করা চাই।
দেশের বিভিন্ন হাইকোর্ট সময় সময় অভিন্ন দেওয়ানি বিধির
প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয়।গোয়াতে
অভিন্ন সিভিল কোড বিল
বিনা বাধায় আইনে রূপান্তরিত হয়।
উত্তরাখণ্ড এবং উত্তর প্রদেশেও বিধান সভায়
এই বিল আনা হবে।আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা জন্মনিয়ন্ত্রণ এবং ইউনিফর্ম
সিভিল কোড, এই দুটিকে আইনে রূপান্তরিত
করার পথে হাঁটছেন।
ভারতে
ফৌজদারি আইন সকলের জন্য সমান, আবার দেওয়ানি আইন
অর্থাৎ ধর্মভিত্তিক।বিবাহ,
বিবাহবিচ্ছেদ,
উত্তরাধিকার,
সম্পত্তির
অধিকারের মতো বিষয়গুলিকে
একই আইনের আওতায় আনা
জরুরি এবং তা সংবিধান লেখার সময়ই অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া উচিৎ ছিল।সংবিধান
প্রস্তুতির সময় বাবাসাহেব আম্বেদকর ইউনিফর্ম
সিভিল কোডের পক্ষে সুদৃঢ় যুক্তিখাড়া করেন। কিন্তু
পণ্ডিত
নেহেরু তা
নাকচ করেন।তা
সত্তেও আম্বেদকর আর্টিকেল 44-এ
ইউনিফর্ম সিভিল কোডের
নির্দেশনা দিয়ে রাখেন এই আশায় যাতে করে ভবিষ্যতে তা আইনে পরিণত করা হয়।
বর্তমান সিভিল কোডে বৌদ্ধ, শিখ এবং জৈন
হিন্দু আইনের আওতায় পড়ে।মুসলমানের ব্যাপারে শরীয়ত আইন।প্রশ্ন ওঠে
তাহলে ফৌজদারি আইন মুসলমানের জন্য শরীয়ত অনুসারী নয় কেন?একদিকে
সংবিধানের উদ্ধৃতি দিয়ে আইনের চোখে সবাই সমান বলা হয়, এরকম প্রতারণামূলক
স্ববিরোধিতা আর কত দিন,
এ প্রশ্নও ওঠে আসে।দেশে অভিন্ন দেওয়ানি আইন(ইউনিফর্ম সিভিল কোড) না থাকায় বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ সমান অধিকার
থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ফলে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে।একই আইনের
অন্তর্গত না হলে সকল ভারতীয়ের মধ্যে যুক্তি সংগত কারণে জাতীয়তা বোধ জাগতে পারে
না।সম্প্রদায় বুঝে আইনের ভিন্নতা দেশে মানুষের মধ্যে নিরপত্তাহীনতা-বোধ
জাগিয়ে তোলে।রাষ্ট্র
কোনও ভাবেই আইন সৃষ্টি করে মানুষে মানুষে বিভেদ আনতে পারে না।কেউ পাবে বার্তি সুযোগ কেউ হবে বঞ্চিত, এমনটা
হতে পারে না।রাষ্ট্রে সম্প্রদায়গত যত ভিন্নতা রয়েছে তার সব কটাই
উঠিয়ে দেওয়া চাই, অনেক আগেই নিরশন করা উচিৎ ছিল। আপাতত অভিন্ন
দেওয়ানি বিধি এবং অভিন্ন জন্মনিয়ন্ত্রণ বিধি নিশ্চিত
হোক।
চীন ও ভারত বিশ্বের
সবচেয়ে জনবহুল দুটি দেশ। চীনে জন সংখ্যা প্রায়
একশ চল্লিশ কোটি এবং ভারতে প্রায়
একশ ত্রিশ কোটি।আয়তনে চিন ভারতের তুলনায়
১৯২% বড়।চিন কয়েক দশক ধরে প্রতি দম্পতির এক সন্তান
নীতি জারি করে জন সংখ্যার হার হ্রাস করতে সক্ষম হয়েছে।একথা নিশ্চিত হয়ে
গেছে যে ঐচ্ছিক জন্ম নিয়ন্ত্রণ ভারতেও
সম্ভব নয়।জন্মহার হ্রাস করতে না পারলে ভারত কখনও প্রথম বিশ্বে
উন্নিত হতে পারবে না।জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে দেশের আবাদযোগ্য
জমির পাশাপাশি অচিরেই পানীয় জলের ব্যাপক ঘাটতি হবে এবং দূষণ বাড়তেই থাকবে।এতো বিপুল
জনসংখ্যার দেশ হওয়া সত্তেও ভারত আজ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তবে দ্রুত
বর্ধনশীল জনসংখ্যাকে মানসম্পন্ন শিক্ষা, আবাসন, স্বাস্থ্য পরিষেবা
এবং পর্যাপ্ত পুষ্টি যোগান দেওয়ার থেকে দেশ অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে।ভারতে প্রতি
বছর প্রায় দুই কোটি পঞ্চাশ লক্ষ শিশুর
জন্ম হয়, সে অনুযায়ী প্রতিটি শিশুকে ভাল পুষ্টি, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং
পরবর্তীতে চাকরি দেওয়ার মতো অবস্থায় নয় এ দেশ আর উন্নত দেশের মতো বেকার ভাতা দেওয়া
তো দূর অস্ত।ভারতের এই সঙ্কটময় অবস্থায় যাদের কাছে এখনও রাষ্ট্রের চেয়ে ধর্ম বড়, জন্ম নিয়ন্ত্রণ যারা মানতে রাজি নয় তারা তো
এক কথায় রাষ্ট্র বিরোধী,রাষ্ট্রের হীত তারা চায় না, আইন অনুযায়ী তাদের সাজা হওয়া উচিৎ।
কারো কারো বেলায় গাছের
খাবো আবার মাটিরও কুড়োব, তা হতে দেওয়া যায় না।ধর্ম ভিত্তিক কোনও ধরণের
কোনও প্রশ্রয় তো ধর্মনিরপেক্ষতা নয়।এক কথায় রাষ্ট্র কোন ধর্মেরই অনুসারী হবে না, ধর্ম
মানে রিলিজিওন বা বলা যায় প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম।একথা মনে রাখতে হবে যে হিন্দু কোন প্রাতিষ্ঠানিক
ধর্ম নয়, হিন্দু ভারতে জাতো প্রাচীন সংস্কৃতি যা পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও শোধনের
মাধ্যমে আজকের দিনে এসে পৌঁচেছে।প্রসঙ্গত,রবীন্দ্রনাথ এক উৎকর্ষিত মানের নান্দনিক
ও মানবিক ধাঁচ গড়ে তুলেন।রবীন্দ্রনাথকে এখানে টেনে আনার কারণ হচ্ছে শাখা-ডাল
বিস্তৃত হিন্দু ধর্মের/সংস্কৃতির আকর বুঝি তিনি।একথা স্পষ্ট হয়ে যাওয়া ভাল যে
হিন্দু ধর্ম আর সংস্কৃতি সমার্থক।বিশ্বকবি যথার্থ অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ, ভারতীয়ত্বের
প্রকৃষ্ট উদাহরণ এবং দেশ তাঁকে অনুসরণ করে চলতে পারলে সমস্যার সমাধান হবে বলে প্রত্যয়ী।রাষ্ট্র কী ভাবে তাঁর
দেখানো ভারতীয়ত্ব বজায় রেখে নিয়ম নির্ধারণ করবে একথা নানাভাবে দেখিয়ে দিয়েছেন
রবীন্দ্রনাথ।১৯৩৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মার্গারেট স্যাংগার নামে এক যশ্বষী সাংবাদিকের কাছে চিঠি লিখে রবীন্দ্রনাথ সেই সময়ের ভারতে
বাস্তবনিষ্ঠ জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন।ঋষি-কবির মনে তখনই ধরা পড়েছিল জন্ম
নিয়ন্ত্রণ না করাতে পারলে দেশে জনবিস্ফুরণ ঘটবে।
কোনও অভিন্ন দেওয়ানি আইন এবং অভিন্ন
জন্মনিয়ন্ত্রণ আইন না থাকায় বিশেষ করে ধর্মীয়
সম্প্রদায় ভিত্তিক বিষবাস্প দেশে বেড়েই চলেছে,কেউ নায্য বিচার পাচ্ছে না, নানা ভাবে লাঞ্ছনা বেড়েই চলেছে।ধর্মের
নির্দেশনায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বিশেষ করে মহিলাদের উপর নিষ্পেষণ বেড়েই চলেছে।৮ মার্চ আন্তর্জাতিক মহিলা দিবস ঘটা করে পালিত হচ্ছে প্রতি
বছর কিন্তু অভিন্ন জন্ম নিয়ন্ত্রণ ও অভিন্ন দিয়ানি আইন সম্পর্কে মহিলারা নীরব।এই দুটি
আইন ব্যতিরেকে মহিলাদের অধিকার রক্ষা কী করে সম্ভব?অথচ এই দুটি আইনের অন্তঃস্থ উদ্দেশ্য ন্যায় এবং
কল্যাণ, সুষ্ঠ গণতান্ত্রিক দেশে যা একান্ত কাম্য।সমানাধিকার গণতন্ত্রের অন্যতম রক্ষাকবচ।
উদ্বাস্তু
বাঙালির হালহকিকত
বিশেষ
দৃষ্টিঃআসাম
স
ম র বি জ য় চ ক্র ব র্তী
ভারত
উপমহাদেশে উদ্বাস্তু নিয়ে লেখতে গেলে স্বভাবত চলে আসে দেশভাগের কথা।দেশের
স্বাধীনতার সংগে যুক্ত দেশের বিভাজন অর্থাৎ ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ অগাস্ট ভারত
স্বাধীনতা লাভ করে আবার যুগপৎ দেশ দ্বিখণ্ডীত হয়।নানা ক্ষেত্রে বাঙালি,সে হোক
সাহিত্য,কলা,বিজ্ঞান,সমাজসেবা, রাষ্ট্রচেতনা, ধর্ম ইত্যাদি, যে বড় মাপের নিদর্শন
রেখে যেতে পেরেছিল,দেশ ভাগের পর এই জাতির অধোগমন শুরু হয়।যে জাতি ছিল গোটা দেশের
পথপ্রদর্শক,সে আজ নিজেই বিভ্রান্ত,পথভ্রষ্ট বললে অত্যুক্তি হবে না বলে মনে করি।ভাঙা
ভারতের পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বঙ্গ(বর্তমান বাংলাদেশ)থেকে আগত শরণার্থীরা আজও
হোঁচট খেয়ে চলেছে। শিরদাঁড়া খাঁড়া করে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে দেশি না বেদেশি প্রশ্নে
জীবন ওষ্ঠাগত।পূর্ব বঙ্গ ছিল বাঙালির আসল
জীবনী শক্তি।পশ্চিম বঙ্গে কলকাতা বাঙালির উৎকর্ষতার প্রকাশ-মঞ্চ।আজ সেই
বাঙালি অনিশ্চয়তা-অবিশ্বাস, দুর্ভাবনা-দুশ্চিন্তা, আশংকা আর ত্রাসের আগুনে দগ্ধ।
কী করে আবার সে দেশ-দশের পথ দেখাবে?দেশভক্তকে বলা হচ্ছে দেশবৈরী, আর যারা দেশকে
আরও ভাঙতে চায়,দেশ থেকে আলাদা হতে চায় তাদেরই পোয়াবারো, সরকার তাদের কথা শোনে ও
মানে।একী দেশ-ভাগ আর স্বাধীনতার ফসল? হায়রে সমঝতায় পাওয়া স্বাধীনতা!ব্রিটিশ দেশ
ছেড়েছে ঠিক,কিন্তু রেখে গেছে যে লিগেসি তা অতীব কুৎসিত, অরাজক ও নপুংসক তাই
হিতাহিতের ধারধারতে পারে না এঁরা।এঁদের ঐকান্তিক ইচ্ছে আর সহযোগে দেশটা ভাগ
হয়েছিল।
দেশ
ভাগের ফলে কত বাঙালি ভারতে উদ্বাস্তু হয়ে এসেছেন এর সঠিক হিসেব ভারত সরকারের কাছে
নেই।বাংলাদেশের জনসংখ্যা নিরীক্ষণ করে বোঝা যায়,এখন পর্যন্ত তিন কোটির উপর মানুষ
উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন।
দেশ
ভাগের ৭০ বৎসর পূর্ণ হলো ২০১৭-এর ১৪ অগাস্ট।ভারত ভাগকে ঐ তারিখের “ওয়াশিংটন
পোস্ট” মানব ইতিহাসের
রক্তাক্ত অধ্যায় বলে উল্লেখ করে।উপরোক্ত তারিখের ওয়াশিংটন পোস্ট অনুযায়ী মাস
কয়েকের দাঙ্গায় শুধু পশ্চিম পাকিস্তানেই প্রায় ২০,০০০০০০ মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা
করা হয়।এই সংখ্যা ভারত, পাকিস্তান মিলে।বেশিরভাগই অমুসলিম নিহত হন এর মধ্যে
হিন্দুর সংখ্যা বেশি।পাকিস্তানে অসংখ্য নারী ধর্ষিত হন, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়,
ব্যাপক লুটতরাজ হয়। যাঁরা ছিন্নমূল হয়ে ভারতে আসার জন্যে ট্রেনে চেপে ছিলেন,
তাঁরাও বাদ পড়েননি,তাঁদের অনেককেই হত্যা করা হয়।ওপর পক্ষে ভারত ভূখণ্ডের পাঞ্জাবে
ব্যাপকভাবে পাল্টা আক্রান্ত হন মুসলমানরা।ভারতের আর কোথাও এমনটি হয়নি।একতরফা
দলবদ্ধভাবে মুসলমান হিন্দুদের আক্রমণ করে, হিন্দুরা আক্রমণ করা তো দূরের
কথা,অনেকটাই প্রত্যাক্রমনে নিশ্চেষ্ট থাকে।যেহেতু একতরফা আক্রমণ, সেইহেতু
হিন্দু-মুসলমানে “দাংগা”,
এই শব্দটা, বোধ করি,যথার্থ নয়, তবুও এই শব্দতেই নির্ভর করতে হচ্ছে কোনও বৈকল্পিক
শব্দের সন্ধান না পাওয়ায়।
একথা
উল্লেখ্য যে একমাত্র নয়াখালি ছাড়া, পূর্ব পাকিস্তান বীভৎসতায় পশ্চিম পাকিস্তানের
সমগোত্রীয় হয়ে ওঠেনি।পূর্ববঙ্গে এবং কলকাতা-দাংগায় কত মানুষ নিহত হয়েছে এ সম্পর্কে
বিশ্বসংবাদ মাধ্যম আশ্চর্যজনকভাবে নীরব।এ ব্যাপারে কোনও গবেষণাপত্রে,সাহিত্যের
কোনও বিভাগে এমনকি বৈদ্যুতিন মাধ্যমে উল্লেখও এই লেখকের নজরে আসেনি।বিক্ষিপ্ত নানা
সূত্র থেকে এই সিধান্তে আসা যায় যে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গ সমেত মোট
দাংগা জনিত মৃত্যুর সংখ্যা দুলক্ষেরও অধিক এবং এদের ৯৯%ই হিন্দু বাঙালি।আর কত যে
আহত হয়েছেন, কত সারা জীবনের জন্য পঙ্গু,এর কোনও হিসেব পাওয়া যায় নি। ধর্ষিত
মহিলাদেরও হিসেব বের হয়নি।
এখন
আসি ১৯৭১ খৃস্টাব্দে।পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতা সংগ্রাম, যার ফল স্বরূপ ৯ মাস
ব্যাপি বাংলাদেশ স্বাধনীতা যুদ্ধে পাকিস্তানি ফৌজ, জামাতি-ই-ইস্লামি,শান্তি কমিটি,
রাজাকার, আল-বদররা অমুসলিমদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালায়।৩০,০০০০০-এর উপর লোককে
তারা হত্যা করে।আজ অবধি মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়ার যুদ্ধেও এত লোক হত হয়নি।প্রায় এক
কোটি হিন্দু ভারতে আশ্রয় নেয়।পাঁচ লক্ষের অধিক নারী ধর্ষিতা হন এবং এর মধ্যে
অধিকাংশই হিন্দু।পৃথিবীর ইতিহাসে স্বাধীনতা যুদ্ধে আর কোথাও এতো মানুষের মৃত্যু তো
হয়ইনি, ধর্ষিতার সংখ্যাও এই মাত্রা ছাড়িয়ে যায়নি।।মুসলমান ধর্মীয় নেতারা অমুসলিম
মেয়েদের গনিমতের মাল অর্থাৎ জনগণের উপভোগ্য বলে গণ্য করায় নারীধর্ষণের ভয়াভয়তা
অভাবনীয় মাত্রায় পৌঁছে।বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের বলি হয়ে যে সমস্ত হিন্দুরা
ভারতে এসেছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই ফিরে যাননি বলে জানা যায়।সিলেট আর কুমিল্লার
শরণার্থীরা স্বাভাবিক কারণে আসাম আর ত্রিপুরায় রয়ে যান, একটা নগণ্য সংখ্যা মাত্র
বাংলাদেশে ফিরে যায়।
দুই
বঙ্গভঙ্গে
উদ্বাস্তু সৃষ্টি হয়নি ঠিক, কিন্তু বাংলা যে একদিন বিভাজন হয়ে এক ভাগ থাকবে ভারতে
আর ওপর ভাগ স্বতন্ত্র রাষ্ট্ হয়ে যাবে আর ফলে বিপুল মানুষ হবে ছিন্নমূল, একথা
অনুমান করা গিয়েছিল।
ব্রিটিশ
প্রসূত দ্বিজাতিতত্ব অনুযায়ী ১৯০৫ এর ১৯ জুলাই ভাইসরয় লর্ড কারজন বঙ্গ ভঙ্গের
সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন।যদিও বলা হয়েছিল শাসনের সুবিধের জন্যে এই
বঙ্গভঙ্গ,আসলে বোঝা যায়, হিন্দু বাঙালি আর মুসলমান বাঙালির মধ্যে দ্বন্দ্ব লাগিয়ে
বাঙালিকে স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে বিরত রাখার চেষ্টায় এই বিভাজন।
বঙ্গভঙ্গ
সম্পর্কে সকল সচেতন বাঙালি অবগত বলে জানি,তবুও, প্রাসঙ্গিক কিছু কথা উল্লেখ না করলেই নয়।বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব প্রচণ্ড রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। পূর্ব বঙ্গের মুসলিমদের এই ধারণা হয় যে নতুন
প্রদেশের ফলে শিক্ষা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের সুযোগ বেড়ে
যাবে। যদিও পশ্চিম বঙ্গের জনগণ এই খণ্ডন মেনে নিতে পারল
না।নানা জাতীয়তাবাদী লেখা ঐ সময় প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯০৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গ রদ করার
প্রস্তাবকদের জন্য এক মর্মস্পর্শী গান “আমার
সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি...” রচনা করেন যা
অনেক পরে, ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে, বাংলাদেশের জাতীয়সঙ্গীতে পরিণত হয়।
বঙ্গভঙ্গ সমেত স্বাধীনতা সংগ্রামী আন্দোলনের
ফলশ্রুতিতে ১৯১১ সালে বঙ্গ আবার একত্রিত হয়।ভাষা ভিত্তিকভাবে হিন্দি, ওড়িয়া এবং অসমীয়া অঞ্চলগুলো বাংলা থেকে আলাদা করে আলাদা প্রশাসনিক কাঠামোর আওতায় আনা হয়। এরই সাথে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে
দিল্লিতে স্থানান্তরিত হয়।এই রাজধানী স্থানন্তর
বাঙালির মেরুদণ্ডে আঘাত হানে।কলকাতা দেশের রাজধানীর সুযোগসুবিধা ও মর্যাদা থেকে
বিচ্যুত হয়।বাঙালি জাতির অধঃপতনের বোধ করি এটি একটি মুখ্য কারণ।প্রসঙ্গত, কলকাতা
দেশের রাজধানী বজায় থাকলে অন্তত বাংলা এদেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্থান পেত বলে
বোধ হয়।অন্তত, সরকারি যোগেযোগের ভাষা হিসেবে বাংলা ও হিন্দি দেশের সংবিধানে স্থান
পেতো, এ অনিবার্য ছিল।একটি জাতির উত্থান তাঁর ভাষা-সংস্কৃতির উত্থানের সংগে
জড়িত।আজ ভারতীয় সংবিধানে বাংলা অন্যান্য রাজ্যিক ভাষার মতো একটি আঞ্চলিক
ভাষামাত্র, অথচ বাংলা তো গুণগত ও জনসংখ্যার নিরিখে আন্তর্জাতিক ভাষা গুলোর একটি।
বাংলা কখনও আঞ্চলিক নয়, ভারতীয় সংবিধানে বাংলার ‘আঞ্চলিক’
অন্তর্ভুক্তি ভুল বলে মনে করি।ভারতে জনসংখ্যার দৃষ্টিকোণে বাংলা আজও দ্বিতীয়
স্থানে আর ভাষার মান বিচারে প্রথম—এতো
বিশ্বস্বীকৃত,বিশ্বের তাবড় ভাষাবিদদের কথা।
উল্লেখ্য,১৯০৫
খৃস্টাব্দের বঙ্গভঙ্গের যন্ত্রনা সিলেটিদের ততটা
নয়,এর অনেক আগে সিলেট বাংলার সীমা থেকে বেরিয়ে গেছে।রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করে
লিখলেনঃ
মমতাবিহীন
কালস্রোতে বাঙলার রাষ্ট্রসীমা হোতে—
নির্বাসিত
তুমি সুন্দরী শ্রীভূমি |
ভারতী
আপন পুন্যহাতে বাঙালীর হৃদয়ের সাথে
বাণীমাল্য
দিয়া বাঁধে তব হিয়া |
সে
বাঁধন চিরদিন তরে তব কাছে
বাঙলার
আশীর্বাদ গাঁথা হয়ে আছে ||
১৮৭৪
খ্রিষ্টাব্দে বাংলা থেকে আলাদা করে আসামের সংগে জুড়ে দেওয়া হয় সিলেটাঞ্চলকে—
বাংলার রাষ্ট্র সীমা থেকে আলাদা হয়ে যাবার এই বেদনা অনেক গভীরে এবং এর বাস্তব
প্রতিক্রিয়া আজ অবধি, জীবন-বৃদ্ধি নয়,শুধুমাত্র টিকে থাকার জন্য বাঙালিকে আজও
যুজতে হচ্ছে।মরার ওপর খাড়ার ঘায়ের মত আসামের বাঙালিদেরে সরকারি মদতে বিদেশি বানিয়ে উৎখাত করার চেষ্টা
চলছে।মনিপুরে বাঙালি তাড়ানো প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে, এতে কেন্দ্রীয় সরকারের
কোনও হেলদোল নেই।ত্রিপুরাতে নাগরিকপঞ্জিয়ন প্রক্রিয়া চালু করার কথা,উচ্চতম
ন্যায়ালয় সরকারকে চাপ দিয়ে চলেছে।একক সংখ্যা গরিষ্ঠ বাঙালি অধ্যুষিত
আন্দামান-নিকবরে বাঙালি উৎখাতের ছলাকলা চলছে।
বলাবাহুল্য,১৯০৫
খ্রিস্টাব্দে সিলেট সমেত আসাম জুড়ে দেওয়া হয় পূর্ব বঙ্গের সংগে। অসফল বঙ্গভঙ্গের
পর আসাম কে আলাদা রাজ্য করে কিছু প্রশাসনিক শর্তে সিলেট আসামের অন্তর্গত হয়
আবার।বাংলার গোয়ালপাড়ারও আসামে অন্তরভুক্তি হওয়ার ইতিহাস রয়েছে। গোয়ালপাড়িয়ারা
অসমিয়াকরণের মধ্যে নিজেদের সঁপে দিয়েছিলেন, বরাক উপত্যকার বাঙালিরা নন, সিলেটিরা নন।ফলে সিলেটিরা অসমিয়া বৌদ্ধিক
মহল ও অসমিয়া নেতাদের কাছে গলার কাঁটা হয়ে ওঠল।সরকারি চাকরি,ব্যবসা সবেতেই
সিলেটি-বাঙালির গরিষ্ঠ অবস্থান।একথা স্বীকার্য যে বাঙালির প্রভাব অসমিয়া অস্তিত্ব
ম্লান করে দিয়েছিল।অসমিয়া প্রাধান্যতা পুনরুদ্ধারের জন্যে শুরু হয় “বঙাল
খেদা”।চলমান
নাগরিকপঞ্জিকরণ প্রক্রিয়া এরই ফসল।
তিন
১৯৪৭
খ্রিষ্টাব্দের ৬ জুলাই গণভোটের মাধ্যমে করিমগঞ্জ মহকুমার কিছু অংশ ব্যতিরেকে পুরো
সিলেটই পূর্ব পাকিস্তান ভুক্ত হয়।আজকের দিনে সিলেট চারটি জেলায় বিভক্ত—সিলেট,
সুনামগঞ্জ, মউলোভীবাজার ও হবিগঞ্জ।ভারত ভাগের সংগে সিলেট ভাগ হয়নি।অথচ তৎকালীন
আসাম সরকার কেন্দ্রকে নানা কৌশলে রাজি করালেন সিলেটে গণভোট করানর জন্যে।
গণভোটে
চাবাগানের শ্রমিকদের ভোটের অধিকার ছিল না অর্থাৎ তাঁদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া
হয়েছিল।।অথচ এনারসিতে চাবাগান-শ্রমিকদের নাগরিকত্ব প্রমানের জন্যে কোনও নথির
প্রয়োজন পড়ে না, সরকার নির্দেশনা দিয়েছে।নথি লাগছে শুধু বাঙালির জন্যে, সে বাঙালি
হিন্দু হোক বা মুসলমান।লক্ষাধিক অসমিয়া এবং
নানা জনজাতির লোকও কিন্তু ওপার বাংলা থেকে ভারতে এসেছেন এবং আজও তাঁদের আসা
অব্যাহত, এঁদেরও কিন্তু নাগরিকত্ব প্রমান-নথির প্রয়োজন পড়ে না।–একি
উদ্বাস্তু বাঙালির প্রতি প্রতারণা নয়?
যাক,
রেফারেন্ডাম নিয়ে কথা হচ্ছিল, রেফারেন্ডাম বা গণভোট বিষয়ে বিস্তর আলোচনার
প্রয়োজন।তা জেনেও,বিষয়ের সংগে সম্পৃক্ত হওয়া সত্তেও মূল স্রোত থেকে দূরে সরে যাব
বলে শুধুমাত্র খানিক উপক্রমণিকায় শেষ করলাম।
যে
সিলেট আসাম হারাল,ভারত হারাল, সর্বোপরি বাঙালি হারাল, সে সিলেট সম্পর্কে দু একটি
কথা বলতেই হয়।বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় সিলেটের স্বাতন্ত্র্য লক্ষ্য করার
মত।সিলেটে বর্ণ হিন্দুর সংখ্যা বাংলার যে কোন জেলা থেকে বেশি ছিল এবং শুধু শহর নয়
গ্রামাঞ্চলও তুলনামূলকভাবে সমৃদ্ধ ছিল। আপেক্ষিক বিচারে সিলেটে ঐক্য ও
ন্যায়পরায়ণতা ছিল,ছিল রুচিশীল জনজীবন।চাবাগান সংগে নিলে ধর্মীয় জনসংখ্যার নিরিখে
সিলেটে হিন্দুর সংখ্যা মুসলমান জনসংখ্যা থেকে সামান্য বেশি।সিলেটে শিক্ষিতের সংখ্যা
বুঝি বাংলার যে কোনও অঞ্চল থেকে বেশি এবং আজও তা বজায় রয়েছে।ব্রিটিশ আমলে সরকারি
চাকরিতে সিলেটিদের আলাদা কমিশন দেওয়া হতো,এই কমিশন বা অনুপ্রেরণা-ভাতা বাংলার আর
কোনও জেলার লোক পেতো না।এরকম এক জনপদ তথা নানাভাবে সমৃদ্ধ অঞ্চল ভারত-ছাড়া হল, জোর
করে পাকিস্তানে ঠেলে দেওয়া হল,এর চেয়ে আক্ষেপ আর কী হতে পারে!সিলেটের ছিন্নমূল
বাঙালি তো আসামে আসবেনই, কারণ আসামেরই তো ভূখন্ড ছিল সিলেট।তবে কেন সিলেটিদের
এনারসিতে নথি পরীক্ষা?যুক্তি বলে,নাগরিকত্বের নথি যদি পরীক্ষা করতেই হয়,করা চাই
মুসলমানদের, সিলেটি-হিন্দু বাঙালিদের তো নয়ই,অন্যান্য অমুসলিমদেরও নয়।
প্রসঙ্গত,
অচ্যুতচরণ তত্ত্বনিধির “শ্রীহট্টের
ইতিবৃত্ত” থেকে খানিক
উদ্ধৃতি দেওয়া প্রাসঙ্গিক মনে করি।
“...ঐ
সময় বঙ্গদেশ আর্যসমাজে অপরিজ্ঞাত ও দশরথের অধিকারভুক্ত থাকিলেও এখন আমরা যাহাকে
বাংলাদেশ বলি, প্রাচীন বঙ্গ তাহা নহে, পূর্ববঙ্গই তখন বঙ্গদেশ নামে খ্যাত ছিল...।
আমরা
যে শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত কীর্তন করিতে উপস্থিত হইয়াছি, তাহা যে বাংলাদেশ হইতে
প্রাচীন তাহার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।
শ্রীহট্টের
ভূতত্ত্ব বিচার করিলে প্রতীয়মান হইবে যে শ্রীহট্ট অতি প্রাচীন দেশ।শ্রীহট্টের
উত্তরদিগ্ববর্তী অভ্রভেদী পর্বতমালা কতো যুগযুগান্তর হইতে দেশের মেরুদণ্ডরূপে
দণ্ডায়মান, তাহা কে বলিবে? বরবক্র ও সুরমা এ জিলার প্রধান নদী; মনু,ক্ষমা প্রভৃতি
অপেক্ষাকৃত ক্ষীণাঙ্গিনী স্রোতস্বতী
বরবক্রে আত্মসমর্পণ করিয়াছে।শেষোক্ত নদীত্রয় পুণ্যসলিলা নদী বলিয়া শাস্ত্রে
কীর্তিত হইয়াছে। মনু নদী সম্পর্কে তন্ত্রে লিখিত হইয়াছে যে সত্যযুগে ভগবান মনু এই
নদীতীরে শিবপূজা করিয়াছিলেন বলিয়া ইহার নাম মনু নদী হইয়াছে(সংস্কৃত রাজমালায়ও একথা
উদ্ধৃত হইয়াছে)।এবং বরবক্র নদ সর্বপাপ প্রনাশক বলিয়া শাস্ত্রে কীর্তিত(তীর্থ
চিন্তামণি ও বায়ুপুরাণের উদ্ধৃতি)।এই নদীগুলি শ্রীহট্টের ভূমিস্তুতির প্রধান
কারণ।...
আর্যযুগ
হিসাবেও শ্রীহট্ট অতিপ্রাচীন দেশ।যখন বঙ্গভূমির অধিকাংশস্থান ব্যাঘ্র ভল্লুকের
বিচরণক্ষেত্র ছিল, যখন বঙ্গদেশ অনার্যজাতির বাসভূমিরূপে পরিগণিত ছিল, তখন
শ্রীহট্টে
আর্যনিবাসের
প্রমাণ একেবারে অপ্রাপ্য নয়।এ অতি সাহসের কথা যে যখন বঙ্গদেশ অনর্যভূমি, তখন
প্রান্তবর্তী সুদূর শ্রীহট্ট আর্যবাসভূমিরূপে পরিণত হইয়াছিল।‘’(দেশভাগ-
দেশত্যাগ বই-এ মুক্তি চৌধুরী লিখিত “ভাঙ্গা-ভারত
কথা”, পৃঃ২৩৩)।
চার
‘ধর্মের
মাদকতা যে কতদূর যেতে পারে!
সিলেট
জেলায় মউলোভীবাজার সংলগ্ন মাস্কান্দি গ্রাম।দীনেশ ভট্টাচার্য, এই নিবন্ধকের পিশতুত
ভাই। বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি বাড়ি ছাড়েননি,পরিবারের অন্যান্যদের
ভারতে পাঠিয়ে দিয়ে তিনি তাঁর এক পুত্রকে সংগে করে বাড়িতেই রয়েগেলেন।ছিলেন স্কুল
শিক্ষক। বিশ্বাস ছাত্ররাই তাঁর নিরাপত্তা।এক দুপুরে কয়েকজন মুসলমান এলো তাঁর
কাছে।এর মধ্যে তাঁর এক ছাত্রও ছিল। তারা এসেছিল তাঁকে আর গ্রামের সকল
হিন্দুধর্মাবলম্বী পুরুষদেরকে কোনও এক স্থানে নিয়ে যেতে।দাদা যেতে রাজি হননি এবং
তাঁর দেখাদেখি গ্রামের সকল হিন্দু যেতে চাইছিলেন না।অগত্যা ঐ ছাত্রের কথায় তিনি
রাজি হয়ে গেলেন, আর সেই সংগে সকলই যেতে সম্মত হলেন।যেখানে যাবেন বুঝি সেখানে তাঁরা নিরাপদ,গ্রামে তাঁরা
অরক্ষিত, পাক সেনারা খানিক পরেই সে গ্রামে হানা দেবে আর সে হানা যে ব্রাসফায়ার সে
কথা সকলেরই জানা।দাদা এবং তাঁর এক সন্তান সহ গ্রামের সকল পুরুষ মানুষ ঐ মুসলমান
রাজাকারদের(তাঁরা জানতেন না যে এরা রাজাকার) সংগে পথ হাঁটলেন।তাঁরা গিয়ে পৌঁছোলেন
এক পুকুর পাড়ে।পাক সেনারা একটা স্কুল ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো।সবাইকে লান ধরে দাঁড়
করালো।তারপর ফায়ার।ব্রাসফায়ার শুরু করতেই সেনা-দলনেতা ফায়ার বন্ধ করে দিল।কারণ
তাঁদের হত্যা করতে গুলির অপচয় আর করতে রাজি নয়।যাঁরা ভূপতিত হলেন তো
হলেনই।বাকিদেরে ধুতি দিয়ে বেঁধে পুকুর-জলে ঠেলে ফেলে দেওয়া হল।সকলেই মারা গেলেন।
দু
এক জন বেঁচে ছিলেন, এর মধ্যে একজন দীনেশ দাদার পুত্র। সে কয়েক মৃত মানুষের নিচে
নির্জীবের মতো পড়ে রয়েছিল।রাজাকার আর সেনাদের চলে যাবার পরে, সে পালায়।শুধু পালায়
বললে তো সবটা বলা হয় না, তাঁর মানসিক ও শারীরিক অবস্থা কে বুঝবে সে নিজে ছাড়া—তার
বাবাকে জলে ডুবিয়ে মারা হয়েছে!
নির্দোষ
মানুষদেরে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হল, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হল,জমি-জেরাত সব
গেলো।জন্ম থেকে লালিত পরিবেশ,সঙ্গিসাথি, পরিচিত মানুষ,পরিচিত স্বর, আলো হাওয়া
রোদ্দুর, সাত পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে ফেলে আসার যে কষ্ট সে ভুক্তভোগী ছাড়া কে
বুঝবে?আমরা শুধু অনুমান করতে পারি—এ-ই
যা!
উদ্বাস্তুদের
সব পেছনে ফেলে রেখে অনিশ্চিত জায়গায় ঠিকানা খোঁজা, অর্থ উপার্জনের সংস্থা, শিক্ষা—
এসবই তো অনিশ্চিত।এ’পাড়ে
এসেও আমৃত্যু মৃত্যু তাড়িয়ে খাওয়া মানুষ।থিতু হতে না হতেই ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে রাজীব
গান্ধি প্রধান মন্ত্রী থাকা কালীন আসু নামে এক ছাত্র সংগঠনের সংগে কেন্দ্রিয়
সরকারের এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যার সরকারি নাম “আসাম
একরড”। এই চুক্তিকে ঘিরে
কিছু প্রশ্ন খাড়া হয়েছে।দেখা যায়, এই চুক্তি অযৌক্তিক ও মানবাধিকার খণ্ডনের এক
মস্ত হাতিয়ার।আসামে এবং আসামের বাইরে দেশের রাজনৈতিক ও বৌদ্ধিক মহলেও একই
প্রশ্ন।বললে অত্যুক্তি হবে না বোধ করি,সরকার উদ্বাস্তুদের উপর কসাইর ভূমিকায়
রয়েছে।
“আসাম
একরড”-ভিত্তি করে ‘এনারসি’,
এ যে কী বিভীশিখা!সরকার ধরে নিয়েছে, তুমি বিদেশি, তোমাকে সরকার-নির্দিষ্ট নথি দিয়ে
প্রমাণ করতে হবে যে তুমি বিদেশি নও, তুমি স্বদেশি!সরকার সময় সময় পাল্টে দিতে থাকেন
নাগরিকতা প্রমাণের নথি।তুমি আসামে একশ বছর ধরে বসবাস করলেও নাগরিকত্ব পাবে না যদি
তোমার নথি সব কোনও কারণে হারিয়ে যায় এবং তা চাই ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের আগের।আগুনে
পুড়ে গেলে, বন্যার জলে ভেসে গেলে চলবে না।অথবা তুমি অপ্রয়োজনীয় ভেবে নথি নষ্ট করে
দিলে!সরকার সময় সময় নষ্ট করে, বা নষ্ট হয়ে যায়,এতে সরকার দোষী নয় কিন্তু আসামে
বসবাসকারী বাঙালি দোষী তাই বাঙ্গালি বিদেশি!বিদেশি প্রমাণিত হলে ডিটেনশন ক্যাম্প
নামক জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া—কয়েদির
মত অমানবিক জীবনধারণকরা।এ এক অন্য বিষয় , বিশাল কয়েকখানা বই লেখা যায়।
এক
মা-এর ছিন্নমূলের কাহিনি এখানে জুড়ে দিচ্ছি। লিখেছেন তাঁর মেয়ে—
“একসঙ্গে অনেক কিছু মাথায়
ঘুরপাক খাচ্ছে। গতকাল বিধায়ক শিলাদিত্য'র রণাঙ্গনে একা যুদ্ধঘোষণা। অমিত
ভাষণে--উইপোকার সম্মান। এইসবকিছু শুনতে শুনতে বারবার আমার মায়ের মুখ ভেসে আসে। তাঁর
কিশোর জীবনের ঘটনা আমাদের সামনে তুলে ধরে তত্কালীন সময়ের চিত্র। সন-
১৯৫২। বছর এগারোর মেয়ে। গায়ের রং কাঁচা হলুদে মোড়া। একঢাল
কুচকুচে কালো চুল।
নাতিদীর্ঘ ছিপছিপে শরীর। বাড়ি -অধুনা
বাংলাদেশ, সেসময়ের পূর্ব পাকিস্তানের দুলালীর প্রত্যন্ত গ্রাম-ব্রাহ্মণ গ্রাম। বাবার
গ্রামের বাজারের সবচেয়ে বড় কাপড়ের দোকান। সবার কাছে
খুব প্রিয় 'সরকার বাবু'। এক
সাপ্তাহিক হাটবারে একে একে লোক আসছেন কাপড় কিনতে। কেউ
একটা দুটো, পরে দুজন তিনজন। ধীরেধীরে ছোট ছোট দলে এবং অবশেষে সংঘবদ্ধ
হানা। প্রথমে ধার চাইতে চাইতে শুরু ছিনতাই। সঙ্গে
উচ্চস্বরে গালিগালাজ। পেছনে ঘরের মহিলারা ভয়ে জড়োসড়ো। বিগত
কিছুদিনের অভিজ্ঞতায় এটা বুঝে গেছেন, মেয়েদের নিরাপত্তা এখানে শূন্য । বাবা
সামনের প্রলয় সামলাতে যখন ব্যস্ত,তখন মা জেঠিরা এইটুকু মেয়ে,যে তখনো তার মেয়ে হয়ে ওঠার
বিষয়ে ততটা ওয়াকিবহাল হবার অবসরটুকু পায়নি,তার নিরাপত্তা নিয়ে শিহরিত, কম্পিত। অভিজ্ঞতায়
এটা বুঝে গেছেন- শেষ কোপটা পড়বে ঐ এইটুকু মেয়ের উপর। তাই
আর তিলার্ধ সময় নষ্ট নাকরে এক কাপড়ে অভুক্ত একাদশী গোটা যৌথ পরিবারের দুলালী
মেয়েটিকে বিদায় দিলেন এক কাপড়ে
চোখের জলে। সঙ্গে সদ্য এন্ট্রান্সের ক্লাসে ওঠা দাদা। দাদার
হাত ধরে পেছনের দুয়ার দিয়ে সেদিন সেই যে অভুক্ত মেয়েটি ছেড়েছিল তার আজন্মের
বাস্তুভিটে, তার স্বজন, তার পোষা ছাগল,নিজের হাতে লাগানো পেয়ারা গাছ, বাবার আহ্নিক করার আসনে
ফোড়াইএর কাজ, মায়ের আচারের বয়াম থেকে চুরি করা পোটলা, জেঠিমার নারকেল তক্তি। সব, স-----ব পেছনে ফেলে কী এক
অজানা আতঙ্কে ছুটছিল ক্ষেতের আলপথ ধরে। বড় রাস্তায় এসে মেয়ের প্রশ্ন-দাদা কোথায়
যাবো? গম্ভীর বড়দার ভয়কে জয় করার অভিব্যক্তি নিয়ে জবাব --আর কোথায়! বড়দির
ঘরে। শুরু অন্য এক যাত্রা। সুনামগঞ্জ। সেখানথেকে
৫বছর পর বিয়ে। শিলচরে মামার হাত ধরে এসে বিয়ে। সেই
কিশোরীর আর ফিরে দেখা হয়নি তার ঘুঙুর বাঁধা হাস, রান্নাঘরের কোণে লাগানো
বাতাসা মরিচের চারাটা,পাশের বাড়ির সই সেলিমা,পূর্ণিমা,আমিনা, জবাকে। পায়নি নাগাল খামারের চাচী, মেছোনানা, গয়লাদাদু কারোর। কোনোদিন। আজ
আশি উত্তীর্ণা আমার মা তাই নাগরিকত্বের প্রশ্নচিহ্নের মুখে কার্যত হতচকিত। বিস্মিত। একটাই
প্রশ্ন তার-এখনো।আরো বাকি?কী কী কী?
শান্তশ্রীসোম
২৫-০৯-২০১৮”
পাঁচ
বাংলাদেশে
অমুসলিম আজও নির্যাতিত।এখন আর পালিয়ে ভারতে আসার সুযোগ নেই। এলেও আজকের সময়ে কোনো
বাংলাদেশী উদ্বাস্তুর স্থান নেই ভারত ভূখণ্ডে, বিশেষ করে আসামে।আসামে যাঁরা
যুগেরপর যুগ ধরে বসবাস করে আসছেন,যাঁরা অনেক আগে উদ্বাস্তু হয়ে এসেছেন, যাঁদের নাম
ভোটার তালিকায় রয়েছে তাঁরাও আজ বিপদে, তাঁদের নাম নাগরিক পঞ্জিতে নাও উঠতে
পারে।বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষরা দালালের তাড়া খান, পুলিসের তাড়া খান।ঘুষ দেওয়া
ছাড়া এক চুলও এদেশে টিকে থাকা মুশকিল আব্র ঘুষ দিয়েও প্রতারিত হতে হয়।ঘর নেই,লজ্জা
নিবারণের বস্ত্র নেই,ছাদও নেই।উদ্বাস্তু মহিলা, মেয়েছেলেদেরে অগত্যা দেখা যায় দেহ প্রসারিণীর
কর্মে লিপ্ত হতে।সবেতেই শোষণ।রোদ, বৃষ্টি, জল, আঁধার উপেক্ষা করে গ্রাসাচ্ছাদনের
তাগিদে তাড়া খেয়ে বেড়াতে হয়।স্বপ্ন তো দূরের কথা, আশার ক্ষীণ আলোও যে
দুর্লভ।স্বাধীনতার ৭০ বছর পরও এই হলও অক্ষরজ্ঞানহীন অধিকাংশ খেটেখাওয়া বাঙালি
উদ্বাস্তুর অবস্থা—এই
অবস্থা পশ্চিম বঙ্গে যতটা ভয়াবহ, উত্তরপূর্বাঞ্চলে ততটা নয়।উত্তরপূর্বাঞ্চলে
শ্রমজীবী মানুষের কাজের ক্ষেত্র বিস্তৃত।এক গুয়াহাটিতেই বাড়িতে কাজের ঝী মানে
পশ্চিম বঙ্গীয় কোনও নারী।ট্যান্ট হাউসে আর হোকারিতে মেলে এক চেটিয়া পশ্চিম বঙ্গীয়
প্রান্তিক মানুষ।
যাক,সিলেট
আর কুমিল্লার উদ্বাস্তুর স্রোত বইছিল উত্তর পূর্বাঞ্চলের আসাম আর ত্রিপুরায় দেশ
ভাগের পর আবার ১৯৭১খ্রিস্টাব্দে।তাঁরা শরণার্থী হলেও, স্বার্থান্বেষী রাজনীতি
তাঁদের ভাষিক আগ্রাসী বলে চিহ্নিত করছিল আর তা এখনও অব্যাহত।সুতরাং এদেরে যেমন
করেই হোক তাড়াও।আবার শুরু হল ‘বঙ্গাল
খেদা’।আসামে জাতি
বিদ্বেষের এই পর্বেও বাংলাভাষী মুসলমানরা দাঙ্গাবাজদের সঙ্গ দিল।এর আগেই উজান
আসামের বাংলাভাষী মুসলমানরা নিজেদের ভাষিক পরিচয় দিয়ে রেখেছিল অসমিয়া।যদিও এদের
অধিকাংশই নিজেদের পরিচয় দেবার সময় ‘অসমিয়া’
উচ্চারণ করতে পারত না, বলত ‘অসম্যা’।এদেরে
বোঝানো হল উদ্বাস্তু বাঙালির আধিপত্য বাঙালি মুসলমানদের সংকট ডেকে আনবে।এরই পরিনাম
ভয়ংকর জাতিদাঙ্গা।লক্ষাধিক হিন্দু বাঙালিকে আবার নিজ দেশে পরবাসী হতে হল,
উদ্বাস্তু হতে হল।এর মধ্যে কিছু সংখ্যক বাঁচার তাগিদে নিজদেরে অসমীয়া বলে নাম
লেখালেন।
আগেই
উল্লেখ করা হয়েছে যে বাঙালি হিন্দু,বৌদ্ধ, খ্রিস্টান অর্থাৎ যাঁরা অমুসলমান পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্যাতিত হয়ে ভারত
ভূখণ্ডে এসেছেন,বাংলাদেশ থেকে এসেছেন, এখনও আসছেন—তাঁরা
ভারত ভূখণ্ডেও অরক্ষিত।সনাতন সমাজের অনৈক্য, ভাষা ও গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব, আবার সরকারি
ধর্ম নিরপেক্ষতার সুযোগে মুসলমানরা সংখ্যা লঘু হলেও তাদের চিরাচরিত আগ্রাসী রূপ
এদেশেও ফুটে ওঠে।মুসলমানদের সকল নন, ব্যতিক্রম রয়েছে।“কোরান’’
নির্দেশিত “দারুল ইসলাম”-এর
পথে তাঁরা,এটা যে তাঁদের ধর্মীয় কর্মের অন্তর্ভুক্ত।একথা বাঙালি বৌদ্ধিক মহল এড়িয়ে
যান,অবশ্য হাতেগোনা দুএক জন ব্যাতিক্রমী মেলে।আমাদের উপন্যাস, গল্প, কবিতা এমন কি
ইতিহাসে মুসলমান দ্বারা হিন্দু নির্যাতনের কথা ধরা পড়ে না।অতীন বন্দ্যপাধ্যায়ের
উপন্যাস “ নীলকণ্ঠ পাখির
খোঁজে” আর তসলিমা
নাসরিনের “লজ্জা”
ব্যতিরেকে এই নিবন্ধকের নজরে আজও পড়েনি বাঙালি হিন্দুর উপর বাংলাভাষী মুসলমানের
অত্যাচারের কোনো সৃষ্টি।“লজ্জা”
মিনিউপন্যাস।“নীলকণ্ঠ পাখির
খোঁজে” পূর্ণ উপন্যাস,
তবে তথ্য বিচারে ‘নাই
মামুর চেয়ে কানা মামু ভাল’র
মতো।
ইহুদীরা
এ ব্যাপারে পুরোদমে সৎ।যেমন তাঁরা তাঁদের ওপর মুসলমানের নিগ্রহের কথা লিখেছেন,
তেমন লিখেছেন নাজিদের নিগ্রহের কথাও।তাঁরা তাঁদের ওপর নির্যাতনের চলচিত্রও নির্মাণ
করেছেন।রিচারড গথেইলের “গ্রানাডা”,ড্যাভিড
লিটম্যানের লেখা “জুস
আন্ডার মুসলিম রুলঃদ্য কেস অব পার্সিয়া”।ইহুদিদের
ওপর হিটলারের নৃশংস অত্যাচারের কাহিনি বিনা রাখঢাকে ফোটে ওঠেছেঃ “দ্য
নাইট পোর্টার”, “হলোকস্ট”,
“ শি অউলফ অব দ্য এসএস”
প্রভৃতি চলচিত্রে।ইহুদিরা কোন দিনও তাঁদের ওপর অত্যাচার লুকিয়ে রাখেননি,
পুংখানুপুঙ্খভাবে প্রকাশ করেছেন নানা মাধ্যমে এবং অদ্যাবধি প্রকাশ করেই
চলেছেন।সত্য কে গোপন করা কেন? অথচ মুসলমান দ্বারা ভয়ংকর নিপীড়িত হিন্দু বাঙালির
কথা আজও কোনও সাহিত্য-মাধ্যমে সততার সংগে তুলে ধরা হয়নি, কোনও চলচিত্রও করা হয়নি(ঋত্বিকের “সুবর্ণ
রেখা”র কথা অনেকেই বলেন,
তা কি দাংগা দেখিয়েছে অথবা দাংগায় ছিন্নমূলের মৌল অবস্থান?অবশ্য হাল আমলে বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমে দেখতে পাই কী ঘটছে
বাংলাদেশে। এ যে কী বীভৎস নিপীড়ন—দেখা
যায় না, সহ্যাতীত।ইহুদীদের ওপর নাজির অত্যাচার কি এর বেশি ছিল?
অথচ
ছিন্নমূল হিন্দুরা ভারত ভূখণ্ডে আশ্রয় নিয়েও হিন্দু-মুসলমানে মিলনের চেষ্টায়
রয়েছেন, তাঁদের ওপর ঘটে যাওয়া অবর্ণনীয় অত্যাচারের কথা প্রকাশ্যে তুলে ধরছেন
না।অবশ্য অনেকেই একান্ত আলাপচারিতায় ব্যক্ত করেন।এতে লাভ কী?এই অহরহ দ্বিচারিতায়
জাতিটা আরও পঙ্গু হল।পারলৌকিকতায় বিশ্বাস করে, ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে,
প্রত্যাক্রমণ নয়, পলায়ন।শুদ্ধ ইতিহাস লিখতেও আমরা হোঁচট খাই, লুকিয়ে রাখি
নিষ্ঠুর-ঘাতুক তত্ব ও তথ্য।আমাদের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা নিজকে বৈশ্বিক এবং ধর্ম
নিরপক্ষতার অছিলায় বিশ্বমানবের অভিনয় করে চলেছেন, এমনটা পৃথিবীর আর কোনও জাতি বা
জনগোষ্ঠীতে কি দেখা যায়?
আন্দামান
নিকোবরের রাজধানী পোর্টব্লেয়ারে অবস্থিত সেলুলার জেলে পূর্ববঙ্গের হিন্দু বাঙালির
সংখ্যা সবচাইতে বেশি।ভারতের সার্বিক রেনেসাঁয় পূর্ব বঙ্গের হিন্দুর অবদান সবার
উপরে, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। এই কথাগুলো কোনও জাতি-গোষ্ঠী-ধর্ম কে খাটো
করার জন্যে বলছি না,এই শরণার্থীরা কোনও ক্রমেও উপেক্ষিত হওয়ার নয়, বরং এঁরা দেশের
গর্বের, এ সত্য প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে বলা।দেশের নিরাপত্তা ও উন্নতির জন্যে এঁদের
প্রয়োজন রয়েছে। দেশভাগ এক ষড়যন্ত্র, হিন্দু বাঙালি কোনও দিনও এর পক্ষে ছিল না।আজও
অখণ্ড ভারতের পক্ষে প্রতি হিন্দু বাঙালি।বাঙালির কোনও বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আজও
গঠিত হয়নি বলে জানি।অদূর ভবিষ্যতের কথা জানা নেই, অস্তিত্ববিপন্নতা অগঠন ঘটাতে পারে,একথা মনে রাখা প্রয়োজন।
প্রয়োজন
পৃথিবীর মানুষের কাছে তুলে ধরা,মানব সভ্যতার ইতিহাসে আসামে নাগরিক পঞ্জিয়নের
প্রক্রিয়া এক কলঙ্কিত অধ্যায়।দেশের স্বাধীনতা তথা দেশ ভাগের সময় থেকে বড় বড় নেতারা
বলে আসছেন দিখন্ডীত ভারতের উদবাস্তুদেরে এ দেশে পুনর্বাসন করা হবে, নাগরিকত্ব
দেওয়া হবে। এ ব্যাপারে ভারতীয় সংবিধানে বিধান করা ছিল।তবে উদ্বাস্তু ছাড়া আর যাঁরা
এ দেশে আশ্রয়নিতে আসবেন তাঁরা অবৈধ বলে গণ্য হবেন, তাঁদেরকে বহিষ্কার করা হবে,এ
বিধানও ছিল।বর্তমান সময়ে এসে দেখা যায় ব্যাপারটা উল্টো, সংবিধানে পরিবর্তন আনা
হয়েছে, উদ্বাস্তুর পক্ষে যতটা এর চেয়ে বেশি বিপক্ষে।
বর্তমান
ভারত সরকার বুঝেও অবোঝ থাকার ভান করছে বলে মনে হয়। যে শক্তির সমর্থনে ভারত সরকার
উদ্বাস্তুদের নিয়ে ফুটবল খেলছে,সে শক্তি যে রাষ্ট্র বিরোধী। উল্লেখ্য,পশ্চিম বঙ্গ
যে পথে হাঁটছে, সে পথ অন্ধ গলিপথ, যে কোনও সময় খাদে পড়ে মৃত্যু।সুতরাং,বাঙালি
উদ্বাস্তু সমস্যার হাল কে ধরবে?পশ্চিম বঙ্গ সরকারের কেবল লোকসভাতেই এমপির সংখ্যা
৪২। তাঁরা লোকসভায় তাহালকা
মাচাতে পারেন, কিন্তু করবেন না।রাজনীতির স্বার্থে, ভোটের
স্বার্থে তারা করবেন না বলে জানি।রাজ্যে সঙ্ঘাতকারী কোনো শক্তি চাড়া দিতে পারে, এই
আশঙ্কাও তাদের রয়েছে।সুতরাং, উদবাস্তুদের জন্যে
উদ্বাস্তুরাই যা করার করা সে আসামে হোক, ত্রিপুরায়, আনাদামান-নিকোবরে বা খুদ
বাঙালির রাজ্য পশ্চিম বঙ্গে।আসামে এ পর্যন্ত বাঙালির উদ্বাস্তু বিপর্যয়ের
উদ্ধারকারী দুই নেতাকে পাই—শিলাদিত্য
দেব আর কমলাক্ষ দেপুরকায়স্থ।তাঁদের অসম সাহস ও উদ্যোগ।ব্রহ্মপুত্র-বরাকের
উত্তাল তরঙ্গের মধ্যে দুই খড়কুটো,ক্ষীণ আলো,উদবাস্ত বাঙালির আশার আলো বলে মনে করি।
--------------------------------------------------------
ইতিহাস
দেশ বিভাগের অভিজ্ঞতা ও জাতীয় ইতিহাস রচনার
সমস্যা
আহমেদ কামাল
আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০১৭, ১৭: ০৫
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মধ্যরাতে পাকিস্তানের জন্ম হয় এবং ভারতের
পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত বাংলা প্রদেশকে ভাগ করা হয়। এই দ্বিখণ্ডিত প্রদেশটির পূর্বাংশ
পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত হয়। ব্রিটিশরাজের কাছ থেকে স্বাধীনতাপ্রাপ্তি বা
ভারতবিভক্তি, যা-ই বলা হোক না কেন, সম্ভবত এটিই হলো দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বাঁক।
যেহেতু ঐতিহাসিক ঘটনার সূচনামুহূর্ত এবং সমাপ্তির কোনো নির্দিষ্টতা নেই, কাজেই এসবের সঠিক দিনক্ষণ
শনাক্ত করাও অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। দেশ বিভাগ মানুষের স্মৃতিতে এখনো বেঁচে আছে
যতটা না ঐতিহাসিক নথিপত্রের মাধ্যমে, তার চেয়ে অনেক বেশি দেশ বিভাগের কারণে বিপর্যস্ত সেই সব ভুক্তভোগী
পরিবারের বারবার কথিত বাস্তব জীবনকাহিনির আলাপচারিতায়। পূর্বপুরুষের ভিটা দেখতে
গিয়ে প্রতিবারই এসব মানুষের মনে জেগে ওঠে দেশ বিভাগের স্মৃতি।
আমাদের অনেকেরই হয়তো সিপিএমের পশ্চিমবঙ্গীয় চিফ মিনিস্টার জ্যোতি বসু
ও তাঁর স্ত্রীর বৃহত্তর ঢাকা জেলায় তাঁদের পৈতৃক নিবাসে বাংলা ভাগের পর প্রথম
আগমনের কথা স্মরণে আছে। বসু পরিবারের দেশের মাটি ছোঁয়ার সময়কার আবেগময়
প্রতিক্রিয়ার কথা সেই সময় একটি সাপ্তাহিকী অত্যন্ত অনুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করেছিল।
এমনকি যেখানে একসময় তাঁর শ্বশুরকুলের পূর্বপুরুষেরা তাঁদের দৈনন্দিন পূজা-আচার
সম্পন্ন করতেন, সেই পরিত্যক্ত মন্দির থেকে জ্যোতি বসুর স্ত্রী দেশে ফিরে যাওয়ার সময়
স্মৃতিস্বরূপ এক মুঠো মাটি নিয়ে গিয়েছিলেন। পূর্বপুরুষের এই নিবাস-দর্শনকে ঘিরে
তাঁর মধ্যে বহু সংবেদনশীল অনুভূতির জন্ম হয়েছিল এবং তাঁর এই অভিজ্ঞতার
প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ছিল একান্তই ধর্মীয়। পূর্বপুরুষের ভিটার মাটি তাঁর কাছে হয়ে
উঠেছিল পবিত্র। সেই সাপ্তাহিকীর একই সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল সম্পাদকের কাছে লেখা
একটা চিঠি। সেখানে বর্ণিত হয়েছিল বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী একটি জেলা সাতক্ষীরার
একটি ঘটনা। এই ঘটনা চিঠির লেখককে অত্যন্ত বিস্মিত করেছিল। একবার তিনি দেখেছিলেন যে
ওখানকার একটি ব্যাংকে ঢোকার সময় একজন শ্মশ্রুমণ্ডিত বৃদ্ধ মুসলমান জুতা খুলে
ঢুকছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ব্যাংকটি অবস্থিত ছিল ওই এলাকার এক হিন্দু জমিদারের পরিত্যক্ত ভবনে।
কৌতূহলবশত পত্রলেখক বৃদ্ধকে তাঁর এ রকম আচরণের কারণ জিজ্ঞেস করেন। প্রতি-উত্তরে
বৃদ্ধ লোকটি বলেন, ‘এই বাড়ি আমাদের জমিদারের। আমরা জুতা পায়ে কখনো এর চত্বরে প্রবেশ
করিনি। যদিও তাঁরা বহুদিন হলো এ দেশ ছেড়ে চলে গেছেন, তবু আমি আগের মতোই এই বাড়ির
প্রতি আমার সম্মান প্রদর্শন বজায় রেখেছি।’ এভাবে প্রজা ও জমিদারের মধ্যকার
ক্ষমতার সম্পর্কের স্মৃতির মধ্য দিয়ে দেশ বিভাগের চিহ্ন রয়ে গিয়েছে। দেশ বিভাগ—বহুজনের দৃষ্টিকোণ থেকে হলো
ছেলেবেলার গল্প—‘আমার গ্রাম, আমার শিশুকাল, আমার সন্তানের জন্মের সময়’। দেশ বিভাগ নির্দ্বিধায় দুই বাংলার বেশির ভাগ মানুষের জীবন-ইতিহাস
নির্মাণে একটি উল্লেখযোগ্য প্রসঙ্গ। ‘দেশভাগের সময়’ বা ‘পাকিস্তানের বছর’ প্রভৃতি হলো লোকমুখে দেশ বিভাগের প্রচলিত অভিব্যক্তি।
‘দেশ বিভাগ’ সরকারি ইতিহাসে আলোচিত হয়েছে
সাংবিধানিক ইতিহাসের পরিভাষায়, নতুন সৃষ্ট দুই রাষ্ট্রের মধ্যকার বিতর্ক; নেহরু, গান্ধী ও জিন্নাহর মধ্যকার
সমঝোতা ও বিরোধিতা; কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান বিভাজন প্রভৃতিতে। অথচ
সীমান্তের দুই পারের বাসিন্দা সাধারণ মানুষের জীবনের বিপর্যয় ও অভিজ্ঞতাকে তুলে
ধরার সে রকম কোনো চেষ্টাই নেওয়া হয়নি। মনে রাখা দরকার, ভারতের বিভক্তিকরণ শুধু একটি
সাংবিধানিক দেশবিভক্তিতেই নিষ্পত্তি হয়নি, বরং বহু ক্ষেত্রেই তা ছিল
অসংখ্য ঘরগেরস্তালি, পরিবার ও মানুষের জীবনের মর্মান্তিক ব্যবচ্ছেদ। জ্ঞান পাণ্ডের
মন্তব্য অনুযায়ী, ভারতীয় ইতিহাসচর্চায় দেশবিভক্তির অবস্থান স্ববিরোধী।
একদিকে জাতীয়তাবাদী এবং পেশাদার ঐতিহাসিকদের চেতনাবোধে দেশভাগ
অনেকখানি আধিপত্য বিস্তার করেছিল। এর মূল কারণটি খুবই স্পষ্ট। এই উপমহাদেশের
ইতিহাসে ভারতবিভক্তিকে বলা চলে বিশ শতকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। স্বাভাবিকভাবেই
‘সাম্প্রদায়িকতা’র ইতিহাসবেত্তারা অর্থাত্ উনিশ
ও বিশ শতকের হিন্দু ও মুসলিম রাজনীতির ইতিহাস-রচয়িতারা এমনভাবে ইতিহাস লিখেছেন যে
মনে হয় সবটাই যেন দেশবিভক্তির পূর্ব ইতিহাস। এর একই সমান্তরালে ভারতীয় জাতি ও তার
জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের জন্য ‘ভারতের সরকারি ইতিহাস ছিল অন্যতম সংকটের বিষয়’। এটি ছিল দেশভাগের ঘটনাবলির
আড়ালে ঢাকা পড়া এক ষড়যন্ত্রের ইতিহাস, ভবিষ্যতের জাতির জন্য যেখানে রয়ে গেছে বহু শিক্ষণীয় বিষয়। এই ইতিহাস
কখনোই সেই সব মানুষের জীবন আর অভিজ্ঞতার কথা ধরে রাখেনি, যাঁরা সেই সংকটকাল পাড়ি দিয়েছেন; এই ইতিহাস লেখেনি কীভাবে
চল্লিশের দশকের ঘটনাপ্রবাহ তাঁদের মনে ছাপ ফেলেছে; উল্লেখ করেনি এই গণমানুষের
পরিচিতির সংকট আর অনিশ্চয়তার কথা, যা দেশভাগের কারণেই তাঁদের জীবনে সৃষ্ট বা আরোপিত। সুমিত সরকার
লিখেছেন, শুধু ব্রিটিশ, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের আলাপ-আলোচনা প্রসঙ্গেই রয়েছে এক বিশাল পরিমাণ
নথিপত্র, যার চূড়ান্ত পরিণতি হলো এমন এক স্বাধীনতাপ্রাপ্তি, যা ছিল পক্ষান্তরে এক ট্র্যাজিক
দেশ বিভাগ।
মাতৃভূমি থেকে উত্খাত হওয়ার বাস্তবতা, উদ্বাস্তু সহস্র মানুষের
দেশত্যাগ, সাম্প্রদায়িক ধর্ষণ, অপহরণ, বলপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণ প্রভৃতি নির্মম ঘটনা দিয়ে নির্মিত হয়েছে দেশ
বিভাগ নামক দেশ ব্যবচ্ছেদ, যা সংঘটিত হয়েছিল একটি নির্দিষ্ট কালব্যাপী এবং অব্যাহত থেকেছিল
সরকারিভাবে বিভক্তিকরণের প্রায় অনেক দিন পর পর্যন্ত।
যদিও ভারতের জন্য দেশভাগ অবধারিতভাবে হয়ে উঠেছিল হারানোর আখ্যান, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের
নাগরিকত্বপ্রাপ্ত বহু মুসলমানের জন্য ওই সময় ছিল অত্যন্ত উচ্চাশা এবং নজিরবিহীন
সামাজিক উত্থানের সময়। অতএব সাতচল্লিশ-উত্তর সরকারি ঘটনাপ্রবাহ এসব আনন্দোন্মাদনাপূর্ণ
মুহূর্তে ভরা। নতুন মাতৃভূমি অর্জনের আনন্দে পূর্ব বাংলার উচ্চবর্গীয় মুসলিম জনগণ
ওই মুহূর্তের সাক্ষ্যপ্রমাণ, হিন্দু জনগণের হারানোর দুঃখ কিংবা দুর্ভোগের ইতিহাসের চিহ্ন নথিপত্র
থেকে মুছে ফেলেছিল। একই সঙ্গে উচ্চবর্গের বিবরণীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বপ্ন এবং
আকাঙ্ক্ষাকে তাদের নিজস্ব প্রকল্পের সঙ্গে এক করে দেখা হয়েছিল।
এবার সেই সময়কার উচ্চবর্গীয় শ্রেণীর কার্যকলাপে তাদের আনন্দোন্মাদনার
নজিরের দিকে একটু দৃষ্টি দেওয়া যাক। ‘আজকের মধ্যরাতই ব্রিটিশ শাসনের শেষ রজনী এবং ভারতের স্বাধীন এবং
স্বতন্ত্র সরকার ও শাসনামলের সূচনা।’ চল্লিশের দশকের এক তরুণ মুসলিম জাতীয়তাবাদী তাজউদ্দীন আহমেদ ১৯৪৭-এর
১৫ আগস্টে লেখা তাঁর ডায়েরির পাতায়, সদ্য রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া আর আনন্দকে
এভাবেই তুলে ধরেছেন। তিনি ডায়েরির পাতার একদম ওপরে ‘স্বাধীনতা’ কথাটা বড় হরফে লিখেছিলেন, যা তাঁর সব আবেগ-অনুভূতির
জমাটবদ্ধ প্রকাশ। তাঁর লেখাতেই জানা যায়, সেদিনকার উত্সবমুখর পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকার বর্ণনা।
ঢাকা শহরের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় অধিবাসীরা দিন-রাত ব্যস্ত থেকেছে স্বাধীনতা
দিবস উদ্যাপনের উদ্দেশ্যে তোরণ নির্মাণ, সাজসজ্জা প্রভৃতির প্রস্তুতি নিয়ে।
একজন প্রখ্যাত জেলা পর্যায়ের কংগ্রেস নেতা প্রভাষচন্দ্র লাহিড়ীর
বক্তব্যেও এর সমর্থন মেলে, ‘উত্তরবঙ্গের জেলা রাজশাহীতে আগত অগণন মানুষের প্রতিটি মুখ উদ্ভাসিত
ছিল বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার বিজয়ানন্দে।’ তাজউদ্দীনের দিনলিপিতে আকর্ষণীয়
বর্ণনায় উঠে এসেছে স্বাধীনতা ও মুক্তির আনন্দে মুখরিত সেদিনকার উত্সবমুখর
প্রাদেশিক শহর ঢাকার জীবন্ত ছবি। এই বিপুল আনন্দ-উচ্ছ্বাস প্রকাশের জন্য ব্যবহূত
হয়েছে ‘জাতীয় শক্তির বিস্ময়কর প্রকাশ’, ‘আনন্দোন্মাদনা’ প্রভৃতি অভিব্যক্তি।
বোঝাই যায়, এই বিজয়োত্সবের দর্শকদের ‘আনন্দোন্মাদনা’ ছিল একমাত্রিক। রাজনৈতিক মুক্তির মুহূর্তে জনগণের এই বিচিত্র ধরনের
প্রতিক্রিয়াকে জাতীয়তাবাদীরা প্রায়ই এক সহজাত গভীর আনন্দবোধ হিসেবে বিবেচনা
করেছেন। এক মুসলিম কবি স্বাধীনতা অর্জনের আনন্দে শরিক হতে গিয়ে পাকিস্তানকে অভিহিত
করেছেন ‘চির ঈদের দেশ’ হিসেবে। অবশ্য এই গণহারে আনন্দোত্সব পালনের হিড়িক দেখে এমনটি ভাবার
কোনো কারণ নেই যে স্বাধীনতার আগমন উদ্যাপনকারী সব মানুষই এক ও অভিন্ন অনুভূতির
সমান ভাগীদার। কেননা ‘পাকিস্তান’কে ঘিরে থাকা বিভিন্ন ও বিপরীত প্রত্যাশাগুলোকে ‘আনন্দোন্মাদনা’ কথাটি একই সঙ্গে প্রকাশ ও আড়াল
করে।
এমনকি জাতীয়তাবাদী রচনা এবং বক্তব্য এ দিনকে ১৭৫৭ সালে পলাশীর
প্রান্তরে নবাবের পরাজয়ের পর থেকে সংঘটিত সব আন্দোলনের শীর্ষ মুহূর্ত হিসেবে
অভিহিত করেছে। আবার অন্যপক্ষ একে ১৮৫৭-এর ব্যর্থ অভ্যুত্থানের কালক্রমে স্থাপন
করেছে, ‘স্বাধীনতার জন্য তাদের অবচেতনভাবে প্রায় এক শতাব্দী প্রতীক্ষা করতে
হয়েছিল।’ ‘পাকিস্তান—প্রতিশ্রুতির ভূমি, আশার ভূমি, সহস্র মানুষের জীবনের বিনিময়ে প্রাপ্ত যে দেশ’, জাতীয় সাহিত্যের পাতায় তখন এ
ধরনের বক্তব্যের ছিল অবিরাম ছড়াছড়ি। কিন্তু এসব অত্যুক্তি মুসলিম লীগের চারপাশে
ভ্রাম্যমাণ হাজার হাজার মানুষকে পরিণতিতে শ্রেণী ও ধর্মীয় বিভেদবর্জিত এক অভিন্ন
মুসলিম জাতির ভ্রান্ত চেহারা ও ভাবমূর্তি দিয়েছিল।
একটি সূচনার ধারণাকে প্রকাশ করার জন্য ‘ইতিহাসের এক নতুন যুগ’ এবং ‘সূর্যোদয়’ প্রভৃতি উপমা ব্যবহার করা হতো।
বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন অত্যন্ত সঠিকভাবেই ‘প্রভাত’, ‘আলো’, ‘সূর্য’ প্রভৃতিকে শনাক্ত করেছেন ‘পুনরুজ্জীবন’, ‘পুনর্জন্ম’ ইত্যাদির প্রতীক হিসেবে, যখন জাতীয়তাবাদীদের জীবন
পৃথিবীর অগ্রযাত্রার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছিল। সেটি ছিল এমন এক সময়, যখন মানুষের আশা বহুদিকে
ছুটছিল। জাতীয়তাবাদী পণ্ডিতেরা এই জটিল প্রপঞ্চের প্রায়ই সরলীকরণ করেছেন।
এবার এসব জটিল প্রতিক্রিয়ার দিকে আলোকপাত করা যাক। ভারতের কমিউনিস্ট
আন্দোলন মুসলিমদের আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিকে সমর্থন দিত। একই সঙ্গে জাতীয় পর্যায়ে
মুসলিম লীগের প্রতিনিধিত্বের দাবিকে তারা গ্রহণ করেছিল। কিন্তু পাকিস্তান
বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে কমিউনিস্টদের মোহভঙ্গ হয়। জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে তাদের
সম্পর্ক ক্রমেই হয়ে ওঠে স্পর্শকাতর এবং পরিণামে এক সময় তারা ভিন্ন পথ বেছে নেয়।
শুধু পৃথক পথে বিচ্ছেদ নয়, তারা তখন পরস্পরের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। সেই সময়
কমিউনিস্টদের স্লোগানে উচ্চারিত হয় ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’। মার্ক্সীয় ব্যাখ্যায় প্রাথমিক তিক্ততার এই ছাপ স্পষ্টই প্রতীয়মান।
এমনকি কেউ কেউ বহু বছরের ব্যবধানে তত্কালীন প্রাপ্ত স্বাধীনতার বাস্তবতাকে নাকচ
করে দিয়ে একে তুলনা করেছে ‘সাদা হাতির পিঠে কালো মাহুত’ বা ‘নতুন বোতলে পুরোনো মদ’ হিসেবে। আমূল সংস্কারকামীদের
কাছে স্বাধীনতার মোহভঙ্গ এত গভীরপ্রসারী হয়েছিল যে তারা একে অন্ধকার যুগের আগমনের
সঙ্গে তুলনা করেছে।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির খুলনা শাখার একজন সাবেক সদস্য ধনঞ্জয় দাস
বহু বছরের ব্যবধানে ১৯৭১ সালে এসেও ১৯৪৭-এর আগস্টে স্বাধীনতা উদ্যাপনের একজন
অংশগ্রহণকারী ছিলেন বলে অনুশোচনা ও খেদ প্রকাশ করেছেন। সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত
বরিশালের এক মুসলিম কমিউনিস্টের আত্মজীবনীতে ব্রিটিশ শাসনের বন্দিত্ব থেকে
স্বাধীনতাপ্রাপ্তির অনুভূতিসংক্রান্ত কোনো কিছুর উল্লেখই নেই। সাতচল্লিশের তথাকথিত
স্বাধীনতা বহু সমাজ-রূপান্তরবাদীর কাছেই ছিল শাসনকাঠামোর বহিরঙ্গের পরিবর্তন মাত্র, আর তারই অন্তরালে ব্রিটিশ, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের একটি
সমন্বিত ও ষড়যন্ত্রমূলক যোগসাজশ। একজন কমিউনিস্ট কর্মীর ব্যঙ্গোক্তিতে এর উদাহরণ
মেলে, ‘কিছু পরিবর্তন ঠিকই হয়েছিল। ব্রিটিশ পুলিশের জায়গায় পাকিস্তানি পুলিশ
তাদের ক্যাম্প বসিয়েছিল।’
তথাপি কমিউনিস্ট আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী পূর্ব পাকিস্তানের
প্রতি বাঙালি মুসলিমদের সমর্থন ঠিকই শনাক্ত করতে পেরেছিলেন, ‘পাকিস্তান সৃষ্টির পেছনে, অন্তত পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের
প্রচণ্ড সজোর ও সক্রিয় সমর্থন ছিল।’ একই সঙ্গে তিনি আরও মন্তব্য করেন, ‘যদিও ভুলটি রাজনৈতিক সচেতনতার
অভাবে ঘটেছিল, কিন্তু তার পরও পূর্ববঙ্গের শ্রমজীবী জনসাধারণ পাকিস্তানকে তাদের
নিজস্ব ভূমি হিসেবেই গ্রহণ করেছিল। পাকিস্তানের তদানীন্তন কমিউনিস্ট লেখালেখির
অন্যতম চরিত্র ছিল এই “সত্য অথচ ভ্রান্ত” গণচৈতন্যকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্বীকৃতি দেওয়া।’
পূর্ব বাংলার সমাজের অপর গুরুত্বপূর্ণ অংশ উচ্চবর্গের হিন্দু
সম্প্রদায়ের অধিকাংশেরই অবস্থান ছিল জাতীয় কংগ্রেসের ছত্রচ্ছায়ায়। তাদের
প্রতিক্রিয়া ও প্রত্যাশাও পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক জটিলতা সৃষ্টিতে অন্যতম
প্রভাবী উপাদান ছিল। প্রথমেই সাতচল্লিশের ১৫ আগস্ট রাজনৈতিক স্বাধীনতা উপলক্ষে
লাহিড়ীর প্রতিক্রিয়ার উদাহরণ টানা যাক, ‘বলাই বাহুল্য ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্ট জেলা কংগ্রেস কমিটির প্রেসিডেন্ট
অনেকটা ফাঁদে পড়েই মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে [পাকিস্তানি]
পতাকা উত্তোলনে বাধ্য হলেন, যা পক্ষান্তরে অখণ্ড ভারতের জন্য আন্দোলনকারী এই সংস্থাকে অপদস্থ
করে।’
পাকিস্তান সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে—এক পরাজয়বোধ, হতাশা ও বিশ্বাসভঙ্গের অনুভূতি
পূর্ববঙ্গের উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজের মনে জেঁকে বসে। এক হিন্দু নেতা তাঁর মোহভঙ্গের
কথা বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘হিন্দুরা কখনোই পাকিস্তানের জন্ম চায়নি। তাদের অনিচ্ছুক মাথার ওপর
পাকিস্তানকে জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ ঢাকার একজন প্রবীণ কমিউনিস্ট
কর্মী জ্ঞান চক্রবর্তী উল্লেখ করেছেন, ‘হিন্দুদের কাছে গোড়া থেকেই পাকিস্তান অগ্রহণযোগ্য ছিল এবং
বিপুলসংখ্যক হিন্দু স্বাধীনতার পরপরই দেশ ত্যাগ করে।’ তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, অধিকাংশ হিন্দু সরকারি
কর্মচারীই সেই সময় পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করে।
কিছু স্থানে হিন্দু পেশাজীবীদের প্রতিক্রিয়া এত বেশি তিক্ত ছিল যে
দেশত্যাগের আগে তারা সরকারি সম্পত্তির যথাসাধ্য ভাঙচুর করেছিল। অজয় ভট্টাচার্য
উল্লেখ করেছেন, সিলেট হাসপাতালের হিন্দু কর্মচারীরা হাসপাতালের সম্পদ ভাঙচুরের পর
সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যায়। সংবাদে প্রকাশিত হয়, মুন্সিগঞ্জ সাবজেলের হিন্দু
কেরানি ও বন্দীরা স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে তাদের জন্য বরাদ্দকৃত বাড়তি রেশনের কোটা
বর্জন করে। পূর্ব পাকিস্তানের সমাজে অগ্রগামী শ্রেণীগুলো মূলত সংগঠিত ছিল
উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দ্বারা এবং এরাই
স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক দিক থেকে রাতারাতি নিঃস্ব হলো। রাজনৈতিক
স্বাধীনতাকে ঘিরে একদিকে উদ্যম, আশা ও প্রত্যাশা; অন্যদিকে, বাংলা দ্বিখণ্ডীকরণের ফলে হতাশা, তিক্ততা ও মোহভঙ্গজনিত বহু
সম্পূরক ও বিপরীত অনুভূতি পরে এক চমকপ্রদ ইতিহাস নির্মাণের উপাত্ত তৈরি করেছে, যা এখনো লেখা হয়নি। লাহিড়ীর
অভিমানসূচক অভিব্যক্তিতে প্রতিফলিত হয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উচ্চবর্গীয় হিন্দুর
ব্যর্থতাবোধ, যারা পূর্ব বাংলায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি থাকা সত্ত্বেও
তাদের আধিপত্যের অবস্থান ও নেতৃত্ব হারিয়েছিল। অন্যদিকে, তফসিলি হিন্দুরা সাংবিধানিক
রাজনীতিতে মুসলমানদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল।
মানুষের আশা তখন বহু দিকে ছুটছিল, জাতীয়তাবাদী পণ্ডিতেরা এই জটিল
প্রপঞ্চের প্রায়ই সরলীকরণ করেছেন। তার পরও পূর্ববঙ্গের সমাজ পরিবর্তনের রাজনীতিতে
যুক্ত বহু উচ্চবর্ণের হিন্দু এখানেই থেকে যাওয়ার এবং সেই সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের
রাজনৈতিক জীবনে অব্যাহত অবদান রাখার সিদ্ধান্ত নেন। ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী এঁদেরই
একজন এবং তিনি লিখেছেন, ‘আমি ঠিক করলাম আমি দেশ ছাড়ব না। আমি পাকিস্তানেই রয়ে যাব।
পাকিস্তানের জনগণের সুখ-দুঃখের ভাগীদার হয়ে আমি থেকে যাব। এই দেশ, এই পূর্ব বাংলা তো আমারই
দেশ...কেন আমি এই দেশ ত্যাগ করব?’ এ দেশে রয়ে যাওয়া তাঁর মতোই মনোভাবসম্পন্ন আরও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক
কমিউনিস্ট দেশের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির বিকাশে অবদান রাখার ইচ্ছায় এগিয়ে আসার
মূল্য হিসেবে পরে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন কারাগারে দীর্ঘ ও দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ
করেন।
উপজাতি অধিষ্ঠিত অঞ্চলগুলোতেও অস্থিরতা দেখা যায়। কেননা সংখ্যালঘু
সম্প্রদায়গুলো বিশেষভাবে অনুভব করে যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর প্রসঙ্গে নতুন
রাষ্ট্রের কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। অতএব এক মাস না পেরোতেই ময়মনসিংহের পাশের
এলাকার উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর একটি স্মারকলিপি পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কাছে
পেশ করা হয়। র্যাডক্লিফ রোয়েদাদের কারণে গারোদের একটি অংশ ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলের আওতায়
পড়ে যায়। এভাবে পূর্ব বাংলার সমতলবাসী গারোরা একটি ধর্মীয় ভিত্তিতে সৃষ্ট
রাষ্ট্রের কারণে শঙ্কিত হয়ে ওঠে। এই স্মারকলিপির উদ্ভব ঘটে ১৯৪৭-এর ২৪ আগস্ট, উত্তর ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের
রংরাপাড়ায় আয়োজিত গারো উপজাতীয়দের এক সমাবেশে। সেখানে উপস্থিত প্রায় চার হাজার লোক
তাদের বসবাসের অঞ্চলের একত্রীকরণ দাবি করে, যার মধ্যে ছিল ময়মনসিংহের অধীনে
পাঁচটি থানা এবং ওই এলাকা-সন্নিহিত ভারতের আসাম প্রদেশ। ব্রিটিশরাজ কর্তৃক
জাতিভিত্তিক নতুন রাষ্ট্র গঠনের এই বিশেষ পদক্ষেপটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোকে
তাদের স্বতন্ত্র গারো উপজাতির জনগোষ্ঠীকে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীনতার দাবি
জানাতে অনুপ্রাণিত করল। পরস্পর যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে এক সময়কার অখণ্ড গারো
সম্প্রদায় যে পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, সেই প্রসঙ্গে কখনোই তাদের কোনো
মতামত নেওয়া হয়নি। সাতচল্লিশের রাজনৈতিক স্বাধীনতার সময় উপজাতিদের আশা ও ভীতি যেসব
প্রসঙ্গের জন্ম দিয়েছিল, তা আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ সংকট হিসেবেই রয়ে
গিয়েছে। স্বাধীনতাপ্রাপ্তির দিনগুলোতে আমরা যখন গ্রামীণ জনগণের প্রতিক্রিয়ার দিকে
মনোনিবেশ করি, তখন স্বাধীনতার সেই বাগাড়ম্বরপূর্ণ অর্থ বহু রকম ব্যাখ্যা ধারণ করতে
শুরু করে। তাজউদ্দীন আহমেদ লক্ষ করেন, ‘রাত নামতেই যখন উত্সব আনন্দ থিতিয়ে আসল, তখনো ঢাকার রাস্তায় বহু মানুষের
ঢল, যাদের
অধিকাংশই কেবল বিজয়োত্সবে অংশ নেওয়ার জন্য আশপাশের জেলাগুলোর বিভিন্ন গ্রাম থেকে
ঢাকায় এসেছে।’
রাজশাহীতে লাহিড়ী সেদিনের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেছেন, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘গ্রামের শতসহস্র মানুষ দলে দলে’ শহরে প্রবেশ করতে লাগল। ঢাকায়
অনুষ্ঠিত স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে লাখো লোকের সমাবেশে সেদিন সমপরিমাণ হিন্দু ও
মুসলমান উপস্থিত ছিল। ১৫ আগস্ট তাজউদ্দীন খেয়াল করেন, এদের অধিকাংশই জেলার বাইরের
গ্রামগুলোর অধিবাসী। তাঁর ধারণা অনুযায়ী, মানুষ সুদূর কুমিল্লা ও ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকেও পাকিস্তানের সুদৃঢ়
আত্মপ্রকাশের মুহূর্তটিকে প্রত্যক্ষ করতে এসেছিল। যে জাতির বেশির ভাগ লোক গ্রামে
বাস করে এবং স্বাভাবিকভাবেই যাদের গতিবিধি ছিল সীমিত, সেখানে কেবল ‘স্বাধীনতার বোধ’—তা যেভাবেই অনুধাবন করা হোক না
কেন—তাদের
সেদিন ট্রেনভর্তি করে নতুন ক্ষমতার কেন্দ্রস্থল ঢাকা শহরে নিয়ে আসতে পেরেছিল।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, আমরা সেদিন সারা রাত ঢাকার পথে পথে ভ্রাম্যমাণ ‘পথচারী’দের সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানি
না। কোনো অনভিপ্রেত ঘটনা ছাড়াই, হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোককেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে দিবসের
বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে দেখা গেছে। সৌভ্রাতৃত্বপূর্ণ মৈত্রী অন্তত বাহ্যিকভাবে
হলেও পরিলক্ষিত হয়েছে সারা দেশেই।
কিন্তু জনগণের এই অত্যধিক উচ্ছ্বাসে আক্রান্ত আচরণের প্রকৃতি দেখে
ঢাকায় তাজউদ্দীন এবং রাজশাহীতে লাহিড়ী উভয়ই অত্যন্ত বিচলিত হয়েছেন। নেতাদের ভাষণ
শুনতে আসা জনগণের উচ্ছৃঙ্খল আচরণ ও বিশৃঙ্খলা প্রত্যক্ষ করে তাজউদ্দীন ব্যথিত
হয়েছিলেন, ‘তারা সব সময় স্থান গ্রহণ না করে ভিড় করছিল।’ অনিয়ন্ত্রিত জনগণ কেবল এই একটি
কাজ করেই ক্ষান্ত হয়নি; লাহিড়ীর ভাষ্য অনুযায়ী; সেদিন কেউই ‘ট্রেনে টিকিট কাটার প্রয়োজন মনে করেনি।’ তাজউদ্দীনও খেয়াল করেন, যেসব লোক ঢাকায় এসেছিল, তাদের ‘ট্রেনের ভাড়া দিতে হয়নি’। মধ্যবিত্ত জাতীয়তাবাদী
নেতাদের কাছে এসব নিয়মবহির্ভূত আচরণ ছিল অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক।
সে সময় আরও বহু বিশৃঙ্খলাসূচক ঘটনা ঘটেছিল। একটি সরকারি প্রতিবেদনে
উল্লিখিত তথ্য থেকে জানা যায়, সাতচল্লিশের ১১ সেপ্টেম্বর মুন্সিগঞ্জ সাবজেল থেকে ৮৩ জন কয়েদি
পালায়। এরা সবাই স্বাধীনতা দিবসে মুক্তিলাভের প্রত্যাশা করেছিল। আরও বেশ কিছু
কয়েদির কাছে স্বাধীনতার আবির্ভাবকে মনে হয়েছিল তাদের ছাড়া পাওয়ার সুযোগ এবং সেই
সঙ্গে পরবর্তী আত্মোন্নয়নের উপলক্ষ। ১৯৪৭-এর ১৪ সেপ্টেম্বর আজাদ পত্রিকার
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রায় সব কয়েদিই অনশন ধর্মঘট পালনে রত। এই
বন্দীরা স্বাধীনতা উপলক্ষে তাদের মুক্তির জন্য প্রার্থনা জানিয়েছিল। উপরন্তু তারা
কায়েদে আযম এবং খাজা নাজিমুদ্দিনের কাছে মুক্তিলাভের জন্য আবেদন জানায়, যাতে নিজেদের চরিত্র সংশোধনের
একটি সুযোগ তাদের অন্তত দেওয়া হয়। অনেকেই স্বাধীনতাকে ব্যাপক হারে ধরে নিয়েছিল
ব্রিটিশ শাসন-সংশ্লিষ্ট পুলিশ ও রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠানের অবলুপ্তির উপলক্ষ
হিসেবে। জেলা পর্যায়ের একজন মুসলিম লীগ কর্মী আতাউর রহমান খানের প্রতি এক প্রবীণ
গ্রামবাসীর জিজ্ঞাসা ছিল, ‘এখন যখন পাকিস্তান অর্জিত হয়েছে, এর পরও কি দেশে পুলিশ, কোর্ট-কাচারি, সেপাই-সাস্ত্রী, জেল এবং লকআপের অস্তিত্ব থাকবে?’ খান এর উত্তরে বলেন, ‘কেন নয়? এসব প্রতিষ্ঠান ছাড়া রাষ্ট্রকে
প্রতিরক্ষা করবেন কীভাবে?’ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হতভম্ব বৃদ্ধ বলেছিলেন, ‘তাহলে কোন ধরনের পাকিস্তান আমরা
পেলাম। দয়া করে এর নাম পাল্টে ফেলুন, আপনারা একে পাকিস্তান নামেই ডাকবেন আবার দুর্নীতি-অনাচারের
অস্তিত্বকেও প্রশ্রয় দেবেন।’ স্বাধীনতার মূল্যবোধের বাস্তবায়নের পথে, রাষ্ট্রীয় ঔপনিবেশিক প্রতিষ্ঠান
বিশেষত পুলিশ এবং আদালতকে এই বৃদ্ধের কাছে অন্তরায় বলে মনে হয়েছে।
‘পাকিস্তান’ বলতেই সাধারণ মুসলমান কৃষকের
মনে ভেসে উঠত এক নতুন নৈতিক সমাজের ছবি, যেখানে সামাজিক জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করবে পারস্পরিক নীতিবোধ এবং
ন্যায়বিচার-জ্ঞান। যুগ যুগ ধরে সমাজের উচ্চশ্রেণী এবং ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের
সদস্যদের দ্বারা অবদমিত জীবনযাপনের পর তারা পাকিস্তান বলতে এক পবিত্র রাষ্ট্রের
কথা ভাবত। অর্থাত্, পাকিস্তান নামের মধ্যে তারা একধরনের পবিত্রতা আরোপ করেছিল।
তাই এতে মোটেও আশ্চর্যবোধ হয় না, যখন পূর্ব পাকিস্তানের জন্মের
অল্প পরই দেশের তাঁতি সম্প্রদায় জোলাদের নেতারা সরকারের কাছে এক আবেদনে তাদের একটি
নতুন সামাজিক স্বীকৃতি ও অবস্থানে উত্তরণের দাবি করে। তত্কালীন রাজনৈতিক
স্বাধীনতার আবহ ও আলোকে তাদের এই দাবিকে যুক্তিযুক্ত ও বৈধ মনে করেছিল। ওই সময় ‘পাকিস্তানের’ অস্তিত্বকে জনপ্রিয় করে তোলার
জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে স্বর্ণযুগের আগমনবিষয়ক বিশ্বাসকে অভ্যস্ত করা হতো।
বেশ্যালয়, মদ ও জুয়ার অবলুপ্তি প্রসঙ্গে ইসলামের নাম করে এই বিশ্বাসের
প্রচারকেরা তাদের অবস্থান প্রতিষ্ঠিত করতে চাইত।
মুসলিম নেতারা ১৯৩৭-এর নির্বাচনের পর থেকেই ‘মুসলমান জনগণের ভবিষ্যত্ স্বদেশ’-এর এমন ছবি এঁকেছিলেন, যেখানে দরিদ্র চাষিদের ‘দিনে দুবেলা দুমুঠো অন্নের’ স্বপ্ন সত্যি হবে। ছেচল্লিশের
মন্বন্তরের পর ‘বিপর্যয়-পরবর্তী কল্পরাজ্য’ তৈরিতে জনগণের কাছে বেঁচে থাকার জন্য দুই বেলা খাবারের স্বপ্নই ছিল
তাদের পরিপূর্ণতার প্রতীক। গ্রিনোর (Greenough)
বক্তব্য অনুসারে, বহু কৃষকের কাছে ‘ভাতের’ আরেক নাম ছিল স্বাধীনতা। সাধারণ মুসলমান চাষিদের আশাবাদ ও
পাকিস্তানকেন্দ্রিক প্রত্যাশা নিঃসন্দেহে পূর্ব বাংলার সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর
মধ্যকার জাতীয়তাবাদী অনুভূতির অস্তিত্বের প্রতিফলন। অবশ্য তত্কালীন সমাজ ও
রাজনীতির বৈশিষ্ট্যের সব দিক বিশ্লেষণ করলে প্রকৃত প্রস্তাবে জাতীয়তাবাদ হতে পারত
একান্তই একটি উচ্চবর্গীয় অনুভূতি। কেননা মৃত্যু ও দুর্ভিক্ষের একদম মুখোমুখি
দাঁড়ানো পরিস্থিতিতে, জাতীয়তাবাদ ছিল বহু বিপরীত শক্তির একটি, যা দরিদ্র জনগণকে সমাজ
পরিবর্তনের আন্দোলনে নামতে বাধ্য করত।
ইসলামধর্ম স্বয়ং এবং ইসলামের ঐতিহ্যগত মানবিক সাম্যবাদের ধারণা তখন
একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শক্তিতে রূপান্তরিত হলো, বিশেষত যখন উচ্চবর্গের হিন্দু
সম্প্রদায়কে দেখা হয় নিপীড়ক শক্তির প্রতিনিধি হিসেবে। ইসলাম-দৈনন্দিন রাজনীতি সেই
সময় এতই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল যে এমনকি ধর্মনিরপেক্ষ দাবিদাওয়াও ধর্মীয়
জাতীয়তাবাদ দ্বারা রঞ্জিত হতো। ১৯৪৮-এর সদ্যগঠিত বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক সমাবেশের বহু
ধারণা ও উদাহরণকে ইসলামের বাণী, সংগঠন ও ইতিহাস থেকে গ্রহণ করা হয়েছিল। নতুন রাষ্ট্রের সমালোচনাবিষয়ক
প্রথম দিককার রচনাগুলোর ধরনে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর ও তাঁর মতাদর্শে
নেতৃত্বদানের মাধ্যমে একটি আদর্শ সমাজ অর্জন ও প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, ‘কবে আমরা হযরত ওমর (আ.)-এর মতো
একজন আদর্শ শাসক পাব, যখন সেই চার খলিফার স্বর্ণযুগের মতো পরিস্থিতির পুনরাবির্ভাব ঘটবে।’
ইতিহাসবিদ গ্রিনো সদ্য স্বাধীনতা-উত্তর কালের সময়টিকে ‘বিশৃঙ্খলা ও দুর্দশা’র এক কাল হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
স্বাধীনতা তখন এক নতুন সূচনার পরিবর্তে নতুন সংকটের চেহারা নিল, যখন খাদ্যঘাটতি, বন্যা ও সরকার পরিবর্তনের ফলে
ক্ষতিগ্রস্ত লক্ষাধিক মানুষের কাছে স্বাধীনতা নতুন সূচনা না হয়ে নতুন সংকট হয়ে
দাঁড়াল।
পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রযন্ত্রের জন্য রাজনৈতিক স্বাধীনতা এক অবধারিত
অনিশ্চয়তার জন্ম দিল এবং জনগণের ‘উদ্যম’ প্রায়ই এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণের ঊর্ধ্বে ছিল। রাষ্ট্রকে
সরকারি কার্যক্রিয়ার সমষ্টিমাত্র হিসেবে বিবেচনা করতেন আমলারা, পক্ষান্তরে সরকারনির্ভর লৌকিক
আকাঙ্ক্ষার ধরন প্রায়ই রাজনৈতিক নেতাদের দুর্বোধ্য ধাঁধায় ফেলে দিত, কেননা নতুন রাষ্ট্র-সম্পর্কিত
জনসাধারণের প্রত্যাশা ছিল সম্পূর্ণই ইউটোপিয়ান। অন্যদিকে, রাষ্ট্রের প্রশাসনিক যন্ত্রের
পুনর্গঠন একান্ত প্রয়োজন ছিল, কেননা পূর্বতন এবং ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত ও প্রচলিত সংগঠনটি ছিল
অগণতান্ত্রিক ও নিপীড়ন-অভ্যস্ত ঔপনিবেশিক কাঠামোর অনুসারী।
দেশভাগ পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি নীতিপ্রণেতাদের জন্য এমন সুযোগ এনে
দিয়েছিল, যার সুবাদে যখনই তাদের রাজনৈতিক বৈধতা হুমকির সম্মুখীন হতো, তখনই তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ
মুসলমানদের কাছে ধর্মীয় সংহতির আবেদনকে ব্যবহার করত। যদিও প্রান্তিকীকরণের
উদ্দেশ্য-সচেষ্ট এসব বাগাড়ম্বরের আবেদন খুবই স্বল্পায়ু ছিল, তবু বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে
সঙ্গে এর দ্বারা সৃষ্ট বৈপরীত্য, জন্মগতভাবে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ এবং ‘গণতান্ত্রিক’ বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটেও সমস্যা সৃষ্টি করে চলেছে। এখানকার
মুসলমানদের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমানদের থেকে ভিন্ন, স্বতন্ত্র ও অখণ্ড একটি পরিচয়
নির্মাণের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের দেশ বিভাগের প্রসঙ্গটি ব্যবহার করেছিল।
ঘটনাচক্রে কীভাবে তা পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রের বৈধতায় ক্ষয় সৃষ্টি করেছিল এবং
পাকিস্তানের নতুন পরিচয় গঠনে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করছিল, তা বাঙালি জাতীয়তাবাদী আলোচনায়
বহুল ব্যবহূত প্রসঙ্গ।
এতে আমরা একটু পরে ফিরে আসছি। ভারতীয় জাতির নিজস্ব পরিচয় খুঁজে
পাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার কারণ বোঝার জন্য এখন ভারতীয় ইতিহাসশাস্ত্রে নতুন করে
প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। ১৯৮৪-তে শিখদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস এবং ১৯৯২-এ
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এ ক্ষেত্রে ট্র্যাজিক প্রভাবকের
ভূমিকা পালন করে। এখন দেশ বিভাগকেন্দ্রিক সন্ত্রাস এবং ইতিহাসে সন্ত্রাস বিষয়ে
কীভাবে লেখা হবে, তা গবেষকদের নতুন করে ভাবাচ্ছে।
এভাবেই এই সন্ত্রাসের ইতিহাস আলোচিত হতে শুরু করেছে। ভারতের চলমান
গণতান্ত্রিক আন্দোলন, দেশভাগের ইতিহাসে মহিলাদের প্রতিনিধিত্বের প্রসঙ্গটি পুনরুদ্ধার করার
ক্ষেত্রে নারীবাদীদের উদ্যোগী ও আগ্রহী করেছে। উর্বশী বুটালিয়া, ঋতু মেনন, কমলা ভাসিন, বীণা দাস তাঁদের আলোচনায় প্রমাণ
করেছেন, ধর্ষণ, অপহরণ, বলপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মহিলাদের স্বদেশে
পুনর্বাসন দেশভাগের স্মৃতির বিশাল অংশজুড়ে আছে। এটা বললে হয়তো স্বতঃসিদ্ধ সত্যের
মতো শোনায়, তবু এ কথা স্মৃতিতে বাস্তব যে যারা দেশচ্যুত, নিহত ও উদ্বাস্তু হয়েছিল, সেই জনগোষ্ঠীর এক বিশাল অংশই
ছিল নারী।
এসব নতুন প্রশ্ন এবং অন্যান্য পরিপ্রেক্ষিত ঐতিহাসিকদের ধারণাকে
উত্তরোত্তর আরও দৃঢ়মূল করেছে যে দেশ বিভাগ, সাধারণ মানুষের জীবন অভিজ্ঞতায়
যেভাবে এসেছে তা জানার প্রচেষ্টার আশু প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সাধারণ মানুষ অথবা তাদের
অভিজ্ঞতাকে রোমান্টিকভাবে না দেখেও বলা যায় যে এসব অভিজ্ঞতা উচ্চবর্গের ইতিহাস
থেকে অনেকখানি আলাদাই ছিল। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ইতিহাসে ধরে নেওয়া সংস্কৃতিগত
অখণ্ড পরিচয়ের কারণে, যার মৌল ভিত্তি ছিল বাংলা ভাষা ও এর ঐতিহ্য, সাতচল্লিশের দেশভাগের
অভিজ্ঞতাকে অমীমাংসিতই রেখেছে।
‘বাংলা’ নামের স্থান এবং ‘বাংলা’ ভাষার ধারণা—উভয়েরই রয়েছে একধরনের চিরন্তন
স্বাভাবিকতা; মনে হয় যেন ইতিহাস, রাজনীতি এবং ধর্মের বাইরে এই ভূখণ্ড, তার জনগোষ্ঠী এবং সংস্কৃতি সব
সময়ই সংযুক্ত অখণ্ড রূপ নিয়ে চিরকাল এখানেই ছিল। বাংলাদেশের অভ্যুদয় অর্থাত্
বাঙালিদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাকে দেখা হয় যুগপত্ এক অনন্য
একাত্মবোধের জাতির কারণ ও পরিণতি হিসেবে, যা রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রথাগত কাঠামোয় বিচ্ছেদ সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের
ঐতিহাসিক বিবরণীতে, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত সময়কালকে একধরনের পথচ্যুতি হিসেবে বিবেচনা
করার প্রবণতা দেখা যায়—যেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্তরণের বিশাল উপাখ্যানে এটি ছিল একটি
মুহূর্তিক বিচ্ছেদ। যদিও বাংলাদেশের সৃষ্টি অবধারিতই ছিল, যা এর অনন্য জনগোষ্ঠী-ভূখণ্ড, ভাষা ও সংস্কৃতিগত একাত্মতার
মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছে—তবে উপনিবেশ-উত্তর সেই কালপর্বটিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, যে পর্বে বাঙালির পরিচয় ‘অন্য কিছু’র অন্তর্ভুক্ত হয়ে চাপা পড়ে
ছিল। সমস্যাটি তখনই বহুমাত্রিক হয়ে ওঠে, যখন জানা যায় সেই ‘অন্য কিছু’টি ছিল প্রভাবশালী ধর্ম ইসলাম, যা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের
মধ্যকার অন্যতম প্রাথমিক যোগাযোগের সূত্র হিসেবে বিবেচিত হতো, তখন বাঙালিত্বের পরিচয়ের সঙ্গে
ইসলামের পরিচয়ের সম্পর্কটি স্বয়ং বিতর্কিত হয়ে ওঠে, যার প্রমাণ সাম্প্রতিক
উত্তেজনাকর পরিস্থিতি।
পূর্ব পাকিস্তানের অস্তিত্বকাল (১৯৪৭-৭১) বাঙালি জাতীয়তাবাদী আখ্যানে
একটি স্ববিরোধী বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, যা একাধারে চূড়ান্ত পরিণামে জন্ম দেয় বাংলাদেশকে, আবার একই সঙ্গে ইসলাম ও
বাঙালিত্বকে এর পরিচয়ের সহজাত উপাদান হিসেবে সমন্বিত করতে চায়। অতএব, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী ইতিহাসবিদ্যায়
ব্যাখ্যা করতে হবে, প্রথমত কীভাবে ১৯৪৭-এ বাংলা বিভক্ত হলো (পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে), দ্বিতীয়ত কীভাবে একটি
সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম রাষ্ট্র পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারল (পূর্ব ও পশ্চিম
পাকিস্তানের মধ্যে)। জাতির কাহিনিতে সাতচল্লিশের দেশবিভক্তি এবং একাত্তরের দ্বিতীয়
ভাঙনের ঘটনাগুলোকে কখনো দমন, কখনো বর্জন, কখনো বা সযত্ন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বলা হয়েছে। দেখা যায়, সরকারি ইতিহাসে ১৯৭১-এর জাতীয়
মুক্তিকে বিজয়ের মুহূর্ত হিসেবে আলোকিত করা হলেও সাতচল্লিশের ঐতিহাসিক মুহূর্তের
গুরুত্বকে অনেকটাই অবমূল্যায়িত করা হয়েছে। এর অন্যতম একটি উদাহরণ হলো ১৯৯২-এ
প্রকাশিত বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি সম্পাদিত তিন খণ্ডের বাংলাদেশের ইতিহাস।
বিশেষত, রাজনৈতিক ইতিহাসবিষয়ক খণ্ডের প্রথম সংস্করণে, যেখানে ১৯৪০-এর মন্ত্রিসভা
গঠনের বিষয়টি সামান্য স্পর্শ করেই এক লাফে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের প্রসঙ্গে চলে
যাওয়া হয়েছে, বলা যেতে পারে উপনিবেশ-উত্তর বাঙালি জাতীয়তাবাদের সূচনামুহূর্তে।
১৯৪৭-এ পাকিস্তান সৃষ্টির ইতিহাস সেখানে সম্পূর্ণ অনুল্লেখিত থেকেছে।
যেভাবেই রচিত হোক না কেন, এসব সরকারি ইতিহাসে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দেশ বিভাগের অভিজ্ঞতা এবং
কীভাবে এসব তাদের দৈনন্দিন জীবন ও পরিচয়ের রূপান্তর ঘটিয়েছিল, তা তুলে ধরার কোনো প্রয়াস দেখা
যায় না। সরকারি ইতিহাস অনেক সময় একই ইতিহাসের লৌকিক ধারণা ও স্মৃতিকথার
অন্তর্নিহিত মৌলিকতা থেকে সরে এসেছে। দেশভাগ-সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে
বিভিন্ন শ্রেণী—যেমন কৃষক, শ্রমিক, নারী, গ্রামীণ জনগণ, নাগরিক শ্রেণী, জমিদার—বিভিন্ন ব্যাখ্যা লাভ করেছে। সরকারি ইতিহাস ও জনগণের স্মৃতি-আশ্রয়ী
অভিজ্ঞতার মধ্যে যথাযথ বিচার ও সমস্যার যথার্থ শনাক্তকরণ হয়নি, বিশেষত রাষ্ট্র কীভাবে এ
মুহূর্তের ইতিহাসের কাঠামো নির্মাণ করবে এবং তার প্রয়োগ ঘটাবে, তা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
দেশ বিভাগের অভিজ্ঞতা পাঞ্জাবের চেয়ে বাংলার অনেকাংশেই পৃথক ছিল।
উদাহরণস্বরূপ, পূর্ব বাংলার বহু মুসলমান জমিদার ও কৃষক দেশ বিভাগকে বৈষয়িক উন্নয়নের
নজিরবিহীন সুযোগ হিসেবে চিন্তা করেছে, যেহেতু অর্থ ও বিত্তগত দিক থেকে তখন প্রাধান্য বিস্তারকারী হিন্দুদের
জোরপূর্বক দেশত্যাগ সংঘটিত হচ্ছিল। অতএব, ১৯৪৭-এ দেশ বিভাগকে তাই জমির মালিকানার পুনর্বিন্যাস ও মুসলিম
মধ্যবিত্ত পেশাজীবীদের উত্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচনা হিসেবে বলা যেতে পারে।
নিঃসন্দেহে বলা চলে, এরাই পরে রাষ্ট্রের সম্পদ, গোষ্ঠীর সম্পদ এবং ১৯৪৭-এ দেশ বিভাগের সময় হিন্দুদের পরিত্যক্ত সমুদয়
সম্পদের স্বত্ব ভোগকারী ছিল। নতুন আবির্ভূত বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতি, যার মূল বিষয় ছিল
কেন্দ্র-প্রদেশবিরোধিতা, প্রতিস্থাপিত করল পুরোনো ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ধারাকে। অতএব, স্বাভাবিকভাবেই যে অভিজ্ঞতাগুলো
বিকাশোন্মুখ জাতীয় ঐক্যকে বাধাগ্রস্ত করতে সক্ষম ছিল, সেগুলোকে প্রান্তীকরণ করা হয়।
উপসংহারে আমি বলতে চাই, রাষ্ট্র যে একটি কাল্পনিক ধারণা, তা পণ্ডিতেরা এত দিনে মেনে
নিয়েছেন। একই সঙ্গে এটিও প্রচ্ছন্ন যে রাষ্ট্র তার পরিপূর্ণ অস্তিত্ব পায় ঐতিহ্য, পুরাণ, ইতিহাস ও পরিচয় আবিষ্কারের মধ্য
দিয়ে। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র স্বার্থবাদের যেসব প্রবণতা রয়েছে—যেমন ‘জাতিগোষ্ঠীবাদ’, ‘সাম্প্রদায়িকতাবাদ’—এগুলো সেই কাল্পনিক সদ্যোজাত
জাতিরাষ্ট্রের কল্পসমাজের বিপক্ষে আরেক ধরনের কল্পিত বাস্তবতা। উপরন্তু যে অভিন্ন
ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এ রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে, সেসব প্রক্রিয়ার মধ্য থেকেই এসব
কল্পিত সত্তার উদ্ভব হয়েছে এবং এ রাষ্ট্রের জন্য সেসব বিভেদকারী শক্তিগুলোই এখন
আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তসলিমা নাসরিন রচিত লজ্জা উপন্যাস পাঠ করতে গিয়ে যে
অস্বাচ্ছন্দ্য অনুভব হয়, তার কারণ এটি সাহিত্য হিসেবে নিম্নমানের বলে নয়, বরং তা বাংলাদেশের রাজনীতির
দেহে ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগের জন্মদাগগুলোকে স্পষ্ট ও প্রকট করে তোলে বলেই।
স্যাংগারের সাক্ষাৎকারে জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে গান্ধির মতামত
স ম র বি জয় চ ক্র ব র্তী
সালটা ১৯৩৫। শীতের দুপুর। ওয়ার্ধা আশ্রমে গান্ধি। এক শেতাঙ্গিনি মহিলা নাম
মারগারেট স্যাংগার পূর্ব নির্ধারিত সময় নিয়ে সাক্ষাৎকার নেবার জন্য মহাত্মা
গান্ধির সংগে দেখা করতে আসেন। সাক্ষাৎকারের বিষয়, জন্মনিয়ন্ত্রণ ও যৌনতা।স্যাংগার সেই
সময়ের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন নামিদামি সাংবাদিক।মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ব
হিসেবেও তাঁর ভালো পরিচিতি।নারীমুক্তি আন্দোলনেও ছিলেন তিনি সক্রিয়।গান্ধির অহিংস
মতবাদ ও সংসারি হওয়া সত্বেও বিষয় বিমুকতা স্যাংগারকে বিশেষ ভাবাতো।
স্যাংগার-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের কিছু দিন আগে
বোম্বে(মুম্বাই) মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের জনৈক কাউন্সিলর গান্ধিজিকে একটি চিঠি লিখে
জানান যে তিনি একটি জন্মনিয়ন্ত্রণ-ক্লিনিক খুলতে চাইছেন,এ ব্যাপারে তাঁর মতামত কী।নিশ্চিত তিনি
ভেবে ছিলেন মহাত্মা জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য ক্লিনিক-খোলাতে শুধু যে অপার খুশি
হয়ে সমর্থন করবেন তা নয়, তাঁকে
উৎসাহিতও করবেন।কিন্তু হলো পুরোটাই বপরীত।জবাবে এক দীর্ঘ চিঠি লিখে মহাত্মা বলেন, এবরশন করে বার্থ-কন্ট্রোল তিনি সমর্থন
করেন না। তাঁর মতে এটি অনৈতিক তো বটেই
অতিমাত্রায় নিষ্ঠুরও।এছাড়াও ওষুধ প্রয়োগ ও অপারেশন করে জন্মনিয়ন্ত্রণের তিনি ঘোর বিরোধী।
মহাত্মা জন্মনিয়ন্ত্রণ চাইতেন না এমন
নয়,তাঁর মতে জন্মনিয়ন্ত্রণ যেন সংযমের
মাধ্যমে হয়,কোন ধরণের যান্ত্রিক বা দাওয়াই-এর
সহায়তায় নয়।মানুষের জন্ম যেহেতু নারী-পুরুষের যৌন মিলনে প্রাকৃতিকভাবে সম্পন্ন হয়,সেইহেতু জন্মনিয়ন্ত্রণ অযান্ত্রিক
হওয়াই কাম্য এবং তা স্বাস্থ্যকরও।পাশ্চাত্যের ব্যাপক যন্ত্র-নির্ভরতা গান্ধি
সমর্থন করতেন না।তিনি মনে করতেন,যৌনতা
স্রেফ বংশরক্ষা নিমিত্ত, অন্যথায়
তা পাপ।
এই ধারণার বশবর্তী গান্ধি,স্যাংগারকে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে
মাত্রাতীত যৌন-পিপাসা কতটুকু কী, কেন
তা পাপ।অসংখ্য সন্তানের জন্ম ভারতের মতো গরীব দেশে অবশ্যই কাম্য নয়, তবে যৌনসংগম থেকে স্বেচ্ছায় বিরত থাকাই
জন্মনিয়ন্ত্রণের স্বাভাবিক সমাধান।কৃত্রিম উপায়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ মানুষকে নিরর্থক যৌনতার দিকে ঠেলে দেয় বলে
তাঁর ধারণা।
স্যাংগার গান্ধিকে পাল্টা প্রশ্ন করেন, যৌনাকাঙ্খা জাগলে কোনো দম্পতির পক্ষে
সংযত থাকা কী করে সম্ভব? শুধুমাত্র
সন্তান কাঙ্ক্ষিত যৌন, অবাস্তব
নয় কি?অসম্ভব বলে মনে হওয়াই তো স্বাভাবিক?
উত্তরে গান্ধিজি বলেন তা সম্ভব। জনবহুল ভারতের প্রেক্ষিতে তাঁর মতে, জন্মনিয়ন্ত্রণ চার সন্তানে সীমিত রাখা
উচিৎ,
অধিক সন্তানের জন্ম দেওয়া অনৈতিক
এবং চার জন সন্তানের জন্মের পর স্বামী-স্ত্রীর পৃথক শয্যায় শয়ন করা
উচিৎ।প্রসঙ্গত,
১৯৪৪ খ্রিঃদে গান্ধিজির স্ত্রী
কস্তুরবার মৃত্যুর পর গান্ধি ব্রহ্মচর্যে কতটুকু সফল তা পরীক্ষা করার জন্য তাঁর
দুই নিকটতম আত্মীয়া কুড়ি-নিম্ন বয়সের আভা ও মনুর সাহায্য নেন। গান্ধির থেকে তারা
৬০ বছরের ছোটো।রাতে বিবস্ত্র অবস্থায় এই দুই নারীকে তাঁর শয্যার দুপাশে রেখে নিজেও
বিবস্ত্র থেকে তাদের মাঝখানে শুয়ে তা পরীক্ষা করেন এবং পরীক্ষায় সমহিমায় উত্তীর্ণও
হোন তিনি।আভা ও মনুর কাঁধে হাত রেখে তাঁর চলাফেরা করার ছবি রয়েছে কিন্তু শয্যার
দৃশ্য আজ অবধি কোথাও দৃশ্যত হয়নি,কেউ
তুলে রাখার সুযোগ হয়তো পায়নি।এ’সমস্ত
কিছুর পরও আভা ও মনুর পরম শ্রদ্ধা ছিল গান্ধির প্রতি।
বিশ্বের তাবড় সংবাদ সংস্থা গান্ধির
যৌনাচার নিয়ে কম ঘাটাঘাটি করেনি, কিন্তু
কোথাও কোনো ব্যভিচারীতা তাঁরা শত চেষ্টায়ও খুঁজে পায়নি।এই প্রেক্ষিতে বার বার আভা
ও মনুকে প্রশ্ন করা হয়েছে কিন্তু প্রতিবারই তাঁদের মুখে মহাত্মার মহত্বই প্রকাশ
পেয়েছে।
গান্ধি চার সন্তানের কথা বলেছিলেন তাঁর
সময়ের প্রেক্ষিতে।সেই সময় গড় হিসেবে প্রতি দম্পতির সন্তান সংখ্যা ১০/১২ হয়েও
যেত।বহু সন্তানের পিতা-মাতাদের সমাজে বিশেষ সম্মানের চোখে দেখা হতো।সেই সময়ে অধিক
সন্তানদায়ী মাতাকে ভাগ্যবতী বলা হতো।এখনকার ধারণার একেবারে বিপরীত।দেশ কালের
প্রেক্ষিতে জন্মনিয়ন্ত্রণে প্রশ্ন আসে। রাশিয়া ও ক্যানাডায় বর্তমানে জন্মনিয়ন্ত্রণ
নেই, কারণ তাদের জনসংখ্যা
ক্রমহ্রাসমান।রাশিয়া ছাড়াও ইউরোপে আরো কয়েকটি দেশ এই পথ অনুসারী।সেই সব দেশগুলোতে
তাদের সরকার সন্তানের জন্মের জন্য ভাতা দিয়ে থাকে এবং গর্ভবতী মায়ের পরিচর্যার
জন্য নিখরচায় চিকিৎসার তো ব্যবস্থা রয়েছেই, শুশ্রুসারও
ব্যবস্থা আছে।বলা বাহুল্য, ঐ
দেশ গুলোতে নাগরিকের চিকিৎসার জন্য কোটি টাকা খরচ করতেও সরকার দ্বিধা করে না।
যৌনতা ও জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়ে মহাত্মার মনোভাব স্যাংগারের সংগে সাক্ষাৎকারের প্রায় এক
দশক আগে ১৯২৫-এ ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’-তে এক প্রবন্ধে প্রকাশিত হয় এবং গান্ধির মতবাদ কেউই
মেনে নিতে পারেননি। স্যাংগার তখনই এক
প্রতিবাদি নিবন্ধ লেখেন এবং গুরুদেব রবীন্দ্রনাথকে এ ব্যাপারে তাঁর মতামত চেয়ে
চিঠি লিখেন।স্যাংগার-এর
সমর্থনে তৎক্ষণাৎ রবীন্দ্রনাথ যে চিঠিটি পাঠান, তা গান্ধি-ভাবনার সম্পূর্ণ বিপরীত— মানুষের কবে নৈতিক বোধ জাগ্রত হবে, তার অপেক্ষায় বসে থেকে অসংখ্য শিশুকে
অভাব ও অকালমৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া চরম অন্যায়,এই ছিল রবীন্দ্রনাথের চিঠির সার কথা।
রবীন্দ্রনাথ এবং স্যাংগার, কেউই যে গান্ধিজিকে তাঁর দীর্ঘলালিত
ধারণা থেকে বিন্দুমাত্র সরাতে পারেননি, তা দশ বছর পরে গান্ধির সংগে স্যাংগারের কথোপকথনে স্পষ্ট হয়ে যায়। মূলকথা গান্ধিজি কখনো তাৎক্ষণিক ফলাফল
চাইতেন না,
তিনি চাইতেন সুদূরপ্রসারী
পরিণতি।ভারতের স্বাধীনতার লড়াইয়েও তা স্পষ্ট।দেশের মানুষদেরে নৈতিকতায় উন্নীত করা
তাঁর এক দিশা ছিল।অনৈতিক মানুষের উপর দেশের ভার দিলে দেশ রসাতলে যাবে, একথা তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস
করতেন।গান্ধি বুঝতেন,সামাজিক
পরিবর্তনের মাধ্যমে স্বাধীনতা না এলে,এই স্বাধীনতার কোনো মূল্য থাকবে না।রাজনৈতিক স্বাধীনতা যথার্থ স্বাধীনতা
নয়।তাই গান্ধি তড়িঘড়ি করে স্বাধীনতা লাভের পক্ষে ছিলেন না,ব্রিটিশের সংগে আলাপচারিতার মাধ্যমে যে
স্বাধীনতা আমরা পাই, তাতে
গান্ধিজির সায় তেমন ছিল না।উল্লেখ্য, গান্ধিজি খণ্ডিত ভারত চাননি।তাঁর এই মননশীলতা, সার্বিক মঙ্গলের মনোভাব, তাঁর প্রতি কাজে প্রতিফলিত হয়, জন্মনিয়ন্ত্রণেও এর ব্যত্যয় নয়।
প্রাসঙ্গিক আর একটি ঘটনা এখানে জুড়ে
দিতে চাইছি।১৯৩৪ সাল।স্যাংগার-গান্ধি
সাক্ষাতের আগের বছর। বিহার এবং নেপাল ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত। পাটনা ধূলিসাৎ, স্রেফ একটি প্রাসাদ টিকে ছিল। বিহারে মৃতের সংখ্যা সরকারি হিসেবে
৭২৫৩।
ঘটনার অব্যবহিত পরে গান্ধিজি এক প্রেস
বিবৃতিতে জানান, হরিজনদের সংগে বিহারে যে ব্যবহার করা
হয়, অর্থাৎ অস্পৃশ্যতা, সেই পাপের শাস্তি এই ভূমিকম্প।গান্ধির এই মন্তব্য ‘হরিজন’ পত্রিকায় ছাপা হলো।গান্ধির এহেন বয়ানে রবীন্দ্রনাথ বিচলিত
হলেন,এযেন তাঁর জানা গান্ধি নন, অন্য কেউ। প্রথমে তিনি গান্ধিকে এক
ব্যক্তিগত চিঠি লিখে জানতে
চাইলেন খবরে যা বেড়িয়েছে তা সত্য কি-না। যদি তাঁর প্রকৃত বক্তব্য এটি হয়, তবে খোলাখুলি বিরোধিতা করা উচিত এবং
তিনি তা করবেন।
রবীন্দ্রনাথ গান্ধির এই ব্যাপারটা অবৈজ্ঞানিক
বলে মন্তব্য করেন।ভূমিকম্পের সংগে ঈশ্বরের অভিশাপের সম্পর্ক তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি, অন্তত মহাত্মার কাছ থেকে এমনটা আশা
করেননি।পরে তিনি গান্ধির জবাবে গান্ধির এমন অবৈজ্ঞানিক মন্তব্যের কারণ বুঝতে পেরে
নীরব থাকেন।
গান্ধি জানতেন কোন দেবতা কোন ফুলে
তুষ্ট।গণদেবতার মানসিকতা মহাত্মার ভালই জানা ছিল।মূলকথা, মানুষের বদ্ধমূল ধারণার বাইরে গিয়ে
কোনো কিছু মন্তব্য করা উচিত নয় বলে তিনি জানতেন।যে অসত্যে আপামর জনসাধারণ বোঁদ হয়ে
আছে তা সহজে হটানো যায় না, বরং
তড়িঘড়ি করে হটাতে গেলে হীতে বিপরীত হতে পারে।মানুষের দীর্ঘ লালিত ধারণা সমাজ
সংস্কারের মাধ্যমেই সমূলে উৎপাটন করা সম্ভব এবং তা করা সময় সাপেক্ষ।গান্ধির এই
মনোভাবই বোধ করি, তাঁর
অহিংস আন্দোলন আর সময় সময় উপোস থাকতে তাঁকে সাহায্য করে যা ইংরেজের কাছে
ধারণাতীত।তাই পশ্চিম মহাত্মার মধ্যে যিশুর প্রতিরূপ দেখতে পায়।বিহারে ভূমিকম্পের
প্রেক্ষিতে গান্ধির মন্তব্য অস্পৃশ্যতা নিবারণের এক হাতিয়ার মাত্র,যদি এই কুসংস্কার অর্থাৎ “ভূমিকম্প পাপের ফল” জেনে মানুষ অস্পৃশ্যতা ত্যাগ
করে।মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, উচ্চ-নীচ
আর ছুঁয়াছুঁত কী করে নিবারণ করা যায়,এ’ব্যাপারে গান্ধি সর্বদাই প্রয়াসী ছিলেন।
মহাত্মা প্রতি কাজে ভারতীয় পরম্পরায় যা
কিছুতে অভ্যস্ত মানুষ তা কাজে লাগিয়ে সমস্যার সমাধান করতে চাইতেন, এর বিপরীতে গিয়ে সমাধান চাইলে হীতে
বিপরীতও হতে পারে, একথা
তিনি মনে করতেন।বৈষ্ণব ও জৈন ধর্মের প্রভাবে উপোস থাকা গুজরাটিদের অভ্যেসে পরিণত
হয়ে গেছিল।হিন্দু ধর্মাচরণের অন্তর্গত হয়ে ওঠে উপোস।সেইজন্য স্বাধীনতা আন্দোলনে
আপামর ভারতীয়ের স্বভাবসিদ্ধ অভ্যাসকেই হাতিয়ার হিসেবে গান্ধি কাজে লাগান।মধ্যবিত্ত
ও সাধারণ সনাতনীদের আক্রমণ-প্রত্যাক্রমণ সভাবসিদ্ধ নয়।প্রসংগত,নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু পরিচালিত
স্বাধীনতা আন্দোলনে লড়াই ছিল গড় ভারতীয় স্বভাবের বিপরীতে।মহাত্মার আন্দোলন গড়
ভারতীয় স্বভাবের অনুকূলে।যৌন সংযমের নির্দেশ ঋষি পতাঞ্জলি দিয়ে গেছেন এবং এই
সংযমের কথা আমরা বাল্যকাল থেকে লোকোমুখেও শুনে আসছি।অসংযমী যৌন জীবন, জীবন বিপন্ন করে, সমাজ উচ্ছন্নে যায়—এ-ই আমরা শুনে আসছি।গান্ধি
জন্মনিয়ন্ত্রণে এই বোধকে কাজে লাগাতে চেয়ে ছিলেন।
স্যাংগার ব্যক্তিগতভাবে মহাত্মার
জন্মনিয়ন্ত্রণ ফর্মুলা মেনে নিতে না পারলেও, গান্ধির প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা
অটুট থাকে। স্যাংগার তো শুধু একজন পত্রকারই ছিলেন না, মানবিক নানা কাজে তিনি নিজেকে নিযুক্ত
রাখতেন।গান্ধির সংগে তাঁর মতানিক্য জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে,গান্ধির এই মনোভাবে তিনি
দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন।সেই দুশ্চিন্তাই তাঁকে সুদূর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতে
নিয়ে আসে আর ফলে আমরা পাই মহাত্মা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধির অন্য একটা দিকের
সন্ধান।
Sources:
1.Margaret Sanger, “Gandhi and Mrs.
Sanger Debate Birth Control,” Nov 1936.
Published article source Vol
26No. 11, Nov.1936, pp.698-702.
2. An Autobiography:The story
of My Experiments with Truth.
উপনিষদ
উপনিষদ বৈদিক সাহিত্যের চতুর্থ বা শেষ স্তর।
উপনিষদ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো যে বিদ্যা নির্জনে গুরুর সমীপে উপবিষ্ট হয়ে গ্রহণ
করতে হয়,
অর্থাৎ গুহ্যজ্ঞান। তবে ব্যবহার
অনুসারে শব্দটি বোঝায় বৈদিক সাহিত্যের অন্তিম পর্যায়ে রচিত বিশেষ গ্রন্থাবলি।
বৈদিক সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত গ্রন্থাবলির চারটি ভাগ হলো সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ। তবে বৈদিক ঐতিহ্য
অনুসারে আরণ্যকগুলি ব্রাহ্মণের এবং উপনিষদগুলি আরণ্যকের অন্তর্গত। প্রতিটি
ব্রাহ্মণ ও আরণ্যক একেকটি সংহিতার সঙ্গে সংযুক্ত বলে ধরা হয়, ফলে উপনিষদগুলিও শেষ পর্যন্ত সেভাবে
পরিগণিত।
উপনিষদের সংখ্যা অনির্দিষ্ট, তবে তেরোটি উপনিষদ প্রধান ও প্রাচীন
বলে স্বীকৃত। সেগুলি হলো: (ঋগ্বেদের) ঐতরেয়, কৌষীতকি, (সামবেদের) ছান্দোগ্য, কেন, (কৃষ্ণ যজুর্বেদের) তৈত্তিরীয়, কঠ, শ্বেতাশ্বতর, মৈত্রায়ণীয়, (শুক্ল যজুর্বেদের) বৃহদারণ্যক, ঈশ, (অথর্ববেদের) মুন্ডক, প্রশ্ন এবং মান্ডূক্য। এগুলির মধ্যে
কয়েকটি শুধু পদ্যে এবং অবশিষ্টগুলি গদ্যে-পদ্যে রচিত। রচনাকাল সাধারণভাবে
প্রাকবুদ্ধ যুগ (খ্রিপূ ৬ষ্ঠ শতক)।
উপনিষদেই ভারতীয় দার্শনিক চিন্তার
প্রথম উন্মেষ ঘটে। পূর্ববর্তী যুগের ক্লান্তিকর যজ্ঞীয় জটিলতা, কর্মকান্ডসংক্রান্ত চুলচেরা বিচার
ইত্যাদি থেকে মুক্তির উপায় এবং চিন্তার জগতে এক নতুন পরিমন্ডলের সন্ধান পাওয়া
যায় উপনিষদে। সমকালীন সামাজিক জীবনেরও কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায় কোনো কোনো উপনিষদ
থেকে। কারও কারও মতে, বিজ্ঞানচেতনার
সর্বপ্রথম উন্মেষের পরিচয়ও উপনিষদে পাওয়া যায়।
উপনিষদে দেবতার কোনো স্থান নেই, একমাত্র ব্রহ্মই এর প্রধান আলোচ্য
বিষয়। উপনিষদে বলা হয়েছে যে, জগতের
মূলে আছেন এক ব্রহ্ম; তিনি
সত্য,
চৈতন্যময় ও জ্ঞেয়; আর সব অসত্য, জড় ও জ্ঞাতা। জীব এবং ব্রহ্ম এক, এদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।
ব্রহ্মের সাক্ষাৎকার হলেই জীবের মুক্তি হয়। ব্রহ্মপ্রাপ্তিই হচ্ছে জীবের একমাত্র
লক্ষ্য।
সুপ্রাচীন কালে যখন বিশ্বের অনেক দেশেই
সভ্যতার আলো ফুটে ওঠে নি তখনও যে ভারতভূমি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল প্রজ্ঞাশীল মননের
আলোকচ্ছটায়,
তারই অবিস্মরণীয় বিবরণী এ গ্রন্থাবলি।
হিন্দুদের নিকট বেদ, গীতা, রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি গ্রন্থের মতো উপনিষদও ধর্মীয়
গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। অনেকেই গীতার মতো নিয়মিত উপনিষদও পাঠ করেন। রাজা রামমোহন
রায়, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ এ উপনিষদের ভিত্তিতেই ব্রাহ্মধর্মের প্রচার করেছিলেন। উপনিষদ
ভারতীয় দর্শনচিন্তার শ্রেষ্ঠ ফসল। [মৃণালকান্তি
গঙ্গোপাধ্যায়]
রামায়ণ
রামায়ণ প্রাচীন ভারতীয় সূর্যবংশীয় রাজাদের
কাহিনী অবলম্বনে মহর্ষি বাল্মীকি রচিত সংস্কৃত মহাকাব্য। এর রচনাকাল আনুমানিক
খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক। অযোধ্যার রাজা দশরথের পুত্র রামচন্দ্রের জীবন-কাহিনী এর
মুখ্য বিষয়। কাব্যটি সপ্তকান্ড বা সাত খন্ডে বিভক্ত। আদিকান্ডে রামের জন্ম ও
বাল্যজীবন;
অযোধ্যাকান্ডে অযোধ্যা থেকে রামের নির্বাসন; অরণ্যকান্ডে রাম-লক্ষ্মণ-সীতার বনবাস ও
রাবণ কর্তৃক সীতাহরণ; কিষ্কিন্ধ্যাকান্ডে
বানররাজ সুগ্রীবের সঙ্গে রামের মিত্রতা; সুন্দরকান্ডে রামের সসৈন্যে লঙ্কা গমন; লঙ্কাকান্ডে রাম-রাবণের যুদ্ধ, যুদ্ধে রাবণের পরাজয় ও সবংশে মৃত্যু, রাম কর্তৃক সীতা উদ্ধার ও রাবণভ্রাতা
বিভীষণকে লঙ্কার রাজা করে সদলে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন; এবং উত্তরকান্ডে রামচন্দ্র কর্তৃক সীতাবিসর্জন, লব-কুশের জন্ম, রাম-সীতার পুনর্মিলন এবং মৃত্যু এ
বিষয়গুলি বর্ণিত হয়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে আনুষঙ্গিক ঘটনাবলি। এই সপ্তকান্ডের
প্রতিটি আবার একাধিক সর্গ বা অধ্যায়ে বিভক্ত। কাব্যটি অনুষ্টুপ্ ছন্দে রচিত এবং
এর শ্লোকসংখ্যা বিভিন্ন সংস্করণে ২৪-৪৩ হাজার পর্যন্ত।
চতুর্দশ শতকে কৃত্তিবাস
ওঝা প্রথম সংস্কৃত রামায়ণের বাংলা অনুবাদ
করেন,
যা কৃত্তিবাসী রামায়ণ নামে পরিচিত।
পরে ষোড়শ শতকে আসামের কবি মাধব কন্দলী এবং শঙ্করদেব যৌথভাবে প্রাচীন অসমীয়া
ভাষায় রামায়ণ রচনা করেন। সতেরো শতকে অদ্ভুত আচার্য (নিত্যানন্দ) রচিত
অদ্ভুতাচার্য রামায়ণ উত্তরবঙ্গে বেশ জনপ্রিয় ছিল, কিন্তু পরে কৃত্তিবাসী রামায়ণ সে
স্থান দখল করে। একই শতকে আরও অনেক বাঙালি কবি রামায়ণ রচনা করেন। তাঁদের মধ্যে
কয়েকজন হলেন দ্বিজ লক্ষ্মণ, কৈলাস
বসু, ভবানী দাস, কবিচন্দ্র চক্রবর্তী, মহানন্দ চক্রবর্তী, গঙ্গারাম দত্ত ও কৃষ্ণদাস।
১৭৬২ খ্রিস্টাব্দে রামানন্দ ঘোষ যে
রামায়ণ রচনা করেন তার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এতে তিনি রামচন্দ্রকে বুদ্ধের অবতার বলে ঘোষণা করেছেন। ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে
বাঁকুড়ানিবাসী জগৎরাম বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর পুত্র রামপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়
যৌথভাবে আরেকটি বাংলা রামায়ণ রচনা করেন। বাংলা ছাড়া ভারতীয় অন্যান্য ভাষায়ও
রামায়ণ অনূদিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে তুলসীদাসের (১৫৩৩-১৬২৪) হিন্দী রামায়ণ
(তুলসীদাসী রামায়ণ বা রামচরিত মানস) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এটি উত্তর ভারতে বহুল
প্রচলিত ও জনপ্রিয়।
উপরিউক্ত বাংলা রামায়ণগুলি সংস্কৃত
রামায়ণের অনুবাদ হলেও রচয়িতার প্রতিভা, জীবন,
জগৎ ও সমাজ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা, রচনারীতি ইত্যাদি কারণে নতুন সৃষ্টির
মর্যাদা লাভ করেছে। বিশেষ করে কৃত্তিবাসী রামায়ণ স্বমহিমায় উজ্জ্বল। মূলের সঙ্গে
বিষয়গত অনেক পার্থক্য থাকলেও বাঙালি হিন্দুসমাজে এর ব্যাপক প্রভাব আছে।
রামায়ণ হিন্দুদের নিকট ধর্মগ্রন্থের
পর্যায়ভুক্ত। এটি ভারতবর্ষ এবং ভারতবর্ষের বাইরেও অনেক দেশেই প্রচলিত ও সমাদৃত।
শ্রীলঙ্কা,
মায়ানমার, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ায় রামায়ণ
এখনও খুবই জনপ্রিয়। বাংলা ও সংস্কৃতসহ ভারতীয় বিভিন্ন ভাষা ও সাহিত্যে রামায়ণের
প্রভাব অত্যন্ত গভীর। যুগে যুগে অসংখ্য কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পী এর দ্বারা
অনুপ্রাণিত হয়েছেন এবং সৃষ্টি করেছেন মূল্যবান অনেক কাব্য, নাটক, চিত্রকলা, কাহিনী ইত্যাদি। মধুসুদন
দত্ত রামায়ণের
অংশ-বিশেষ অবলম্বনে তাঁর বিখ্যাত মেঘনাদ বধ
কাব্য রচনা
করেন। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে উপমাদি অলংকার এবং চিত্রকল্প রচনায় রামায়ণের বহু ঘটনার
ও চরিত্রের উল্লেখ আছে।
সংস্কৃত রামায়ণকে পৃথিবীর আদি
মহাকাব্য বলা হয়। এতে প্রাচীন
ভারতের সমাজ,
সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, দর্শন, শিক্ষা ইত্যাদি সম্পর্কে মূলবান তথ্য
সন্নিবেশিত হয়েছে। কৃত্তিবাসী রামায়ণে অনুবাদসূত্রে ওইসব বিষয় সংক্রামিত হয়েছে।
সে সঙ্গে রয়েছে মধ্যযুগীয় বাংলা তথা ভারতবর্ষ সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
রামায়ণের প্রধান কয়েকটি চরিত্র যেমন রাম, সীতা, লক্ষ্মণ, ভরত, বিভীষণ একেকটি আদর্শের প্রতীক। পিতৃসত্য ও প্রজা পালন, পতিপরায়ণতা, ভ্রাতৃভক্তি, ভগবদ্ভক্তি ইত্যাদি গুণের কারণে এ
চরিত্রগুলি শাশ্বত রূপ লাভ করেছে। আর এ কারণেই ভারতীয় সমাজজীবনে বিশেষত
হিন্দুসমাজে রামায়ণের প্রভাব
চিরকালীন।
[সমবারু চন্দ্র
মহন্ত]
মহাভারত
মহাভারতওরামায়ণঠিকধর্মগ্রন্থনয়।কিন্তুসাধারণহিন্দুদেরমনেহাজারবছরেরলালিতসংস্কারওবিশ্বাসেএদুটিমহাকাব্যধর্মগ্রন্থেরস্থানদখলকরেআছে।শুধুতাইনয়, এদুটিমহাকাব্যেরকেন্দ্রীয়চরিত্রদুটিÑ শ্রীকৃষ্ণওরামমানুষরূপীঅবতাররূপেপূজিত।এদুটিমহাকাব্যইগ্রন্থাকারেলিপিবদ্ধহয়েছেখ্রিস্টপূর্বচতুর্থশতাব্দীথেকেখ্রিস্টীয়চতুর্থশতাব্দীরমধ্যে।তবেএদুটিমহাকাব্যেরমূলকাহিনিওউপাখ্যানগুলোখ্রিস্টপূর্বপ্রথমসহ¯্রাব্দেরপ্রথমাংশেরচিতবলেমনেকরাহয়।মহাভারতহচ্ছেÑ
The great epic poem of the Hindus, probably
the longest in the world. It is divided into eighteen parvas or books, and
contains about 2,20,000 lines. The poem has been subjected to much modification
and has received numerous comparatively modern additions, but many of legends
and stories are of Vedic Character and of great antiquity.
‘মহাভারত’ প্রসঙ্গেরবীন্দ্রনাথেরমন্তব্যপ্রণিধানযোগ্য।রবীন্দ্রনাথতার ‘ভারতবর্ষেরইতিহাস’ প্রবন্ধে উল্লেখ
করেছেন : ‘আর্য সমাজে যত কিছু জনশ্রুতি খ- খ- আকারেচারিদিকেছড়াইয়াপড়িয়াছিলতাহাদিগকেওএকত্রকরিয়ামহাভারতনামেসংকলিতহইল।’ মহাভারতেরমূলকাহিনিপা-ব-কৌরবদেরদ্বন্দ্ব-সংঘাতকেকেন্দ্রকরেপল্লবিতহয়েছে।এইদ্বন্দ্ব-সংঘাতশেষপর্যন্তকুরুক্ষেত্রনামকস্থানে১৮দিনব্যাপীএকমহাসমরেপরিণতিলাভকরে।
রামায়ণ
সাধারণভাবে ‘রামায়ণ’ হচ্ছেবনবাসরতঅযোধ্যাররাজারামেরসুন্দরীপতœীসীতারাক্ষসরাজরাবণকর্তৃকঅপহরণএবংতাকেউদ্ধারেরকাহিনিকাব্য। ‘মহাভারতে’রবন-পর্বে ‘রামায়ণে’রমূলকাহিনিরউল্লেখরয়েছে। ‘রামায়ণ’ সংস্কৃতভাষায়রচিতপ্রাচীনতমদুইমহাকাব্যেরঅন্যতম।ধ্রুপদী ‘রামায়ণে’ররচয়িতাঋষিবাল্মীকি। ‘রামায়ণে’রসবচেয়েপরিচিতভাষ্যগুলোরমধ্যেএকটিউত্তরভারতেরঅন্যটিবাংলাভাষায়রচিতÑ
The Northern is the older and purer; the
additions and alternations in that of Bengal are so numerious that it is not
trustworthy, and has even been called Spurious.
বাংলাভাষায় ‘রামায়ণ’ অনুবাদকরেনমধ্যযুগেরকবিকৃত্তিবাসওঝা (১৪০০-১৪৭৫খ্রিস্টাব্দ)।কৃত্তিবাসীরামায়ণআক্ষরিকঅনুবাদতোনয়ই; বরংএটিবহুলাংশেমৌলিকরচনা।বাঙালিহিন্দুরাকার্যতকৃত্তিবাসীরামায়ণেরদ্বারাইসবচেয়েপ্রভাবিতহয়েছেন।উত্তরভারতেরসংস্কৃতওহিন্দি ‘রামায়ণ’ ছাড়াভারতেরনানাপ্রাদেশিকভাষায়ও ‘রামায়ণ’ বিভিন্নসময়অনূদিতহয়েছে।ব্যাখ্যারঅপেক্ষারাখেনাপ্রায়প্রতিটিক্ষেত্রেইএসব ‘রামায়ণে’ (এমনকি ‘মহাভারত’ও) স্থানীয়অনুবাদকবারচয়িতারহাতেপরিবর্তিত, সংযোজিতহয়েছেএবংস্থানীয়ভাষ্যহিসেবেপ্রচারিতহয়েছে।এরসঙ্গেযুক্তহয়েছেরাম-সীতাসম্পর্কেনানালোককাহিনি-লোকগাঁথা।
শ্রীকৃষ্ণওরামকোনোঐতিহাসিকচরিত্রকিনাতানিয়েবিস্তরবিতর্কআছে।এখনপর্যন্তকোনোপ্রতœতাত্ত্বিকবাঅন্যকোনোবিজ্ঞানসম্মতপ্রামাণ্যনিদর্শনপাওয়াযায়নি, যাথেকেরামচন্দ্রকেকোনোঐতিহাসিকব্যক্তিহিসেবেগণ্যকরাযায়।হিন্দুমিথোলজিঅনুসারেরামচন্দ্রওমানুষরূপীঅবতার : The Rama is the seventh incarnation
of God Vishnu, and made his appearances in the world at the end of the Treta or
second age.
একথাসত্যবটে, বাস্তবঐতিহাসিকব্যক্তিমানুষবাঘটনাকেকেন্দ্রকরেওমানবকল্পনাপ্রসূতমিথগড়েউঠতেপারে।কিন্তুবাস্তবেঅস্তিত্ববিহীনব্যক্তিএবংপৌরাণিককাহিনিকাব্যকেঘিরেযেমিথগড়েওঠে, তাকেসাহিত্যহিসেবেগ্রহণকরাগেলেও, ইতিহাসহিসেবেঅবশ্যইতাপরিত্যাজ্য।দুঃখজনকহলেওসত্যযে, মৌলবাদীরাযুক্তিরবাবৈজ্ঞানিকপ্রমাণেরধারধারেনা।তারামিথকেহয়জাগতিকনয়তোঐশ্বরিকসত্যবিবেচনাকরে, সেই ‘সত্যপ্রতিষ্ঠায়’ যেকোনোপথগ্রহণেদ্বিধাহীন।উপমহাদেশে ‘হিন্দুত্ববাদী’ সাম্প্রদায়িকএবংমৌলবাদীশক্তিগুলো ‘রামজন্মভূমি’ নিয়েযেহিংসাশ্রয়ীঘটনা (বাবরিমসজিদধ্বংস, ৬ডিসেম্বর, ১৯৯২) ঘটিয়েছে, তারপ্রেরণারঅন্যতমউৎসরামকাহিনিবা ‘রামায়ণ’।অথচ ‘রামায়ণে’ সূর্যবংশীয়রাজারামচন্দ্রকেএকজনন্যায়পরায়ণ, সত্যনিষ্ঠ, মানবহিতৈষী, প্রজাবৎসলএবংপরমধার্মিকঅতিমানবহিসেবেউপস্থাপনকরাহয়েছে।আধুনিকস্বাধীনভারতেরপ্রতিষ্ঠাতামহাত্মাগান্ধীএইরামরাজত্বকেইতাররাষ্ট্রচিন্তারভিত্তিহিসেবেগ্রহণকরেছেন।গান্ধীজীতারজীবনদিয়েপ্রমাণকরেছেনপরমধার্মিকহওয়াসত্ত্বেওতিনিছিলেনসেকুলারমানবতাবাদী।রামরাজত্বেরধারণাকেতিনিরূপকবাপ্রতীকহিসেবেগ্রহণকরেছিলেন।তিনিবলেছেন, আমারকাছেরামওযে, রহিমওসে।কিন্তুহিন্দুত্ববাদেরধ্বজাধারীরারামজন্মভূমিওরামরাজত্বকেহিন্দুত্ববাদীসাম্প্রদায়িক-মৌলবাদীজাতীয়তাবাদীরাষ্ট্রচিন্তারআকরহিসেবেপ্রতিষ্ঠারজন্যউঠে-পড়েলেগেছেবারংবার।
নূহ-উল-আলমলেনিন
মহাভারত
মহাভারত কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস রচিত সংস্কৃত
মহাকাব্য। চন্দ্রবংশীয় কুরু-পান্ডবদের ভ্রাতৃবিদ্বেষ ও যুদ্ধ এর মূল উপজীব্য।
ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ররা (দুর্যোধনাদি শতভাই) প্রপিতামহ কুরুর নামানুসারে কুরু বা
কৌরব এবং পান্ডুর পুত্ররা (যুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চভাই) পিতার নামানুসারে পান্ডব নামে
পরিচিত। কুরুপক্ষের প্রধান দুর্যোধন, আর পান্ডবপক্ষের প্রধান যুধিষ্ঠির। কুরুক্ষেত্র নামক স্থানে এঁদের মধ্যে যে
যুদ্ধ সংঘটিত হয় তা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ নামে পরিচিত। যুদ্ধে কুরুপক্ষের
সহায়তায় প্রধানত ছিলেন ভীষ্ম, দ্রোণ
ও কর্ণ,
আর পান্ডবপক্ষে ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ।
মহাভারতের রচনাকাল নিয়ে মতবিরোধ আছে।
প্রাচীনপন্থী পন্ডিতদের মতে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের পূর্বে মহাভারত রচিত হয়, কিন্তু আধুনিক ও ইউরোপীয় পন্ডিতদের
মতে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের মধ্যে মহাভারত রচিত
হয়। প্রথম দিকে মহাভারত ‘জয়’ নামে পরিচিত ছিল, যার শ্লোকসংখ্যা ছিল ৮-১০ হাজার। যুগে
যুগে প্রক্ষেপণের ফলে শ্লোকসংখ্যা বাড়তে থাকে এবং বর্তমানে প্রচলিত মহাভারতের
শ্লোকসংখ্যা ন্যূনাধিক এক লাখ। শ্লোকগুলি ষোলো মাত্রিক চরণে রচিত।
ভারতের প্রায় সকল প্রাদেশিক ভাষায়
মহাভারতের অনুবাদ হয়েছে। বাংলা ভাষায়ও হয়েছে, তবে বাংলা মহাভারত রচয়িতার নিজস্ব
জীবনবোধ ও সমাজচেতনা এবং রচনাশৈলীর স্বাতন্ত্র্যের কারণে তা মৌলিক কাব্যের মর্যাদা
লাভ করেছে।
বাংলা মহাভারতের রচয়িতা একাধিক।
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কবি নিজের মতো করে মহাভারত রচনা করেছেন। কবীন্দ্র পরমেশ্বর রচিত
কবীন্দ্র মহাভারত বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মহাভারত। সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের
রাজত্বকালে (১৪৯৩-১৫১৯) চট্টগ্রামের শাসনকর্তা পরাগল খানের নির্দেশে তাঁর সভাকবি
কবীন্দ্র পরমেশ্বর পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দে সংক্ষিপ্তাকারে এই অষ্টাদশপর্ব মহাভারত
রচনা করেন। এজন্য এর আরেক নাম হয় পরাগলী মহাভারত।
অন্য একটি মতে সঞ্জয় রচিত মহাভারত
প্রথম বাংলা মহাভারত। এছাড়া পরাগল খানের পুত্র ছোটে/ছুটি খানের (প্রকৃত নাম নসরৎ
খান, ১৫১৯-৩২) নির্দেশে তাঁর সভাকবি
শ্রীকরনন্দীও বাংলায় জৈমিনি মহাভারতের অশ্বমেধপর্বের ভাবানুবাদ করেন। এর অপর নাম
ছুটিখানী মহাভারত। ষোড়শ শতকের কবি নিত্যানন্দ ঘোষ বৃহদাকারে মহাভারত রচনা করেন যা
পশ্চিমবঙ্গে সমধিক প্রচলিত ছিল। এ শতকেই উড়িষ্যার রাজা মুকুন্দদেবের সভাকবি দ্বিজ
রঘুনাথ রচিত ‘অশ্বমেধপর্ব’, উত্তর রাঢ়ের কবি রামচন্দ্র খানের ‘অশ্বমেধপর্ব’ এবং কোচবিহারের রাজসভার কবি
রামসরস্বতীর ‘বনপর্ব’ এবং পীতাম্বর দাসের ‘নলদময়ন্তী উপাখ্যান’ও এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
সপ্তদশ শতকে কাশীরাম দাস পদ্যে মহাভারত
রচনা করেন,
যা বাঙালিদের নিকট সর্বাধিক জনপ্রিয়।
কাশীদাসী মহাভারত আঠারো পর্ব এবং একশত পর্বাধ্যায়ে বিভক্ত। আদিপর্বে বংশ বিবরণ, জতুগৃহদাহ, পঞ্চপান্ডবের সঙ্গে দ্রৌপদীর বিবাহ; সভাপর্বে যুধিষ্ঠিরের দ্যূতক্রীড়া ও
পরাজয়বরণ;
বনপর্বে পান্ডবদের বনগমন; বিরাটপর্বে বিরাটের গৃহে পান্ডবদের
অজ্ঞাতবাস;
উদ্যোগপর্বে যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্ততি; ভীষ্মপর্বের সূচনায় গীতা এবং পরে
যথাক্রমে দ্রোণ,
কর্ণ, শল্য ও সৌপ্তিক পর্ব পর্যন্ত
কৌরব-পান্ডবের যুদ্ধ; স্ত্রীপর্বে
স্বামিহারা স্ত্রীদের বিলাপ; শান্তিপর্ব
ও অনুশাসনপর্বে রাজধর্ম; অশ্বমেধপর্বে
যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞানুষ্ঠান; আশ্রমবাসিকপর্বে
ধৃতরাষ্ট্র প্রমুখের আশ্রমবাস; মৌষলপর্বে
যদুবংশ ধ্বংস;
মহাপ্রস্থানিকপর্বে পরীক্ষিৎকে রাজ্যে
অভিষিক্ত করে পান্ডবদের মহাপ্রস্থান এবং সর্বশেষ স্বর্গারোহণপর্বে যুধিষ্ঠিরের নরক
দর্শন ও পরলোকগত অর্জুনাদিকে দর্শন কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।
কাশীরামের পরে মহাভারত রচয়িতা হিসেবে
আরও যাঁদের নাম পাওয়া যায় তাঁরা হলেন ঘনশ্যাম দাস, অনন্ত মিশ্র, রামনারায়ণ দত্ত, রামকৃষ্ণ কবিশেখর, শ্রীনাথ ব্রাহ্মণ, কবিচন্দ্র চক্রবর্তী, ষষ্ঠীধর সেন, তৎপুত্র গঙ্গাদাস সেন, বাসুদেব, ত্রিলোচন চক্রবর্তী, দৈবকীনন্দন, কৃষ্ণরাম, রামনারায়ণ ঘোষ, লোকনাথ দত্ত, রাজেন্দ্র দাস, গোপীনাথ দত্ত, গঙ্গাদাস সেন, সৃষ্টিধর সেন প্রমুখ। এঁদের রচনা
অধিকাংশই অসম্পূর্ণ এবং এ কারণেই সেগুলি সুধীসমাজে তেমন প্রচার পায়নি। উনিশ শতকে
কালীপ্রসন্ন সিংহ এবং রাজশেখর বসুর গদ্যানুবাদ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ সময় কেউ
কেউ মহাভারতের ইংরেজি অনুবাদও করেছেন।
মহাভারতে বিভিন্ন মত ও পথের অপূর্ব
সমন্বয় ঘটেছে। এতে শৈব, শাক্ত
ও বৈষ্ণব দর্শনের সমন্বয় প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। এটি একাধারে মহাকাব্য, ইতিহাস, পুরাণ, ধর্মশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র, কামশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র, মোক্ষশাস্ত্র ইত্যাদি। এই মহাকোষগ্রন্থ
প্রাচীন ভারতের এক বিশাল জ্ঞানভান্ডার। তখনকার সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, গার্হস্থ্যবিদ্যা, ভক্তিবাদ, যুদ্ধনীতি, রোম্যান্টিক কল্পগাথা, অসংখ্য মিথ, জ্যোতির্বিদ্যা, সম্মোহনবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, নৃত্যবিদ্যা সবকিছুর সমাবেশ ঘটেছে
মহাভারতে। গুরুত্বের দিক থেকে তাই একে বলা হয় পঞ্চমবেদ। প্রসিদ্ধ ধর্মদর্শনগ্রন্থ
ভগবদগীতা এর ষষ্ঠ পর্বের অন্তর্ভুক্ত।
মহাভারতের চরিত্রসমূহ মানুষের দৈনন্দিন
জীবনের চাওয়া-পাওয়া, লাভ-ক্ষতি, লোভ-মোহ, আশা-নিরাশা, ধর্ম-অধর্ম ও পাপ-পুণ্যের প্রতীক।
এখানে ভীষ্মের মতো বিশাল ব্যক্তিত্ব, ধর্মনিষ্ঠ যুধিষ্ঠির, মহীয়সী
গান্ধারী,
প্রাজ্ঞ বিদুর, ধৈর্যশীলা কুন্তী, বুদ্ধিদীপ্তা তেজস্বিনী দ্রৌপদী, বীর যোদ্ধা কর্ণার্জুন এবং মহান
শ্রীকৃষ্ণ চিরস্মরণীয়। তাঁদের প্রত্যেকের জীবনদর্শনই মানুষকে উদ্দীপিত করে, অনুপ্রাণিত করে। অন্যদিকে আবার
দুর্যোধন-দুঃশাসনের বিদ্বেষপরায়ণতা ও নীতিহীনতা, কুটিলবুদ্ধি শকুনি প্রমুখ যেন
লোভ-লালসাপূর্ণ এক অনাকাঙ্ক্ষিত জীবনের প্রতীক।
বহু শতাব্দী ধরে
ভাস-কালিদাস-রবীন্দ্র-নজরুল প্রমুখ কবি, চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর্যশিল্পী মহাভারত থেকে তাঁদের সৃষ্টির অনুপ্রেরণা ও
উপাদান লাভ করেছেন। এটি গণজীবন ও লোকসংস্কৃতির ওপর গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মহাভারতের প্রভাব অপরিসীম। [সমবারু চন্দ্র মহন্ত]
…………………………………………………………………………………………………………………………………
প্রথমেই স্পষ্ট করে নেওয়া উচিৎ বলে মনে
করি ,
যে ভূখণ্ডের নাম ভারত , ইংরেজিতে ইন্ডিয়া , ভারতীয় সংবিধানে এটি রাষ্ট্র বলে স্বীকৃত, এই নিবন্ধকের কাছে এটি কোনো দেশ নয়, এটি একটি উপমহাদেশ।ভারতীয় সংবিধানের
খিলাপ করছি না,কিন্তু স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার
যেহেতু এ ‘দেশ’-এর প্রতিটি নাগরিকের রয়েছে,সেই অধিকারে যৌক্তিক আলোচনায় অসুবিধা
কোথায়?
ব্রিটিশ রাজত্বে ভারত উপমহাদেশ বর্তমান
Vaishnavism, Shaivism, Shaktism and Smartism
Gautam Buddha and Lord Mahavira were contemporaries. If Lord
Mahavira is taken as the founder of Jainism, then both Jainism and Buddhism
originated almost at the same time.
But Lord Mahavira is NOT the founder of Jainism; he only
re-established Jainism. He is the last of the series of 24 tirthankars of the
current time-cycle, Lord Rishabhdev being the first one.
There is enough evidence available of some of the earlier Jain
tirthankars. There is mention in BhaagwatPuran that Rishabhdev (the first Jain
tirthankar) established Jain religion. Besides, Yajurved also makes
a mention of three Jain tirthankaras namely Rishabhdev, AjitNath and
Arishtnemi.
At the time of Gautam Buddha (and Lord Mahavira), the followers
including saints of the 23rd Jain tirthankar, Lord Parshwanath were there.
There is a gap of about 250 years between Lord Parshwanath and Lord Mahavira.
All this establishes that Jainism existed much before Gautam Buddha founded
Buddhism.
ফেসবুকেকবিতাসম্পর্কেতোমারলেখাটিপড়লাম।ভেবেছিলামলিখবনা,
পরক্ষণেইমনেহলওএড়িয়েযাওয়াঠিকহবেনা।যেহেতুতুমিআমাকেদাদাবলেডাকো,
আমারলেখাউচিৎ।তুমিযেমঞ্চেরয়েছ,
অর্থাৎমহাবিদ্যালয়েরবাংলারঅধ্যাপকহিসেবে,
তোমারযেকোনোকথারদামবাংলাভাষা-সাহিত্যসম্পর্কেস্বাভাবিককারণেইআমাদেরচেয়েবেশি।আমারভুলহলেআমিতাশুধ্রেনেব।কথাটাহচ্ছে—‘কাব্য’
শব্দজানিতৎসম,
শুদ্ধসংস্কৃতশব্দআর
‘কবিতা’তৎভব—এইতোদুইশব্দেপার্থক্য।ইংরেজিতে Verse, Poetry
আর Poem রয়েছে।Verse জানিশ্লোকেরমতো,দু’চারলাইনেমিত্রাক্ষর-কবিতা।Poem বলতেকাব্যবাকবিতা
( কাব্যযা , কবিতাওতাই—কাব্য,
কবিতারমধ্যেপার্থক্যেরকোনোসৌরসপেলেজানতেদিও)। Poetryতেঅন্তর্ভুক্ত Verse, Poem দুটোই।কবিতাসম্পর্কেতোমারমূলবক্তব্য,
ছোটোহলেও,
শিক্ষণীয়।উত্তরেরঅপেক্ষায়রইলাম।
আমারকথাহচ্ছে, তোমাদেরবক্তব্যউচ্চতমন্যায়ালয়েররায়েরমতো।সুতরাং…
‘কবিতা’রব্যুৎপত্তি
কাব্যইকবিতা,
আরকবিতাইকাব্য—এনিয়েকোনোদ্বিমতনেই।সুবলচন্দ্রমিত্রসংকলিতসরলবাংলাঅভিধানপৃষ্ঠানং৩৬৭
‘কাব্য’।
ওইঅভিধানেকবিতা৩৩৮পৃষ্ঠাদ্রষ্টব্য।
কবিতাশব্দটারকোনোউৎসকোথাওলিখানেই।
আমারমনেহয়কটনবিশ্ববিদ্যালয়কবি-কাব্য-কবিতা-পদ্যনিয়ে
একটা গবেষণা মূলক কাজ করতে পারে, সেমিনার
করতে পারে এবং এটা হবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অন্যতম মাইলফলক। কারণ এনিয়ে কোনো স্পষ্ট কাজ
আজ অবধি চোখে পড়েনি। গুগুল
সার্চ করেও পাইনি। অনুসন্ধানে
একেবারে নির্দিষ্ট রায় মেলেনি ঠিক, কিন্তু
প্রায় সর্বাংশে মিলেগেছে একথা ঠিক, কাব্যওকবিতারমধ্যেকোনোঅমিলনেই।আজসকালেঅমরেন্দ্রভট্টাচার্যবলেএকবিশিষ্টসংস্কৃতজ্ঞপণ্ডিতেরসঙ্গেমোবাইলেআলাপহল।তিনিস্থানীয়এককলেজেসংস্কৃতপড়াতেন।তিনিএকইকথাবললেন,
অর্থাৎকাব্যেরনামান্তরকবিতা।ভাবছিলামতপোধীরভট্টাচার্যমহাশয়েরসঙ্গেযোগাযোগকরবো,
কিন্তুপরক্ষণেইমনসায়দিলনা।আমারকাছেবিষয়টাঅত্যন্তগুরুত্বপূর্ণ।
আমিইংরেজিরশিক্ষকছিলাম।বাংলাপড়িয়েআমিপেটপালিনি।সুতরাংবুঝতেইপারছবাংলাবিষয়েগবেষণামূলকবই-পত্তরআমারনাইবললেইচলে।
অনেকআগেবঙ্কিমচন্দ্রের
(বইটাআমারকাছেআছে,
তবেকোথায়আছেখুঁজেপাচ্ছিনা)
কাব্য-কবিতা-পদ্যসম্পর্কেএকরচনায়
, আমারমনেপড়ে, কাব্যওকবিতাযেএকসেকথারউল্লেখরয়েছে।
রবিঠাকুরেররচনাবলীআমারকাছেআছে,
তবেনির্দিষ্টসেইপ্রবন্ধবেরকরামুশকিল।গুগুলথেকেপাওয়াতাঁরএকখানালেখা,
প্রাসঙ্গিক,
এখানেতুলেদিচ্ছি।
আমারপড়াশুনো
, অভিজ্ঞতাওবুদ্ধিসংযোগেনিরীক্ষাবলেদেয়,কবিতাশব্দটিবাংলায়প্রয়োগহয়আঠারশতকেবাঙালিরইংরেজিসাহিত্যেরসংসর্গেআসারপর।আরকাব্যকথাটাসুপ্রাচীনচর্যাপদেরঅনেকআগথেকেইরয়েছে।যেকোনোকবিতারবইকেকাব্যগ্রন্থবলাযেতেপারে।অবশ্যইশব্দচয়নেরুচিরপ্রশ্নরয়েছে,
প্রায়োগিকনির্দেশেরকথাওতোরয়েছে।
রবীন্দ্রনাথঠাকুরেরসঞ্চয়িতানির্দ্বিধায়কাব্যগ্রন্থ।
আশাকরিআমারবক্তব্যবোঝারমতোকরেবলতেপেরেছি।বিষয়টানিয়েআমারবিস্তারিতলেখারইচ্ছেরয়েছে।ভালোকরেঘাটাঘাটিকরেলিখতেহবে।
বাঙালি জীবনে মহাপ্রভু ও কীর্তনের ঐক্য
মহিমা
সমরবিজয় চক্রবর্তী
তুমি তো আজো প্রেমে উন্মন
ভক্ত এঁকেছে প্রভু
আকাশের কেউ
আমি জানি তুমি যে রণে
ভাঙছ বিভেদের দেয়াল
কীর্তনে।
কমনউএলথ-এর
সদস্য মানে ব্রিটিশের অধীনতা স্বীকার
স
ম র বি জ য় চ ক্র ব র্তী
ভারত
এখনও স্বাধীন নয়—এ
কথা প্রায়ই শোনা যায়।কয়েকটা কারণে এ দেশ সত্যিকার অর্থে পরাধীন আর এই কারণ কটির
মধ্যে কমনউএলথ অব ন্যাশনস-এর সদস্যভুক্তি অন্যতম।অস্ট্রেলিয়া,
নিউজিল্যান্ড,নিউফাউন্ড ল্যান্ড আর সাউথ আফ্রিকা সংগত কারণে কমনউএলথ-এর সদস্য,এ
দেশগুলোতে ইংরেজ সংখ্যা গরিষ্ঠ, অবশ্য শেষোক্ত দেশ ছাড়া। সাউথ আফ্রিকায় ইংরেজ
সংখ্যাগরিষ্ঠ না হলেও ইংরেজের অবস্থান সে দেশে প্রণিধানযোগ্য।ভারত উপরোক্ত
লক্ষণযুক্ত রাষ্ট্র নয়।প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, তাহলে কেন ভারত আজও সাত দশক পেরিয়েও
কমনউএলথ অব ন্যাশনস থেকে বেড়িয়ে আসছে না, সদস্য পদ থেকে ইসতফা দিচ্ছে না?
কমনউএলথ-এর অন্তর্ভুক্তি মানে ইংরেজের দাসত্ব স্বীকার করা, নয় কি?
প্রসঙ্গত,
ভারতে ইন্ডিয়ান পলিস এক্ট(১৮৫৭),ইন্ডিয়ান পেনাল কোড ইত্যাদি ব্রিটিশ প্রণোদিত আইন
আজও বলবত রয়েছে—সামান্য পরিবর্তন
করা হয়েছে, এদিকসেদিক করা হয়েছে তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আজও ব্রিটিশের পদাঙ্কানুসারি।ইংরেজ এই আইন গুলো
জারি করেছিল তাঁদের ঔপনিবেশিক রাজত্ব চালানর সুবিধার্থে,স্বাধীন সার্বভৌম ভারতের
নাগরিকদের সর্বাত্মক উপযোগিতার জন্যে নয়,এক অর্থে ভারতীয়দের পরাধীন করে রাখার
অনুকূলে এই আইনগুলো, মোদ্দা কথা, রাজত্ব কায়েম রাখার পক্ষে।ভারতবাসীর পায়ে আজও
ব্রিটিশের শেকল বাঁধা।আলাপালচনার মাধ্যমে, দেশকে দুটুকরো করে, কমনউএলথ-এর দাস করে
রেখে গেছে ব্রিটিশ।
১৯৫০
খ্রিস্টাব্দে ভারত কমনউএলথ-এর অধীনতায় থাকা অবস্থায় প্রজাতন্ত্রে দীক্ষিত হয়। ”অধীনতা”
শব্দ লক্ষণীয়।অপরের অধিক্ষেত্রে থেকে দেশ কীভাবে স্বাধীন, আর “প্রজাতন্ত্র”
তো দুরস্ত।অথচ আমাদের একটা বড়মাপের সংবিধান রয়েছে।এ বিষয়ে ১৯৫৩-এর ২ সেপ্টেম্বর
রাজ্যসভায় ড০ আম্বেদকর কী বললেন দেখা যাক,”People
always keep on saying to me, so you are the maker of this constitution. My
answer is I was a hack. What I was asked to, I did much against my will. I am
quite prepared to say that I shall be the first person to burn it. It does not
suit anybody.”
সার
কথা, ড০ আম্বেদকর ভারতের সংবিধান রচনা করে মোটেও সন্তুষ্ট হতে পারলেন
না।কারণ,তাঁকে অন্যের নির্দেশ শুনতে হয়েছে, নিজের মনন ঠিক কাজে লাগাতে পারেননি।তাই
তাঁর দ্বিধাহীন উচ্চারণ, “এ
কথা বলতে আমি সম্পূর্ণ প্রস্তুত যে আমিই
হব সেই ব্যক্তি যে এটি জ্বালাবে।এটি কারোর সহায়ক নয়।“
ব্রিটেনের
রানি কমনউএলথের প্রধান।রানি স্বাধীন ভারতে এলে তাঁর নাম অনুষ্ঠান সূচির প্রথমে
রাখার নিয়ম,তাঁর নিচে থাকবে রাষ্ট্রপতির নাম।এটি স্পষ্ট ভারত কমনউএলথ-এর
অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্র বলে ভারতবাসীকে এই অসম্মানটুকু সইতে হয়।তা ছাড়া, রানির
কমনউএলথ দেশ গুলোতে বিনা পাসপোর্ট, ভিশায় ভ্রমণের অধিকারও রয়েছে।জানা যায়,এই লিখিত
অধিকার আর কোনও রাষ্ট্রপ্রধানের নেই।
একটার
সংগে আর একটা জড়িত, কমনউএলথ-এর সংগে যেমন জড়িত ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তি, তেমনই
জড়িত দেশভাগ, বিষয়টি কান টানলে মাথা আনার মতো।ব্রিটিশ সমঝতার মাধ্যমে দেশের
শাসনভার তুলে দেয় পণ্ডিত জওহরলালের নেতৃত্বাধীন নেতৃবৃন্দের কাছে, যুগপৎ দেশ হলও
দুভাগ।এটি সকল সচেতন এবং ভুক্তভোগী ভারতীয়ের জানা।একথাও জানা যে মহাত্মা গান্ধি
দেশভাগ চাননি।নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু বাইরে থেকে রেডিওর মাধ্যমে অখণ্ড ভারতের কথা
প্রচার করেন—অতুলন
অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন নেতাজি কুচক্রীদের মদতে দেশ ভাগ যে হতে পারে তা নিশ্চিত আঁচ
করতে পেরেছিলেন,তাই ইথারের মাধ্যমে ভারতবাসীর প্রতি তাঁর সতর্ক বাণী।কিন্তু সে
বাণী তুয়াক্কা করলেন তৎকালীন ব্রিটিশের
সাথে দেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে আলাপালোচনকারীরা।দেশভাগের বলি হলও বাঙালি আর
পাঞ্জাবী।
একথা
না বললেই না হয়,নানা ক্ষেত্রে বাঙালি,সে হোক সাহিত্য,কলা,বিজ্ঞান,সমাজসেবা,
রাষ্ট্রচেতনা, ধর্ম ইত্যাদি, যে বড় মাপের নিদর্শন রেখে যেতে পেরেছিল,দেশ ভাগের পর
এই জাতির অধোগমন শুরু হয়।যে জাতি ছিল গোটা দেশের পথপ্রদর্শক,সে আজ নিজেই
বিভ্রান্ত,পথভ্রষ্ট বললে অত্যুক্তি হবে না বলে মনে করি।ভাঙা ভারতের পূর্ব
পাকিস্তান বা পূর্ব বঙ্গ(বর্তমান বাংলাদেশ)থেকে আগত শরণার্থীরা আজও হোঁচট খেয়ে
চলেছে। শিরদাঁড়া খাঁড়া করে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে দেশি না বেদেশি প্রশ্নে জীবন
ওষ্ঠাগত।পূর্ব বঙ্গ ছিল বাঙালির আসল জীবনী
শক্তি।পশ্চিম বঙ্গে কলকাতা বাঙালির উৎকর্ষতার প্রকাশ-মঞ্চ।আজ সেই বাঙালি
অনিশ্চয়তা-অবিশ্বাস, দুর্ভাবনা-দুশ্চিন্তা, আশংকা আর ত্রাসের আগুনে দগ্ধ। কী করে
আবার সে দেশ-দশের পথ দেখাবে?দেশভক্তকে বলা হচ্ছে দেশবৈরী, আর যারা দেশকে আরও ভাঙতে
চায়,দেশ থেকে আলাদা হতে চায় তাদেরই পোয়াবারো, সরকার তাদের কথা শোনে ও মানে।একী
দেশ-ভাগ আর স্বাধীনতার ফসল? হায়রে সমঝতায় পাওয়া স্বাধীনতা! কমনউএলথ-এ দেশের
অন্তর্ভুক্তি!ব্রিটিশ দেশ ছেড়েছে ঠিক,কিন্তু রেখে গেছে যে লিগেসি তা অতীব কুৎসিত,
অরাজক ও নপুংসক তাই হিতাহিতের ধারধারতে পারে না এরা।
১৯৪৯
খৃস্টাব্দে জওহরলাল ব্রিটিশ মহারাণীর মুকুটের অধীনে কমনউএলথ-এর অন্তর্ভুক্ত করলেন
ভাঙা স্বদেশ।সমঝতায় পাওয়া স্বাধীনতা নামেই স্বাধীন, এখনও ব্রিটিশ-মুকুটের অধীনে
পরাধীন স্বদেশ।
নিশ্চিত
এই পরাধীনতা থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষে মানুষের লাগামছাড়া আবেগ উপচে পড়েছিল
নরেন্দ্র মোদীর প্রতি।মোদী-সরকার গঠিত হলও।কিন্তু নানা কায়েমি স্বার্থলোভী চক্র
সরকার গঠনের পর থেকেই তাঁকে গদিচ্যুত করার চেষ্টায় রত।ড০ সুব্রমোনিয়াম স্বামী
মন্ত্রীসভার অন্তর্ভুক্ত নন, তবু, প্রত্যয়ী দেশভক্ত মোদী নেতৃত্বে সহযোদ্ধা। তাঁরা
এক যোগে দেশের পুঞ্জীভূত ভ্রষ্টাচার মোচনে এবং পরম্পতাগত ঐতিহ্য ও স্বাধীন
সার্বভৌমত্বের পক্ষে আপসহীন সংগ্রাম করে চলেছেন। বোঝা যায় অচিরে ভারত ব্রিটিশ
রানির মুকুটের অধীনে থাকা কমনউএলথ-এর দাসত্ব থেকে মুক্তিপাবে।
--------------------------------------------------------
মোবাইলঃ
৯৪৩৫৩৭২৯৮৩
কালিকাপ্রসাদ স্মরণে
(১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭০ –০৭ মার্চ ২২০১৭)
বরাক উপত্যকাতে তথা শিলচরে প্রসাদ আর এর বাইরে তিনি কালিকা নামে
গোটা বিশ্বে পরিচিত।বাঙ্গালাভাষী তথা বাঙালির চিত্তে কালিকা এতোটাই
শ্রদ্ধা-আদরে-আহ্লাদে স্থান পেয়েছিলেন, তাঁর পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া বাঙালি আজও
মেনে নিতে পারছে না।
কলকাতার ক্যাওড়াতলার শ্মশানে
গানস্যালুটের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় কালিকার
মরদেহ দাহ করা হয়।একজন শিল্পীর পক্ষে এমন মর্যাদা পাওয়া অতিবিরল।এক অর্থে
রাজপুত্রের মতো তিনি জীবন কাটিয়েছেন, তাঁর জীবনাবশানের পরবর্তী জীবনও গল্পের
রাজপুত্রের মতো।
ছোট্ট ছেলেটা অসম্ভব ভাল তবলা বাজাত। বাজাবে
নাই বা কেন! বাড়ির সকলে তো গানবাজনা নিয়েই থাকে।শিলচর
সেন্ট্রাল রোডের ভট্টাচার্য বাড়ির ছেলেটার সহজাত ওই প্রতিভা দেখে তাই কেউ কখনও
অবাক হননি। সেই ছেলেই যখন নিজস্ব গানের দল ‘দোহার’ গড়ে, তখনও আশ্চর্য হননি
কেউ। সেটাই যেন স্বাভাবিক ছিল।
সঙ্গীতের আবহেই জন্ম হয়েছিল ছোট্ট সেই ছেলে কালিপ্রসাদের। গানের
সঙ্গেই জুড়ে ছিল তাঁর গোটা পরিবার। গানই যেন বেঁচে থাকার একমাত্র
অবলম্বন। বাবা, কাকা, পিসি সকলেই গানের সাধনা করতেন। সংগ্রহ
করতেন লোকগান। সংগৃহীত সেই গান বাড়িতে তো বটেই, বাইরেও গাওয়া হত। বাংলাদেশের
সিলেট অঞ্চলের পাশাপাশি সেই সংগ্রহে ছিল উত্তর-পূর্ব ভারতের একটা বিস্তীর্ণ
অঞ্চলের লোকগান। আর সেই লোকগানের সাতন্ত্র্য ধরে রাখতেই গান গাওয়া শুরু করেন
কালিকাপ্রসাদ। ‘লোকগানের রূপ, রস, গন্ধ— সব কিছুর অরিজিন্যালিটি বজায় রাখার
চেষ্টা’তেই গড়ে ওঠে তার গানের দল ‘দোহার’।
১৯৭০-এর ১১ সেপ্টেম্বর অসমের শিলচরে জন্ম কালিকাপ্রসাদের।তাঁর
বাবার নাম রামচন্দ্র ভট্টাচার্যয় আর মা-এর নাম গায়ত্রী।কালিকার এক ছোটো বোনও
রয়েছে, নাম ইন্দ্রাণী।কালিকাদের একান্ন বর্তী পরিবার।এমনই নিবিড় বন্ধনে এই পরিবার
কেউ না বললে বোঝা মুস্কিল কে জ্যাঠাত্ব আর কে খোড়াত্ব ভাইবোন।শিক্ষা শুরু শিলচরের
শিশুতীর্থে।প্রসঙ্গত তখন শিশুতীর্থ প্রাথমিক স্তর অবধি ছিল, এখন এটি একটি
হাইস্কুল এবং শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি।নরসিংহ স্কুল থেকে কালিকা মাধ্যমিক পাশ করেন। এর
পর স্থানীয় গুরুচরণ কলেজে ভর্তি হন। উচ্চমাধ্যমিক থেকে স্নাতক—
সবই ওই কলেজ থেকে।
গুরুচরণ কলেজের ছাত্র যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ভর্তি হয়েছিলেন
তুলনামূলক সাহিত্যের ছাত্র হিসাবে। সেখান থেকেই এমএ পাশ। বিশ্ববিদ্যালয়ে
পড়ার ফাঁকেই কালিকার মাথায় গানের দলের ভাবনা আসে। কয়েক
জন বন্ধুকে নিয়ে তৈরি করেন ‘দোহার’। চার দিকে তখন ব্যান্ডের রমরমা। কিন্তু,
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে কালিকারা গেয়ে চলেছেন লোকগান। যদিও,
ব্যান্ডের সঙ্গে ‘দোহার’-এর তুলনাই চলে না।দোহার গানের
আবহ সঙ্গীত স্রতি করেন এথনিক বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে। বাদ্যযন্ত্র যেমন ঢোল, খোল,
মাদল, ধামসা, সারিন্দা, ডুবকি, খঞ্জনি ইত্যাদি। অবশ্যই হারমনিয়াম এক খানা থাকে।এটি
তো প্রায় এথনিক পরযায়েই পৌঁছে গেছে ভারত উপ মহা দেশে। প্রান্তিক মাস্নুস থেকে শুরু
করে একে বাড়ে উপর তোলার মানুষ, পল্লিগান, কীর্তন থেকে আরম্ভ করে খেয়াল অবধি
হারমনিয়ম বাজানো হয়।যাক, শুধু মাত্র এই এথনিক যন্ত্র সহযগে গান করা দোহারের অন্যতম
ক্রিতিত্য। ভাবে ধ্বনির বাতাবরণ তৈরি হয় এটা দোহারের অন্যতম কৃতিত্ব। দোহারের
লোকগানের মাদকতায় মঞ্চে মেতে উঠতেন গায়ক-বাজিয়েরা আর অডিটোরিয়ামে, মাঠে
দর্শক-শ্রোতারা। কালিকা বিহীন দোহারও এই পথে চলছে।
কালিকাপ্রসাদের বাবা ছিলেন রামচন্দ্র ভট্টাচার্য। তিনি
ছিলেন ধ্রুপদী সঙ্গীতের শিল্পী, সংগঠক এবং পৃষ্ঠপোষক। কাকা
অনন্ত ভট্টাচার্যের সংগ্রহে অনেক লোকগান ছিল। তাঁর
আর এক কাকা প্রখ্যাত নৃত্যগুরু মুকুন্দদাস ভট্টাচার্য এবং পিসি আনন্দময়ী—এরা সবই
সঙ্গীতময়। অনন্তবাবুর সংগ্রহে প্রায় পাঁচ হাজার লোকগান ছিল। কালিকার
বাবা রামচন্দ্রও সেই সংগ্রহের কাজে অনন্তবাবুকে সাহায্য করতেন। মূলত
সেই গানের উপর ভিত্তি করেই দোহারের সফর শুরু হয় ১৯৯৯তে।বাউল,
কীর্তন, ঝুমুর, ভাটিয়ালি, চটকা, ভাওয়াইয়া প্রভৃতি গান কালিকাপ্রসাদেরা বিভিন্ন
অনুষ্ঠানে পরিবেশন করেন। সুরের মৌলিকত্ব ঠিক রেখে তাঁদের গায়কীতে থাকত নিজস্বতা।.কালিকার
অকাল প্রয়াণের পরে কিন্তু দোহার ঘুরে দাঁড়াতে পারল। আরোগ্যকালীন অবস্থায় ডাক্তারের
পরামর্শ নিয়ে সৌম্য(সুদীপ্ত)ও স্টেজে এসে
গেছে।
বাংলা লোকসঙ্গীতের নগরায়ন এবং বাংলা লোকসঙ্গীতকে কলকাতা-সহ
আন্তর্জাতিক মানচিত্রের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন
কালিকাপ্রসাদের।এ ব্যাপারে জিবাংলা চ্যানেলের ভূমিকা অনস্বীকার্য।.জিবাংলা কালিকার
মনস্কামনাকে বাস্তবায়িত করতে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে। কালিকা বলতেন, ‘‘আগে কখনও কলেজ সোশ্যালে লোকগীতি হত না। এখন
হয়। কলেজের ছেলেরা যখন ব্যান্ড তৈরি করে অনুষ্ঠান করে দু’-তিনটে সাধারণ
গান গাওয়ার পর চলে যায় লোকগানে। সিনেমাতেও আসছে লোকগান। লোকগান
চলে এসেছে মেনস্ট্রিম ইন্ডাস্ট্রিতে। এই ভাবেই লোকগান প্রসারিত
হয়েছে।’’
শুধু এ রাজ্যে নয়, উত্তর-পূর্ব ভারতেও নয় কালিকাপ্রসাদ তাঁর
‘দোহার’ নিয়ে পৌঁছেছেন প্রবাসী বাঙালির কাছেও। গান
তাঁর কাছে শুধু বিনোদনের বিষয় ছিল না। বছর কয়েক আগে যখন শাহবাগ
আন্দোলনে উত্তাল বাংলাদেশ, তখন সেখানেও পৌঁছেছেন কালিকা। ঢাকায়
তরুণ প্রজন্মের আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে গান লিখেছেন। সুর
দিয়েছেন। গেয়েওছেন। ‘শাহবাগ দিচ্ছে ডাক’ শিরোনামে সেই গানে তিনি লিখেছিলেন, ‘‘আজ
আমাদের প্রেম, আমাদের রাগ, শাহবাগ শাহবাগ/ আজ দুনিয়ার কাছে লড়াই মানেই, শাহবাগ
শাহবাগ।’’
শিলচরের শৈশবটাকে কালিকাপ্রসাদ কোনও ভাবেই হারিয়ে ফেলেননি। গ্রামীণ
মানুষের শেকড়ে গেঁথে থাকা গান খুঁজে নিয়ে শেষ দিন পর্যন্ত পরিবেশন করে গিয়েছেন
কালিকাপ্রসাদ। রবীন্দ্রনাথ, লালন থেকে শুরু করে শাহনুর, শিতালং, শেখ ভানু,
রাধারমন, আরকুম শাহ, হাসন রাজা, রশিদউদ্দিন, উকিল মুন্সি, দূরবীন শাহ, আব্দুল
করিম— সকলেরই গান গাইতেন তিনি। কালিকাপ্রসাদ বলতেন,
‘‘সংগ্রহে আছে সাড়ে পাঁচ হাজার গান। কাকা অনন্ত ভট্টাচার্য ছিলেন
শিলচরের মানুষ। সেখানকার আকাশে বাতাসে গান। তিনি এই সব
গান সংগ্রহে রেখে গিয়েছেন বলেই আমরা গাইতে পারি। আমরা
বাউল, কীর্তন, ঝুমুর, ভাটিয়ালি, চটকা, ভাওয়াইয়া গাই। লোকগান
বাঁধার প্রসেসটা কন্টিনিউয়াস চালাচ্ছেন গ্রামের মানুষ। আমাদের
দলের সদস্যেরা এবং আমি সে সব গান সংগ্রহ করে আনছি। আনবও।’’
মাটির গহন থেকে সেই গানই ছেঁকে আনতেন কালিকাপ্রসাদ।
-------------------------------------------------------------.
বিবেক অগ্নিহোত্রীর 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' কতটা বাস্তব
সমরবিজয় চক্রবর্তী
'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' ঝড় তুলেছে
দেশে বিদেশে।চলচ্চিত্র
নির্মাতা বিবেক অগ্নিহোত্রী হিন্দি সিনেমায় 'বুদ্ধ ইন এ ট্র্যাফিক জ্যাম' দিয়ে বলিহুডের প্রচলিত ধারা ভেঙে
বেরিয়ে এসেছিলেন।তাঁর এই নিজস্বতা নিয়েই তিনি নির্মান করলেন 'চকলেট' এবং 'হেট স্টোরি'। কিন্তু এই তিন ছবির একটিতেও বিবেকের উতকর্ষিত
মাত্রার মানবদরদী বিবেকের দেখা মেলে না।হ্যাঁ,তাঁর 'দ্য তাসখন্দ ফাইলস' মুড় ঘুরিয়ে দিল, তাঁকে পরিচালক হিসেবে অনেক উঁচুতে উঠিয়ে দিল।দেশ বিদেশে, অন্তত, সিনে-ক্রিটিকদের কাছে পরিচিত হলেন
তিনি।'দ্য কাশ্মীর ফাইলস'-এ সূক্ষ্মভাবে 'দ্য তাসখন্দ ফাইলস'-এর স্রোত বইছে।'দ্য তাসখন্দ ফাইলস'-এ হাত পাকানো হয়েছে তাঁর—এরই ফলস্রুতি বলব 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস'।গতবার অর্থাৎ ২০২১এ তিনি ইতিহাসের
নোংরা কার্পেটে চাপাপরা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর রহস্যজনক মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেন, এবার তিনি কাশ্মীরে সংগঠিত হিন্দুদের ওপর নরসংহার ও এর উৎসের মুখোশ প্রকাশ্যে
তুলে ধরেন।ছবিটি মানুষের অন্তরে চেপে থাকা নৃশংস সত্যের সাহসী প্রকাশ, এ-ই এর যথার্থতা।তাবড় চিত্র পরিচালক
সত্যজিৎ রায়,
মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক (মেঘেঢাকা
তারা, সুবর্ণরেখা এবং কমলগান্ধার-এ ইঙ্গিত দিয়েছেন মাত্র),শ্যাম বেনেগাল, আদুর গোপালাকৃষ্ণনান এরা কেউই এমন কোনও ছবি করলেন না যা
বাস্তুচ্যুত তাড়িত মানুষ,ধর্ষণ, গণহত্যা দেশ বিভাজনের সাম্প্রতিক অতীতে
ও পরে (অদ্যাবধি এই উপমহাদেশে ঘটে চলেছে)যার তুলনা ব্যক্তিগত নিরীক্ষায় ইহুদিদের ওপর নাজি নৃশংসতাকেও হার মানায়। কাশ্মীর
প্রসঙ্গে বলব, কাশ্মীর রাজধানী নতুন
দিল্লি থেকে তেমন দূরে নয়, আসাম অনেক দূরে, তবুও স্বাধীন ভারতে সরকারের নাকের ডগায়
বীভৎসতার বলি হলেন পণ্ডিতরা,এ পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বলে বুঝি।
'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' ফিল্মটি ইতিহাসের স্বাধীন-সার্বভৌম
ভারতে ভয়াবহ গণহত্যা ও বাস্তুচ্যুত মানুষের সত্য কাহিনি। কাশ্মীর পণ্ডিতই সম্ভবত
দেশের একমাত্র সম্প্রদায় যাকে স্বাধীনতার পর তাদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয় এবং
এর বিরুদ্ধে দেশের বিবেকবান মানুষ কোনও আন্দোলন করা তো দূরের কথা কোনও আওয়াজ
পর্যন্ত তোলেননি,অথচ
সময় সময় বিছিন্ন নারকীয় ঘটনার প্রতিবাদে বিচার চেয়ে আন্দোলিত হয়ে ওঠে দেশ।এ
ব্যাপারে কলকাতা অন্যতম।৩০ বছর আগে ঘটে যাওয়া নিরীহ, অনাক্রমক মানুষের উপর ‘জল্লাদদের’ আক্রমণ দেশের কেউ দেখেও দেখল না, জল্লাদদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি
দেওয়া তো দূরের কথা। সত্য উদ্ঘাটনের জন্য পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রীর জীবন না কি
প্রাণঘাতী বিপন্নতার মুখোমুখী এখন।
বিবেক বলেছেন ঘটে যাওয়া অন্যান্য
গণহত্যার কিছু না কিছু ছবি পাওয়া যায়, কিন্তু কাশ্মীর হত্যার কোনও ছবি তিনি কোথাও পাননি।তাঁকে বিশ্বময় কাশ্মীরি
পণ্ডিতদের খুঁজে ঘুরে ঘুরে সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছে।এই সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতেই ছবিটি
তৈরি করা হয়।নিজের দেশ ভারত ছাড়াও মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জারমেনি, পল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ইত্যাদি দেশে তাঁর
স্ত্রী পল্লবীকে সংগে করে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের সাক্ষাৎকার নেন।এমনতর শুধু
সাক্ষাৎকারভিত্তিক গবেষণালব্ধ ছবি এর আগে বুঝি কোথাও হয়নি।অভিযোগ উঠতে পারে, ছবিটি বিষয় অনুযায়ী যথেষ্ট স্পেস
পায়নি এবং আজকের দিনে দাঁড়িয়ে প্রযুক্তিগত দিক থেকে
দেখলে দুর্বল। কিন্তু, যে পরিস্থিতিতে এবং বাজেটে এটি নির্মাণ
করা হয়,এর চেয়ে বেশি আশা করা যায় না বলে মনে
করি।
'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' ফিল্মটিতে অনুপম খের এবং মিঠুন
চক্রবর্তী ছাড়াও অভিনয় করেছেন আরও দুই পরিচিত মুখও— পল্লবী জোশী এবং দর্শন
কুমার।প্রত্যেকের অভিনয়ই অভিনয় ছাড়িয়ে বাস্তবমুখী হয়েছে, এ যেন নিজ চোখে দেখা সত্য।একথা না
বললেই নয়,
পল্লবীর কাছে আরও কিছু পাওয়ার ছিল।
বিবেক অগ্নিহোত্রী চলচ্চিত্রটিতে বর্বর
ঘটনা চিত্রিত করতে কোথাও দ্বিধা করেননি। নিষ্ঠুর সত্যকে পরিস্রুত করার কোনও চেষ্টা
করেননি।ছবিটি পুরো দেখার পরও মনে হয় আরও কিছু বাকি রয়েছে।জেএনইউর কারো কারো
দেশদ্রোহিতা সহ আরও কিছু রাষ্ট্র বিরোধী বিষয়,সন্ত্রাসীর উপপত্নীর সাথে মিডিয়ার
তুলনা,
নির্বাচনী প্রতিবেদনের জন্য বিদেশী
মিডিয়াকে দায়ী করা, ভারতীয়
সেনাবাহিনী,
রাজনৈতিক যুদ্ধ, ৩৭০ অনুচ্ছেদ, কাশ্মীরের প্রাচীন সভ্যতা, কাশ্মীর একটি হারিয়ে যাওয়া স্বর্গ, মানবিক সঙ্কট, সীমান্ত সন্ত্রাস, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ইত্যাদির
উল্লেখও মেলে এই ছবিতে।
উল্লেখ্য, চলচ্চিত্র নির্মাতা বিধু বিনোদ চোপড়া
এর আগে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের দেশত্যাগ সম্বলিত 'শিকারা' নামে এক রোমান্টিক ট্র্যাজেডি তৈরি করেন।কাশ্মীরি পণ্ডিতদের বেদনা ধুয়াশায়
রেখে চলচ্চিত্রটি করেছিলেন বলে তাঁকে সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়।তবুও ‘শিকারা’ই প্রথম ছবি যা কাশ্মিরী পণ্ডিতদের
সংস্কৃতি,
তাদের বেদনা এবং হতাশার অন্তত আভাশ
তুলে ধরে। বিবেক অগ্নিহোত্রী পণ্ডিতদের যন্ত্রণা এবং রাজনীতি ও চরমপন্থা
খোলাখুলিভাবে তুলে ধরেন।
নিজের দেশে নির্যাতিত উদ্বাস্তু যা
কেবল দেশত্যাগ নয়,বর্বর
গণহত্যা যা রাজনৈতিক কারণে কার্পেটের নীচে চাপা রাখা হয় প্রায় ৩০টি বছর।নির্বাসিত
জীবনযাপন,
বাড়িঘর এবং দোকান উগ্রবাদীদের বেদখলে, কাশ্মীরি পণ্ডিতরা ন্যায়বিচারের আশা
করে আজো ব্যর্থ।
নথিভুক্ত প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে
করা হলেও কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ধর্মের কারণে চরম বর্বরতার শিকার তা চালের ব্যারেলে
টেলিকম প্রকৌশলী বি গাঞ্জুর হত্যাই হোক, যুদ্ধের ইউনিফর্ম পরা জঙ্গিদের হাতে নদীপথে ২৪ জন কাশ্মীরি পণ্ডিতের হত্যাই
হোক, কিম্বা ভয়ানক স্লোগান— গায়ে কাঁটা দেয়, চোখে জল আসে।
মোবাইলঃ৬০০০৭৩৫২০৪
অনামি
মহাপুরুষ
--সমরবিজয়
চক্রবর্তী
এই
মহান জীবনকে কতটুকু দেখতে পেরেছি, কতটুকু উপলব্ধি করেছি, তা বলা বড় কঠিন।এই কঠিনের
মোকাবিলায় কিছু ঘটনা ও কিছু মানুষের প্রসঙ্গ প্রাসঙ্গিকতায় এসে যেতে পারে।আপাতত এ
কথা বলে রাখি, এক কথায়, দেখা-অদেখার দোলাচলে আমার মানসলোকে ডঃ খগেন্দ্র চন্দ্র
চক্রবর্তী এক উজ্জ্বল কীর্তিমান পুরুষ।অন্ধের হাতি দেখার মতো হয়তো আমার এ দেখা,
তবে যা দেখেছি তাতে ধন্য হয়েছি।
তখন
আমি নেহাৎই ছোটো, পাঠশালায় পড়ি।“হাডুডু”(কাবাডি)খেলার
সময় আমার হাত ভাঙ্গে।আমাদের দিগরখালের বাড়ির কাছাকাছি কোনও ডাক্তার ছিলেন
না।বাড়িতে মা, মা-ই তখন আমাদের অভিভাবক।বাবা হাইলাকান্দির লালাছড়া চা বাগানে চাকরি
করতেন। মায়ের একছত্র অভিভাকত্বে আমরা বাড়িতে দুই ভাই, এক ভাতিজা আর দুই বোন।
আমাদের বিরাট পরিবার। অন্যান্যরা ছড়িয়ে-ছিঁটিয়ে রয়েছেন আসামের নানা জায়গায়।মা
একান্তই নীরব প্রকৃতির, তবে চেতনাময়ী,সামাজিক ও সাহসী।
আমাদের
বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে গুমরা। আমাদের বাড়িতে মাঝে-মধ্যে আসতেন গুমরা থেকে ডাঃ দেবরায়—হাতুড়ে
ডাক্তার, তবে তাঁর পরিচিতি ছিল। তিনি এসে আমার হাতে বাঁশের ছড়িকোটা বেঁধে দিলেন।মা
তো না-ই,পাড়াপড়শির কেউ এতে ভরসা পেলেন না, একজন ডাক্তার দেখানো চাই-ই আর দেখাতে
হলে ডঃ খোগেন চক্রবর্তীকেই দেখাতে হবে—ইনি-ই
এই অঞ্চলের সব চাইতে ভরসার ডাক্তার।আমার ছোড়দাকে ডেকে আনা হল।ছোড়দা মানে—শক্তি(তিনি
এখন প্রয়াত)।ছোড়দা এলেন বড়ডুবি থেকে, তিনসুকিয়ার কাছে, সেই সময় ট্রেনে, বাসে আর
হেঁটে আসা,সে কী হ্যাপা।ছোড়দা এসে আমাকে নিয়ে গেলেন জালালপুর চা বাগানে সাইকেলে
করে—কাঁচা রাস্তা,সবচাইতে
সংক্ষিপ্ত রাস্তা,দূরত্ব প্রায় আট কিলোমিটার।গিয়ে উঠেছি অজিত চক্র.বর্তী(ধনদা)-র
কোয়ারটারে।পাশেই হাসপাতাল।ছোড়দা পরদিন সকালে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যান।
ডাক্তারবাবু এলেন, ডাক্তার খগেন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তী(আমরা ডাক্তার খোগেন চক্রবর্তী
বলেই জানতাম এবং এখনো এ নামই স্বাভাবিক)।এই প্রথম তাঁকে আমি দেখি।সামান্য তামাটে
ফর্সা।প্যান্টশার্ট পরা।চা বাগানের প্রকৃতির সজীবতা যেন তাঁর সঙ্গে মিলেমিশে
একাকার হয়ে আছে।প্রথম দর্শনেই তাঁর প্রত্যয়ী হাসিমুখ আমার শিশু মনে প্রত্যয় বাড়িয়ে
দিল।তিনি বাঁশের ছড়াগুলো খুললেন,হাত টেনেটুনে ঠিক করলেন, প্লাস্টার করে দিলেন।এ
সমস্ত প্রক্রিয়ায় ব্যথা পেলাম।তবে শিশু মন ভুলিয়ে রাখার মতো তাঁর কিছু কথা আর
শরীরী ভাষা আমার ভাললাগলো।সেই থেকে তিনি আমার একান্ত আপন জন,তবে তিনি শুধু মাত্র
একান্ত আপন জন হয়েই রইলেন না, ক্রমে পরম প্রেম ও শ্রদ্ধার ব্যক্তিত্ব স্বরূপ হয়ে
উঠলেন।বড় হয়ে জানলাম আমার ডান হাতের রিষ্ট ডিস্লোকেটেড হয়েছিল।যাক,পাঠশালার পর
আমরা প্রায় এক দশক দিগরখালের বাইরে ছিলাম।এরপর যখন আবার দিগরখালে ফিরে আসি, তাঁকে
পাই অন্য পোষাকে,বহিরঙ্গে তিনি অন্য রকম, খাঁটি বাঙালি। পরনে ধুতি, শার্ট/
কুর্তি।চা বাগানের চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন তিনি।জালালপুর চা-বাগানের পাশের গ্রাম
কুশিয়ারকুলে বাড়ি করেছেন।সামনে বিশাল পুকুর।বাড়িময় গাছ-গাছালি,ফুল-ফল-সব্জিতে ভরা।
আমার
পিসতুতো দাদা সুন্দরদার(রসিকরঞ্জন ভট্টাচার্য)বাড়ি ঢিলছোঁড়া দূরত্বে।তাঁরা দু’জন
সমসাময়িক।পিসতুতো দাদার বড় মেয়ে অঞ্জুর(ভাতিজী, বয়সে বেশ বড় তাই অঞ্জুপিশি বলে ডাকি) সঙ্গে বিয়ে
হয়েছে ডাক্তারবাবুর বড় ছেলে দিলিপ চক্রবর্তীর।প্রসঙ্গত,দিলিপ ভাল গায়ক। তাঁর কণ্ঠে
শোনা রবীন্দ্রসঙ্গীতের আস্বাদ আমি আজো ভুলি না।যাক,ডাক্তারবাবু তারপরে হয়ে গেলেন
আত্মীয় সম্পর্কে দাদা।
এক
দিনের একটা ঘটনার কথা বলি যা নিশ্চিত তাঁর চেতনার অন্য একটা দিকও স্পষ্ট তুলে ধরতে
খানিক সাহায্য করতে পারে।আমি সুন্দরদার বাড়িতে বনফুলের “ভুবন
সোম” উপন্যাসের ইংরিজি অনুবাদ
পড়ছিলাম।আমি পড়ায় আবিষ্টই ছিলাম। নিশ্চয়ই অনুবাদ উন্নতমানের ছিল।এর আগে আমি বাংলা
কোনও অনুবাদ গ্রন্থ পড়িনি, পাঠ্যপুস্তকে হয়তো পড়েছি—সে
অন্য কথা।ডাক্তার দাদা এলেন সুন্দরদার বাড়ি।হেসে চোখ পাকিয়ে আমাকে দেখলেন। আমি
সমীহে নম্র হলাম কিন্তু পড়ার আরাম ছাড়লাম না। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন “কী
হে, কী পড়ছ”?
উত্তরে
বললাম— “বনফুলের ‘ভুবন
সোম’’।
তিনি
বললেন— “তিনি তো বাংলায়
লিখেছেন, অনুবাদে পড়ছ কেন?’’
আমার
কোনও কিছু বলার ছিল না।তাঁর কথার প্রকৃত অর্থ হৃদয়ঙ্গম করার মতো মন আমার ছিল না,
হয়তো সেই বয়সে সেই ক্ষমতাই ছিল না। তবে, একটা ঝটকা মেরেছে আমার মাথায়, আমাকে
দীর্ঘক্ষণ আত্মমগ্ন রেখেছে, পড়তে পারিনি।এখন বুঝি সে ঝটকা কতটুকু গভীরভাবে ইতিবাচক
ছিল।মুখ্যত, এরকম পজিটিভ ঝটকা যত খাবে ততোই তো জীবন সমৃদ্ধ হবে।
ডঃ
খগেন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তীর চাকুরি জীবন আর অবসর জীবনের মধ্যে ব্যবধান তেমন একটা
ছিল না।তিনি সব সময়ই যথার্থ কর্মবীর আর সমাজকর্মী।
দুই
যথার্থ
রাষ্ট্রবাদী ব্যক্তি ছিলেন ডঃ খগেন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তী, তিনি আরএসএস পন্থী
ছিলেন। কাঠিগড়া অঞ্চলে আরএসএস-এর মজবুত ঘাঁটির সৃষ্টিতে তাঁর কৃতিত্ব শীর্ষে।শুধু
তাই নয় গোটা বরাক উপত্যকায় আরএসএস-এর বিস্তারলাভের পেছনে তাঁর অবদান অসামান্য।
দেশ
ও জাতীর প্রতি তাঁর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ছিল।তিনি তাঁর জীবন দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন
ভারতীয়ত্বে যে মানবতা বোধ কত বিশাল।সাধারণ জীবনযাত্রা ও উঁচু মনের সমন্বয়ে
বিশ্বাসী এই মানুষ।দেশের-দশের কাজে লেগে যেতে অনুপ্রাণিত করতেন তিনি ছেলেদেরকে।তাঁর অনুপ্রেরণায় তাঁর অন্যতম মেধাবী
পুত্র ডঃ শিবশঙ্কর চক্রবর্তী নিজেকে সোঁপে দিলেন জাতির সেবায়।ডঃ শিবশঙ্কর
চক্রবর্তী তৎকালীন উত্তর কাছাড়, বর্তমান ডিমাহাসাও জেলায় সংঘের প্রচারে ন্যস্ত
ছিলেন।ওখানকার বিভিন্ন পাহাড়ি উপজাতিদের মধ্যে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে
ওঠেন।দুর্গম প্রত্যন্ত অঞ্চলেও তিনি যেতেন, মানুষের সেবা করতেন। হঠাৎ মানুষের
সেবায়, চিকিৎসায় নিবেদিতপ্রাণ এই যুবক এমবিবিএস ডাক্তারকে অকাল মৃত্যু গ্রাস
করে।এই বেদনা ডাক্তার খোগেন চক্রবর্তীকে দেশ ও দশের স্বার্থে সহ্য করতে হলও। তবুও
তিনি তাঁর জীবনাদর্শে অবিচল—এক
চুলও নড়তে দেখি নি তাঁকে।
ডাক্তার
খোগেন চক্রবর্তীর আর এক প্রতিভাবান পুত্র গৌরীশঙ্কর(বাচ্চু)বর্তমানে সংঘের
প্রচারকের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন।বলাবাহুল্য, বরাক উপত্যকার নানা উন্নয়নের কাজে তাঁর
ভূমিকা, আমার জানামতে, অতুলনীয়।শুধু তাই নয়,আসামে বাঙালি(হিন্দু)শরণার্থীর
নাগরিকত্বের সংকট সমাধানে তাঁর অপ্রতিহত প্রচেষ্টার কথা ইতিহাসে সোনার অক্ষরে
লেখার মতো অবদান বলে আমি মনে করি।আমার তো মনে হয়, তিনি না হলে আজ বাঙালির এই
দুর্গতির কথা দিল্লির কানে কার্যকরীভাবে পৌঁছত না। ভোট সর্বস্ব রাজনীতির দিনে
ভোট-স্বার্থ-ছাড়া কে কাকে চেনে।আজকের বিজ্ঞাপনের যুগে গৌরীশঙ্করাই অবিজ্ঞাপিত
থাকতে পারেন।এই শিক্ষাও তাঁর পিতা আমার ডাক্তার দাদারই দেওয়া।
অকিঞ্চিতকর
নয় মনে করি—স্বাস্থ্য ও
খাদ্যাভ্যাসের প্রতি ডাক্তার খোগেন চক্রবর্তীর খ্যাল আমার নজর কাড়ে। তিনি একদিন
বেশ ক’জনকে বলতে শুনেছি,
মুসর ডালে যথেষ্ট প্রোটিন রয়েছে।প্রোটিনের জন্যে মুসর ডালই যথেষ্ট।সেই সময় মুসর ডালের
বাজারমূল্য যথেষ্ট কম ছিল।তিনি ছেলে-মায়েদেরে খেলাধুলায় যথেষ্ট উৎসাহিত
করতেন।গ্রাম-বাগানের ছেলেদেরে তিনি টেনে এনে সাঁতার শেখাতেন,খেলাধুলো
করাতেন।তাদেরে তিনি লেখাপড়ায়ও সাহায্য করতেন।
ডাক্তার
দাদার কুশিয়ারকুল বাড়িতে দেখা যেত, বিশেষ করে সকালবেলা, রোগীর ঢল। এদের বাশিরভাগই
ছিল পাহাড়ি।তিনি নিখরচায় তাদের চিকিৎসা করতেন।তার উদ্দোমে কুশিয়ারকুলে হাইস্কুল
স্থাপিত হয়। তিনি নিজেও পড়াতেন।তারপর ক্রমে এই ভেঞ্চার স্কুল সরকার অধিগ্রহন
করে।তিনি বাড়িতে শুধু সন্তানদেরেই পড়াতেন না,তাঁদের সাথে অন্যান্য
ছাত্র-ছাত্রিদেরেও পড়াতেন।সেটাও তিনি
নিখরচায় সারতেন।
আমরা
শুনে আসছি, যে কোনও ব্যক্তির অগ্রগতির পেছনে একজন মহিলার অবদান আবশ্যক।ডাক্তার
খগেন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তীর স্ত্রীকে অন্তরালে নিরন্তর কাজ করে যেতে হয়েছে।তাঁর
ত্যাগ তিতিক্ষার শেষ নেই।তাঁদের সাত পুত্র(দিলিপ, প্রদীপ,পল্লব,বাচ্চু,দীপক,দিপাল
ও শম্ভু) ছাড়াও বাড়িতে আশ্রিতও ছিল ক’জন।এ
ছাড়াও বাড়িতে প্রতিদিনই লোকজনের ভিড় থাকত।
“তমসো
মা জ্যোতিরগময়”। এই স্বার্থমগ্ন
পৃথিবীতে ডাঃ খগেন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তীর মত নিঃস্বার্থ মানব আজকের দিনে কল্পনার
মানুষ বলে মনে হয়।এ সম্পর্কে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথকে—“স্বার্থমগ্ন
যে জন বিমুখ বৃহৎ জগৎ হতে সে কখনো শেখেনি বাঁচিতে”।
এই বৃহৎ জগৎ-এ তাঁকে (ডাঃ খগেন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তী) খানিক কাছে পেয়েছিলাম বলে
নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি।আমার এ ক্ষুদ্র জীবনেও তাঁর প্রভাব পড়েছে।
চিন ভারতের নিরাপত্তা ও উন্নতির পথে বড়
বাধা
সমরবিজয় চক্রবর্তী
একটি দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা যদি
বিঘ্নিত হয়,তাহলে বহির্শক্তি অতি সহজেই দেশকে
পঙ্গু করে দিতে পারে।ভারতকে সব সময়ই দেশদ্রোহিতার মোকাবিলায় সচেতন থাকতে হচ্ছে এবং
অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি কত হাজার কোটি টাকা যে দেশের নষ্ট হচ্ছে তার কোনও ইয়ত্তা নেই , এই টাকা উন্নয়নের কাজে ব্যয়ীত হলে
নিশ্চিত যে “ ভারত আবার জগত সভার শ্রেষ্ঠ আসন…”-এ বসতে পারত।কিছু কিছু মানুষের রাষ্ট্রীয় সম্পদ
নষ্ট করতে এতোটুকুও বাধে না।দেশের ভেতর অনিরাপদ হলে বাইরের শত্রুকে ঠেকান
মুশকিল।ওই যেমন ঘরের ভেতরে অশান্তি থাকলে বাইরের অমানুষ ক্ষতি করার সুযোগ
পায়।অস্থিতিশীল,
চরম দূরনীতিগ্রস্ত, মৌলবাদী পাকিস্তানকে দিয়ে তেমন ভয় নেই
আজ যতটা ভয় চিনকে দিয়ে।চিন পূর্ব এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ধীরেসুস্থে আধিপত্য বিস্তার
করে চলেছে। ভারতকেও ছলেবলে কৌশলে তার কবলে রাখার জন্য নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে
যাচ্ছে।সীমা লংঘন তো তার নিত্যকার ব্যাপার।সম্প্রতি হুমকি এমনটাই ছিল যে মনে হয়েছে
দুদেশের মধ্যে যুদ্ধ লেগেই যাবে।যাক, আপাতত বাঁচা
গেল।আসলে চিনের
সংগে ভারতের বিবাদের কারণ কী এটি বোঝা দরকার।আসলে কোনো বিবাদ আছে কী, না চিনের শক্তির আস্ফালন?ভৌগোলিক অবস্থানে দুই দেশই একে অন্যের
কাছাকাছি,সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আশ্রয়েও আমরা
একেঅন্যের কাছাকাছি ছিলাম, কমিউনিজম
আসার পর থেকে সব কিছু ওলটপালট হয়ে গেল।চিন এখন ভারতের টেনশনের কারণ।চিন একসময়
অনিকেত বুদ্ধের অনুসারী ছিল।সাধারণত একটা
সভ্যতার সাথে আর একটা সভ্যতার যোগাযোগ গড়ে ওঠে ব্যাবসায়িক স্বার্থে। কিন্ত ভারত ও চিনের সম্পর্ক
শুরুর ভিত্তি ছিল ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক আধ্যাত্মবাধ যার মূল কারিগর ছিলেন চিনে ধর্ম প্রচারের
উদ্যেশ্যে যাওয়া বৌদ্ধ ভিক্ষুরা।গুপ্ত যুগে চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিয়েন আসেন বৌদ্ধ
দর্শনের মূল স্বরূপ খুঁজতে। গুপ্ত যুগেই তৈরী নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বৌদ্ধ দর্শন
চর্চার পাশাপাশি দুই সভ্যতার সাংস্কৃতিক আদান প্রদানের মূল কেন্দ্র হয়ে ওঠে।আজকের ‘কমিউনিস্ট চিন(?)’ পুরোটাই বস্তুনিষ্ঠ,আধিদৈবিক কোনও ধারণায় তারা বিশ্বাসী নয়,ফলে নৈতিক-অনৈতিকতার কোনও বালাই নেই আর কূটনৈতিক চুক্তিতে তো নয়ই।ভারতের সংগে যতই সমঝোতা হোক না কেন, চুক্তি হোক না কেন চিন সময় সময় তা ভংগ
করেছে।
প্রসঙ্গত,শ্রীলংকা চিনের কাছে, বলা যায়, বিক্রি হয়ে গেছে।চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক
চুক্তি করে আপাতত এখন পস্তাচ্ছে।হাম্বানটোটা বন্দরকে ৯৯ বছরের জন্য চিনকে লিজ
দেওয়ায় চিনের কাছে ফেঁসে আছে শ্রীলংকা।ভারতের সমুদ্র অ্যাক্সেসের কাছাকাছি অবস্থিত
শ্রীলংকার হাম্বানটোটা বন্দর তো আছেই, এছাড়াও দেশটি আধিপত্য বিস্তার করছে মিয়ানমারে অবস্থিত এটি কোকোস
দ্বীপপুঞ্জে,বাংলাদেশের চট্টগ্রামে, মালদ্বীপের অন্তর্গত মারো অ্যাটলে ও
পাকিস্তানের গোয়াদরে এবং এ সমস্ত বন্দরে নৌ ঘাঁটি নির্মাণের মাধ্যমে ভারতকে ঘিরে
রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।অন্যদিকে ভারত শুধু জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ভিয়েতনামের সঙ্গে
নয়, চিনের নিকটবর্তী মধ্য-এশীয়
প্রতিবেশীদের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ভারত ও চিনের সীমান্ত রেখা প্রায় ৩,৪৮৮ কিমি দীর্ঘ। সীমান্ত এখনও
স্পষ্টভাবে চিহ্নিত না হওয়ায় ভারতকে আন্তঃসীমান্ত অনুপ্রবেশ ও অধিগ্রহণের মতো
সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।অরুণাচল প্রদেশ ও কাশ্মীরের বিশাল ভূখণ্ডের ওপর চিনের
চোখ রয়েছে—লাদাখের একটা বিরাট অংশ অধিগ্রহনের চেষ্টায়।
আবার, চিন অরুণাচল প্রদেশের বাসিন্দাদের
স্ট্যাপলড ভিসা দিচ্ছে।স্ট্যাপলড ভিসা মানে,একটি ছোট কাগজে লিখা ভিসা পাসপোর্টে স্ট্যাপ্লার
দিয়ে লাগিয়ে দেওয়া
হয়।অরুণাচলীরা এই ভিসার মাধ্যমে চিনে গিয়ে কাজ করতে পারছে আবার ফিরে আসার সময়
সীমান্তে সেটা ছিঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়।এভাবে ভারত-চিন সীমান্তে বসবাসকারী অরুণাচলীদের
ওপারের চিনাদের সংগে সুসম্পর্ক গড়ে উঠছে।চিন তাদের মন কেড়ে নিচ্ছে।উপরন্তু, চিন অরুণাচল প্রদেশের ছয়টি স্থানের
চিনা(মান্দারিন)ভাষায় সরকারী নাম ঘোষণা করেছে কারণ চিনের দাবি অরুণাচল প্রদেশের
বিস্তর অঞ্চল তিব্বতের অংশ।
তিব্বতি সরকার গড়লেন দালাই লামা ঐ
সিঙ্গাপুরে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ সরকার গড়ার মতো, কিন্তু দালাই লামার সরকারের কোনও ফৌজ
নেই, অস্ত্রশস্ত্র তো দূরের কথা।তবে এ সরকার
ভারতে নির্বাসিত তিব্বতিদের সেবায় নিয়োজিত। সম্প্রতি বাস্তুচ্যুত তিব্বতিরা দালাই
লামার নেতৃত্বে ভারতে তাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য অরুণাচল প্রদেশে "থ্যাঙ্ক ইউ
ইন্ডিয়া" নামে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে যাচ্ছিল।চিনের প্রবল বিরোধিতার
জন্য অনুষ্ঠানের স্থান পরিবর্তন করা হয়।
এবার আসি জল বিরোধে।চিন ব্রহ্মপুত্র
নদীর উপরিভাগে বাঁধ নির্মাণ করছে। ভারত এ বিষয়ে আপত্তি জানালেও চিন অনড়।এর ফলে
অতিপ্লাবনে ভয়াবহ বন্যা হতে পারে আবার নদটিকে শুকিয়েও দেওয়া যায়।
ভারত চিন-পাকিস্তান-ইকোনমিক করিডোর
(সিপিইসি) প্রকল্পটিকে ভারতের সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতায় চিনের হস্তক্ষেপ
হিসাবে দেখে কারণ করিডোরটি পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরের মধ্য দিয়ে যাবে।আপত্তি
সত্ত্বেও চিন প্রকল্পটির বাস্তবায়নের চেষ্টায় রয়েছে।এ কথা স্বীকার্য যে, পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদের উত্স,অথচ ভারত জাতিসংঘে জইশ-ই-মোহাম্মদ প্রধান
আজহারকে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করলে চিন বাদসাধে।
চিন ভারতকে নিউক্লিয়ার সাপ্লাইয়ারস
গ্রুপে( এনএসজি) প্রবেশের অনুমতি দিতে চায় না এবং এই বিষয়ে প্রদত্ত প্রস্তাব
ভেটো পেতে থাকে।
খবরে আসে, গত ২০২১এর এপ্রিল থেকে লাদাখের প্যাংগং
লেক এবং আরও কয়েকটি অঞ্চলে চিনা সেনারা বারবার সীমান্ত লঙ্ঘন করেছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারত
বর্তমানে শীর্ষ স্থানে।চিন ছাড়া প্রায় প্রতিটি শক্তিধর দেশের সংগে কূটনৈতিক
সম্পর্ক ভালো থাকায় ভারতের বেলায় চিনের আগ্রাসন ঢিমেতালে চলছে।কোভিড পরিস্থিতি,প্যালেস্টাইন সহ মধ্যপ্রাচ্যে লাগাতার
যুদ্ধ,
পেট্রোলিয়াম তেল সমৃদ্ধ ও আণবিক
শক্তিতে বলীয়ান ইরানের সংগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীতল যুদ্ধ,রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের ফলে বিশ্বে
আর্থিক মন্দা অবস্থা চলছে। ১৩২কোটির দেশে এই মন্দা অবস্থার মধ্যেও ভারত কিন্তু
মুষড়ে পড়েনি,
এখনও মাথা তুলে আছে।বেইজিং ঠিক জানে
ভারত আর ১৯৬২র ভারত নয়, সুতরাং
ভারতের সংগে বুঝেসুঝে চলা চাই।প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং জানিয়ে দিয়েছেন—“আমরা চীনের সাথে শান্তিপূর্ণ সমাধানের
জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তবে
যেকোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত”।
দৈনিক যুগশঙ্খ, উত্তরসম্পাদকীয়,৩০/০৩/২০২২
নাগরিক
পঞ্জিয়ন ,ডিটেনশন ক্যাম্প ও সমাধান
সূত্র
--সমরবিজয়
চক্রবর্তী
আবার
আর এক বিপর্যয়য়ের মুখে আসামের বাঙ্গালিদেরে ঠেলে দেওয়া হলো। নাগরিক পঞ্জিয়ন নবীকরণ
করা হোক তা কে না চায়, কিন্তু
সেটা করতে গিয়ে প্রকৃত নাগরিকরাও যে নাকাল হচ্ছেন।!অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশীদেরে
সনাক্ত করে একটা বিহিত করা প্রয়োজন সেটা তো সকল সজ্জনই চাইবেন—আসামের
সার্বিক উন্নয়নের ভারসাম্য ও নিরাপত্তা
বিঘ্নিত করছে এই অনুপ্রবেশকারীরা।কিন্তু এদেরকে খুঁজে বের করে বহিষ্কার করার মানদণ্ড তো
যৌক্তিক হওয়া চাই।তা
করতে গিয়ে বৈধ বাঙালি নাগরিকদেরেও যে হয়রানি করা হচ্ছে। শুধু মাত্র সন্দেহের উপর
ভিত্তি করে একজন মানুষ কে বিদেশী বলে ধরে নেওয়া অনুচিত।শুধু ‘অনুচিত’
শব্দে এই নিষ্ঠুরতা ধরে রাখা যায়
না।ভারতের মত প্রাচীন সভ্যতার দেশে, বর্তমান ‘জনহিতকর’
গণতান্ত্রিক দেশে কখনও তা মানা যায় না।
মানবিক ও নৈতিক দৃষ্টিতে বাংলাদেশ থেকে
নির্যাতিত ধর্মীয় সংখ্যা লঘু যারাই
এসেছেন, আসছেন এবং আসবেন তাঁদের নাম নাগরিক পঞ্জীতে আসা চাই। ঠিক সে রকম, পূর্ব
পাকিস্তান থেকে যারাই এসেছিলেন তারাই এ দেশের নাগরিক।সেই জন্য পরিচয় পত্রের
প্রয়োজন পড়ে না,নিজের নামই হোক পরিচয় পত্র।
বলা
বাহুল্য, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে পূর্ব বঙ্গের অবদান অনস্বীকার্য। যে বিচারে
পূর্ব বাংলার সংখ্যা লঘুরা স্বাধীন ভারতের আসাম প্রদেশে বিদেশী, সে বিচারে
স্বাধীনতা সংগ্রামী সর্ব ভারতীয় নেতা বিপিন চন্দ্র পালও কি বিদেশী? বিদেশী যারা
আন্দামানের সেলুলার জেলে বন্দি ছিলেন এবং তাদের বংশের লোকরাও?ভারতের স্বাধীনতা
সংগ্রামে বাংলার অবদানের কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। প্রসঙ্গত, সেলুলার জেলে ভারতের
অন্যান্য প্রান্তের তুলনায় ভাষিক জাতি হিসেবে অধিকাংশই ছিলেন বাঙালি এবং অধিকাংশই
পূর্ব বঙ্গের হিন্দু বাঙ্গালি(এই লিখিয়ে ধর্মীয় পরিচয়ে মানুষের পরিচিতি দেওয়া
নিম্ন স্তরের মানুষের কাজ বলে মনে করে। অবস্থার প্রেক্ষিতে ‘হিন্দু
বাঙালি’ বলতে হলো।)এই বাঙালিকে আসামের মাটিতে বিদেশী বলে
হেনস্থা করা হয় এবং এই হেনস্থা প্রতিহত করার জন্যে আমাদের ভোটে জেতা নেতারা
নিরন্তর নিরস্ত কেন?তারা কি সেই স্বাধীনতা সংগ্রামী বাঙালির পরম্পরায় পড়েন
না?ভারতের তাবড় তাবড় প্রাতস্মরনীয়দের জন্ম দিয়েছে বাংলা,অথচ এই বাঙালি আজ
বাস্তুহারা, অনুপ্রবেশকারী বিদেশী বলে গণ্য হচ্ছে। আসামে অসমিয়ারা অনুপ্রবেশকারী
নন, আর কোনও জাতিগোষ্ঠী অনুপ্রবেশকারী নন, বিদেশী নন, অনুপ্রবেশকারী বিদেশী কেবল
মাত্র বাঙ্গালি।হায় রে বাঙালি!
প্রাসঙ্গিক
আর এক প্রশ্ন মনে চাড়া দিলো, আসামে গত লোক সভার নির্বাচনে বিদেশীদের ভোটে কি
সাংসদদেরে নির্বাচন করা হয়েছিল?যদি
বিদেশীদের ভোটে সাংসদরা নির্বাচিত হয়ে থাকেন তাহলে সেই নির্বাচন অবৈধ।আর যদি অবৈধ না হয় তাহলে ২০১৪ তে যে
ভোটার আইডেন্টিটি কার্ড-প্রাপক ভোটাররা ভোট প্রদান করেছিলেন তাঁরা তো এ দেশের বৈধ
নাগরিক বলে বিবেচিত হওয়ার কথা, তাঁদের
নামই তো নতুন নাগরিক পঞ্জীতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া চাই, নয় কি? এ প্রশ্ন তো শুধু এই
লেখিয়ের একার নয়, এ
প্রশ্ন তো সকল সচেতন মানুষের।
প্রশ্ন
দুই, যাদের রেশন কার্ড আছে,
ব্যাঙ্কে
একাউন্ট আছে,পারমানেন্ট
রেসিডেনসিয়েল সার্টিফিকেট আছে, আন্তর্জাতিক
পাসপোর্ট রয়েছে, যারা ব্যাংক
থেকে লোণ নিয়েছেন, সে যে কোনও সময়েই হোক,—তাঁরা
কি করে এ দেশের নাগরিক নন?বিদেশিরা
কি এ দেশে এ সব সুযোগ পেতে পারে?যারা
এই পরিসেবাগুলো পেয়েছেন তাঁরা তো সরকারি নিয়ম মেনেই পেয়েছেন,
কোনও
বিদেশিকে তো এ সব পরিসেবা দেওয়া হয়না।বাংলাদেশী
অনুপ্রবেশকারিদের রোধ করার জন্যে তো সীমান্তে কাঁটা তারের বেড়া দেওয়া হয়েছে,
ফৌজ
মোতায়েন করা হয়েছে—দেশের
কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে।
এ সব কি তবে নিছক অর্থের মোচ্ছব? এতো
সব করা সত্ত্বেও এ দেশে অনুপ্রবেশ হয় কী করে? মূলে জড় না মেরে অনুপ্রবেশ কি বন্ধ
করা সম্ভব?
অবৈধ
বিদেশী সন্দেহে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দাও—এতে
করে যে দেশের প্রকৃত নাগরিক দের কেউ কেউকে ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকতে বাধ্য করা
হচ্ছে! ডিটেনশন
ক্যাম্পের কথা মনে এলে এ লিখিয়ের মনে হয় হিটলারের কথা,
তাঁর
কৃত কনসেনট্র্যাশন ক্যাম্পের কথা। কনসেনট্র্যাশন
ক্যাম্প আর ডিটেনশন ক্যাম্পের মধ্যে ব্যবধান খুব একটা আছে বলে মনে হয়না। এ দেশের
মানুষ তো হিটলার, মুসলিনির একনায়ত্বে বাস করছেন না, তা হলে কী করে এ সব সম্ভব হয় ?
২
কী
অসহনীয় আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন আসামের বাঙালিরা। নৃপেদ্র শুক্লবদ্য একজন
চাষি। আজ
তিনি পক্ষাঘাতে আক্রান্ত।এর
কারণ স্পষ্ট জেনে গেছি তিনি আতঙ্কিত—
তিনি
সমেত তাঁর ছ’ জনের পরিবার হয়তো
অচিরেই ডিটেনশন ক্যাম্পে নিক্ষেপিত হবেন, তারপর
আধপেটা আঁকড়া চালের ভাত খেয়ে,ধারণাতীত
নোংরার মধ্যে কয়েকটা দিন কাটানর পর কাঁটা তারের বেড়ার ওপারে ঠেলে দেওয়া হবে
তাঁদেরে। হয়তো
এর আগে তাঁদের কেউ কেউ মারাও যাবেন।
ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায়, ডিটেনশন ক্যাম্পে, ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে
বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার প্রক্রিয়ায়...নারী নিগ্রহের আশংকাও উড়িয়ে দেওয়া যায়না। কথায় আছে বিপদে পড়লে বেঙও
ঠেং দেখায়।অপমান,ক্ষুধা,
শারীরিক,
মানসিক
যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট মানুষ কদিন আর টেকে!এ ভাবেই কি বাঙালি নিধনের ছককশা হয়েছে?নৃপেন্দ্র
পুতি(কাকা)কে দেখে, তাঁর
মনের কথা জেনে যে কোনও সংবেদি মানুষই তো তীব্র মানসিক যন্ত্রণার শিকার হবেন। শুনে,
দেখেই
যদি আমাদের এই অবস্থা, তা
হলে আসল নিগৃহীতের অবস্থাটা কী!
দেখলাম,
নৃপেন্দ্র
পুতিদের বাথানে জমি চাষের জন্যে একটি বলদ রয়েছে,রয়েছে
গাই-বাছুর; রয়েছে তাঁদের কতক পায়রা,দু
একটা পাঁঠা-ছাগল,এক
জোড়া হাস—বাড়ির ডুবা-পুকুরে
সাঁতার কেটে গোধূলিতে ফেরে।নিজের
হাতে লাগানো গাছ–গাছারি,
নিকনো
উঠোনের একপাশে তুলসিবেদি—সন্ধ্যের
সময় নৃপেদ্র পুতির স্ত্রী প্রদীপ জ্বালিয়ে,
ধূপদানিতে
ধূপ জ্বালিয়ে পরমেশ্বরের কাছে প্রণাম করেন এই তুলসি বেদীতে।এযে নিত্যকার অভ্যেস।বারোমাসের তেরো পার্বণের প্রায় সবকটিই
গ্রামে পালিত হয়। সময়
সময় হয় কীর্তন। এই
বৈষ্ণবীয় কীর্তন শুধু ভগবানের জন্য নয়, তাঁদের
নিছক আবেগিক আশ্রয়ও যে এই কীর্তন।এ
সবই তো যুগযুগান্তর বেয়ে চলে আসা অভ্যেস।মানব-ডিএনএ সংলগ্ন বুঝি।দারিদ্র্যের মধ্যে থেকেও এক মায়াময়
জীবন তাঁদের।এই
জীবন ছেড়ে শুকরের খুঁয়ারে জীবন কাটানো হিটলারের কন্সেন্ট্র্যাশন ক্যাম্পে জীবন
কাটানোর সমতুল্য কিনা!
নৃপেদ্র
শুক্লবদ্যরা এপারে এসেছেন ৫৫সালে। কিন্তু
তাঁর ঘর-বাড়ি জ্বলে যাওয়ায় তাঁর হাতে কোনও সাক্ষী-প্রমাণ নেই যে তিনি এই ভূখণ্ডেরই
মানুষ।কোনও
রহস্যময় কারণে অান্তর্জালে তাঁদের লিগেসি ডাটার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।তাহলে ডাটা কি আপলোড করা হয়নি?অথবা
অফিসে তাঁদের ভোটার লিস্ট কোনও কারণে খুইয়েছে?সরকারি
কাজে অবহেলা যে নেই সে কথা কেউ হলপ করে বলতে পারবে না।
৩
আর
একটি সত্য ঘটনা এবং এ নিয়ে খানিক মন্তব্য।এটি ফেস বুকের গত ২৭ মে’র নিজস্ব স্ট্যাটাস থেকে তুলে আনা।সেই জন্যে
কোটেশনের মধ্যে রাখলাম।
“আজ আমি অত্যন্ত মর্মাহত , না, ‘মর্মাহত’ শব্দটা দিয়ে কুলোতে পারছিনা। শিলচরের সুচন্দাকে ডিটেনশন ক্যাম্পে কাটাতে হয়েছে কয়েক রাত, অথচ তিনি ভারতবাসী। তাঁর জন্ম শিলচরে!অবিভক্ত ভারতের যেখানে যার জন্ম সেখানে তাঁর বাস করার
অধিকার থাকা স্বাভাবিক ।আর
অমুসলিমদের তো কোনও কথাই নেই, তাঁরা যখনই
বুঝবেন তাঁরা অসুরক্ষিত, ভারত ভূখণ্ডে
এসে স্থায়ী ভাবে বসবাস করার অধিকার তাঁদের রয়েছে।যাক, সে
বিস্তৃত আলোচনা।আমরা হিটলারের কনসেনট্র্যাশন
ক্যাম্পের কথা পড়েছি, শুনেছি, ফিল্মে দেখেছি—আমাদের এই স্বাধীন দেশে যে এমনটা হবে, এরকম
ব্যবস্থা রয়েছে, বিদেশী সন্দেহে ডিটেনশন ক্যাম্পে ছুঁড়ে ফেলে
দেওয়া—এই বীভৎসতা আমাদেরে সহ্য করতে হচ্ছে।আমরা জেনে আসছি বাঙালি এ দেশে রেনেসাঁর জনক, আমার সন্দেহ
হয়—একী রেনেসাঁ চরিত্র!দৌরদণ্ড প্রতাপি ইংরেজের
বিরুদ্ধে লড়েছে বাঙালি, নানা সময়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়েছে, তবে আজ কী
হলো, কেনও এই দেউলিয়াপন, আমাদের ওপর
চরম দুর্বৃত্তায়ন মুখবুজে সহ্য করছি আমরা! আর কতো দিন!”
৪
একজন
কাজের মাসির (মেইড সারভ্যান্ট)কথা শুনলাম। তাঁরা পঞ্চাশের দশকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসেছিলেন।এপারে এসে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার
উদালগুড়িতে বসতি গাড়লেন।নতুন
উদ্যম ও প্রত্যাশায় তাঁদের জীবন শুরু হলো। আগের পরিবেশ খুইয়ে নতুন জায়গায় কৃষ্টি চর্চার কিছুটা
রাখলেন,বেশ কিছু ছাড়লেন,সময়
ও নতুন পরিস্থিতির মোকাবিলায় এমনটা করতে হলো।জায়গা-জিরেতও কিছু করলেন।প্রায় একদশক কাল তাঁরা মোটামুটি
নিরাপদেই উদালগুড়িতে কাটালেন।ষাটের
দশকের প্রথম দিকে বঙ্গাল খেদার বলি হলেন তাঁরা এবং ওই গ্রামের সকল বাঙ্গালি।বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হল।কেই কেই মারা গেলেন,
আহত
হলেন বহু।
ছয়
বছরের বাচ্চা ছিলেন কাজের মাসি ছায়ারাণী দাস।রাতের অন্ধকারে কোলেপিঠে করে চলে এলেন
পাশের এক ঘনজঙ্গল টিলায়।প্রায়
এক বস্ত্রে আসা মানুষ সংখ্যায় দুশর মত হবে,কী
করে পালিয়ে সামনের রেল স্টেশনে আসবেন, এ
কথা ভাবছিলেন।ভোর
হওয়ার আগেই তাঁরা বেরিয়ে পড়বেন এমনটাই তাঁদের মনে ছিল।কিন্তু পারলেন না,
টিলার
নিচে খুনি মনস্ক ছেলেছোকড়ারা জড় হতে লাগলো।অভুক্ত, কয়েক
ডজন আহত,অসুস্থও,
এর
মধ্যে অচল বৃদ্ধও রয়েছেন।তুলনামূলক
সবলেরা এক রোখা হলেন, মারব
নয় মরবো।দা,
কুড়ুল,
লাঠি
হাতের কাছে যা পেয়েছেন তা নিয়ে মোকাবিলার জন্যে প্রস্তুত হলেন। আক্রমণকারির অনেকেই আহত
হলো, কয়েকজন গুরুতরভাবে আহতও
হলো।আক্রান্তদের
কেউর গায়ে আঁচড়ও লাগেনি। ঘটনা
এখানেই থেমে থাকে নি। অল্প সময়ের মধ্যেই কাতারে কাতারে মার-মুখো জনতা জড়ো হতে লাগলো
টিলার নিচে। টিলার
চার দিকে আগুন জ্বালিয়ে দিলো তারা।
এই
কিংকর্তব্যবিমুড় অবস্থায় অবতারের মত দেখা দিল একজন মধ্য বয়সী পাহাড়ি গাউ বুড়া।এই গাউ বুড়া বাঙালি সমাজে পরিচিত।তিনি তাঁদেরে এক গোপন রাস্তা দিয়ে
পাহাড়ি বসতিতে নিয়ে গেলেন।তারপরও
অনেক ঝোক্কি পোহাতে হয়েছে তাদেরে।কয়েক
দিনের মধ্যেই প্রায় সবাই চলে এলেন তৎকালীন কাছাড়ে অর্থাৎ বর্তমান বরাক উপত্যকায়।ছায়ারাণীরা গেলেন করিমগঞ্জের শনবিলে।বিবাহ সূত্রে এখন ছায়ারাণী শিলচরের এক
স্লাম এরিয়াতে রয়েছেন।তার
কাছে সরকারি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী কোনও বংশ সূত্রের নথিপত্র নেই।নাগরিক পঞ্জয়ন সেবা কেন্দ্র এবং এই
লিখিয়ে আন্তরজালে খুঁজে পায়নি তার বংশসূত্র।
অনিশ্চয়তা
ও নিরাপত্তাহীনতার দংশনে রয়েছেন ছায়ারাণী এবং আরও কত নৃপেন্দ্র।এরকম কত লক্ষ বাঙালি জানি অনিশ্চিত
শঙ্কায় আক্রান্ত!এমন টা তো হওয়ার কথা ছিল না।তাঁদেরে বলে কয়ে তো দেশ ভাগ হয়নি,
তারাও
তো নিশ্চিত জীবন চেয়েছিল—স্বাধীন
দেশে স্বাধীন ভাবে বাস করবে।
তাঁদের মধ্যে অনেকেই ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু একী?
৫
মোদ্দা
কথা পাকিস্তান কিম্বা বর্তমান বাংলাদেশ অমুসলিমদের বাসস্থল নয়,
হতে
পারে না এর কারণ বিশ্লেষণের প্রয়োজন পড়ে না,
এযে
সকল সচেতন মানুষেরই জানা—এযে
বহু পঠিত, বহু চর্চিত,
বহু
প্রচারিত বিষয়।মাত্র
কয়েক লক্ষ সংস্কৃতি-মনা মুসলমান-নামে পরিচিত শাহবাগ- পন্থি বাঙালি গোটা বাংলাদেশের
মুসলমানের প্রতিভূ নয় কিন্তু। বাংলাদেশ
বাংলাভাষী মুসলমানের দেশ—এটাই
খাঁটি কথা।সুতরাং,
যখনই
নির্যাতিত কেউ ভারতে আসবেন নৈতিকতার দৃষ্টিতে তাঁকে নাগরিকত্ব প্রদানকরা
বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়ে।জানা
যায় আগামী সংসদ অধিবেশনে নাকি এ মর্মে এক বিল পাশ করা হবে। যদি কথার সত্যতা থেকে থাকে
তাহলেও সংশয় রয়েই যায়, লোকসভায়
পাশ হবে কিন্তু রাজ্যসভা?
মাননীয়
প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক বিচক্ষনতায় যদি মুশকিল আসান হয়।
--------------------------------------------------------
দৈনিক যুগশঙ্খ,৮/০৭/’২২
ধর্ম বনাম দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা
সমরবিজয় চক্রবর্তী
ভারত উপমহাদেশে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা দিনের পর দিন বেড়েই
চলেছে।অথচ ধর্ম তো মানুষের বিশেষ আবেগিক আশ্রয়, মানব
কল্যাণের জন্য ধর্মের সৃষ্টি।‘বৈশেষিক দর্শণ’-এ কণাদ মুনি ধর্মের সংজ্ঞা দিয়েছেন—
‘য়তো অভ্যুদয় নিঃশ্রেয়সিদ্ধিঃ স ধর্ম’।(বৈশেষিক
দর্শন, ১ম অধ্যায়,১ম আহ্নিক,২য় সূত্র) অর্থাৎ, যা দ্বারা যথার্থ উন্নতি এবং পরম
কল্যাণ লাভ হয় তাই ধর্ম। ধর্মের এই সংজ্ঞা
মেনে নিলে মানব
কল্যাণের বিপরীতে কোনও কাজ করা যায় না, করলে তা হবে অধার্মিক কর্ম।
উল্লেখ্য, ‘ধৃ’ ধাতু থেকে ধর্ম শব্দের উৎপত্তি।এই
বহু শ্রুত কথার মধ্যে ধর্মের আকর নিহিত রয়েছে।এই ‘ধৃ’ ধাতু জাত
ধর্ম শব্দের সাধারণ অর্থ ধারণ করা।সে অর্থে আগুণ উত্তাপ ধারণ করে, অর্থাৎ আগুণের
ধর্ম উত্তাপ, বরফের ধর্ম শৈত্য ইত্যাদি।তেমনি মানুষের ধর্ম ‘মনুষ্যত্ব’।ব্যুৎপত্তি নির্ণয় করে সংস্কৃত প্রতিটি শব্দের অর্থ বোঝা যায়।বলা
বাহুল্য,সংস্কৃত ছাড়া আর কোন ভাষায় এই বিশেষ বৈশিষ্ট নেই।
নূপুর শর্মার কথার প্রতিক্রিয়ায় যা হয়ে গেল এবং এখনও
ইতস্তত হতে চলেছে তা এক কথায় ‘বর্বরতা’ শব্দকেও হার মানায়।প্রতিবাদের ভাষা মানুষ
খুন করা, মানুষের ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট, স্কুল, গাড়ি ইত্যাদি নষ্ট করা, জ্বালিয়ে
পুড়িয়ে শেষ করে দেওয়া,একি ধর্ম
রক্ষা?মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটা দেশে ভারতের
পণ্যদ্রব্য বয়কট করা হয়েছিল, ভারতীয়দের চাকরি থেকে বরখাস্ত করার কথাও শোনা গেল,এর
মোকাবিলায় ভারত কতটুকু কী করতে পারে? কিন্তু ভারতবাসী ভারত বিরোধী কর্ম করে যাবে
তা কী করে বরদাস্ত করা যায়।তাহলে
তো ব্রিটিশের কবল থেকে ভারতের
স্বাধীনতা অর্জন করার কোনও প্রয়োজন ছিল
না। সে সময়টাই ভালো ছিল।ব্রিটিশ এ দেশে থাকলে হয় তো দেশভাগ হতো না এবং এ ভাবে
বিয়াল্লাপনা করা, জাতীয় সম্পত্তি নষ্ট করা অসম্ভব ছিল,ব্রিটিশ তা করতে দিত
না,ইতিহাস এর সাক্ষ্য।ব্রিটিশ যখন জানল যে তাদেরে ভারত ছেড়ে চলে যেতে হবে, সেই
থেকেই শুরু হয়ে গেল ভারতীয়দের নিজেদের মধ্যে খুনো-খুনি, নারী ধর্ষণ,বাড়ি-ঘর
জ্বালিয়ে দেওয়া, কোটি কোটি মানুষের জীবন বিনষ্ট করে দেওয়া,উদ্বাস্তু করে দেওয়া।
সুপ্রিম কোর্ট থেকে নূপুর শর্মার বিরুদ্ধে যে রায় বেরোবে
মনে হয় না সে রায় তাঁর পক্ষে যাবে কারণ কয়েক বিচারকের মন্তব্যে তা বোঝা যায়।তাই
যদি হয় তা হলে নূপুর আইনের চোখেও দোষী বলে সাব্যস্ত হবেন।উচ্চতম ন্যায়ালয় শুধু তাকে দোষী বলে সাব্যস্ত করতে পারে তা
শুধু নয়,এর আগেভাগে ভর্তসনাও তো করেনিল।সুপ্রিম কোর্টের
রায় যাই হোক না কেন, কিছু কিছু ব্যক্তি, দেশে এবং বিদেশে, শ্রীমতী শর্মার পক্ষে
কথা বলছেন।নূপুর কোরাণ-হাদিসে যা আছে তাই বলেছেন বুঝি।তাদের মতে তাহলে এতে দোষ
কোথায়।হ্যাঁ তাঁর শরীরী ভাষা অভদ্র ছিল এ কথাও প্রকাশ পায়।ভগবান শিব সম্পর্কে তসলিম রেহমানির কুমন্তব্যের যুৎসই জবাব দিতে গিয়ে নূপুর
শর্মা ফাঁদে পড়েন, এ কথা তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন।টেলিভিশনে বিতর্ক সভায় যা
বলেছিলেন এমন কি রেহমানিও কী বলেছিলেন গোটা বিতর্কই মুছে ফেলা হয়। সুতরাং বিতর্কটি
যারা দেখেছেন এবং নূপুর শর্মার সাক্ষাৎকারের উপর ভিত্তিকরে আমরা যারা এই বিতর্কিত
বিতর্ক দেখিনি তাদেরে যা কিছু সংবাদ মাধ্যম পরিবেশন করছে তার ওপর বিশ্বাস করতে
হচ্ছে।এ এক আশ্চর্যের ব্যাপার রেহমানির কোনো সাক্ষাৎকার কিন্তু নজরে এলো না।
সুপ্রিম কোর্টের রায় কিন্তু মাথা পেতে নিতে হবে যদিও
কারো কারো মনে হতে পারে তা একপক্ষিও রায়।দেশে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা যদি ক্ষুণ্ণ
হয়, বাইরের শত্রু রাষ্ট্রগুলো এর সুযোগ নিতে পারে।সিএএ-এর
আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন,কোভিড-১৯,অগ্নিপথ স্কিমের বিপক্ষে আন্দোলন, প্রাকৃতিক
দুর্যোগ ইত্যাদির মধ্যে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা সংখ্যা লঘুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত।এতোসব ধ্বংসাত্মক প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে
দেশ কীভাবে এগোয়?রাশিয়া-ইউক্রেনের
যুদ্ধের জেরে গোটা বিশ্ব ভুগছে।দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা শক্তপোক্ত না হলে
বহির্শত্রুরা পেয়ে বসবে কি-না?অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাহীনতার অন্যতম কারণ হচ্ছে দেশের
সংখ্যা গরিষ্ঠের সংগে সংখ্যা লঘুর বিবাদ।এ বিবাদ মেটা অতি আবশ্যক, এ বিবাদ অনেক
আগেই মিটে যাওয়া উচিৎ ছিল।এ
বিবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ কী
বলেন দেখি,
"মুসলমান ধর্মসমাজের চিরাগত নিয়মের
জোরেই তার আপনার মধ্যে একটা নিবিড় ঐক্য জমে উঠেছে, আর হিন্দুর ধর্মসমাজের সনাতন অনুশাসনের
প্রভাবেই তার আপনার মধ্যে একটা প্রবল অনৈক্য ব্যাপ্ত হয়ে পড়েছে। এর ফল এই যে, কোনো বিশেষ প্রয়োজন না থাকলেও হিন্দু
নিজেকেও মারে,
আর প্রয়োজন থাকলেও হিন্দু অন্যকে মারতে
পারে না। আর মুসলমান কোনো বিশেষ প্রয়োজন না ঘটলেও নিজেকে দৃঢভাবে রক্ষা করে, আর প্রয়োজন ঘটলে অন্যকে বেদম মার দিতে
পারে। তার কারণ এ নয়, মুসলমানের
গায়ে জোর আছে,
হিন্দুর নেই; তার আসল কারণ, তাদের সমাজের জোর আছে, হিন্দুর নেই।
এক দল আভ্যন্তরিক বলে বলী, আর-এক দল আভ্যন্তরিক দুর্বলতায়
নির্জীব। এদের মধ্যে সমকক্ষভাবে আপস ঘটবে কী করে। অত্যন্ত দুর্যোগের মুখে
ক্ষণকালের জন্য তা সম্ভব, কিন্তু
যেদিন অধিকারের ভাগ-বাটোয়ারার সময় উপস্থিত হয় সেদিন সিংহের ভাগটা বিসদৃশরকম বড়ো
হয়ে ওঠে,
তার কারণ তার থাবার মধ্যে।- - - - -
ভারতবর্ষের কল্যাণ যদি চাই তা হলে হিন্দু-মুসলমানে কেবল যে মিলিত হতে হবে তা নয়, সমকক্ষ হতে হবে। সেই সমকক্ষতা তাল-ঠোকা
পালোয়ানি ব্যক্তিগত সমকক্ষতা নয়,উভয়পক্ষের
সামাজিক শক্তির সমকক্ষতা।"
কবি নজরুল
ইসলাম বলেন—
“অবতার-পয়গম্বর কেউ বলেননি, আমি
হিন্দুর জন্য এসেছি, আমি মুসলমানের জন্যে এসেছি, আমি
ক্রিশ্চানের জন্য এসেছি। তাঁরা বলেছেন, আমরা মানুষের
জন্য এসেছি – আলোর মতো, সকলের জন্য”।
হিন্দু মুসলমানে মিলন ছাড়া দেশ এগোতে পারে না কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে কী করছে? সরকার যদি ভোটের অংকই কষতে থাকে, তাহলে
এ দেশ কখনো দাঁড়াতে পারবে না। একটি রাষ্ট্র চাইলে এক মুহূর্তেই সব অনাচার বন্ধ
করে দিতে পারে। রাষ্ট্রের অবহেলার কারণেই কিংবা অসৎ কোন উদ্দেশ্যের জন্যই দেশে এইসব অরাজকতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। মানুষ যখন অপরাধ করে পার পেয়ে যায় তখন অপরাধ
ক্রমশ বাড়তেই থাকে।
নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ভারতের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন
সমরবিজয়
চক্রবর্তী
স্বাধীনতার
৭৫তম বৎসর অনন্য এক আবহ তৈরি করেছে গোটা ভারতবর্ষে।এ কাজে বর্তমান ভারত সরকার
অত্যন্ত নিপুণভাবে জনমনে বিপুল আবেগ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন এবং কয়েক দৃষ্টিকোন
থেকে বিষয়টা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।সবকটি দৃষ্টিকোন এখানে আলোচ্য নয়।আলোচ্য রাষ্ট্রের
কোষাগারে বেশ কিছু অর্থের আমদানি হয়েছে।দেশের সর্বত্র সাধারণ ব্যবসায়ীরাও
উপক্রিত,পতাকা বিক্রি আর তৎসহ অন্যান্য আবশ্যক দেদার বিক্রি হয়েছে এবং হচ্ছেও।দেশভক্তির
জোয়ার বইছে এবং এ জোয়ারের গুরুত্ব যথেষ্ট।হ্যাঁ, পতাকাবিক্রি জনিত বাণিজ্য, বোধ করি, মাননীয়
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিরদ্বারা সম্ভব হয়েছে, কারণ তিনি
গুজরাটি। গুজরাটিরা এ দেশে বাণিজ্যে এক নম্বর।বাঙালি এমন এক মতিভ্রষ্ট জাত হয়ে
দাঁড়িয়েছে এখন আমাদের তথাকথিত নেতানেত্রীরা, আমাদের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা এক চরম
নিন্দনীয় জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এই জাতটাকে যে জাত এক সময় গোটা ভারতকে পথ
দেখিয়ে ছিল।স্বাধীনতার ৭৫ বৎসর উপলক্ষে বাংলা গান দিয়ে ভালো বাণিজ্য করতে পারত
বাঙালি। পুরনো গান
দিয়েই তা সম্ভব ছিল। এই গানগুলো এক সময় শুধু বাংলা মুলুক কেন অবিভক্ত ভারতবর্ষের
সর্বত্র আকাশবাতাস মথিত করত।এই গানগুলোর মৃত্যু নেই, এগুলো
সর্বকালের সর্ব জনের, ভাষার অন্তরায় অতিক্রম করার ক্ষমতা রাখে এসব গান।দেলের
মাহান্দির গাওয়া পাঞ্জাবি গান যেমন
পুরোপুরি না বুঝলেও ভাললাগে,এ বাংলা গানগুলোর ব্যাপারেও একই কথা
প্রযোজ্য।তবে এই গানগুলোতে তৎসম শব্দ বেশি থাকায় অবাঙালি ভারতীয়রাও বুঝতে পারত, এর
প্রমাণ রয়েছে।এখনও বুঝতে পারবে বলে মনে হয়।এই গানগুলোর
প্রচার কই, বাংলা অধ্যুষিত এলাকাতেই কদাচিৎ একদুটো শোনা যায়। ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা
আমাদের এই বসুন্ধরা...’, ‘উঠো গো ভারত লক্ষ্মী, উঠো আদি জগত জন পুজ্যা...,’ বলো
বলো সবে শত বীণা বেনু রবে,ভারত আবার জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে...,’ ‘মুক্তির
মন্দির সোপান তলে কত প্রাণ হল বলিদান...,’ ‘যদি তোর ডাক শুনে তোর না আসে তবে একলা
চলো রে...(ইন্দিরা গান্ধির অত্যন্ত প্রিয় গান),’ ‘কারার ঐ লৌহ কপাট...,’ ‘জাগো
অনশন বন্দী...’ আরো কত রয়েছে।এই গানগুলো আজকের সাউন্ড সিস্টেমে রেকর্ড করে অন্তত বাংলা মুলুকে তো চালানো
যেতো।গুজরাটি অথবা মাড়োয়ারির এ রকম গান
থাকলে ভালোই বাণিজ্য করত বলে মনে হয়।বাঙালি আত্মবিস্মৃত তো বটেই চরম হীনমন্যও।
এখন আসি অন্য
বাঁকে।স্বাধীনতার ৭৫ বৎসর পেরিয়ে আজ আমরা কতটা স্বাধীন, এ প্রশ্ন শুধু আজকের নয়, এ
প্রশ্ন স্বাধীনতার মধ্যরাত থেকেই শুরু হয়ে গেছে(মধ্যরাতে কেন
দেশ স্বাধীন হল এ এক স্বতন্ত্র বিষয়, এনিয়ে এক সময়
বিস্তৃত আলোচনা করা যেতে পারে।)।ব্রিটিশ দেশ ছেড়ে চলে গেছে কিন্তু রেখে গেছে খণ্ডিত ভারত।ধর্ম যে মানুষকে খুন
করাতে পারে, একই ভাষিক, একই জাতির মানুষের বাড়িঘর,আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাকে ধর্ষণ করতে
পারে, দেশভাগ হয়ে স্বাধীনতার ফলাফলের এতো নৃশংস নিদর্শন মানব ইতিহাসে আর কোথাও
নেই।নাজির হত্যাকাণ্ডকেও হার মানিয়েছে এবং এখনও তা চলছে।ইহুদি তাঁদের উপর নারকীয়
অত্যাচার আর হত্যার খবর সাহিত্য ও চলচিত্রের নানাধারায় স্পষ্ট তো তুলে ধরেছে,
কিন্তু বাঙালি তা করেনি।‘কাশ্মীর ফাইলস’-এর মতো বাস্তবমুখী চলচিত্রে বাঙালির
তথাকথিত ভব্য বুদ্ধিজীবীর আপত্তি।যতই বাঙালিকে নিগৃহীত করো, বাঙালি পালিয়ে বাঁচতে
জানে, অ্যামিবার চরিত্রে বেঁচে থাকতে জানে।আজকের বাঙালিকে দেখে মনে হয় না
রবীন্দ্রনাথ, নেতাজি, বিদ্যাসাগর, রামমোহন রায়, স্বামিজী এরা বাঙালি ছিলেন।এই
মহান, সাহসী, মহাপুরুষ বাঙালির যে এতোটুকুও আমাদের চরিত্রে নেই।
যে উপমহাদেশে
আদিকাল থেকে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে আসছে “বসুধৈব কুটুম্বকম”,সেই উপমহাদেশ
দ্বিখণ্ডিত হয় ধর্মের জিগির তুলে।আজও দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা আকাশছোঁয়া প্রশ্ন
চিহ্নের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে।এর মধ্যে পাকিস্তান জাত শত্রুর মতো বিনা উস্কানিতে ভারতের ক্ষতি করে
চলেছে।অথচ চিকিৎসার
জন্য,খাদ্যের জন্য ভারত তার চাইই চাই।বাংলাদেশের মানুষও ভারতবৈরী বারবার
প্রমাণিত হচ্ছে।রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ সরকার ভারতের সঙ্গে
বন্ধুসুলভ আচরণ বজায় রাখছে, কিন্তু আবেগিক বন্ধন বোঝা যায়, নেই।একই ভাষীক
জাত, একই পরাম্পরাগত সংস্কৃতির অধিকারী বাঙালি হিসাবে হিন্দু,মুসলমান বাংলাভাষী এক
হতে পারল না আজও।কিন্তু খ্রিস্টান, বৌদ্ধ এবং হিন্দু বাংলাভাষী একই সূত্রে গাঁথা
বাঙালি।হিন্দু সংখ্যা গরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও খ্রিস্টান কিম্বা বৌদ্ধ বাংলাভাষীর
সংগে হিন্দু বাংলাভাষীর কোনোদিন কোনো বৈরী সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি আর দাঙা তো অনেক
দূরের কথা।খ্রিস্টান কিংবা বৌদ্ধ বাঙালির নামও বাংলায়।কথাবার্তায় ধর্মের পরিচয়
ফোটে ওঠে না।মুসলমানের সাথে ‘একই সূত্রে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান’ কাব্যে শুধু।বাংলাদেশে
হিন্দুর উপর চরম অত্যাচার এখনও অব্যাহত,জমি-দখল-ঘর-দোকানপাট-মন্দির
জ্বালিয়ে দেওয়া নিত্যদিনের কাজ।অন্যান্য বাংলাভাষী ধর্মীয় গোষ্ঠীরও একই হাল।কোনো বিচার
নেই।
দ্বিখন্ডিত
মুলুকের
মানুষরা যারা ভারতবর্ষে এলো তারা
তাদের সাত পুরুষের মাটিবাড়ি ছেড়ে এলো।যন্ত্রণাক্লিষ্ট
কোটিকোটি উদ্বাস্তু মানুষের কাছে এ দেশের স্বাধীনতা অর্থহীন নয় কি?
উল্লেখ্য,
ব্রিটিশ বারবারই এই দেশটাকে ভাগ করেছে।ব্রিটিশ রাজত্বকালের ৬১বছরের মধ্যে
সাতবার ভারতকে ভাগ করেঃআফগানিস্তান ১৮৭৬ সালে,নেপাল
১৯০৪ সালে,
ভুটান ১৯০৬
সালে,তিব্বত ১৯০৭ সালে,
সিলোন, বর্তমানে শ্রীলংকা
১৯৩৫ সালে,
বার্মা, বর্তমানে মিয়ানমার
১৯৩৭ সালে এবং ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ভারত থেকে
বিচ্ছিন্ন হয়।
ইন্ডিয়ান
ইন্ডিপেন্ডেন্স বিল ১৯৪৭সালের চার জুলাই ব্রিটিশ হাউস অফ
কমন্সে উত্থাপিত হয় এবং প্রায়
একপক্ষ কালের মধ্যে তা পাশ হয়ে দেশকে দুভাগ করে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে
কয়েকটা শর্তে ভারতবাসীর কাছে দেশ শাসন করার ক্ষমতা অর্পণ করা হয়,এ-ই দেশবাসীর কাছে
ভারতের স্বাধীনতা অর্জন(কেন মধ্যরাতে ভারতের স্বাধীনতা
ঘোষনা করা হল,পরে একবার স্বতন্ত্র বিষয় হিসাবে খোলসা করে বলা যেতে পারে।)।এই
স্বাধীনতা ক্ষমতা হস্তান্তরমাত্র।এখনও ভারত ব্রিটিশ কমনউয়েলথের অন্তর্গত।কোনও কোনও ব্যাপারে ব্রিটিশের মুকুটে ভারতকে মাথা নত করতে হয় আজও।
একথা এখন সর্বজন বিদিত যে ভারত যতটাই স্বাধীন হয়েছে, তা
মহাত্মা গান্ধির অসহযোগ আন্দোলনে নয়,নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ভারতের স্বাধীনতা এনে
দিয়েছেন।অবশ্য এই ভারত উপমহাদেশকে একসূত্রে বাঁধার মূলে গান্ধিজির অবদান
অসামান্য।দেশবিভাজনে এই একসূত্রে বাঁধা আর রইল কই,আজ রাজ্যিক ও ভাষীক দ্বন্দ্বে
ভারত জর্জিত। আর এর ওপর রয়েছে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও আর্থিক দুর্ভোগ।
বলা বাহুল্য,নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ডিসেম্বরের ৩০,১৯৪৩
স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করেন স্বাধীন আন্দামান নিকবরের পোর্টব্লেয়ারের জিমখানা
মাঠে, বর্তমানে এই মাঠের নাম নেতাজি স্টেডিয়াম।৭৯
বৎসর আগে ভারত স্বাধীন হয়।স্বভাবত প্রশ্ন জাগে তাহলে ভারতের স্বাধীনতা দিবস ১৯৪৩এর
৩০ ডিসেম্বর কেন ধরা হচ্ছে না?ভারতের এই
দ্বীপপুঞ্জ স্বাধীন হয় ক্ষমতা হস্তান্তরে নয়,ব্রিটিশকে পরাজিত করে এই
স্বাধীনতা অর্জিত হয়।সুতরাং এই দিনই তো ভারতের প্রকৃত স্বাধীনতা দিবস, নয় কি?
উল্লেখ্য, এর পরের বছর মনিপুরের মইরাঙ্গে আজাদ হিন্দ ফৌজের লেফটেন্যান্ট কর্নেল সইকত
মালিক স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করেন।
একটি দেশের স্বাধীনতা অর্জনের উদ্দেশ্য কী হতে পারে—
রাষ্ট্রের স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা,
প্রতিটা মানুষের মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিত করা,অশিক্ষা-কুশিক্ষা ও
দারিদ্র্যমুক্ত সমাজের
প্রতিষ্ঠা,রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতায় উৎকর্ষ মাত্রায় পৌঁছা,প্রতিটি মানুষের
মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলা।যে স্বাধীনতায় মানুষ অন্তর-মনের স্বাধীনতা উপলব্ধি করতে
পারে— এক কল্যাণময়, প্রেমময় রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাই হওয়া চাই
একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা।প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বৎসর
বর্ষপূর্তিতে আমরা সেই মাত্রার কতটুকু
পৌঁছোতে পেরেছি?
*দৈনিক যুগশঙ্খ,উত্তরসম্পাদকীয়, ১৫ আগস্ট,২০২২
নেলসন
মেনডেলা শুধু কৃষ্ণাঙ্গের নন
দৈনিক যুগশঙ্খের (ডিসেম্বর ০৭,২০১৩) প্রথম পৃষ্ঠার
লিড খবর সম্পর্কে আমার এই পত্রের অবতারণা।খবর নিয়ে আমার কোনও কথা নেই।লেখাটি
নিঃসন্দেহে ভাল হয়েছে। শিরনামঃ ‘কৃষ্ণাঙ্গের
মুক্তিসূয অস্তমিত’-- এখানেই
আমার আপত্তি। এভাবে নেলসন মেনডেলাকে সীমায়িত করা যায় কি? তিনি কি শুধু কালো আদমির
মানুষ, না গোটা বিশ্বের? তিনি বিশ্বে
মানবতার বন্দি দশার অন্যতম মুক্তিযুদ্ধা। দেশ, কাল, জাতি, বর্ণ,ধর্ম অতিক্রম করে
গেছেন তিনি। এই মহামানবকে কি করে আমরা শুধু মাত্র কালো আদমির মুক্তিযুদ্ধা বলে আখ্যায়িত করি? এই করে আমরা
তাকে ছোট করলাম না, আমরাই ছোট হলাম।
শুধু
একটি মাত্র উধাহরণই তো,আর সব ছেড়েই দিলাম, আমার কাছে তাঁর অভাবনীয় বিশ্বমানবের
পরিচয় দিয়ে দেয়। যার( F.W. de
Klerk )
জন্যে তাঁকে ২৭ বৎসর জেল খাটতে হয়েছিল, নেলসন তাঁর মুক্তির পর ওই ব্যক্তির পাশে
বসে হাসি মুখে তার সঙ্গে আলাপ চারিতায় ডিনার করতে পেরেছিলেন। আকস্মিক কারও কারও
মনে হতে পারে, সাধারণ এক
ব্যাপার, এই সাধারণের মধ্যেই লুকিয়ে আছে যুগন্ধর এক বিশ্বমানবের পরিচয়ও কিন্তু। যে
ব্যাক্তিটির জন্যে তাঁর বদনাম প্রচারিত হত সাউথ আফ্রিকাতে, প্রজন্মের কাছে--
পাঠ্য পুস্তকে তাঁকে বলা হতো উগ্রপন্থী এবং এই
ব্রেন ওয়াশ তাঁর মুক্তির আগ অব্দিই চলছিল—সেই
ব্যাক্তিটিকে তিনি প্রেসিডেনট হওয়ার পর, এতটুকুও কটু কথা বলেননি, হ্যারাস করা তো
দূরের কথা। যুগন্ধর এই বিশ্বমানব সম্পর্কে খবরের শিরনামের মাধ্যমে আমাদের নিজেদের
ক্ষুদ্রতারই প্রকাশ পেলো —নয়কি?
--
সমরবিজয়
চক্রবর্তী
পার্ক
রোড, শিলচর।
পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের হাল ও উত্তরণ
সমরবিজয় চক্রবর্তী
শিল্পায়ন না হলে কোনও অঞ্চল এগোতে পারে না,কর্মসংস্থান
সৃষ্টি হবে না,এ কথা আজকের দিনে সর্বাংশে ঠিক নয়।যে অঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল—জল পথ, আকাশ পথ,সড়ক-সংযোগ রয়েছে,অঞ্চলটি নিরাপদ, সে
অঞ্চলে শিল্পায়ন না হলে তেমন কিছু নয়, যেমন, সিঙ্গাপুর—এটি একটি মার্কেট মাত্র,
কোনো বড় শিল্প নেই,কলকারখানা,ঐ এসেম্বলিং করার জন্য
যা।সিঙ্গাপুর তো পৃথিবীর অন্যতম উন্নত নগররাষ্ট্র।পৃথিবীর সেরা
উন্নত দেশগুলোর মধ্যে একটি সুইজারল্যান্ড, শিল্প
কোথায়?সর্বাস্থায় শিল্পায়ন বা মার্কেট গড়ার স্বপক্ষে শুধু
উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা নয়, নিরাপত্তা ও শান্তির বাতাবরণ তৈরি করে রাখা জরুরী যাতে
করে শিল্পপতিরা এখানে ব্যবসা করতে ভরসা পায়।
দেখা
যাচ্ছে এই ভরসার জায়গাটা তৈরি করতে এবার রাজ্য সরকার যথেষ্ট তৎপর।সকল
প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও রুপালী রেখা উপেক্ষা করা যায় না যা মুখ্যমন্ত্রীর এবারকার
দু’দিনের বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিটের বক্তৃতায় প্রত্যয়ের সাথে প্রকাশ পায়।এ
নিয়ে ছ’বার বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট হল।এক একটা সম্মেলনে
কোটি
কোটি টাকা খরচ করা হয়, আসাযাওয়া,
থাকাখাওয়া, কিন্তু আগের পাঁচটির ফলাফল প্রায় শূণ্য।নানা কারণে এবারের গুরুত্ব,
বিশেষজ্ঞদের মতে, বেশি।ষষ্ঠ
বিজিবিএসের শেষ দিনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যপাধ্যায় তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন,“আমি
ঘোষণা করতে পেরে অত্যন্ত আনন্দিত যে আমরা বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট (বিজিবিএস)
২০২২-এ ৩,৪২,৩৭৫
কোটি টাকার বিনিয়োগের প্রস্তাব পেয়েছি।এই ব্যবসায়িক শীর্ষ সম্মেলন প্রায় ৪
লক্ষ কর্মসংস্থান তৈরি করবে বলে আশা করা যায়”।
স্বাধীনতা
পরবর্তী সময়ে ডঃ বিধান চন্দ্র রায়ের আমলে শিল্পে পশ্চিমবঙ্গ ছিল এক নম্বরে।১৯৬৩তে
তাঁর মৃত্যুর পর শিল্প ক্ষেত্রে অধঃপতন শুরু হয়।বাম
সরকার কোনও সময়ই শিল্পায়নের পক্ষে ছিল না।দেশের আইটি সেক্টরে আজ বেঙ্গালুরু এক
নম্বরে।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাম আমলে পশ্চিমবঙ্গে আইটি হাব খুলতে চেয়েছিল।
অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র বাঁধ সাধলেন।তিনি কম্পিউটার ব্যবহারের বিরুদ্ধে গেলেন।
ডুবল পশ্চিমবঙ্গ।তাঁর মতো অর্থনীতিবিদ ও সুসাহিত্যিক কেন অটোমেশনের বিরুদ্ধে
গেলেন, কম্পিউটারের বিরুদ্ধে গেলেন?
তাঁর কি দূরদৃষ্টির অভাব ছিল?
ন্যানো চলে গেল তবে শিখিয়ে গেল।পশ্চিমবঙ্গ থেকে ন্যানো চলে যাওয়ার পর
রতন টাটা দেশের অন্যত্র জমি
খুঁজছিলেন।ন্যানো তাঁর এক অন্যতম স্বপ্ন যাতে করে এ দেশের মানুষ অত্যন্ত কম দামে
কারটি কিনতে পারে।সিঙ্গুর ছেড়ে দেওয়ার পর টাটা
অটোমোবাইল ফ্যাক্টরি বিদেশের মাটিতে খুলতে চাইছিলেন না তিনি।ইত্যবসরে তৎকালীন গুজরাটের
মুখ্যমন্ত্রী,
বর্তমানে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, তাঁকে গুজরাটে ন্যানো ফ্যাক্টরি
খুলতে অনুরোধ করেন।এখন
প্রশ্ন জমি?টাটার লাগবে ৯৯৭ একর জমি যা তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার সিঙ্গুরে টাটাকে
বরাদ্ধ করেছিল।ঐ জমি তিন ফসলি।গুজরাটে ন্যানোর জন্য বরাদ্ধ জমি তিন ফসলি তো দূরের
কথা, চাষাবাদ যোগ্যও নয়।টাটা ১১০০ একর জমি পেল গুজরাটে।কোনও
ঝামেলা নেই, জমি রাতারাতি হস্তান্তর করা হল। করনাটক,
অন্ধ্রপ্রদেশ,হরিয়ানা, ওড়িশা, মহারাষ্ট্র এবং উত্তরাখণ্ড ন্যানো ফ্যাক্টরির জন্য
প্রস্তাব রেখেছিল কিন্তু গুজরাট অগ্রাধিকার পেল। মোদির তৎপরতা ও কৌশল জমি
হস্তান্তর সহজ করে দিল।ম্যাজিকটা ঐখানে, নরেন্দ্র মোদি আগে থেকেই রাজ্যকে
শিল্পায়িত করার উদ্দেশ্যে জমি ব্যাংক করে রেখেছিলেন যা পশ্চিমবঙ্গ কেন অনেক
রাজ্যই করেনি।অনেক দেরি হয়ে গেলেও বর্তমানে আসাম জমি ব্যাংক করে রাখছে।পশ্চিমবঙ্গে
সব জমিই উর্বর,সুজলা সুফলা,চাষাবাদের জন্য উত্তম।এর উপর রয়েছে জন-ঘনত্ব ও
জনবিস্ফুরনের চাপ।রাজ্যে শিল্পায়ন করতে গেলে এই জমি ছাড়া উপায় কী?
ডানলপ, হিন্দুস্থান মটরস, জুট মিলের মতো বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো তো উর্বরা
জমির উপরই ছিল।
পশ্চিমবঙ্গে উৎপাদন
শিল্পের বিবর্ণ চিত্র কেন্দ্রীয় শিল্প-বাণিজ্য মন্ত্রকের পরিসংখ্যানেও ফোটে
ওঠে।উৎপাদন শিল্পে লগ্নির বড় সুযোগ হাতছাড়া
হয়ে যাওয়ায় এখনও খেসারত দিতে হচ্ছে। ন্যানো তো গিয়েইছে, লার্সেন অ্যান্ড টুব্রো-র
মতো নামী সংস্থা চাহিদা
অনুযায়ী জমি না-পেয়ে তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প করতে পারেনি।আবার
সরকার শিল্পের জন্য কোনও জমি অধিগ্রহণ করবে না,
একথা
আগেভাগে জানানো হয়েগেছে।রেড ট্যাপিজম, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ
আর
একাধিক মালিকানার প্রতিবন্ধকতা জমি অধিগ্রহণ করতে শিল্পসংস্থাগুলোকে
নিরুৎসাহী করে।এসব
থেকে মুক্তি দেবেন রাজ্য সরকার,এমনই প্রত্যয়ী কথা ওঠে আসে এবারকার গ্লোবেল বিজনেস
সম্মেলনে।
রাজ্য সরকারের মতে, ২০১৫-১৯এর
আগের শিল্প সম্মেলনগুলিতে অন্তত বারো লক্ষ কোটি
টাকার শিল্প-প্রস্তাব এসেছিল।টাকার অঙ্কংটা
এতোটাই যে রাজ্যে শিল্প বিস্তার এতোটাই হতে পারত অচিরেই তার হৃত গৌরব ফিরে পেত এবং
এতো দিনে উন্নতির আরও সোপানে ওঠে যেতে পারত রাজ্য।
এসব
দেখেশুনে অবশ্য ভেবাচেকা খেয়ে আছেন রাজ্যবাসী, শিল্প-বিনিয়োগের
আশ্বাসকেও অপরাপর রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির মতোই ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে
ওঠেছেন তাঁরা।ষষ্ঠ
বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট স্বচ্ছন্দের হাসি দুটো
ঠোঁটে ব্যর্থতার রঙ মুছে দিতে বারবার প্রলেপন নয় তো?এখন শিয়রে শমন,খাদ্যসাথী, স্বাস্থ্যসাথী, কৃষকবন্ধু, লক্ষ্মীর
ভাণ্ডার—এসব টেনে নিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা।রাজ্যকে ৫,২৮,৮৩৩,০৫ কোটি টাকার ঋণের
বোঝা বইতে হচ্ছে।
শিল্পমহলের আশঙ্কা,রাজ্যে শিল্পের হাল এমন
থাকলে কর্মসংস্থান তলানিতে ঠেকবে।
হিন্দমোটর, শালিমার পেন্টস, ঊষার মতো পুরোনো সংস্থা বন্ধ
হয়ে গেল! রাজ্যের শো-পিস হলদিয়া পেট্রোকেমও খোলেনি।সেন্ট্র্যাল স্টেটেসটিকাল অর্গানাইজেশনের এক সমীক্ষায়
বলা হয়েছে আজকের পশ্চিমবঙ্গ শিল্প ক্ষেত্রে ১১ নম্বরে দাঁড়িয়ে আছে। নতুন কর্মসংস্থান তো
দূরের কথা, মানুষের চাকরি রাখাই কঠিন হয়ে পড়ছে।সুতরাং
এবার বোধ করি শিল্প হবেই।
মানুষ আশায় বাঁচে, আশায়
প্রত্যয় জাগে।পশ্চিমবঙ্গ এক সময় দেশের সেরা রাজ্য ছিল।এশুধু শিল্পে নয়, সব দিক দিয়ে।শরণার্থীর
সমস্যা প্রবল থাকা সত্ত্বেও মাথা উঁচু করে ছিল পশ্চিমবঙ্গ।বাংলার দিকে তাকিয়ে
বহির্বঙ্গের বাঙালিরা শুধু নয়,সেই আদর্শ-বাংলা অনুসরণীয় ছিল সবার কাছে।বাংলা পথ দেখাবে,তার
উন্নত কাজের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত খাড়া করে রাখবে,অজুহাত নয় সুদৃঢ় প্রত্যয়ে মাথা উঁচু
করে দাঁড়ানো চাই— একসময় এমনটাই ছিল বাংলা।এ
রাজ্যে লগ্নি করবার আগে
বিনিয়োগকারীদের ভাবতে হবে না— তাঁরা
জানবেন, যে কোনও প্রয়োজনে
রাজ্য সরকার তাঁদের পাশে আছেন,লগ্নিকারীদের
মধ্যে এই আশ্বাস জাগানোই এখন বড় কথা।
ভারত
বাংলা ভাষার অস্তিত্ব রক্ষায় ‘অপুর পাঠশালা’
বাঙালির সন্তান, অথচ বাংলা ভাষায় লেখাপড়ার সুযোগ নেই বললেই চলে৷ পশ্চিমবঙ্গের
পার্শ্ববর্তী রাজ্য ঝাড়খণ্ডে এমনই পরিস্থিতি৷ এর সমাধানে ঘাটশিলায় বাঙালিরাই
বিভূতিভূষণের স্মৃতি বিজড়িত গৌরীকুঞ্জে চালু করেছেন ‘অপুর পাঠশালা’৷
ঝাড়খণ্ডে প্রচুর বাঙালির বাস৷ কয়েক প্রজন্ম ধরে
তাঁরা অবিভক্ত বিহার তথা অধুনা ঝাড়খণ্ডে বসবাস করছেন৷ কিন্তু, এই রাজ্যে সরকারি স্তরে বা প্রশাসনিক কাজকর্মে বাংলার কোনো ব্যবহারিক
কার্যকারিতা নেই৷ সর্বত্র হিন্দি ভাষারই রাজত্ব৷ স্থানীয় স্কুলগুলিতে হিন্দি, ইংরেজি, সংস্কৃত ভাষাকে গুরুত্ব দেওয়া হলেও সেখানে নেই
বাংলার কোনো স্থান৷ ফলে শিশুপাঠ্যে নেই বাংলা ছড়া, কবিতা বা গদ্য৷ ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে' কিংবা ‘পাখি
সব করে রব'-এর অমোঘ ছন্দ বাঙালি শিশুদের অজানা৷ এও কি কম
যন্ত্রণার! এরকম অবস্থায় স্থানীয় বাঙালিরা ভাষা নিয়ে বহু আন্দোলন করলেও তার ফল
আদতে কিছুই মেলেনি৷ মুখ্যমন্ত্রী রঘুবর দাস বাংলা ভাষাকে ঝাড়খণ্ডের দ্বিতীয় ভাষা
হিসেবে চালু করার কথা বললেও তা বাস্তবায়িত হয়নি৷
মাতৃভাষা যে কোনো জাতির কাছে অনেক প্রিয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ বাংলা ভাষার সম্মানে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম দেখেছে
বাংলাদেশ ও ভারতের আসামের বরাক উপত্যকা৷ ভাষার জন্য বাংলাদেশের সংগ্রামের স্বীকৃতি
হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয় বিশ্বজুড়ে৷ সেই ঐতিহ্য বয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন
ঘাটশিলার বাঙালিরা৷ সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ১২৫তম জন্মদিবস
উপলক্ষ্যে গতবছরের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে কচিকাঁচাদের বাংলা শেখার জন্য শুরু হয়েছে ‘অপুর পাঠশালা'৷বরেণ্য
সাহিত্যিকের সাহিত্যকর্মে যেমন ঘাটশিলার বিভিন্ন অঞ্চলের কথা বারবার উঠে এসেছে, তেমনই তাঁর ব্যক্তিজীবনেও ছিল
এই এলাকার দারুণ প্রভাব৷ ‘চাঁদের পাহাড়', ‘পথের পাঁচালী', ‘আরণ্যক'-এর স্রষ্টা গৌরীকুঞ্জেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন৷ সেই ভিটেতেই
শতরঞ্জি পেতে সপ্তাহের একটি দিন, রবিবার চলছে ‘অ-আ-ক-খ' শেখার প্রথা বহির্ভূত অবৈতনিক ‘অপুর পাঠশালা'৷
পাঠশালা খোলার তাগিদ কেন অনুভব করলেন? গৌরীকুঞ্জ উন্নয়ন সমিতির
সভাপতি তাপস চট্টোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘এখানে শহরের কিছু এলাকা
বাদ দিয়ে ৮০ শতাংশ মানুষ বাংলায় কথা বলেন৷ বিগত ২০ বছর ধরে বাংলা ধীরে ধীরে
অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে৷ আগে স্কুলগুলিতে বাংলা পঠনপাঠন থাকলেও এখন স্কুলে বাংলা পড়ানো
হয় না৷ এখানে বাংলা বইও পাওয়া যায় না৷ অথচ বাংলাই এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের
ভাষা৷ নতুন প্রজন্ম তো বাংলা পড়তে পারে না৷
এমন অবস্থা হয়েছে যে ভবিষ্যতে পঞ্জিকা দেখতে গেলে
বাংলা জানা লোক আনতে হবে বাইরে থেকে৷''
উল্লেখ্য, বিশেষ কোনও রাজ্যের ভাষা সংস্কৃত নয়, সংস্কৃত শুধু ভারত কেন, গোটা বিশ্বে এক উন্নত মানে রয়েছে।সংস্কৃতভাষা মৃত কি-না, এনিয়ে বিতর্ক রয়েছে।ধ্রুপদি ভাষা হিসেবে
সংস্কৃতের মূল্য আন্তর্জাতিকস্তরেও অতুলনীয়।অথচ সংস্কৃতের গর্ভে বাংলার জন্ম।একসময় ভারতীয়
সংস্কৃতির সকল ধারায় বাংলা স্থান করে নিতে পেরেছিল।স্বাধীনতাপূর্ব ভারতে কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সম্মেলনে
উদ্বোধন সঙ্গীত হিসেবে বাংলায় গান গাওয়া হয়েছে।বাংলা দেশাত্মবোধক গান ও কবিতা
অবাঙালির কন্ঠেও ধ্বনিত হত।এখন মাত্র দুটি বাংলা গান অবাঙালি ভারতীয়ের কন্ঠে শুনতে
পাই, এক, জাতীয় সঙ্গীত আর মাঝেমধ্যে—“যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো
রে...”।
বিপুল সংস্কৃত শব্দের ভাণ্ডার থেকে বাংলা দ্রুত সরছে।সমৃদ্ধ রবীন্দ্রসাহিত্যে তৎসম
ও তৎসম শব্দের প্রাচুর্য লক্ষ করি।দেখা যায় বিশেষ করে রবীন্দ্রসঙ্গীতের পদ শিক্ষিত
অবাঙালি বুঝে নিতে পারেন, কারণ সংস্কৃত শব্দ যে নিজ ভাষায়ও রয়েছে।বাংলা
ভারতে সর্বজনীন নয়। সংস্কৃতভাষা
আসমুদ্রহিমাচলে মন্ত্র উচ্চারণ ছাড়াও সঙ্গীতে আজও ব্যবহৃত হচ্ছে।
“মৃত–ঘোষিত” ভাষা হওয়া সত্ত্বেও কোনও না কোনও ভাবে প্রয়োগ হচ্ছে।ভারতীয় নানা ভাষার জননী হিসাবে সংস্কৃত পড়া আবশ্যক।একথা বাঙালির ক্ষেত্রে বেশি প্রযোজ্য।আবারও বলতে হয়,
বাংলা ভাষার সঙ্গে সংস্কৃত ওতপ্রোতভাবে জড়িত।বাংলা ভালো লিখতে গেলে, বাংলা
সাহিত্যের উত্তর উত্তর বৃদ্ধির জন্য সংস্কৃত পড়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশের
মত একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র থাকা সত্বেও আগামী দু’
এক দশক পরে স্বমহিমায় বাংলাভাষা সে
সেদেশেই টিকে
থাকবে কি-না, এ’
নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।যেভাবে বাংলাকে ইসলামিকরণ করা হচ্ছে,
আরও কয়েক দশক পরে বাংলা আর
বাংলা চরিত্রে থাকতে পারছে না।যে সমাজে মুক্তচিন্তার অবকাশ নেই বা ক্ষীণ, সে সমাজ তো পঙ্গু সমাজ, সে সমাজে
কোনও উন্নতিই সম্ভব নয়। স্বাভাবিক কারণে বাংলাভাষা-সাহিত্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বাংলাভাষীদের
কাছে এক বিশেষ স্থান।
কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির পক্ষে মোটেই আশাব্যঞ্জক
নয়।বাংলারমত বিশ্বমানের ভাষা টিকে থাকাই তো সব কথা নয়।প্রসঙ্গত, বাংলাভাষা ও
সাহিত্যের একসময় কেন্দ্রীয় স্থল ছিল কলকাতা। আজ তা প্রায় অস্তমিত সুর্যের মত। বাঙালির আবেগিক আশ্রয় কলকাতা আর নয়, কলকাতা বিপন্ন। তাহলে বাংলা বাঁচে-বাড়ে কী করে ! জাতি-ভাষা-শিল্প-সাহিত্যের একটা কেন্দ্রস্থল চাই।
বানানে
পরিবর্তন বাংলার অগ্রগতিতে অন্যতম বাঁধা বলে মনে করি।দুই বাংলায় দুরকম বানান
আবার কোনও কোনও
পত্রিকার
নিজস্ব বানান বিধি।কই ইংরেজির মতো বিশ্বজনীন
ভাষায় তো এমনটি
নয়, শত শত বছর ধরে চলে আসা বানান আজও বৈধ।হ্যাঁ, দু’এক সামান্য পরিবর্তন লক্ষ করা
যায়,
যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে colour
হয়েছে color,behaviour হয়েছে
behavior, এ রকম।আবার ‘আসাম’ কেন ‘অসম’
হবে?অসমিয়ারা ‘বাঙালি’কে
‘বঙাল’ বলে,
বলে কি আমরাও ‘বঙাল’ বলব?প্রতিটি ভাষাই তার চরিত্র মেনে চলে।বাংলায় ‘ইংলিশ’ হয়েছে ‘ইংরেজি’ বা ‘ইংরাজি’।শব্দের
ব্যুৎপত্তি বিবেচনায় যাইহোক না কেন,দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত শব্দের মৃত্যু ঘটানো উচিৎ নয় বলে মনে করি।
এ ব্যাপারেও ক্ষানিক আলোকপাত করার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে
করি যে বিশেষ করে ভারতে বাংলাভাষার হরফ পরিবর্তনের
সম্ভাবনা রয়েছে।লেখার বেলায় রোমান ও দেবনাগরীর ব্যবহার এ’প্রজন্মের
ছেলেমেয়েদের মধ্যে লক্ষ করা যায়।এর
একটা কারণ মাতৃভাষা বাংলার বদলে তারা তাদের শিক্ষায়তনে হিন্দি কিম্বা অল্টারনেটিভ ইংলিশ
পড়ছে।ইন্টারনেটে রোমান হরফের ব্যবহার বাংলায় লেখার বেলায়ও প্রায় সকল বয়সের মানুষই
করছেন—এমন দেখা যায়। কেন করছেন?—এর
এক কথায় উত্তর, তুলনামূলক ভাবে রোমান হরফে লেখা সহজ।বাংলা অক্ষর ভবিষ্যতে
ইনটারনেটে বন্ধুসুলভ হয়ে গেলেও অধিকাংশ
ছেলেমেয়েরা বাংলায় লেখবে না,
এই প্রবণতা
তো আমরা এখনই দেখতে পাচ্ছি। অধিকাংশ ছেলেমেয়েরা আজকাল দেখা যায় ইনটারনেটের সোসিয়াল
মিডিয়ায় হিন্দি কিম্বা ইংলিশে লিখছে—হিন্দি
কিন্তু সচরাচর রোমান হরফে লিখতে দেখা যায়। আরো কয়েক দশক পরে, যদি এরই মধ্যে কোনও
বিহিত করা না হয়, তা হলে সমাজ জীবনের কোনও ক্ষেত্রেই বাংলাভাষার ব্যবহার থাকবে না বলে আশঙ্কা।
বাংলাভাষার
সংকটজনক অবস্থান ও সমাধান
--সমরবিজয়
চক্রবর্তী
ভারতীয় সংবিধানে বাংলাভাষা আঞ্চলিক অর্থাৎ সরকারি
দৃষ্টিতে বড়, মনিপুরি, অসমীয়া ইতাদি ভাষার সমগোত্র। এর বাইরে বাংলার কোনও স্থান
দেওয়া হয়নি। তাই এই রেনেসাঁ ভাষা সরকারি কোনও ধরণের সাহায্য পাচ্ছে না, যা তাঁর
পাওয়ার হক রয়েছে। আমাদের চাই সংবধানভুক্ত বাংলার এক বাড়তি মান,যাতে করে সরকারি
নানা সুযোগ সুবিধা বাঙ্গা পেতে পারে , যে ভাবে হিন্দি পাচ্ছে। পাচ্ছে কিন্ত্রু তামিল
তেলেগু, মালয়ালাম ভাষাও—এ গুলো ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে এবং সে
অনুযায়ী নানা সরকারি সুযোগসুবিধা পাচ্ছে। বাংলা এ ব্যাপারে পিছিয়ে—কারণ
বাংলা যে এ দেশে শুধু আঞ্চলিক ভাষা। বাংলাভাষী কোনও দিন এ
ব্যাপারে সরকারের সংগে বসেনি, পশ্চিম বঙ্গ, ত্রিপুরা,আন্দামান নিকবর দ্বীপপুঞ্জ, ঝাড়খণ্ড ইদ্যাদি বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে তেমন কোনও
সাড়া পাওয়া যায়নি। যে
ভাষা দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার হয় না, সে’
ভাষার মৃত্যু হল, ধরে নিতে হবে। ভাষার
মৃত্যু হলেও, সে’
ভাষায় যদি ধ্রুপদী গুণবত্তা সন্নিবিষ্ট থাকে,
তা
হলে আমরা ধরে নেই সে’ ভাষা
ধ্রুপদী ভাষা--যেমন ভারতের সংস্কৃত
ভাষা।
সংস্কৃত হিন্দু ধর্মাচরণের কাজে ব্যবহার করা হয়।এ’
ছাড়া সংস্কৃত ভাষায় গানও গাওয়া হয়। সংস্কৃত ঐচ্ছিক ভাষা হিসেবে
স্কুল,কলেজ,ইউনিভারসিটিতে পড়ার সুযোগ রয়েছে আর ‘টুল”-এ
তো সংস্কৃতভাষা শিক্ষার মাধ্যমই।সংস্কৃত ভারতের বেবাক ভাষার বীজ ভাষা।সংস্কৃত কোনও
না কোনও ভাবে ব্যবহার হচ্ছে যদিও বলা হয় সংস্কৃত মৃতভাষা,আবার
এটি ক্ল্যাসিকাল ভাষা হিসেবে সংবিধান স্বীকৃত, যাক,
এনিয়ে বিতর্ক রয়েছে বলে আর এদিকে এগোচ্ছিনা।।বাংলা কিন্তু এই অবস্থানে নয়, নয় বলেই
সংস্কৃতের মত ভারতের বিভিন্ন ভাষা গোষ্ঠীর কাছে বাংলা সানন্দে গ্রহনীয় নয়। এই
প্রেক্ষিতে সিবিএসই-তে পঞ্চম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী অব্দি সংস্কৃত বাধ্যতামূলক
বিষয়।বর্তমানে ভারতের সর্বত্র কিন্তু
নামি স্কুল্ গুলোতে সিবিএসই কউরস চলে।স্বভাবত, সিবিএসই পাঠ্য তালিকায় ভারতের অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষার
মত বাংলাভাষাও কয়েকটা ক্লাস অবধি ইলেক্টিভ বিষয় হিসেবে পড়া যায়।
কিন্তু বাংলাতো আঞ্চলিক ভাষা নয়। ভারতবর্ষের নানা জায়গায় বাংলাভাষীর গরিষ্ঠ
অবস্থান।এ
দেশে বাংলাভাষী সংখ্যায় দ্বিতীয় স্থানে।সাহিত্যমান ও ভাষার গুণগত উপাদানে বাংলাভাষা
আন্তর্জাতিক স্তরের ভাষাগুলোর এক আসনে বসার যোগ্যতা রাখে।এ এই লিখিয়ের কথা নয়,
ভাষাবিদদের কথা।বাংলা ভারতীয় সংবিধানে আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত
মানে,কেন্দ্রীয় সরকারের নিরিখে বাংলা আসমিয়া, মনিপুরি, বড়ো ইত্যাদি ভাষার সমোমানে অবস্থান করছে। CBSE, ICSE কোর্সে বাংলা ঐচ্ছিক বিষয়। কে ঐচ্ছিক পড়বে? হিন্দি, ইংরাজি, সংস্কৃত, সমাজবিদ্যা, বিজ্ঞান, অঙ্ক তো পড়তেই হয়।এর পরে পড়বে বাংলা—এযে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। আগামী প্রজন্ম কী করে বাংলা শিখবে। এই যদি স্বাধীন দেশে বাংলার অবস্থা হয়, তা হলে বাংলা বাঁচবে কী করে।বাংলা আন্তরজাতীক ভাষা। বাংলার জন্যে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র রয়েছে।বাংলাভাষার বর্তমান অবস্থা বজায় থাকলে
আন্তরজালেও বাংলা টেকার কথা নয়।
ভারতের জাতীয় সঙ্গীত বাংলায়, অথচ বাংলা এ দেশে আঞ্চলিক ভাষা।পৃথিবীর কোথাও এমনটি নয়। এর থেকে বাঁচার উপায় সাংবিধানিক পরিবর্তন। আঞ্চলিকের বাইরে ভারতীয় সংবিধানে বাংলাভাষার
জন্যে আরও এক সম্মাননা জুড়ে দেওয়া বাঞ্ছনীয়। হিন্দি ভারতে কেন্দ্রীয়
সরকারের দপ্তরি ভাষা, রাষ্ট্রভাষা নয়।হিন্দি ভারতের রাষ্ট্রভাষা এ কথা সংবিধানের
কোথাও উল্লেখ নেই।ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তপশীলে হিন্দি আঞ্চলিক ভাষা, এ ছাড়া
হিন্দিকে দেওয়া হয়েছে আর এক বাড়তি সুবিধা—হিন্দি
কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তরী ভাষা। আন্তর্জাতিক স্তরের বাংলাভাষার জন্যে কোনও বাড়তি
সুবিধা নয়।
এ
ক্ষেত্রে দুটো ব্যাপার বোঝার--এক,বাংলাভাষী
লোকের সংখ্যা ভারতে দ্বিতীয়। দুই, বাংলাভাষার সাহিত্যমান অতি উন্নত।বাংলা
সাহিত্যে যে রেনেসাঁস এসে ছিল উনবিংশ ও বিংশশতকের সত্তরদশক অবধি এর প্রভাবে
প্রভাবিত হয়েছে ভারতের প্রায় প্রতিটি ভাষা।হিন্দিভাষার দৃষ্টান্তই দেওয়া যাক, যারা
হিন্দিভাষা-সাহিত্যের ইতিহাস পড়েছেন, তাঁরা নিশ্চিত লক্ষ্য করেছেন বাংলাসাহিত্যেরে
প্রভাব হিন্দি সাহিত্যে কতো গভীরে।বাংলাসাহিত্যিকের নাম, গুণ-কীর্তন পরতেপরতে
মেলে।
সংস্কৃত
বাংলার মূল উৎস হলেও, বিশ্বায়নের থাবাতে বাংলাভাষা বেঁচে থাকবে কিনা এ’
নিয়ে ভাষাবিদদের মধ্যে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। সংস্কৃতের মত ভারতীয় সংস্কৃতির সকল ধারায় বাংলা স্থান করে নিতে
পারেনি।সংস্কৃতভাষার গাঁথুনি থেকে বাংলাভাষা দ্রূত সরে যাচ্ছে।বাংলা ভারতে
সর্বজনীন নয়। সংস্কৃত কোনও না কোনও ভাবে ‘মৃত–ঘোষিত’
ভাষা হওয়া সত্ত্বেও আসমুদ্রহিমাচল অবধি কোনও না কোনও ভাবে সংস্কৃতভাষার প্রয়োগ হচ্ছে
এবং ক্লাসিক্যাল ভাষার সুবাদে এটি বাড়তি সরকারি সুবিধা পাচ্ছে যা বাংলা পায় না।বিশেষ সংস্কৃতভাষা সনাতন ধর্মীয় ক্রিয়াকর্মে আজো একান্ত আবশ্যক। এ ছাড়াও সঙ্গীতে সংস্কৃতের
ব্যবহার রয়েছে। ভারতীয় নানা ভাষার জননী হিসাবে সংস্কৃত পড়া
আবশ্যক।বাংলাভাষায় সংস্কৃতের বিপুল প্রয়োগরের জন্য বাংলাভাষীর সংস্কৃত পড়া দরকার।
এ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, সংস্কৃত যথার্থ
মৃতভাষা।বাংলা ভিনভাষীর কাছে আজ আর আবশ্যক ভাষা নয়। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে বাংলার
প্রয়োজনীয়তা আজ অনেকটাই হারিয়েছে। খুদ বাঙালির কাছেই বাংলাভাষার গুরুত্ব
দিন-কে-দিন হ্রাস পাচ্ছে।।বাংলার
অস্তিত্বের বিপন্নতা বোধ স্পস্ট করার লক্ষ্যে বাংলার মূল উৎস সংস্কৃত
সম্পর্কে এ’ সব বলা।
স্বাধীনোত্তর
ভারতে দেখা যায় ক্রমে বাংলাভাষার ব্যবহার সঙ্কুচিত হচ্ছে।এ’
ভাবে চললে বাংলাভাষা বেহাল হতে বাধ্য এবং ক্রমে বিলুপ্তও হয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশের মত একটি স্বাধীন রাষ্ট্র
থাকা সত্বেও আগামী দু’
এক দশক পরে স্বমহিমায় বাংলাভাষা টিকে থাকবে কি-না, এ’
নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আরও কয়েক দশক
পরে বিশেষ করে ভারতে বাংলাভাষার হরফ পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে । লেখার বেলায়
রোমান ও দেবনাগরীর ব্যবহার এ’
প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে অনেকেই করছে। এর একটা কারণ মাতৃভাষা বাংলার বদলে তারা
তাদের শিক্ষা নিকেতনে হিন্দি কিম্বা অল্টারনেটিভ ইংলিশ পড়ছে। ইন্টারনেটে রোমান
হরফের ব্যবহার বাংলায় লেখার বেলায়ও প্রায় সকল বয়সের মানুষই করছেন—এমন দেখা যায়। কেন করছেন?--এর এক কথায় উত্তর,
তুলনামূলক ভাবে রোমান হরফে লেখা সহজ।বাংলা অক্ষর ভবিষ্যতে ইনটারনেটে বন্ধুসুলভ হয়ে
গেলেও অধিকাংশ ছেলেমেয়েরা বাংলায়
লেখবেনা, এই প্রবনতা তো আমরা এখনই দেখতে পাচ্ছি। অধিকাংশ ছেলেমেয়েরা আজকাল দেখা
যায় ইনটারনেটের সোসিয়াল মিডিয়ায় হিন্দি কিম্বা ইংলিশে লিখছে—হিন্দি
কিন্তু সচরাচর রোমান হরফে লিখতে দেখা যায়। আরো কয়েক দশক পরে, যদি এরই মধ্যে কোনও
বিহিত করা না হয়, তা হলে সমাজ জীবনের কোনও ক্ষেত্রেই বাংলাভাষার ব্যবহার থাকবেনা বলে আশঙ্কা করা অমূলক নয় বলে মনেকরি ।
প্রসংগক্রমে,মূলত বাংলাভাষা আর মৈথিলীভাষার হরফ একই ছিল, কিন্তু বর্তমানে
মৈথিলীদের ভাষার বর্ণলিপি দেবনাগরী । এ’
ব্যাপারে হিন্দিভাষার ঔপনিবেশিকতা কাজ করেছে। মৈথিলীদের অজান্তেই অনায়াসে হিন্দি
বর্ণমালা এসে গ্রাস করেছে তাঁদের নিজস্ব
বর্ণমালা ।বড়োভাষার বর্ণমালা ছিল
অসমিয়া( অসমিয়া বর্ণমালায় ‘র’-এর
পেট কাঁটা ছাড়া আর সবই তো বাংলা বর্ণমালার সঙ্গে মিলে যায়),এখন হয়েছে দেবনাগ্রী
।মনিপুরিভাষার বর্ণমালা ছিল বাংলা, এখন আর বাংলা নয় । বাংলা হরফের গ্রহণযোগ্যতা
হ্রাস পাওয়া বাংলাভাষার জন্যে নেতিবাচক ইংগিত বহন করছে।
আবার বৃটিশশাসিত বাংলায় সরকারি কাজকর্ম ও শিক্ষাব্যবস্থা ইংরেজি ভাষার
মাধ্যমে চললেও ধর্মসংস্কার ও সমাজ সংস্কার আন্দোলন, নতুন সাহিত্য সৃষ্টি সবই
হয়েছে বাংলা ভাষায়। স্বাধীনতা আন্দোলন, জনগণের মুক্তিসংগ্রাম ও ভবিষ্যৎ চিন্তার অবলম্বন ছিল বাংলা ভাষা। তখন
জনসাধারণের মধ্যে দেশপ্রেম, স্বাজাত্যবোধ ও জাতীয় উন্নতির আকাঙ্ক্ষা ছিল প্রবল। সে
অবস্থায় বাঙালির চিন্তাধারা বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যের বিস্ময়কর রকম উন্নতি
হয়েছিল। সেদিন বাংলা ভাষার ভাবুক ও কর্মীদের চালিকাশক্তি ছিল অন্তঃস্থিত
রেনেসাঁসের তাড়না উন্নত জীবন ও সমাজ গড়ার অদম্য স্পৃহা। বাঙালি
জীবনে তখন সাধনা ছিল, সংগ্রামও ছিল। উন্নতির লক্ষ্য ছিল।তখন
কলকাতা ছিল শুধু মাত্র বাঙালির নয়, গোটা ভারতের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির
কেন্দ্রস্থল।১৯১১-এ কলকাতা থেকে ভারতের রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ার পরও স্বাধিনতার
প্রাককাল অবধি কলকাতা ছিল এ দেশের প্রাণকেন্দ্র, দেশের আদর্শ স্থল, দেশের
পাথেয়।দিল্লি দেশের রাজধানী হওয়া সত্বেও
আদর্শগত ভাবে সারা দেশের প্রতিভূ
হয়ে ওঠতে পারেনি, এখনও কি পারছে ? সে থাক ।
দুই
সামাজিক ও বানিজ্যিক মূল্য হারালে ভাষার উত্তর
উত্তর বৃদ্ধি কখনোও সম্ভব হওয়ার নয়।ভাষার উন্নতি মানে সাহিত্য সমেত নানা শিল্প ক্ষেত্রে মান বাড়া। অর্থ ছাড়া ভাষা মূলত মৌলিক ক্ষেত্রে উন্নত
থাকলেও সে’ ভাষার সাহিত্যমান বাড়তে পারে না।
দেখা গেছে, যে ভাষা রাজকার্যে ব্যবহার হয়, যে ভাষা বানিজ্যে
ব্যবহার হয় সে ভাষার উপনিবেশিক শক্তি বেশি এবং এ’ ভাষাগুলোরই বাঁচা ও উন্নতির
সম্ভাবনা বেশি। স্বভাষীক
গোষ্ঠী ছাড়াও অন্য ভাষীক গোষ্ঠীও যদি সে ভাষা প্রয়োগ করে, তা হলে সে ভাষার বাঁচা-বাড়ার সম্ভাবনা প্রবল। এক সময় বাংলা নানা ভাষীক মানুষের মধ্যে
বাক্যালাপে আদান-প্রদানের মাধ্যম ছিল, বাংলা এ’ জায়গা ক্রমশ হারাচ্ছে।যে ভাষার উপনিবেশিক চরিত্র নেই, সে ভাষার
স্থায়িত্বও নেই, এ’ তো ঐতিহাসিক সত্য। এক সময় বাংলা সর্ব ভারতে
এবং বাইরে বৌদ্ধিক মহলে স্থান
পেয়েছিল,আজ তা প্রায় একেবারেই নেই।এক সময় বাংলার বাইরে অনেক অবাঙালিরাও বাংলায় লিখতেন, বিদেশিরাও লিখেছেন,
পত্রপত্রিকা বেরতও ভারতের নানা স্থান থেকে, আজ এ সব নেই, নিজ ভূমেই বাংলা প্রবাসী
যেন।
যে সমাজে মুক্তচিন্তার অবকাশ নেই বা ক্ষীণ, সে সমাজ তো পঙ্গু সমাজ, সে সমাজে
কোনও উন্নতিই সম্ভব নয়। স্বাভাবিক কারণে বাংলাভাষা-সাহিত্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বাংলাভাষীদের
কাছে এক বিশেষ স্থান।
কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির পক্ষে মোটেই আশাব্যঞ্জক
নয়।বাংলারমত বিশ্বমানের ভাষা টিকে থাকাই তো সব কথা নয়। ভারতে এবং (বাংলাদেশ ছাড়া)
বিশ্বের নানা স্থানে বাংলাভাষা বেঁচে থাকাটাই সঙ্কটের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।প্রসঙ্গত, বাংলাভাষা ও সাহিত্যের এক সময়
কেন্দ্রীয় স্থল ছিল কলকাতা। আজ তা প্রায় অস্তমিত সুর্যের মত। বাঙালির আবেগিক আশ্রয় কলকাতা আর নয়, কলকাতা বিপন্ন। তাহলে বাংলা বাঁচে-বাড়ে কী করে ! জাতি-ভাষা-শিল্প-সাহিত্যের একটা কেন্দ্রস্থল চাই।
তিন
এই
প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা নিজেদের মধ্যে হিন্দিতে বাক্যালাপ করতে দেখা যায়। হিন্দি তাদের মাতৃভাষা বাংলার চেয়েও
আপন মনে হয়। এই প্রবণতা শুধুমাত্র ইংরিজি পড়ুয়াদের মধ্যে নয়,
বাংলা
মাধ্যমে পড়ুয়াদের মধ্যেও লক্ষ্য করা যায় । আজকের ছেলে মেয়েদের যে কোনো জন কে
জিজ্ঞাসা করলে –তুমি কী কী ভাষা
জান—প্রশ্নের উত্তরে বলতে শোনা
যায় – ইংরিজি, হিন্দি ও
বাংলা বা হিন্দি, ইংরিজি, বাংলা—বাংলা
তাদের কাছে তৃতীয় স্থানাধীকারী । বাংলা তাদের কাছে প্রথম স্থান পায়না । ইংরাজি মিডিয়াম
স্কুলে বাঙালি বাচ্চারাও বাংলা অপশনাল না নিয়ে হিন্দি নিচ্ছে .আর ..টিভিতে ডরিমন
বা ছোটা ভিম-এর হিন্দি সিরিজ তো আছেই,-- দিন নেই রাত নেই ।
ইংরাজি স্কুলগুলির দৌলতে
আমাদের ছেলে মেয়েরা ইংরাজি ভালই শিখছে , বিজ্ঞান মনস্ক হচ্ছে , ইতিহাস, ভূগোল , সমাজ , এসব তো ভালই শিখছে। সারা বিশ্ব জুড়ে
প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে নিজেদের দারুন ভাবে তৈরী করছে। কিন্তু, এত পড়ার মাঝে , এত বইয়ের ওজনে কখনো কখনো
সন্দেহ হয় কোথাও কিছু হারিয়ে যাচ্ছে নাতো , নাকি এটাই সময়ের চাহিদা ? তাদের কি দৈত্য দানো , বাঘের উপর টাগ, ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী আছে ? সেই আমাদের যেমন ছিল ? কই ঠাকুরমার ঝুলি বা
উপেন্দ্রকিশোরের টুন টুনির গল্প , এসব তো তারা বিশেষ পড়ে বলে শুনি না ? আবার, বই বাচ্চারা পড়ে না এমনও
তো নয়। তারা সবাই হ্যারী পটার-এর মস্ত বিশাল আকৃতির বইগুলি
তো গোগ্রাসে পড়ছে , একটার পর একটা। জিজ্ঞেস করে দেখুন যেকোনো
বাচ্চাকে দেখবেন কি উত্সাহ নিয়ে পটর পটর কি সুন্দর গল্প গুলি বলে দিচ্ছে। ইংরাজি শিক্ষা আর ইংরাজি
ভাষায় বিশ্বপরিচয়ের সঙ্গে
সঙ্গে শৈশবের ফ্যান্টাসি গুলিও দ্রুত আর পুরোপুরি পাল্টে যাচ্ছে ।
মার্কেটিং-এর কামাল এগুলো। ইংরাজির মাধ্যমে তারা বিশ্বপরিচয় শিখছে, ইংরাজি ও
হিন্দির মাধ্যমে তারা যোগাযোগ শিখছে । ইংরাজি স্বাভাবিক কারণে বিশ্বভাষায় পরিনত
হয়েছে, হিন্দির বেলায় রাষ্ট্রশক্তি
তার পেছনে । হিন্দির গুরুত্ব ব্রিটিশ আমলে
তেমন ছিল না।আজ রাষ্ট্রশক্তি হিন্দির পেছনে বলে হিন্দি বাড়তি অনেকগুলি সুযোগ – সুবিধা পাচ্ছে।বাংলা রাষ্ট্রের পৃষ্টপোষকতায় নেই বললেই চলে।
হিন্দুধর্মের মূল প্রাণকেন্দ্র যে অঞ্চলটায় রয়েছে সে’ অঞ্চলটাই হিন্দি বলয়। এ’ অঞ্চলে ভ্রমণ পিপাসু ও ধার্মিক বাঙালির ঢল সবসময়েই ছিল। অবশ্য আজকাল বাঙালির তীর্থক্ষেত্রে যাওয়ার
প্রবনতা অনেকটা কমেছে।ধর্ম আপামর মানুষের পরম মানসিক আশ্রয়।ওই অঞ্চলে যাতায়াতের
ফলে কোননা কোন রকমে হিন্দিতে কথাবলা বাঙালিরাও কিছু না কিছু আয়ত্ত করেছে। এও এক কারণ হিন্দি নানা ভাষীক
মানুষের মধ্যে সংযোগের ভাষা হিসেবে উঠে
আসার। বর্তমানে হিন্দির রাষ্ট্রীয় দপ্তরী ভাষার স্বীকৃতি, কোটি কোটি টাকার অনুদান,
কেদ্রিয় মদতে প্রচার-প্রসার, হিন্দির ওপর বিশেষ পৃষ্টপোষকতা হিন্দির জীবনীশক্তি
হাজার গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।হিন্দি এখন বিশেষ প্রয়োজনীয় ভাষা হিসেবে স্থান পাচ্ছে।
বাংলা না শিখে শুধু মাত্র হিন্দির সাহায্যে একজন সারা জীবন বাংলা মুলুকে বাস করতে
পারবে। ফলে বাংলার মত রেনেসাঁ ভাষাও মার খেতে বাধ্য। ভাষার প্রাধান্যতাই তো ভাষাকে
রক্ষা করে, ভাষার বৃদ্ধি ঘটায়। আজ বাংলার প্রধান্যতা বাংলা মুলুকেই ক্ষীণ—এ-ই হচ্ছে মুশকিল।
ব্রিটিশ আমলে কোনও ভারতীয় ভাষাই রাষ্ট্রীয় প্রাধান্যতা পায়নি। রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা
ছাড়াই ভারতীয় উপমহাদেশের সকল ভাষার পথীকৃৎ হয়ে ওঠল বাংলা।আজ বাংলা
রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিতে মনিপুরি, বড়, অসমীয়া, পাঞ্জাবি ইত্যাদি ভাষার সমতুল্য। আজ বাংলা
রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে আঞ্চলিক ভাষা। নিজ গুনে যে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেয়েছিল
বাংলা, আজ সে মর্যাদা বাংলার নেই। রাষ্ট্র শক্তি
পেছনে না দাঁড়ালে বাংলা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেতে পারেনা।
ইতিবাচক দিকও রয়েছে, যেমন--ভারতের জাতীয় সঙ্গীত
বাংলায়, বাংলাদেশের তো আছেই। সিয়েরা লিয়নে বাংলা অন্যতম সরকারি ভাষা। আমেরিকায় নির্বাচনী প্রচারে বাংলাদেশী এবং ভারতীয় অভিবাসী বাঙালীদের জন্য বাংলাভাষায়
প্রচার থাকছে। শিকাগো, নিউ ইয়র্কে বাংলা নামের সাইন বোর্ড অব্দি আছে
দোকানে দোকানে-- ঢাকা মিষ্টান্ন ভান্ডার, সুরুচি,গুলশন কাফে ইত্যাদি।
ব্রিটেনের শিক্ষা ব্যবস্থায় বাংলা ঐচ্ছিক ভাষা হিসেবে অন্তরভুক্ত।অবশ্য, এ’ সবের সৌজন্যে
বাংলাদেশ। কলকাতা আর বাংলাভাষার প্রথম বিশ্ব নয়।
2
বিবিসির জরিপ অনুযায়ী বর্তমান সময়ে পৃথিবীতে ছয় হাজারের মতো
মাতৃভাষা আছে। যার মধ্যে ৫০০ থেকে এক হাজার ভাষা প্রায় বিলুপ্তির পথে। প্রতিবছর
হারিয়ে যাচ্ছে ২৫টির মতো ভাষা। অর্থাৎ প্রতি ১৪ দিনে একটি করে মাতৃভাষা
এই পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। ভাবতেই কেমন
লাগে! প্রতি ১৪ দিন পর কেউ নিজেকে প্রকাশের জন্য হারিয়ে যাওয়া সেই ভাষাটিকে আর
ব্যবহার করবে না। অথচ একদিন এই ভাষাতেই শিশু তার মাকে মা বলে ডেকেছে, বাবা সন্তানের প্রতি প্রকাশ
করেছেন তাঁর ভালোবাসা৷ প্রেমিক-প্রেমিকা চোখে চোখ রেখে সরব কিংবা নীরব উচ্চারণে এই
ভাষাতেই প্রকাশ করেছে প্রাণের আবেগ।
প্রশ্ন হচ্ছে, মাতৃভাষা বিলুপ্তির এই প্রবহমান ধারায় আমাদের বাংলাভাষা কতটা শক্ত
অবস্থানে আছে? আশা করা যায় বাংলাদেশের ১৬ কোটি আর পশ্চিমবঙ্গের নয় কোটি এবং
বাকী ভারতবসের নানা যায়গায় ঘন বসতিপুরন বসবাসকারি মানুষের মাতৃভাষা যত দিন বাংলা থাকবে, তত দিন সেই আশঙ্কা নেই। ভারতে
সমাজের একটি শ্রেণির ইংরেজি ভাষার প্রতি ক্রমবর্ধমান প্রীতি আর
সরকারিভাবে মাতৃভাষার পৃষ্ঠপোষকতার অভাব রয়েছে। বাংলা অধুয়সিত এলাকার বাইরে বাঙ্গালিকে এবং
অন্যান্য ভাষাভাষী প্রতিটি মানুষকেই শিক্ষাক্ষেত্র থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্র—প্রতিটি জায়গায় ইংরেজি ও হিন্দিতে নিজেকে প্রকাশ করতে হয়। অভিবাসী
বাংলাভাষী মূলত অস্তিত্বের সংকটের সঙ্গে ভাষার সংকটেও পড়ে। ইংরেজি
বলার দক্ষতা আয়ত্ত করতে না পারার ব্যর্থতা ঢাকতে তাই অনেকেই বাসায় তার স্কুলগামী
শিশুসন্তানটির সঙ্গে বাংলায় কথা বলার অভ্যাস পরিত্যাগ করেন। অনেকেই
আবার এই শঙ্কায় ভোগেন যে, তাঁর সন্তানটি যে চমৎকার ইংরেজি ও হিন্দিতে কথা বলে, তাকে বাংলা শেখানোটা নেহাত
বোকামি হয়ে যাবে।
পৃথিবীর যে কোন ভাষার
বিকাশ ঘটেছে মধ্যবিত্তের হাতে ; আবার মধ্যবিত্তের উপেক্ষা ও অনীহা সে ভাষার
মৃত্যুও ডেকে এনেছে।
নতুন সহস্রাবব্দে বিগত
দশ-এগারো বছরের কথা ধরা যাক:
১. আপনার সন্তান আমার
সন্তান কোন স্কুলে ভর্তি হয়েছে ?
২. আমাদের সন্তানরা কি
ঠিকভাবে বাংলা বলতে ও পড়তে পারছে ? প্রথম প্রশ্নটির সাধারণ উত্তর : ইংরেজি মাধ্যম
স্কুলে। দ্বিতীয় প্রশ্নটির
সাধারণ উত্তর : ওরা আসলে ইংরেজিতেই বেশি ‘কমফোর্ট ফিল’ করে।
দ্বিতীয় প্রশ্নটির আরও
একটি উত্তর : ওরা হিন্দিতেও বেশ ভালো। কিছু উল্লেখযোগ্য
ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই রয়েছে।
এই পরিবর্তিত অবস্থাটির
জন্য সন্তানদের দোষারোপ করা অর্থহীন। কোন স্কুলে ভর্তি হবে, কোন বই পড়বে শৈশবের এই
সিদ্ধান্তগুলো তাদের নিজেদের নেওয়া নয়। কাজটা আমরাই করেছি।
নিজেদের কাজের সমর্থনে
পর্যাপ্ত যুক্তি আমাদেরও আছে। যুক্তিগুলো যথেষ্ট
যুক্তিসম্মতও। ইংরেজি ও হিন্দি জানা
প্রার্থী চাকরিতে ও পদোন্নতিতে অগ্রাধিকার পান।
কিন্তু ভালো বাংলা জানা
প্রার্থীর অগ্রাধিকার রয়েছে এমন কোন চাকরির বিজ্ঞাপন গত চল্লিশ বছরেও চোখে পড়েনি, কিংবা ভালো বাংলা জানা
প্রার্থী পদোন্নতিতে অগ্রাধিকার পেয়েয়েন তাও শুনিনি।
মানি বা নাই মানি
জীবনের প্রায় সকল কর্মকাণ্ডের চালিকাশক্তি অর্থ উপার্জনের সক্ষমতা।
বাংলা ভাষা অর্থ
উপার্জনে কোন ভাবেই সহায়তা করছে না ।
সমাধান--
ভারতীয় সংবিধানে বাংলাভাষার আঞ্চলিক অবস্থানের অতিরীক্ত একটি মূল্যবান স্থান জুড়ে
দেওয়া চাই,কারণ এ বাংলার তা প্রাপ্য।এ’করে
নিতে পারলে বাংলার কেন্দ্রীয় আর্থিক সহায়তা অনেকগুণ বেড়ে যাবে, একই সাথে
বাড়বে বাংলার প্রায়োগিক ক্ষেত্র, বাড়বে বানিজ্যিক মূল্য। বাংলা আগের লিঙ্গুয়া
ফ্রাঙ্কাও অনেকটাই ফিরে পাবে।বাংলার
দুর্গতির জন্য দায়ী বাঙালি।বাঙালির
জনসংখ্যা সমেত বাংলাজানা মানুষের জনসংখ্যা একা এই
ভারত ভূখণ্ডে দ্বিতীয়।সুতরাং এর একটা সাংবিধানিক সুবিধাজনক সুযোগ পাওয়া বাঞ্ছনীয়। ভারতীয় সংবিধানে বাংলা আঞ্চলিক ভাষা মাত্র।
এখানটায়ই মুশকিল।আমাদের জাতীয় সঙ্গীত বাংলায়, অথচ সংবিধানে বাংলা আঞ্চলিক ভাষা—এর নজির পৃথিবীতে নেই।
----------------------------------------------------------
বাংলার মার্গ সঙ্গীতের উৎস ও কীর্তনে রূপান্তর
--সমরবিজয় চক্রবর্তী
বাংলা ভাষা ও সঙ্গীতের প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদ এবং চর্যারগানগুলো রাগাশ্রিত। বর্তমান
কালের বাংলা গানের স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও আভোগ এই চার কলির পরিবর্তে সেকালে ছিল উদ্গ্রাহ, মেলাপক, ধ্রুব ও আভোগ। এগুলিকে
বলা হতো ধাতু। এই চারটি ধাতুর মধ্যে উদ্গ্রাহ ও ধ্রুব সব গানেই থাকত, অন্য দুটি বাধ্যতামূলক ছিল না। তাই
একটি ধাতু বর্জিত হলে সেই গানকে বলা হতো ত্রিধাতুক, আর দুটি বর্জিত হলে দ্বিধাতুক। সাধারণভাবে
সঙ্গীতকে তখন প্রবন্ধগীত বলা হতো। মেলাপকবর্জিত বলে চর্যাগুলি ত্রিধাতুক
প্রবন্ধগীত।
চর্যাগীতিগুলি যেসব রাগ-রাগিণীতে গাওয়া হতো সেগুলি হলো পটমঞ্জরী, মল্লারী, গুর্জরী, কামোদ, বরাড়ী, ভৈরবী, গবড়া, দেশাখ, রামক্রী, শবরী, অরু, ইন্দ্রতাল, দেবক্রী, ধানশ্রী, মালসী, মালসী-গবড়া ও বঙ্গাল রাগ। এর
সঙ্গে পটহ বা ঢোল এবং একতারা বাদ্যযন্ত্র হিসেবে
ব্যবহূত হতো।
চর্যাগীতিগুলি মুখ্যত বৌদ্ধ সহজিয়াদের সাধনপদ্ধতিমূলক গান। বৌদ্ধধর্মাবলম্বী
পালরাজাদের সময় চর্যাগীতি বাংলায় বিস্তার লাভ করে।পরবর্তীতে
চর্যাগীতির অনুসারী হয়ে আসে জয়দেবের গীতগোবিন্দম। দ্বাদশ শতকে সংস্কৃত ভাষায় রচিত গীতগোবিন্দম্ কাব্যগ্রন্থ হিসেবে
যেমন আদৃত, তেমনি সঙ্গীতশৈলীর একটি নিদর্শন হিসিবেও সমাদৃত। জয়দেব ছিলেন রাজা লক্ষ্মণসেনের
সভাকবি। তাঁর রচিত পদগুলিতে কাব্য ও সঙ্গীতের অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে, যা বাংলা সঙ্গীতের একটি
প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই পদগুলি রাধাকৃষ্ণের লীলাকে কেন্দ্র করে রচিত। গীতগোবিন্দম্
বিভিন্ন চরিত্রের উক্তি-প্রত্যুক্তি সমন্বিত নাট্য লক্ষণাশ্রয়ী কাব্যগ্রন্থ। আবার
বাংলাদেশে শুদ্ধস্বরের বিভাস রাগ আছে, যা লোকসুরে বিশেষভাবে প্রচলিত। গীতগোবিন্দম্-এ
যেসব তালের উলেখ আছে, বাংলা কীর্তনে এখনও তার পরিচয় পাওয়া যায়।
গীতগোবিন্দম্-এর দুটি প্রধান গায়নরূপ প্রচলিত ছিল একটি ধ্রুপদাঙ্গ, অন্যটি কীর্তনাঙ্গ। তবে
গীতগোবিন্দম্ প্রধানত ধ্রুপদাঙ্গেই গীত হতো। বঙ্গদেশে
গীতগোবিন্দম্ল-এর প্রভাব বিলুপ্ত হওয়ার পর শ্রীচৈতন্যের প্রভাবে কীর্তনান্দোলন
শুরু হয় এবং তাঁর অনুসারীরা কীর্তনাঙ্গে জয়দেবের গীতগোবিন্দম্ গাইতে থাকে। ফলে
গীতগোবিন্দম্-এর পদগুলি কীর্তনে পরিণত হয়। এভাবে বাংলা
কীর্তন গানে গীতগোবিন্দম্-এর গভীর প্রভাব পড়ে।
বাংলা সঙ্গীতকলার উৎকৃষ্ট নিদর্শন বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। গ্রন্থটি
কাব্যসঙ্গীত এবং গীতিনাট্য উভয় দিক থেকেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর
মধ্যে নৃত্যেরও পরিকল্পনা ছিল বলে মনে করা হয়। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে
মোট পদের সংখ্যা ৪১৮। প্রতিটি পদে সুর, তাল ও গায়নরীতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ছন্দেরও বৈচিত্র্য রয়েছে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের
রচনাকাল যেমন চর্যাগীতি ও লোচনদাসের ধামালি রচনার মধ্যবর্তী, তেমনি এর ছন্দরীতিও প্রাকৃত ও বাংলা-প্রাকৃত রীতির
মধ্যবর্তী। সাঙ্গীতিক পরিভাষায় শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বিপ্রকীর্ণ জাতীয় গীতরূপ। দুটি
গ্রাম্য গোপ বালক-বালিকার প্রণয়কাহিনী অবলম্বনে এটি রচিত। এতে
গ্রামের পথঘাট, বনাঞ্চল এবং গ্রাম্যজীবনের এক স্বাভাবিক চিত্র ফুটে উঠেছে। তিনটি
চরিত্র রাধা, কৃষ্ণ ও বড়াইর ছন্দোবদ্ধ উক্তি-প্রত্যুক্তির মধ্য দিয়ে কাহিনীটি
বর্ণিত হয়েছে। অনেকের ধারণা, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মধ্যে বাংলার ঝুমুর গান ও লোকযাত্রার বীজ নিহিত।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে মোট ৩২টি রাগ-রাগিণীর উলেখ আছে। সেগুলি
হলো আহের, ককু, কহু, কহু গুর্জরী, কেদার, কোড়া, কোড়া দেশাগ, গুর্জরী, দেশ বরাড়ী, দেশাগ, ধানুষী, পটমঞ্জরী, পাহাড়ী, বঙ্গাল, বঙ্গাল বরাড়ী, বরাড়ী, বসন্ত, বিভাস, বিভাস কহু, বেলাবলী, ভাটিয়ালী, ভৈরবী, মলার, মালব, মালবশ্রী, মাহারঠা, রামগিরি, ললিত, শৌরী, শ্রী, শ্রীরামগিরি ও সিন্ধোড়া। যেসব তালের
পরিচয় পাওয়া যায় সেগুলি হলো যতি, ক্রীড়া, একতালী, লঘুশেখর, রূপক, কুড়ুক্ক ও আঠতালা। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে ব্যবহূত ‘শৌরী’ রাগ সম্ভবত চর্যায় ব্যবহূত ‘শবরী’ রাগের অপভ্রংশ। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে
ব্যবহূত কয়েকটি রাগ-রাগিণীর পরিচয় প্রাচীন সঙ্গীতশাস্ত্রে পাওয়া যায়, যেমন আহের (আভীর), কহু (ককুভ), রামগিরি (রামক্রি), ধানুষী (ধানশ্রী), দেশাগ প্রভৃতি।
গীতগোবিন্দম্-এ যেসব রাগ-রাগিণীর উলেখ আছে তার পরিচয়
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেও পাওয়া যায়। তবে গীতগোবিন্দম্-এ পটমঞ্জরী রাগে রচিত
পদের সংখ্যা অধিক, আর শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে পাহাড়ী রাগে রচিত পদের সংখ্যা অধিক, যা গীতগোবিন্দম্ল -এ নেই। গীতগোবিন্দম্ল
-এ যেসব তালের উলেখ আছে তার পরিচয় শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেও পাওয়া যায়, যেমন যতি, রূপক ও একতালি। শুধু
সাঙ্গীতিক দিক দিয়ে নয়, রচনাশৈলী এবং আঙ্গিকের দিক দিয়েও উভয় কাব্যের মধ্যে সাদৃশ্য
লক্ষ্য করা যায়। এক কথায় শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে জয়দেবের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে।
বাংলা সঙ্গীতের ক্ষেত্রে বিদ্যাপতি র দান অপরিসীম। তাঁর
পদাবলি মৈথিলী ভাষায় রচিত হলেও একসময় তা বাংলায় খুব জনপ্রিয় ছিল। বৈষ্ণবপদাবলি
তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা। তাঁর পদাবলিতে যেমন আছে ভক্তিরস, তেমনি আছে মানবিক প্রেম। পরবর্তীকালের
গীতিকবিরা তাঁকেই অনুসরণ করেছেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাপতির ভক্ত ছিলেন। তিনি
বিদ্যাপতির অনেক পদ সুরসংযোগে গাইতেন। বিদ্যাপতি রচিত ‘ভরা বাদর মাহ বাদর’ পদটিতে রবীন্দ্রনাথ সুরারোপ
করেছেন।
বৈষ্ণবপদাবলি রচনার ক্ষেত্রে বিদ্যাপতি জয়দেবের অনুসারী ছিলেন। সেজন্য
বিদ্যাপতিকে ‘অভিনব জয়দেব’ বলা হতো। আবার বিদ্যাপতির এক শতাব্দী পরে বাংলার বৈষ্ণবকবি গোবিন্দ দাস
বিদ্যাপতির পদাঙ্ক অনুসরণ করতেন বলে ‘দ্বিতীয় বিদ্যাপতি’ নামে খ্যাত হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ গোবিন্দ দাসেরও ভক্ত ছিলেন। গোবিন্দ
দাস রচিত ‘সুন্দরী রাধে আওয়ে বনি’ পদটিতে রবীন্দ্রনাথ সুরারোপ করে ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীতে
অন্তর্ভুক্ত করেছেন। বিদ্যাপতির পদগুলি শব্দমাধুর্য ও সুরলালিত্যে অপূর্ব। বাংলার
কীর্তনীয়ারা তাঁর পদসমূহ রসকীর্তন ও পালাকীর্তনের অন্তর্ভুক্ত করে তাঁকে অমর করে
রেখেছেন।
সামগ্রিকভাবে বাংলার ধর্ম, সমাজ, সংস্কার ও মননে বৈষ্ণবপদাবলির
প্রভাব অপরিসীম। এর প্রভাবে বাঙালির মানবতাবোধ উজ্জীবিত হয়। বৈষ্ণব
মতবাদের প্রভাবে সহজিয়া ও বাউল মতবাদ পরিপুষ্ট হয়; শাক্ত সম্প্রদায়ে ভক্তিবাদ
প্রবল হয়ে ওঠে এবং বাৎসল্য রসাশ্রিত শাক্তপদাবলি রচিত হয়। বৈষ্ণবরাই
বাংলা গীতিকবিতা রচনা এবং অলঙ্কার ও দর্শনশাস্ত্রের আলোচনার সূত্রপাত করেন। প্রেমানুভূতি
এবং ভাবের সূক্ষ্ম ও বিচিত্র অভিব্যক্তির কারণে বৈষ্ণবপদাবলি বিশ্বসাহিত্যের
মর্যাদা লাভ করে।
রবীন্দ্রনাথের ভাষায়: ‘কীর্তনে আমরা যে আনন্দ পাই সেতো অবিমিশ্র সঙ্গীতের আনন্দ নয়, তার সঙ্গে কাব্যরসের আনন্দ
একাত্ম হয়ে মিলিত।’ চৈতন্যোত্তর যুগে বাংলা ও
ব্রজবুলিতে প্রায় দশ হাজারের মতো পদ রচিত হয়েছে। বৈষ্ণবপদাবলির
শ্রেষ্ঠ পদকার হলেন বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস, গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাস, মালাধর বসু, শেখ ফয়জুল্লাহ, সৈয়দ সুলতান, বলরাম দাস, লোচন দাস, বাসুদেব ঘোষ, মুরারি গুপ্ত, নরহরি দাস, নরোত্তম দাস প্রমুখ।
বঙ্গদেশে প্রাচীনকাল থেকেই কীর্তন বা ঈশ্বরের নামগান করার প্রচলন
ছিল। বৌদ্ধরাও চর্যাগান করত, যা কীর্তন গানেরই অনুরূপ। ঈশ্বরের নাম, লীলা ও গুণের উচ্চভাষণই
কীর্তন। এই কীর্তনের বিশিষ্ট রূপ দেন চৈতন্যদেব। তিনি
কীর্তনকে দুটি পদ্ধতিতে ভাগ করেন নাম-সংকীর্তন ও রসকীর্তন বা লীলাকীর্তন। কীর্তনের
পাঁচটি অঙ্গ কথা, দোঁহা, আখর, তুক্ ও ছুট্। কীর্তনের অপর একটি অঙ্গ হলো ঝুমুর। বাংলা
লোকসঙ্গীত এবং আধুনিক গানে ঝুমুরের প্রভাব লক্ষ করা যায়। কাজী নজরুল ইসলাম ঝুমুর সুর ব্যবহার
করেছেন তাঁর বিভিন্ন গানে, যেমন ‘চুড়ির তালে নুরির মালা’, ‘তেপান্তরের মাঠে বঁধু হে’, ‘রাঙামাটির পথেলো’ প্রভৃতি।
কীর্তন উদ্গ্রাহ, মেলাপক, ধ্রুব ও আভোগ অনুসারে রচিত, অর্থাৎ আধুনিক কালের
সাঙ্গীতিক পরিভাষায় স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও আভোগ এই চার কলিতে নিবদ্ধ। কীর্তনে
যেসব তালের পরিচয় পাওয়া যায়, প্রাচীন সঙ্গীতগ্রন্থে তার উলেখ আছে। তালগুলি
দক্ষিণী সঙ্গীত এবং বাংলা কীর্তনে এখনও প্রচলিত। তালগুলি
হচ্ছে ধ্রুবতাল, শ্রুতিতাল, রুদ্রতাল, বৃক্ষতাল, জপতাল প্রভৃতি। জয়দেবের গীতগোবিন্দম্ল -এর তাল এবং
পরবর্তী কীর্তনের তাল প্রায় একই।
ষোলো শতকের শেষদিকে কীর্তন গান সারা বাংলায় বিস্তার লাভ করে। এ
সময় কীর্তনের চারটি শাখা গড়ে ওঠে গরাণহাটি, মনোহরশাহী, রেনেটী ও মন্দারিণী। এগুলির
মধ্যে মনোহরশাহী কীর্তনের প্রভাব ছিল সর্বাধিক। আঠারো-ঊনবিংশ
শতাব্দীতে সমগ্র বাংলায় প্রধানত এই কীর্তনই প্রচলিত ছিল। কবিগান ও আধুনিক পাঁচালিতেও মনোহরশাহী
কীর্তনের প্রভাব পড়েছে।
কীর্তন ভেঙে বাংলায় ঢপকীর্তনের সৃষ্টি হয়। মুর্শিদাবাদের
রূপচাঁদ অধিকারী (১৭২২-১৭৯২) ও বনগ্রামের (যশোর) মধুসূদন কিন্নর (মধুকান) রচিত ঢপকীর্তন
এক সময় অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। আখরবিহীন এই ঢপে পাঁচালি ও যাত্রাগানের
প্রভাব সুস্পষ্ট। ঢপকীর্তনে সাধারণত তিন, চার, পাঁচ ও সাত মাত্রার তাল ব্যবহূত হয়। শাস্ত্রীয়
উচ্চাঙ্গ কীর্তনের মতো দশকোষী, আড়, লোফা প্রভৃতি জটিল তালের ব্যবহার এতে নেই। রবীন্দ্রনাথের
বেশ কিছু কীর্তন-অঙ্গের গানে ঢপকীর্তনের ভাব ও রীতির অনুসরণ দেখা যায়। ‘ওকে বলো সখী বলো, কেন মিছে করে ছলো’ মায়ার খেলার এই গানে মধুকানের স্পষ্ট প্রভাব রয়েছে। মধুকান
রাধা-কৃষ্ণলীলা অবলম্বনে বহু পদ রচনা করেন এবং সেগুলি রাগ-রাগিণী সহযোগে গীত হতো।
এ কথা দ্বিধাহীনভাবে বলা যায় যে কীর্তনে শ্রীহট্টাঞ্চলের অবদান
অপরিসীম। শুধুমাত্র সরকারের কোনও দৃষ্টি শ্রীহট্টাঞ্চলের কীর্তনে নেই বলে এই
অঞ্চলের “ছুটা কীর্তন” যার এক অন্য ধরণ রয়েছে তা ক্রমশ হ্রাস হওয়ার পথে। সিলেট
রেফারেন্ডামের পর কীর্তনের সমৃদ্ধ অঞ্চলটি পূর্ব পাকিস্তানে চলে যায় আর যে অংশ
ভারতে রয়েছে সে অঞ্চলে উদ্বাস্তু হয়ে আসতে হয় সিলেটি বাঙালিদের।বাঁচার লড়াইয়ে এঁরা
ব্যতিব্যস্ত। সুতরাং কীর্তন হারায় তার সৌকর্য ও মাধুর্য।সরকারি সাহায্য ব্যতিরেকে
এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ কীর্তনের উত্তরোত্তর উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ, টিকে থাকাই
তো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।উল্লেখ্য, “কীর্তনাশ্রয়” নামে এক সংস্থা এক্ষত্রে তার কাজ করে চলেছে।এ অঞ্চলের ঠাট কীর্তনে
রয়েছে মার্গ সঙ্গীতের উপাদান।কীর্তন সঙ্গীত শিক্ষার অন্তর্ভুক্তি করা প্রয়োজন বলে
এই নিবন্ধক মনে করেন।
চর্যাপদের পর থেকে কীর্তনের ধারাবাহিক আলোচলা মাত্র কয়েক শব্দে ধরে
রাখা যায় না,আর স্মরণিকা গবেষণামূলক বিস্তারিত লেখার ক্ষেত্র নয় বলে এক চামচ
বীক্ষণ শুধু করা হল,আলোকপাত মাত্র।
ভারত কবে উন্নত দেশ হবে
সমরবিজয় চক্রবর্তী
স্বাধীনতার ৭৪বছর পরও ভারত উন্নত দেশ হল না।স্বভাবতই
প্রশ্ন জাগে উন্নত হতে আর কত বাকি?আমরা কি এগোচ্ছি, না
পিছুচ্ছি?কেন এখনও পর্যন্ত উন্নত দেশ হওয়ার স্বীকৃতি অর্জন
করতে পারলাম না?আর কত বছর উন্নয়নশীল হয়ে থাকব?হামেশাই
শোনা যায় ভারত বুঝি সুপার পাওয়ার হতে চলেছে।অবশ্য সুপার পাওয়ার এক আর উন্নত
রাষ্ট্র আর এক।সুপার পাওয়ার হতে হলে উন্নত দেশ হতে হবে তা নয়।প্রথম বিশ্বের ধারণার
সঙ্গেও উন্নত রাষ্ট্রের সূত্রে বিভেদ রয়েছে।
বিশ্বের উন্নত দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে হলে
আর্থিক স্বচ্ছলতা চাইই,
অর্থনীতির ভাষায় গ্রস ডমেস্টিক প্রোডাক্ট(জিডিপি),মোট
দেশজ উৎপাদন। কিন্তু, তার চেয়েও বড় বিষয় হল দেশের মানুষের সার্বিক উন্নয়ন।
তাই উন্নত দেশের তালিকা ঠিক করা হয় মানব উন্নয়ন সূচক বা হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট
ইনডেক্স-এর মাধ্যমে।অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে শীর্ষ সারিতে না থেকেও মানব
কল্যাণের দিক থেকে নরওয়েকে পৃথিবীর সবচাইতে উন্নত দেশ হিসাবে ধরা হয়।
মানব উন্নয়ন সূচক (এচডিয়াই) হল
আয়ু, শিক্ষা এবং আয় সূচকের একটি সমন্বিত পরিসংখ্যান। পাকিস্তানি
অর্থনীতিবিদ মাহবুব-উল-হকের মস্তিষ্কপ্রসূত এই এচডিয়াই।১৯৯০ সালে নোবেল বিজয়ী
অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন একই মত পোষণ করেন এবং জাতিসংঘ তা গ্রহণ করে।অদৃষ্টের কী
পরিহাস!ভারত এবং পাকিস্তান উভয় দেশই জাতিপুঞ্জ
স্বীকৃত মানব উন্নয়ন সূচক দেশগুলোর তালিকায় আজও অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেনি।এচডিয়াই পাকিস্তানকে ১৪৬ নম্বরে স্থান দিয়েছে, ভারত
১৩১ এবং বাংলাদেশ ১৩৩।
নিচে উল্লেখিত দেশগুলোকে উন্নত দেশ হিসেবে গণ্য করা
হয়।জিডিপি তাদের উন্নত,
উন্নত তাদের এচডিআইও।অর্থাৎ মানুষকে ভালভাবে বেঁচে
থাকার জন্য যে অর্থের প্রয়োজন এবং তার সাথে জড়িত সুখ ও শান্তির পরিবেশ সৃষ্টিকারী
পরিসেবা তা এই দেশগুলোতে রয়েছে।
বেলজিয়াম,কানাডা,ডেনমার্ক,ফ্রান্স,জার্মানি,গ্রীস,আইসল্যান্ড,ইতালি,লুক্সেমবার্গ,নেদারল্যান্ডস,নরওয়,পর্তুগাল,স্পেন,তুরস্ক,মার্কিনযুক্তরাষ্ট্র,ইউনাইটেড কিংডম,ইজরায়েল,জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া,অস্ট্রেলিয়া,নিউজিল্যান্ড,অস্ট্রিয়া,আয়ারল্যান্ড,সুইডেন,সিঙ্গাপুর
এবং সুইজারল্যান্ড।
ব্রিটিশ আসার আগে পুরো বিশ্বের ১২% জিডিপি এবং পুরো
ভারতের ৫০% জিডিপি ছিল বাংলার।অবশ্য আজকের মানবতার মান উন্নয়নের নিরিখে জীবনের মান
উন্নত ছিল না।চিন বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্র, তা
স্বত্বেও জাতিসঙ্ঘ কিন্তু চিনকে উন্নত দেশ হিসাবে গণ্য করছে না এবং এর কারণ
এইচডিআইর পরিমাপে চিন উন্নতশীল।ঠিক সে রকম রাশিয়া, বাহেরিন, দুবাই
এবং সৌদি আরবও।আবার তুরস্ক নয়,
জাতিপুঞ্জের নিরিখে তুরস্ক উন্নত রাষ্ট্র।আবার বিশ্বে
বিশেষ নামী ডাও জোন্স এবং ফিনান্সিয়াল টাইমস স্টক এক্সচেঞ্জ গ্রুপের মতো সংস্থা
তুরস্ককে উন্নত রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিতে
নারাজ।তাদের নিরিখে তুরস্কে মানব কল্যাণ-জনিত কাজকর্ম
যথার্থ নয়।
ভারত এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র,জনসংখ্যায়
বিশ্বে দ্বিতীয়,সামরিক শক্তিতে চতুর্থ,অর্থনীতিতে
বিশ্বের ষষ্ঠ (২০২০ এবং ২০১৯তে পঞ্চম ছিল) এবং বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র। মহাকাশ
গবেষণা,যোগাযোগ,উচ্চশিক্ষা ও
গবেষণা ইত্যাদি ক্ষেত্রে এদেশ গত ৭৪ বছরে
বেশ উন্নতি করেছে।কিন্তু মানবিক দিকটা কষ্টদায়ক বিষাদময়!এর মূল কারণ জন বিস্ফূরণ
আর এই বিপুল অনিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যার জন্য লাগামছাড়া দুর্নীতি আর সাম্প্রদায়িকতা।এই
সাম্প্রদায়িকতায় নিহিত রয়েছে দেশের নিরাপত্তাহীনতার বীজ।মানুষরূপী জানোয়ার
আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও জনকল্যাণমুখী কাজকর্মের বাধা হয়ে দাঁড়ায়।উল্লেখ্য, পশ্চিম
ইউরোপের কয়েকটি জনকল্যাণকামী দেশ,জনকল্যাণকামী অ্যামেরিকা ও কানাডায় বহু সংখ্যক
মানুষরূপী জানোয়ারের অনুপ্রবেশ ঘটায় ঐ দেশগুলো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।এভাবে চললে ঐ দেশগুলোর উন্নতশীল দেশে নেমে পড়ার আশংকা অমূলক নয়।
ভারতে অস্থিরতা, অপরাধপ্রবণতা
লাগামহীনভাবে বাড়ছে।ধর্ষণ,
পাশবিক নির্যাতন,ধর্মের
নামে অকথ্য অত্যাচার আর দাঙ্গা,
রাজনৈতিক হত্যাকান্ড,প্রতিহিংসার
রাজনীতিসহ জঘন্যতম কর্মকান্ড ,পৈশাচিক কায়দায় খুন, শিশু
নির্যাতন, সন্ত্রাসবাদ, মাদক, লুটপাট, দুর্নীতি, মারামারি
আর হানাহানির ছয়লাপ আজ মিডিয়ায় নিরন্তর দেখতে পাই।এসব দেখে-শুনে মানুষের মন কীভাবে
উন্নত হয়!নোংরা রাজনীতির কারণে দেশ এগোতে পারছে না।দুর্নীতিবাজদের অনেকেই ক্ষমতায়
এসে যায়।
অনিরাপত্তা, অনুপ্রবেশ, দেশদ্রোহী
কাজকর্ম এবং পাকিস্তানকে মোকাবিলা করতে গিয়ে ভারতকে বছরে কয়েক লক্ষ কোটি টাকা খরচ
করতে হচ্ছে,এর মধ্যে উন্নয়নের কাজ চালিয়ে যাওয়া অসম্ভবকে সম্ভব
করার সামিল।বসুধৈব কুটুম্বকম,অথিতি দেব ভব,শৃন্বন্তু
বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রার দেশ ভারত,তাহলে এচডিয়াই ১৩১তম অবস্থানে কেন?পার্শবর্তী দুই দেশ বাংলাদেশ আর পাকিস্তান থেকে অবশ্য
ভালো অবস্থানে।উন্নত দেশের নিরিখে অনেক পিছিয়ে।
আসলে সবচেয়ে বড় উন্নয়ন হল মানুষের নৈতিক উন্নয়ন।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন দিয়ে নৈতিক উন্নয়নের মান বিচার হয় না।অর্থ চাই তবে নৈতিক উন্নয়ন
বাদ দিয়ে নয়। এ দু’টো
সমানভাবে এগোলেই ভারত উন্নত রাষ্ট্রের মর্যাদা পাবে। দেশে উপার্জন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান
ও চিকিৎসাসেবা সর্বজনীন হয়নি বলেই সর্বক্ষেত্রে সামাজিক বৈষম্য আজও রয়ে গেছে। খাদ্যের মান ঠিক নেই, ভেজালখাবার
খেয়ে মানুষ দুরারোগ্য রোগে ভুগছে। অনৈতিকতার থাবা সর্বস্তরে প্রসারিত। দেশে
প্রতিদিন যেভাবে অনৈতিকতার হাত প্রসারিত হচ্ছে, তাতে
প্রত্যেকেরই জীবন ওষ্ঠাগত।বলা বাহুল্য, একটা দেশ-জাতির অবনমন তখনই বোঝা যায় যখন
মানুষ মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারায়।
দুর্বিত্তায়ন ও দুর্নীতির মূলে, বোধ
করি, জনসংখ্যার অপ্রত্যাশিত
বৃদ্ধি।জন্ম নিয়ন্ত্রণ একান্তভাবে কাম্য।দেশের আইন ব্যবস্থায়
পরিবর্তন আনা চাই,সবার জন্য সমান আইন হওয়া চাই।দুর্নীতির অন্যতম কারণ
হচ্ছে বেকারত্ব, ঘুষ,
স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবে অদক্ষ, অনভিজ্ঞ
ও অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করা।নির্লজ্জভাবে এসব এদেশে চলছে।
অর্থ এবং শিক্ষা থাকা সত্ত্বেও এ দেশে নুংরা
স্বার্থপর মানুষের অভাব নেই,
তারা রাস্তায় থুথু ফেলে, রাস্তায়
আবর্জনা ফেলে, গাল-গালাজ করে, চেঁচিয়ে
কথা বলে,যেখানে-সেখানে তর্ক জুড়ে দেয়, মানুষকে আঘাত দিয়ে কথা বলে,পেছনে কাঠি নাড়ে, উন্নতশীল
দেশের উন্নতিতে রূপান্তরের অন্তরায় যে এরাও।
মধ্যবিত্ত বাঙালির বেশি প্রয়োজন গয়ংগচ্ছ মানসিকতার
আমূল পরিবর্তন, মনটাকে বৈশ্বিক করা,অন্যকে
দায়ী না করে, অন্যের উন্নতিতে ঈর্শ্বান্বিত না হয়ে নিজের উন্নতিতে মনোনিবেশ
করা।একথা ঠিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র আজ সংকোচিত।দিশেহারা আজ শিক্ষিত যুবকেরা।পশ্চিমবঙ্গ ভারতের গরীব রাজ্যগুলোর মধ্যে একটি। এরাজ্যের মাথা পিছু আয় ১৬০০ ডলার যা বাংলাদেশের থেকেও বেশ
কম( বাংলাদেশের জিডিপি মাথাপিছু হচ্ছে 2222 ডলার )।আর অন্য দিকে ভারতের সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্র
হচ্ছে গোয়া , মাথাপিছু আয় ৬৮০০ ডলার।মোট জিডিপি বিবেচনা করলে
মহারাষ্ট্র সবচেয়ে ধনী প্রদেশ।উল্লেখ্য,উত্তর
পূর্বাঞ্চলের মিজোরাম দেশের অন্যতম প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত, কঠিন
পাহাড়ি ভূখণ্ড,দুর্গম যাতায়াত,তা
স্বত্বেও মানব উন্নতি সূচকে দেশের ২৯টি রাজ্যের মধ্যে অন্যতম আদর্শ স্থানে রয়েছে।
উন্নত বিশ্বের বহু দেশ অর্থনৈতিক উন্নতির চেয়ে নাগরিকদের
নৈতিক মূল্যবোধের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে, যে
মূল্যবোধ মানুষকে পরম মানবিক করে তুলতে পারে।এই প্রেক্ষিতে জাতিসংঘ ধারাবাহিকভাবে ‘ওয়ার্ল্ড
হ্যাপিনেস রিপোর্ট’ প্রকাশ করে। প্রায় দেড় শতাধিক দেশের ওপর জরিপ করে এই
প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। রিপোর্টে ভারতের অবস্থান অনেক পেছনে। মানবিক মূল্যবোধের তুমুল
আকাল চলছে। দেশ যে কবে উন্নতির শিরোপা পাবে!
.............................
বাঙালি জীবনে মহাপ্রভু ও কীর্তনের ঐক্য মহিমা
সমরবিজয় চক্রবর্তী
তুমি তো আজো প্রেমে উন্মন
ভক্ত এঁকেছে প্রভু
আকাশের কেউ
আমি জানি তুমি যে রণে
ভাঙছ বিভেদের দেয়াল
কীর্তনে।
জাতি গঠনে যে সমস্ত উপাদানের প্রয়োজন এর মধ্যে
সঙ্গীতের ভূমিকা গভীর ও বিস্তর।আমরা জানি গান, নাচ,অভিনয়,বাদন—এসব
নিয়ে সঙ্গীত।আর এই সঙ্গীতের মধ্যে বাঙালি জীবনে কীর্তনের স্থান অনন্য আর ‘কীর্তন’ শব্দটার
সংগে জড়িত শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতাদর্শ।
কীর্তন আমাদের ডিএনএ-এর অন্তর্গত।বাঙালির সকল
আঞ্চলিক-ভাষিক-গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে তৃণমূল স্তরে একটা বিষয়ে মিল পাওয়া যায়, সে
হলো কীর্তন।এরকম একটা সর্বগ্রাহ্য মাধ্যম ছাড়া কোনও জাতিই তার জাতিসত্তা টিকিয়ে
রাখতে পারে না।কীর্তন, অবশ্যই সমবেত কীর্তন, বাঙালি
ঐক্যের প্রধান বীজমন্ত্র,অথচ কীর্তন বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের কাছে উপেক্ষিত, খেটেখাওয়া
প্রান্তিক মানুষের কাছে সমাদৃত—কীর্তন তাদের ধর্মীয় আশ্রয়,আবেগিক
আশ্রয়।বাঙালির ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির অন্যতম কারণ কীর্তনের প্রতি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত
বাঙালির উদাসীনতা।আমরা জানি প্রতিটি সমস্যারই সমাধান রয়েছে, এই
সমাধান খুঁজে বেরকরা চাই।সমাধানের খোঁজ পেলেই তো আর হয় না, তা
কার্যকরী করা চাই।
আজ বাঙালি সর্বত্র দলিত, অথচ
বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্বের জন্ম দিয়েছে এই জাতি। রাজনীতি, ধর্ম, সাহিত্য, সিনেমা,বিজ্ঞান,ইতিহাস, সমাজসংস্কার
সকল কাজে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে।দেশপ্রেমের জুড়ি বাঙালির মতো এ দেশে আর কে আছে?—বিশেষ
করে ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবে বাঙালি সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্বের
অন্যতম বর্বরোচিত আন্দামানের সেলুলার জেলে সংখ্যা গরিষ্ঠ ছিল
বাঙ্গালি।বাঙালি(অমুসলিম বাংলাভাষী)র কোনও সন্ত্রাসী দল নেই যে দেশের ক্ষতি করবে,দেশের
ঐক্যে বিঘ্ন ঘটাবে।বাঙালির দেশভক্তি প্রশ্নাতীত(এক দুটা বিরল শ্রেণীর প্রাণী
বাঙালির মধ্যেও রয়েছে—এরা ধর্তব্যে আসতে পারে না, এ
তো সকল জাতি/ গোষ্ঠীর মধ্যেই রয়েছে)অথচ স্বাধীন ভারতে সর্বত্র বাঙালি নানাভাবে মার
খাচ্ছে।আসামে বাঙালি ভাষিক সংখ্যা গরিষ্ঠ হওয়া সত্তেও সে শুধু লাঞ্ছিত নয়, তার
নিরাপত্তা বিঘ্নিত, দাঙ্গা নিপীড়িত, বিতাড়িত।অথচ
গণতন্ত্রে সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষেরই প্রাধান্য থাকার কথা।ত্রিপুরায় শাসন-ক্ষমতায়
থেকেও বাঙালি মার খায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আদি জনগোষ্ঠী রেড ইন্ডিয়ান, অস্ট্রেলিয়ার
আদি জনগোষ্ঠী বুশম্যান—এরা বৃহৎ জনগোষ্ঠীতে প্রায় লীন।কিন্তু বাঙালির কেন
এমন দশা?আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এবং ঝাড়খণ্ডেও বাঙালি
সংখ্যা গরিষ্ঠ।বাঙালির জন্যে পশ্চিম বঙ্গ তো রয়েছেই, পশ্চিম
বঙ্গ ছাড়া আরও চারটা রাজ্যে বাঙালি একক সংখ্যা গরিষ্ঠ।বাঙালির অবস্থা যদি অন্য
কোনও ঐক্যবদ্ধ জনগোষ্ঠীরই হতো তাহলে বাংলাভাষা ভারতীয় সংবিধানে শুধু মাত্র আঞ্চলিক
ভাষা হিসেবে থাকত না, অন্য আর এক মান আদায় করে নিতে পারতো তারা—এরকম
তো এ লিখিয়ের মনে হয়।বাংলা আন্তর্জাতিক ভাষা এবং আন্তর্জাতিক মানের উচ্চ ভাষা, তা
স্বত্বেও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে বাংলা আঞ্চলিক ভাষা—এর
কারণও কিন্তু বাঙালির অনৈক্য আর এই অনৈক্য বাঙালিকে আত্মঘাতী করে তুলেছে।
তথাকথিত বৌদ্ধিক বাঙালির কেউ কেউ নিজেকে বৈশ্বিক বলে
জাহির করতে চায়,নিজের বাড়ির পাশে লোক অভুক্ত, মরছে,সে
কিউবাতে চাল পাঠায়— লোকসমক্ষে গোমাংস খেয়ে নিজেকে অসাম্প্রদায়িক প্রমাণ
করতে চায়,আবার লোকসমক্ষে শুকরের মাংস খায় না। এ রকম বিশেষ
পোশাকি বুদ্ধি-মহলের মানুষ প্রত্যেক জাতি/ জনগোষ্ঠীর জন্যে বিপদজনক। শুধু বিপদজনক
বললে কম বলা হয়—এরা,
এক কথায়,মানুষের শত্রু।
ঐক্যবদ্ধতা যে কোনও জাতির উন্নতির অন্যতম শর্ত।বাঙালি
তার ঐক্যের মূল মানুষটাকে দূরে সরিয়ে রেখেছে।শ্রেষ্ঠ বাঙালি, প্রেমাবতার
বাঙালি,বিপ্লবী বাঙালি, ঐক্যের
বাঙালি, পৃথিবীতে প্রথম অহিংস আন্দোলনের হোতা যিনি, বিশ্বে
শ্রীচৈতন্যদেব বা গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু নামে বিশেষ ভাবে পরিচিত,তাঁর
যথপোযুক্ত স্থান বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের কাছে নেই বললেই চলে।এই বোধকরি আমাদের
সকল সমস্যার মূল।এই জট থেকে বেরোতে পারলে শুধু বাঙালি নয়, বাংলাভাষা, ধর্ম
ও কৃষ্টিতে আশ্রিত সকল জনজাতি/গোষ্ঠী অস্তিত্ত বিপন্নতার হাত থেকে
রক্ষাপাবে।বাঙালি তার জাতিসত্তা বজায় রেখে নানাভাবে উন্নীত হবে। তখন রবি ঠাকুরের, “যুক্ত
করো হে সবার সংগে/ মুক্ত করো হে বন্ধ/ সঞ্চার করো সকল কর্মে, শান্ত
তোমার ছন্দ”—বাঙালি পরিচিতি বজায় রেখে বাস্তবায়িত করতে সক্ষম হবে।
কীভাবে চৈতন্যদেব আমাদের মুসকিল আসান করতে পারেন?যে
সময়ের প্রেক্ষিতে চৈতন্য দেবের আবির্ভাব ঘটে,সেই
প্রেক্ষিত অনুসারে তাঁর অবদানকে ‘চৈতন্য আন্দোলন’ও
বলা হয়। চৈতন্যদেবের আন্দোলনের কারণ স্বধর্ম ও স্বসমাজের সংস্কার সাধনের মধ্য
দিয়ে এক ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠন করা।তিনি একদিকে অভিজাতদের ম্লেচ্ছাচার রোধ করেন, অপর
দিকে নামকীর্তনের মাধ্যমে সর্বসাধারণকে প্রেমধর্মে সমান অধিকার দেন। এ ভাবে তিনি
উচ্চ ও নিম্ন বর্গকে অভিন্ন ধর্মাচরণ ও ভাবাদর্শে পরস্পরের কাছে এনে এক করতে চেয়েছিলেন।
তিনি তখনকার সামাজিক অচলায়তন ভেঙে তাতে মানবতার নবপ্রাণ সঞ্চার করতে চেয়ে ছিলেন
এবং অনেকাংশে সাফল্য লাভ করেওছিলেন।পরবর্তী সময়ে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সৃষ্ট
বৈষ্ণব ধর্ম যা গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম নামে বিধৃত তা নানা ভাবে ত্রুটীযুক্ত হয়ে
ওঠে।কীর্তনের সংগে যুক্ত হয় শ্রীচৈতন্য অনির্দেশিত সময়-সাপেক্ষ জটিল ক্রিয়াকর্মের
ভার,বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীর সৃষ্টি ও তাদের নস্টাচার, নেড়া
মাথা আর শিখার বারবারান্ত নানাভাবে সমাজের একতা আনয়নে বাধ সাধে।ঊনবিংশ শতকে এসে
ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির রুচি বহির্ভূত হয়ে ওঠে শ্রীচৈতন্য-প্রবর্তিত
বৈষ্ণব ধর্ম।
আবার এই বৈষ্ণব ধর্মে আচরিত সঙ্গীত নিঃসন্দেহে
সংস্কৃতির অঙ্গনে এক অনবদ্য সৃষ্টি।এর বীজ বপন হয়েছিল চরয্যা পদে শ্রীচৈতন্যের
জন্মের প্রায় পাঁচশ বছর আগে। শ্রীচৈতন্যের সময়ে এবং পরবর্তী সময়ে ক্রমে তা
পরিস্রূত হতে থাকে।এই সৃষ্টিশীল পরিবর্তন শ্রীচৈতন্যের আন্দোলনেরই ফসল।অন্যভাবে
বলা যায়, তাঁর সৃষ্ট গৌড়ীয় বৈষ্ণববাদের প্রভাবেই এই পরিবর্তন
সম্ভব হয়েছে।আখড়া-মন্দিরে বিকৃত আচরণের মধ্যে এ যে কীকরে সম্ভব তা ভাববার বিষয়—এ
যেন এঁদো পুকুরে পদ্মফুল।
চৈতন্য আন্দোলনের ভিতগাড়া সংকীর্তনে এবং তা একক নয়
একসাথে অনেকে মিলে করতে হয়। এ কথা সত্য বহু প্রচলিত নামসংকীর্তনে বৈচিত্রের অভাব, আবার
তা যতটা ধার্মিক ততটা সংস্কৃত নয় বলে সংস্কৃতিমনা শিক্ষিতের কাছে আবেদন রাখতে
পারছে না।পদাশ্রিত কীর্তনের কথা স্বতন্ত্র। পদনির্ভর কীর্তন রুচিবান শিক্ষিত লোকের
মন ছোঁয়, তবে একক শিল্পীর অনুষ্ঠান তাঁরা পছন্দ করেন, কোরাস
নয়।
আবার বাঙালি মধ্যবিত্ত শুধু মাত্র ধর্ম পালন করার
জন্যে কীর্তন করিয়ে থাকেন এবং তা সমবেত কীর্তন। শ্রাদ্ধ, গৃহ
প্রবেশ,গৃহ শুদ্ধি ইত্যাদি অনুষ্ঠানে বাড়িতে কীর্তন করা হয়,এ
সব অনুষ্ঠানে পদাশ্রিত কীর্তনই বেশি হয়।যাঁরা করেন তাঁরা কিন্তু বাঙালি সমাজের
গায়েগতরে খেটে খাওয়া শ্রেণীর লোক।শিক্ষিত মধ্যবিত্ত গৃহের লোকজন কিন্তু এতে সামিল
হতে দেখা যায় না।তাঁরা শুনেন শুধু।কোনো কোনো বাড়িতে কীর্তনিয়া কীর্তন করছে, কিন্তু
বাড়ির কেউই এতে নেই,শুনতেও কেউ আসে না।
দুই
বিশেষ করে ইস্কন-এর মাধ্যমে আজ কীর্তন বিশ্বজুড়া
স্থান পেয়েছে।ক্রমে তা আরও বাড়ছে বৈ কমছে না।তবে ইস্কনের মাধ্যমে নামকীর্তনের
প্রচারই বেশি করে হচ্ছে ‘যদিও বৈষ্ণব পদাবলী সংখ্যায় বিপুল, ভাবে
গভীর, রূপে সমৃদ্ধ আর আঙ্গিকে শিল্পমন্ডিত।‘
বঁধু তোমার গরবে গরবিনী আমি
রূপসী তোমার রূপে।
হেন মনে করি ও দুটি চরণ
সদা লয়ে রাখি বুকে।।
নয়নের অঞ্জন অঙ্গের ভূষণ
তুমি সে কালিয়া চান্দা।
জ্ঞানদাস কয় তোমার পিরীতি
অন্তরে অন্তরে বান্ধা।।
.................................
রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।
প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।।
হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে।
পরাণ পিরীতি লাগি থির নাহি বান্ধে।।
জগতজুড়া ইস্কন ছাড়াও অন্যান্য আখড়া-মন্দিরে
নামকীর্তনই বেশি করতে দেখা যায়—কদাচিত পদকীর্তন বা পদাশ্রিত কীর্তন।তবে সমবেত কীর্তন
মঞ্চে হয় না।এর কারণ ধর্মাচরণের বাইরে বিনোদনের জন্যে মঞ্চে উপস্থাপনের রীতি এখনো
হয়ে ওঠতে বাকি।এ কাজটা যত তাড়াতাড়ি হবে ততোই জাতির মঙ্গল।
এ কথা অনস্বীকার্য যে শিল্প-বিচারে পদাবলীকীর্তনের
মাত্রা অনেক উপরে।গদ্যে বর্ণনার ভাগটা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র পদ গাওয়াও যেতে
পারে।এতেকরে অনেকেই পদাবলীকীর্তনে সামিল হতে পারেন এবং গানটি অন্যান্য গানের মতো
প্রায় তিন মিনিটের মধ্যে গাওয়া যেতে পারে।রবীন্দ্রনাথ করে দেখিয়েছেন—রবীন্দ্রনাথের
অনেক গান পদকীর্তনের আঙ্গিকে করা।
নামকীর্তনের মতো বাংলা পদআশ্রিত কীর্তনও সমাজের
প্রান্তিক লোকরাই ধরে রেখেছেন,
ধরে রেখেছেন কিছুমাত্র,আঙ্গিক
মাত্র—এর কারণ প্রশিক্ষণের অভাব।অবশ্য নামি-দামি দলের
নেতৃত্বে দেখা যায় রয়েছেন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত কেউ।মোদ্দা কথা, বাঙালি
মধ্যবিত্তের কোনো কীর্তনদল আজ অবধি এই লিখিয়ের চোখে পড়েনি। অথচ এই মধ্যবিত্ত
শ্রেণীই তো সমাজে পরিবর্তন ঘটায়,ভারতের স্বাধীনতা-যুদ্ধের কথা ভাবুন।পৃথিবীর সর্বত্র
আর্থিক-সামাজিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয়-কলা-সংস্কৃতি-সাহিত্য ইত্যাদির পরিবর্তন
মধ্যবিত্তের হাত ধরেই হয়েছে এবং হচ্ছেও। মধ্যবিত্তের কাছে কীর্তন সংস্কৃতি হিসেবে
স্থান না পেলে কীর্তনের কোনো প্রকার শ্রীবৃদ্ধি হবার নয়।শিক্ষিত মানুষের সাহায্য
না পেলে পদকীর্তনের কোন হেলদোল হবার নয়। যা বলার, জাতিসত্তা
রক্ষা ও মজবুদ করার প্রয়োজনে বিশেষ করে পদকীর্তন এবং পদনির্ভর কীর্তন জাতীয় জীবনের
অন্তরগত হওয়া একান্ত আবশ্যক।ধর্মাচরণের বাইরেও তার স্থান থাকা চাই।কীর্তন
সাংস্কৃতিক বিনোদনের বিষয় হিসেবে স্থান পাওয়া জরুরী। বিনোদন ব্যতিরেকে যথার্থ ঐক্য
আসতে পারে না।ভজনে সেই নিছক বিনোদন রয়েছে, রয়েছে
ক্যারল-এ/খ্রিস্টান-ভজনেও।বসার ঘর থেকে শুরু করে শোয়ার ঘর।মঞ্চ।লং রাইডে যেতে যেতে
ভজন শোনা—এই পর্যায়ে কীর্তন আজো নয়।
রবীন্দ্রনাথ যে ভাবে মনিপুরি নৃত্য বিশ্বলোকের কাছে
তুলে ধরেছেন,সে ভাবে কীর্তনের বিশাল সম্ভার সাংস্কৃতিক বিনোদন
হিসেবে আজো পৌঁছেনি।ধর্মকারায় বন্দি থাকলে কীর্তন মানুষের হয়ে উঠবে না,ভক্তের
হয়েই থাকবে।দেখা গেছে ভগবত আশ্রয়ে শিল্প সৃষ্টি হতে পারে,কিন্তু
শিল্পের উত্তর উত্তর শ্রী বৃদ্ধি হতে পারে না।আজকাল কাউকে কীর্তন গান লেখতে শোনা
যায় না।রবিঠাকুর কীর্তনের ব্যাপারেও চেষ্টা করে গেছেন,তবে
এক জীবনে এক হাতে তো সব কিছু করা যায় না, তিনি সূচনা করে
গেছেন, আক্ষেপ করে গেছেন কীর্তনের শুধুমাত্র দেবতা-নির্ভর
অবস্থানের—
“শুধু
বইকুন্ঠের তরে বৈষ্ণবের গান!
পূর্বরাগ, অনুরাগ, মান-অভিমান,
অভিসার,প্রেমলীলা, বিরহ-মিলন,
বৃন্দাবনগাথা—এই
প্রণয়-স্বপন
শ্রাবণের শর্বরীতে কালিন্দীর কূলে,
চারি চক্ষে চেয়ে দেখা কদম্বের মূলে
শরমে সম্ভ্রমে—একি
শুধু দেবতার!
এ সঙ্গীতরসধারা নহে মিটবার
দীন মর্ত্যবাসী এই নরনারীদের
প্রতি রজনীর আর প্রতি দিবসের
তপ্ত প্রেম তৃষা।“
–রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরঃ বৈষ্ণব কবিতা
উল্লেখ্য, গৌড়ীয় কীর্তন
অভয়াচরণ দে(প্রভুপাদ)স্থাপিত ইস্কন-এর আবির্ভাবের কয়েকশ বছর আগেই নিমাই চাঁদের
নদীয়া ছেড়ে বিশেষ করে উত্তর পূর্বাঞ্চলের নানা ভাষীক গোষ্ঠীর মধ্যে তার ডালপালা
ছড়িয়েছিল।ডিমাসা, জয়ন্তীয়া, মনিপুরির মধ্যে
গৌড়ীয় বৈষ্ণবধারা আজো প্রচলিত।মনিপুরের মহারাজা ভাগ্যচন্দ্র বাংলায় বেশ কিছু
বৈষ্ণব পদাবলী রচনাও করে গেছেন।ধর্মের মাধ্যমে বাংলাভাষাও চলে আসে ডিমাসা, জয়ন্তীয়া, মনিপুর
ও ত্রিপুরার (বৈষ্ণববাদ ততটা নয় যতটা ব্রাহ্মণ্য বা যাকে বলা চলে বেদ-অনুসারি
ধর্মাচরণ) রাজ দরবারে।
বলাবাহুল্য,বাঙালির ঐক্যে
কীর্তনের ভূমিকা বিশেষ ক্ষীণ হতে থাকে ব্রিটিশ আমলে ইংরেজি শিক্ষিত মধ্য বিত্তের
আবির্ভাবের পর থেকে।নানাদিক থেকে নিজ ভূমি-সঞ্জাত চালচিত্র,আদর্শ
ও জীবনচর্চায় তাঁরা মুখ ফিরিয়ে রইলেন।আজো তা বজায় রয়েছে।
তিন
সঙ্গীত, নৃত্য, নাটক
ইত্যাদি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অন্তর্গত হয়ে যাওয়ায় উত্তর উত্তর
উন্নতি-বৃদ্ধি-প্রসার লাভ করছে।সঙ্গীতের অন্তর্গত কীর্তন, অথচ
কীর্তনের শিক্ষায়তনে অন্তর্ভুক্তি অতি বিরল।
সব বিষয়েই শিক্ষার প্রয়োজন।প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা
ব্যতিরেকে কোনো বিষয়ই পূর্ণতার পথে এগোতে পারে না।যত দিন না মধ্যবিত্ত শিক্ষিত
ব্যক্তিরা কীর্তনকে তাঁদের পছন্দের সঙ্গীতের তালিকাভুক্ত করবেন,ততদিন
কীর্তন শুধু ধর্মাচরণের বিষয় হয়েই থাকবে।এ কথা এই আলোচনার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে গেছে
যে,মধ্যবিত্ত শিক্ষিত জনেরা কীর্তনকে মেন স্ট্রিম সঙ্গীত
হিসেবে আজো স্থান দিতে পারেননি।
যাক,চাই বৈজ্ঞানিক চিন্তানিষ্ঠ সিলেবাস।চাই স্বরলিপি, মৃদঙ্গের
জন্য বোল-বাণী,কীর্তনের ব্যাপারে এ সব আজো পিছিয়ে।পদকীর্তনের
সাহিত্যিক বিচার মোটামুটি হয়েছে,
হচ্ছেও কিন্তু সঙ্গীতের দিকটা, এক
কথায়, অবহেলিত।কীর্তন নিয়ে সেমিনার, গবেষণা
অনেক দূরের কথা।উল্লেখ্য,
পদকীর্তন এক ধরণের পদনির্ভর কীর্তন।
প্রসঙ্গত, বরাক-সুরমা
উপত্যকার ঠাট কীর্তন চিরতরে বিলুপ্ত হওয়ার পথে—
সরকারি স্বীকৃতি, অনুদান
ও অতি সত্বর শিক্ষার অন্তর্গত করা প্রয়োজন।এ এক উচ্চ কোটির নৃত্য-কীর্তন।একে
হারানো মানে আমাদের জাতি সত্তার একটা স্তম্ভের বিলুপ্তি।সময়ের দাবিতে অনেক কিছুই
হারায়, কিন্তু উৎকর্ষিত মাত্রার কিছু হারালে তা কি মেনে
নেওয়া যায়?
সমস্ত দিক বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, আমাদের
মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করতে পারে সমবেত পদাশ্রিত কীর্তন।জাতি-ঐক্য ঘটাতে নগরসংকীর্তনের
প্রভাব বেশি, তা পরীক্ষিত সত্য।আর যিনি এই ঐক্যের হোতা শ্রীচৈতন্য
মহাপ্রভু, ধর্মাচরণের বাইরে,তাঁর
জন্মদিন পালন করা যেতে পারে,
যেমন আমরা রবীন্দ্রজয়ন্তী করি।এ ব্যাপারে কোন্ ছবি
আমরা বেছে নেবো—এ প্রশ্ন আসতে পারে। এই লিখিয়ে মনে করে উদ্বাহু ছবি
নয়,স্বাভাবিক ছবি, হাত
নামানো ছবি। অথবা মশালহাতে বা মৃদঙ্গ বাজাচ্ছেন এমন।এই ছবি গুলোর ঐতিহাসিক অথচ
বাস্তব প্রেক্ষিত যতটা মাটির কাছাকাছি, ততোটা গৌরাঙ্গের
ঊর্ধ্ববাহু ছবি নয় বলে মনে করি।গৌরাঙ্গের প্রচলিত ছবির সব কটিতেই চোখ ঊর্ধ্বে—পরম
ভাব-আহলাদিত, পরম ভক্তি।প্রশ্ন জাগে গৌরাঙ্গ কি ভক্তিযোগ সর্বস্ব? আমরা
গৌরাঙ্গ বা শ্রীচৈতন্যের মধ্যে নিমাই কে ভুলে যাই। শ্রীচৈতন্য যে কর্ম যোগীও।ভুলে
গেলে চলবে না তিনি মশাল হাতে দলবল নিয়ে কীর্তন করতে করতে অত্যাচারী চাঁদ কাজির
বাড়ি ঘেরাও করে ছিলেন।
তোমাকে এঁকেছি প্রভু, কত
ছলে
আমার অবোঝ মন ভুলে
তুলে দেয় বীণা হাতে
রূপ ও লাবনী
ভুলে যায় তুমি যে বিপ্লবী।
কীর্তনকে আশ্রয় করে ঐক্য-বোধ-সমন্বিত একখানা কীর্তন
গানও এখানে সংলগ্ন করা গেলো—
কীর্তনাশ্রয় বলো কীর্তনাশ্রয় করো
কীর্তনাশ্রয় আলো জানো হে!
এ জনমে হৃদে গৌরহরি প্রীতে
এক হয়ে সব চলো রে।
কে কারে দেবে ভক্তি কে কারে দেবে শক্তি
কে কারে দেবে প্রেম নিধি হে!
গৌরচাঁদ সমুখে রাখিয়া নিজেরে
হও বলীয়ান সকলে।
একবার উচ্চস্বরে বলো সবে
হৃদয়ের আকুতি খুলিয়া প্রকাশে
সরল হই আমি গরল নই কভু
নিমাইরে পাইয়া অন্তরে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ভাঙা ভারত ও পরিণতি
সমরবিজয় চক্রবর্তী
ইউক্রেনের উপর রাশিয়ার
আক্রমণ কবে যে শেষ হবে তা বলা মুসকিল।ইউক্রেনের মতো একটা উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের বেঁচেবাড়ার অবকাঠামো
এ’ক’মাসের যুদ্ধে প্রায় শেষ হয়ে
গেছে।রাশিয়ার পর ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহৎতম রাষ্ট্র ইউক্রেন।রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সঠিক
হতাহতের খবর পাওয়া যাচ্ছে না।উভয় পক্ষই পরস্পরবিরোধী হিসাব দিচ্ছেন।জাতি সঙ্ঘের
উভয় রাষ্ট্রের নিহতদের আজ অবধি হিসেব ১৪২০০ থেকে ১৪৪০০।বলাবাহুল্য,এখন অবধি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ছাপিয়ে যায়নি ভারত ভাগ জনিত দাংগা এবং ১৯৭১এর
বাংলাদেশ যুদ্ধের হতাহতের হার। মানব ইতিহাসে নিকৃষ্টতম উদাহরণ হচ্ছে ভারত বিভাজন আর ১৯৭১এ
পূর্বপাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে রূপান্তরের লড়াই।এই ভারত উপমহাদেশে একই ডিএন-এর মানুষ, একই ভাষার মানুষ, একই
পরম্পরার মানুষ হওয়া সত্ত্বেও গত আট দশক ধরে কত বীভৎস জঘন্য পৈশাচিক ঘটনা ঘটে
চলেছে।দেশ বিভাগের ফলে সেই সময়েই তিন কোটির ঊর্দ্ধে মানুষের নিষ্ক্রমণ(এক্সডাস) এবং ভারত
ভূখণ্ডে উদবাস্তুর প্রবেশ আজও অব্যাহত। এতো বেদনা জর্জর সংকট আর কোথায়?এই
উপমহাদেশে হত্যা,ধর্ষণ,ধ্বংস ইহুদিদের ওপর হিটলারের অত্যাচার ও হত্যাকেও
হারমানায়।বৈদ্যুতিন মাধ্যমের অভুতপূর্ব উন্নতির জন্যে আজ পৃথিবীটা ছোটো হয়ে
গেছে।খবরাখবর হাতের মুঠোয় এসে যাওয়ায় খুব একটা কেউ কিছু লুকিয়ে রাখতে পারছেন না।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে নানা ঘাতপ্রতিঘাতের
মধ্য দিয়ে ইউক্রেন হাল আমলে পৃথিবীর ভ্রমণপিপাসুদের বিশেষ
আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল।ইউক্রেনের জনসংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি এবং এর মধ্যে ৯০%-এর ওপর
খ্রিষ্টান। পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের সংখ্যা অনেকটাই বেশি।উপযুক্ত পাত্রীর সন্ধানে
বিশেষ করে ইউরোপ, অ্যামেরিকার পুরুষদের ভিড় লেগে থাকত। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়ান উপদ্বীপ ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করে নেন।তা সত্ত্বেও এগোচ্ছিল দেশ।ইউক্রেনের রাষ্ট্রপ্রধান ভলোদিমির জেলেন্সকি, একজন
অভিনয় শিল্পী(কমেডিয়ান), দেশের নিরাপত্তায় তেমন কোনো গুরুত্ব দেননি, গুরুত্ব
দিয়েছিলেন দেশের উন্নয়নে।তিনি হয় তো ভেবেছিলেন ন্যাটো তো আছে, জাতি সঙ্ঘ রয়েছে,
সবচাইতে বড় কথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন তাঁর দেশ পেয়ে আসছে, বিপদে
যুক্তরাষ্ট্র তো পাশে দাঁড়াবেই যেমন ইসরায়েলের পাশে দাঁড়ায়, কিন্তু ইসরায়েলের
প্রসঙ্গ তো অন্য।জগত খ্যাত মানবতাবাদী দার্শনিক বারটেন্ড রাসেল কয়েক দশক আগে তাঁর
জীবদ্দশার শেষ সময় তাঁর বিশ্লেষণী মতামত তিনি এ’ভাবে তুলে ধরেন, যুক্তরাষ্ট্রের
ইসরায়েলকে সমর্থন না করে উপায় নেই। ইসরায়েল অন্যায়ও যদি করে ইসরাইলের বিপক্ষে গিয়ে
ফিলিস্তিনকে সমর্থন করতে পারবে না অ্যামেরিকা। এর একটাই বড় কারণ ইহুদিদের আর্থিক
সহযোগিতা ছাড়া বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে
রাষ্ট্রপতির পদে নির্বাচনে জেতা প্রায় অসম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রে অনুবীক্ষণিক সংখ্যায় ইহুদিদের বাস,তা সত্ত্বেও
অ্যামেরিকার বিভিন্ন দিকে বিস্তর উন্নতি এবং বিশ্বে ক্ষমতাবান দেশ হিসেবে গড়ে ওঠার
পেছনে ইহুদিদের অবদান অতুলনীয়।ইসরায়েল(আয়তন ২১৯৩৭
বর্গ কিমি )ইউক্রেন(আয়তন ২,৩৬,৮০০ বর্গ কিমি )-এর তুলনায় আয়তনে অনেক ছোটো, তা সত্ত্বেও
প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় বিশ্বের অন্যতম
শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে গন্য হয় ইসরায়েল। অপরদিকে পাই ‘নিরপেক্ষ’ সুইজারল্যান্ড।সুইজারল্যান্ডকে মোডেল হিসেবে ধরে
নিতে পারে না ইউক্রেন।প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ গেল
কিন্তু সুইজারল্যান্ড সুরক্ষিত ছিল। সুইজারল্যান্ডের ওপর আজ অবধি কোনও আক্রমণ
হয়নি, এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গেলে একটা বড় নিবন্ধ লেখা হয়ে যাবে, তাই এখানে
থামছি।জেলেন্সকি যদি তাঁর দেশকে সুইজারল্যান্ড ভেবে থাকেন তাহলেও ভুল
করছেন।অবস্থানগত প্রেক্ষিতে, বোধ করি, নিজ প্রতিরক্ষার জন্য ইউক্রেনকে সামরিক
শক্তিতে স্বয়ং সম্পূর্ণ হতে হবে।এই দৃষ্টিতে
ইউক্রেন ইসরায়েলকে মোডেল হিসেবে গণ্য করতে পারে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের ৬০লক্ষেরও
বেশি মানুষ
প্রতিবেশী দেশগুলিতে আশ্রয় নিয়েছেন
এবং কয়েক লক্ষ বাস্তুচ্যুত মানুষ দেশের
মধ্যেই আটকা পড়ে আছেন।খাদ্যাভাব এবং চিকিৎসার অভাবেও কাতারে কাতারে মানুষ
অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, মারা যাচ্ছেন। ক্রমবর্ধমান যুদ্ধে,
সকল
প্রকার পরিসেবা বন্ধ। সাঁকো,
রাস্তা,
যোগাযোগের
সকল ব্যবস্থা ছিন্ন হয়ে গেছে। এর
ওপর চরম আর্থিক অনটন।ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তাঁরা দেশ
ছেড়ে যেতে পারছেন না।দেশে আটকা পড়া বেশির ভাগই শিশু এবং নারী, নারীদের
মধ্যে অন্তস্বত্বাও রয়েছেন।এযাবৎ ৩০ লক্ষেরও
অধিক ইউক্রেনিয়ান পোল্যান্ডে
শরনার্থী হিসেবে আছেন আর বাদবাকি গেছেন
রোমানিয়া, মলদভা, হাঙ্গেরি, এবং স্লভানিয়ায়।
ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, জ্বালানির ঘাটতি এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বিপর্যয় হল
ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পরিণতির প্রধান কয়েকটি। বিশ্বব্যাপী সরবরাহ চেন মারাত্মকভাবে
বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।সারা
বিশ্বে জ্বালানি ও খাদ্যের দাম বেড়েই চলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গ্যাসের দাম গড়ে ৪৩.৭ সেন্ট প্রতি গ্যালন বেড়েছে।শ্রীলংকার দিউলিয়া
হওয়ার পেছনেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ উড়িয়ে দেওয়া যায় না।এখন বোঝা যায়
পাকিস্তান স্বর্বস্বান্ত হওয়ার পথে। তাইওয়ানের দিকে চিন ঝুঁকে রয়েছে, সমর মহড়া
চলছে।আজকের উন্নত তথ্য প্রযুক্তির যুগে একটা বাদ দিয়ে আর একটা নয়,গোটা বিশ্বই যে
একটা চেনে আবদ্ধ, কেউ কাউকে বাদ দিয়ে নয়।ভালো হোক, মন্দ হোক, যেখানেই হয় সেখানের
প্রভাব সর্বত্র পড়বেই পড়বে।
সম্প্রতি দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক সমীক্ষায় দেখা
যায়, জার্মানি, পোল্যান্ড এবং সুইডেনের মতো ন্যাটো দেশগুলি তাদের দেশকে আরও
ভালভাবে প্রতিরক্ষার জন্য ইউক্রেনীয়দের অত্যাধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করছে।এই
আক্রমণ-প্রত্যাক্রমনে কি সমাধান আছে? পশ্চিমের উচিত ছিল ইউক্রেনকে ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টার প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের
আশঙ্কা যে রয়েছে তা বুঝে পা ফেলা। রাশিয়ার মতো প্রবল পরাক্রমশালী রাষ্ট্র ইউক্রেনকে যদি অন্তর্ভুক্ত করে নিতে পারে, তাহলে পুতিনের
নেতৃত্বে রাশিয়া পশ্চিমা দেশগুলো লক্ষ্য করে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে পারে।এই কারণে পশ্চিমা দেশগুলি বেশি শঙ্কিত।২০১৪সালে ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার
অন্তর্ভুক্তির পর
থেকে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে উত্তেজনার ফলশ্রুতি এই চলমান যুদ্ধ।একদিকে
শক্তিশালী রাশিয়া আর অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র জোট, এই দুইয়ের
চাপের মধ্যে দুর্বল ইউক্রেন যদিও খনি এবং
প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এই দেশ।
দেশভাগ-পরবর্তী
বাঙালির দশার মতই আজ ইউক্রেনবাসী।ভবিষ্যৎ অজানা।দেশ
ভাগের পর বাঙালির
অধোগমন শুরু হয়।যে জাতি ছিল গোটা দেশের পথপ্রদর্শক,সে আজ নিজেই বিভ্রান্ত,পথভ্রষ্ট
বললে অত্যুক্তি হবে না।ভাঙা
ভারতের পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বঙ্গ(বর্তমান বাংলাদেশ)থেকে আগত শরণার্থীরা আজও
হোঁচট খেয়ে চলেছে।ইউক্রেন বাসীর সংগে
বাঙালির মিল খোঁজে পাচ্ছি।
ইউক্রেনিয়ানদের মাথা
খাঁড়া করে বাঁচতে হলে যুদ্ধ থামাতে হবে।সম্প্রতি যুদ্ধ থামানোর জন্য ফ্রান্সের
প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল
ম্যাক্রোঁর সক্রিয় ভূমিকা প্রশংসনীয়।তা সত্ত্বেও নানা কারণে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে চলমান যুদ্ধ নিরসনের জন্য
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা অত্যন্ত জরুরী।যুদ্ধ নিরসন ভয় দেখিয়ে নয়,অস্ত্র সরবরাহ করে নয়, যুদ্ধ
নয়,বিশ্বের প্রধান দেশগুলোর প্রধানদের নিয়ে মস্কোতে পুতিনের সাথে আলোচনায় বসা এবং
সমাধানে আসা। মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই তার কপট চাল বন্ধ করতে হবে।
দৈনিক যুগশঙ্খ,১জুন,২০২২
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ভারতের ভূমিকা
সমরবিজয় চক্রবর্তী
ভারত
আজ এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির
মধ্যে,এর
কারণ রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সংগে ইউক্রেনের ভারসাম্যহীন সম্পর্ক। রাশিয়াকে সমর্থন করতে পারছে না নতুন দিল্লি, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষেও দাঁড়াতে পারছে না,না
পারছে ন্যাটোদেশগুলোর
সমর্থনে থাকতে,অথচ এদেশ পরম মানবতাবাদী বলে বিশ্বের কাছে পরিচিত।“বসুধৈব কুটুম্বকম” এসমস্ত সনাতন মানবতাপুষ্ট বানি আজ
গালভরা কথার মতো শোনাচ্ছে।প্রধানমন্ত্রী মোদির নেতৃত্বে ভারত সরকার আজ এক ত্রিশঙ্কু অবস্থায়,
কূটনৈতিক সমাধান দেখিয়ে শান্তিমূলক সংলাপ ছাড়া আর কোনও গত্যন্তর নেই এবং মোদি এপথেই অবিচল।
রাশিয়া
এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের সাথে ভারতের কৌশলগত অংশীদারিত্ব রয়েছে, উভয়ের কাছ থেকে ভারত যুদ্ধাস্ত্র আমদানি করে—সৌদি
আরবের পর ভারত আজ বিশ্বের
দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক দেশ।এই দুই দেশের সংগে ভারতের সুসম্পর্ক, রাশিয়ার সংগে তো
আগেই ছিল, মোদি আমলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংগে সম্পর্ক অনেকটাই বেড়েছে। কিন্তু
বাইডেন-সরকার যতোটা মনোযোগী হওয়ার কথা ছিল ভারতের প্রতি বাস্তবে ততোটা নয় বলে বোঝা
যাচ্ছে।মূলত কাশ্মীর সমস্যা,পাকিস্তান ও চিনের সংগে ভারতের প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে
আমেরিকার মনোভাব দায়সারা গোছের, অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এড়িয়ে যাওয়া সম্বব নয়,
আবার যুক্তরাষ্ট্রের সংগে ভারতের সুসম্পর্ক পুতিনের রাশিয়ার চলমান ইউক্রেন আক্রমণের
প্রেক্ষিতে মেনে নেওয়ার মতো নয়।তবে,রাশিয়ার ডেপুটি চিফ অব মিশন রোমান বাবুশকিন
বলেছেন যে ভারত একটি দায়িত্বশীল বৈশ্বিক শক্তি হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে—ভারতের পক্ষে মস্কোর এই মন্তব্যে মোদির কূটনৈতিক চাল নিরাশাব্যঞ্জক নয় বলে ধরে নেওয়া যায়।
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে
একটি খসড়া প্রস্তাব তোলা হয়। এই প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটির আগেই রাশিয়া, ইউক্রেন ও যুক্তরাষ্ট্র ‘সঠিক কাজ’ করার জন্য নয়াদিল্লির প্রতি
আহ্বান
জানিয়েছিল।এক্ষেত্রে ভারত নিরাপত্তা পরিষদে
ভোটদানে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের দেওয়া বিবৃতিটি
ভালোভাবে পড়লে বোঝা যায়, নয়াদিল্লি পরোক্ষভাবে মস্কোকে আন্তর্জাতিক আইনকে সম্মান করতে
বলেছে।
রাশিয়াকে
তার সামরিক দুঃসাহসিকতার কূটনৈতিক সমাধানের জন্য পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের
সীমাবদ্ধতা রয়েছে, বিশেষত
যখন তার নিজস্ব সীমান্ত ইস্যুতে ১৪
দফা কর্পস কমান্ডার-স্তরের আলোচনার পরেও বেইজিং থেকে পূর্ব লাদাখে
ডি-এস্কেলেশন করাতে পারেনি নয়াদিল্লি।
মার্কিন
নেতৃত্বাধীন ন্যাটো সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে সামান্য সহায়তা পাওয়া সত্ত্বেও,
ইউক্রেন
রাশিয়ান বাহিনীর শক্তির বিরুদ্ধে প্রবল
প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।পুতিন
তার পারমাণবিক প্রতিরোধক বাহিনীকে উচ্চ সতর্কতা দেওয়ায় বিশ্ব আজ সঙ্কিত।বিবিসির এক সমীক্ষায় বলা হয়
মাত্র ১৫মিনিটের মধ্যে রাশিয়া তার পারমাণবিক আক্রমণ-দ্বারা লন্ডন নগরী গুড়িয়ে দিতে
সমর্থ।বিষয়টা তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সংকেতবহ নয় তো?
ইউক্রেনের
রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কিক রাশিয়াকে
মোকাবিলা করতে বিশিষ্ট রাষ্ট্রগুলোর কাছে আবেদন রেখে চলেছেন।মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের প্রতি
অনেকটাই নিশ্চেষ্ট, অছচ রাষ্ট্রপতি,
জো
বাইডেন, ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতার
প্রতি ওয়াশিংটন অবিচল,
এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।তিনি এও বলেছিলেন,
"রাশিয়া যদি এগিয়ে যায়, আমরা
বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করব।"
মার্কিন
নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোট মস্কোকে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা ছাড়া আর বিশেষ কিছু করছে না।রাশিয়ার আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য
দেশগুলোর কোনও প্রতিআক্রমণ নেই।এটা একদিকে ভারতের জন্য ভালোই হলও, কারণ
ভারতকে কোনও এক পক্ষ সমর্থন করে যুদ্ধে
নামতে হত।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত ন্যাটো-অন্তরভুক্ত দেশগুলোর প্রতিআক্রমণে নিষ্ক্রিয় থাকাটা শুধু ভারতের
জন্য নয় গোটা বিশ্বের জন্য নিরাপদ অবস্থান।
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে,১৬
বছর মসনদে থাকার পর গত ডিসেম্বরে জার্মান চ্যান্সেলর পদ থেকে
পদত্যাগ করা অ্যাঞ্জেলা মার্কেল যদি এখনও দায়িত্বে থাকতেন তবে হয় তো পুতিনকে অন্যভাবে ভাবতে হত, এতো বেপরোয়া হতে
পারতেন না পুতিন।বর্তমানে রাশিয়ার প্রতিপক্ষ কেই নেই বললেই চলে।চিন চুপ
যেন ওৎপেতে বসে আছে আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দর্শকের ভূমিকায়ই বলা যায়।
পুতিনের সামরিক বাহিনী
নির্লজ্জভাবে এবং খুব বেশি আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ ছাড়াই ইউক্রেনের মতো একটি
সার্বভৌম দেশকে দখল করে ফেলছে,
এ-কি চিনের শি জিনপিং এবং উত্তর কোরিয়ার কিম
জং-উনের স্বৈরশাসকদের এপথে এগোতে
সাহস বাড়িয়ে দিচ্ছে না? ভারতের উপর চিনের হুমকি বাড়ার আশঙ্কা অমূলক নয়,
সেইসাথে
তিব্বতের মতো তাইওয়ানকে চিনের অন্তর্ভুক্তি করার জন্য আক্রমণকরা অনভিপ্রেত
নয় এখন।
ইউক্রেন রাশিয়ার কাছে অতি লোভনীয়।দেশটি প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর।দেশটি ইউরেনিয়ামের ক্ষেত্রে ইউরোপে প্রথম,
টাইটানিয়াম
মজুদের ক্ষেত্রে ইউরোপে দ্বিতীয় এবং বিশ্বে ১০তম,
ম্যাঙ্গানিজ
ও লৌহ আকরিক মজুদের ক্ষেত্রে দ্বিতীয়, তৃতীয়
ইউরোপে এবং শেল গ্যাসের মজুদে বিশ্বে ১৩তম,
কয়লা
মজুদের ক্ষেত্রে বিশ্বে অষ্টম এবং সূর্যমুখী তেল রপ্তানিতে বিশ্বে প্রথম।এই বিবেচনায়ও ভারতের সংগে ইউক্রেনের সম্পর্ক ভালো থাকা জরুরি।
ভারতকে
চাহিদার ৬০
শতাংশ সূর্যমুখী তেল আমদানি
করতে হয়,এর মধ্যে রাশিয়া এবং ইউক্রেন থেকে
বেশিরভাগ সরবরাহ হয়।
এই দুটি রাষ্ট্র বিশ্বের
সূর্যমুখী তেলের মিলিত ৮০
শতাংশ রপ্তানি করে।দেশে রান্নার
তেল মহার্ঘ্য,
দাম আরও বাড়তে পারে,
যুদ্ধের ফলে ভারতের জন্য বরাদ্ধ রাশিয়া-ইউক্রেনের বিভিন্ন বন্দরে ৩.৫ লাখ টন রান্নার তেল আঁটকে পড়ে আছে।
যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে পেট্রোল,
ডিজেল
এবং গ্যাসের দাম
আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে,
চলমান
রাজ্য নির্বাচনের কারণে গত দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে দাম কিছুটা নিয়ন্ত্রণে ছিল।
নতুন দিল্লির তৎপরতায় ইউক্রেনে
আটকাপরা ভারতীয়
প্রায় ১৮০০০
ডাক্তারি পড়ুয়ারা দেশে ফিরতে পারছেন।ইউক্রেনের খারকিভ-সহ অন্যান্য শহর থেকে নিরাপদে এই ছাত্রছাত্রীদেরে রাশিয়াতে নিয়ে আসার জন্য প্রধানমন্ত্রী মোদির সংগে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের ফোনালাপের ভিত্তিতে রাশিয়া ১৩০টি বাসের ব্যবস্থা করেছে।
পরিশেষে দেশের বামেদের উল্লেখ করে বলব, যারা সর্বদাই
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মুখর,আন্দোলন ও সংলাপে ছয়লাপ, তারা কেন
আজ রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের ব্যাপারে
চুপ?মানুষের প্রতি প্রেম তাদের,বারবার প্রমাণিত হচ্ছে,পক্ষপাতদুষ্ট।তাদের
প্রেম বুঝি হৃদয়সঞ্জাত নয়, মস্তিষ্কপ্রসূত, ‘মেধাবী প্রেম’।মানবতার ক্ষেত্রেও
কূটনীতি?নতুন দিল্লির ভূমিকায় তাদের কোনো উচ্চবাচ্য শোনা যাচ্ছে না, বোঝা যায়,
তাদের সমর্থন রয়েছে।
*দৈনিক যুগশঙ্খের ছয় মার্চ সংখ্যায় উত্তর সম্পাদকীয়
শিলচরে গোবর এবং…
শিলচর কেন
এমন
সমরবিজয় চক্রবর্তী
একটা শহর কতটুকু উন্নত তা শুধু দালানকোঠা দেখে বোঝা যায় না,দামি
গাড়ি- বাইকের চলনও নয়।কতটা সাংস্কৃতিক সঙ্ঘ রয়েছে, কতটা
প্রেক্ষাগৃহ আছে,অনুষ্ঠান কত বেশি হচ্ছে, সাংস্কৃতিক
অনুষ্ঠানের মান কেমন ইত্যাদি—এ সব কিছুর মানেই থাকে না যদি সে শহর ক্লেদাক্ত ও দুর্গন্ধযুক্ত
হয়।
শিলচর শহরের উদ্দেশ্যে বলা, এ-যে ঈশানবাংলার/বরাক উপত্যকার মুখ্য
শহর, বরাকের প্রায় ৪০লক্ষ মানুষের প্রাণকেন্দ্র।এ
শহর বরাক উপত্যকার নানা ঘটনার সাক্ষী,উন্নতি-অবনতির
সাক্ষী।ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম অংশী আর মাতৃভাষা রক্ষায়
এ শহরের বুকে ১১জন শহিদের স্থান,এ এক অনন্য পুণ্য ভূমি।অজস্র
মানুষের জীবন-মরণ পণ করে সংগ্রাম আর প্রতিটি
সংগ্রামের ফলশ্রুতি হিসাবে এ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হল মেডিক্যাল কলেজ, ইঙ্গিনিয়ারিং
কলেজ, এশিয়ার অন্যতম কাগজ কল (বর্তমানে
বন্ধ), চিনি কল(বর্তমানে বন্ধ)। বরাক
উপত্যকায় স্বল্প দূরত্বে যতটা স্কুল রয়েছে তা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় নেই এবং ভারতের
অন্যত্রও মেলা ভার বলে জানি।এই সমস্ত কিছুর,সমস্ত
ঘটনা প্রবাহের নার্ভ সেন্টার এই শিলচর শহর।প্রসারিত হচ্ছে,লোক সংখ্যা বাড়ছে,যানজট
বাড়ছে কিন্তু রাস্তাঘাট নালার সংস্কার দূরস্থ।প্রসারিত রাস্তার অভাব। ফুটপাত তো নেই
বললেই চলে, যেখানে আছে তা সরু এবং এবড়োখেবড়ো, যে কোনও সময় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে,
হচ্ছেও,ভাঙ্গা ফুটপাতে পা ফোসকে ড্রেনে পড়ছেন কত পথচারী।আসলে এতো ফুটপাত নয়, এর
অন্য এক নাম দেওয়া চাই—মরণ ফাঁদ?আমাদের স্পিডব্রেকার দেখার মতো,কীভাবে দূর্ঘটনা ঘটতে এর এক সুবিন্যস্ত ব্যবস্থা ছাড়া আর কী বলা
যায়।বেশিরভাগ জায়গায়ই নিয়মমাফিক স্পিডব্রেকার নেই।অথচ শিলচর ভারতের ম্যাপে জায়গা করে নিয়েছে,সংস্কৃতির
শহর।কবির শহর বলেও জায়গা করে নিয়েছে।এ
তো আশ্চর্য বই আর কী বলা যায়—
আবর্জনা-পচা-গলা-পূতিগন্ধময় পরিবেশে
নন্দন চর্চা কী করে হয়?এ নিজের কাছে নিজেরও এক প্রশ্ন।শিলচর
শহরবাসী কি এতোই অন্ধ-বধির-মূক,
দেখেও দেখে না বুঝি—“পিশাচেরা
ফুল হাতে ঘোরে…!”
শিলচরে ফ্লাই অভার চাই, ড্রেন চাই, প্রশস্ত রাস্তা চাই,
চাই ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভোলপমেন্ট, চাকরি আর ব্যবসায়ের সুযোগ চাই,চাই পাঁচ তারা হোটেল,চাই
আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, চাই চিকিৎসার সুরাহা। কিন্তু কোনো কিছুই, কোনো কিছু নয়
যদি স্বভাব না বদলায়।নিজের দিকে তাকাতে হয়, কারণ শিলচরবাসী যে সময় সময় আওয়াজ
তোলেন অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে, এ শহরবাসী সংস্কৃতির দাবিদার।সংস্কৃতি কি মঞ্চেই
সীমায়িত, না প্রতিদিনের আচরণে বিধৃত?
গরু, মানুষ এক সাথে চরে এই শহরে। যত্রতত্র গরুর
লেদা।মাত্র কতিপয় মানুষের খাটাল রয়েছে এখানে, রাস্তায় গরু না-ছাড়তে
এদেরে বাধ্য করা যায় না? বেওয়ারিশ গরুদের খোঁয়াড়ে পুরা যায় না?
পান চিবুতে চিবুতে রাস্তায় পিক ফেলা,কফ-কাশি ফেলা, রাস্তার পাশে চা খেয়ে কাপটা রাস্তায় ফেলে দেওয়া,আবর্জনা যেখানে খুশি নির্দ্বিধায় ফেলে দেওয়া—এর মধ্যে
আমরা সবাই বাস করছি।বাইরের মানুষ এসে শিলচর সম্পর্কে কী ইম্প্রেশন নিয়ে যায়? ভালো?
এক সময় শিলচর আর তেজপুর—আসামের এই দুটি শহর ছায়াঘন বৃক্ষ, ফুলে
সুশোভিত, ছিমছাম, পরিষ্কারপরিচ্ছন্নতার জন্য খ্যাত ছিল—সে
টেনেটুনে ষাটের দশক অবধি ছিল—এই প্রতিবেদক স্বয়ং প্রত্যক্ষদর্শী।এক সময় শিলচরে
রাস্তাঘাট জল দিয়ে ধোয়া হত,সে বুঝি ব্রিটিশ দেশ ছাড়ার পরেও বেশ কয়েক বছর মেনটেন
করা হয়েছিল।এ
ক্ষেত্রে পরাধীন ভারতই ছিল ভালো কি?শিলচরের
ক্ষেত্রে তো তাই মনে হয়।
মানুষের মানদণ্ড শুধু অর্থ দিয়ে নির্ণয় করা যায়
না,জীবনের মান শুধু আর্থিক স্বচ্ছলতা এনে দিতে পারে না,জীবনের মান নির্ণয়ে,
কওয়ালিটি অব লাইফ নির্ণয়ে দৈনন্দিন জীবন প্রবাহে কৃষ্টি-বিবেক-পরিস্কার-পরিছন্নতা
চলনে ও বলনে অন্বিত নয় কি?
কোনও অঞ্চলের
শরীর নোংরা মানে সে অঞ্চলের লোকজনও
নোংরা।এক
সময় এই শহরের নগর পালিকা ছিলেন বীথিকা দেব।শহর অপরিস্কার হওয়ার ক্ষেত্রে তিনি শহরবাসীর
প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করায় পত্র-পত্রিকায়
ঝড় ওঠে,তিনি নাকি অন্যায় কথা বলেছেন।কটোক্তি ওঠে তাঁর প্রতি, তাঁর মোরদ নেই শহর
পরিস্কার রাখার আর দোষ দিচ্ছেন শহরবাসীর।কথাটা রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্যে বলা নয়,তাঁর
বয়ান সত্য বলে বিবেচ্য এ কথাই এখানে প্রতিপাদ্য।
প্রলয়ঙ্কারী বন্যার ক্ষতি অস্বীকার করার নয় কিন্তু সবসময়
বন্যা কবলিত হয়ে আছি এমন তো নয়!আসলে শিলচরের দুরারোগ্য ব্যাধির মধ্যে একটি হল মানুষের
স্বভাব, সকলের নয় কিছু কিছু মানুষের।রাস্তাঘাট নালা
নর্দমা জল ইত্যাদি দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে অনেক
লেখাজোখা হয় কিন্তু মানুষ না পাল্টালে এসব কি পালটাবে? মেন বিহাইন্ড
দ্য মেশিন, এ কথাটা সর্বাগ্রে বিবেচ্য নয় কি? সুতরাং আগে আমাদেরে
পাল্টাতে হবে।
............................................................................................
ওই সে দিন মকর সংক্রান্তিতে কীর্তনাশ্রয় আয়োজিত
নগরসংকীর্তনে যোগ দিয়েছিলেন কলকাতা আর শান্তিনিকেতনবাসী দুজন।শিলচর তাঁদের
জন্মস্থান।তাঁদের মুখেও শুনি একই খেদ, বিশেষ করে যখন এক জনার পা
পড়ে এক দলা গোবরে।
.............................................................................................
স্যাংগারের সাক্ষাৎকারে জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে গান্ধির মতামত
স ম র বি জয় চ ক্র ব র্তী
সালটা ১৯৩৫। শীতের দুপুর। ওয়ার্ধা আশ্রমে গান্ধি। এক শেতাঙ্গিনি মহিলা নাম
মারগারেট স্যাংগার পূর্ব নির্ধারিত সময় নিয়ে সাক্ষাৎকার নেবার জন্য মহাত্মা
গান্ধির সংগে দেখা করতে আসেন। সাক্ষাৎকারের বিষয়, জন্মনিয়ন্ত্রণ ও যৌনতা।স্যাংগার সেই
সময়ের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন নামিদামি সাংবাদিক।মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ব
হিসেবেও তাঁর ভালো পরিচিতি।নারীমুক্তি আন্দোলনেও ছিলেন তিনি সক্রিয়।গান্ধির অহিংস
মতবাদ ও সংসারি হওয়া সত্বেও বিষয় বিমুকতা স্যাংগারকে বিশেষ আকর্ষণ করে।
স্যাংগার-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের কিছু দিন আগে
বোম্বে(মুম্বাই) মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের জনৈক কাউন্সিলর গান্ধিকে একটি চিঠি লিখে জানান যে তিনি একটি
জন্মনিয়ন্ত্রণ-ক্লিনিক খুলতে চাইছেন,এ ব্যাপারে তাঁর মতামত কী।নিশ্চিত তিনি ভেবে ছিলেন মহাত্মা
জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য ক্লিনিক-খোলাতে শুধু যে অপার খুশি হয়ে সমর্থন করবেন তা নয়, তাঁর বিশেষ তারিফও করবেন।ভদ্রলোক
মহাত্মাকে দিয়ে তাঁর এই ক্লিনিক উদ্বোধন করার জন্য অনুরোধও করেন।জবাবে এক দীর্ঘ চিঠি লিখে মহাত্মা
বলেন,
এবরশন করে বার্থ-কন্ট্রোল তিনি সমর্থন
করেন না। তাঁর মতে এটি অনৈতিক তো বটেই
অতিমাত্রায় নিষ্ঠুরও।এছাড়াও ওষুধ প্রয়োগ ও অপারেশন করে জন্মনিয়ন্ত্রণের তিনি ঘোর বিরোধী।
মহাত্মা জন্মনিয়ন্ত্রণ চাইতেন না এমন
নয়,তাঁর মতে জন্মনিয়ন্ত্রণ যেন সংযমের
মাধ্যমে হয়,কোন ধরণের যান্ত্রিক বা দাওয়াই-এর
সহায়তায় নয়।মানুষের জন্ম যেহেতু নারী-পুরুষের যৌন মিলনে প্রাকৃতিকভাবে সম্পন্ন হয়,সেইহেতু জন্মনিয়ন্ত্রণ অযান্ত্রিক হওয়াই
কাম্য এবং তা স্বাস্থ্যকরও।পাশ্চাত্যের ব্যাপক যন্ত্র-নির্ভরতা গান্ধি সমর্থন
করতেন না।তিনি মনে করতেন,যৌনতা
স্রেফ বংশরক্ষা নিমিত্ত, অন্যথায়
তা পাপ।
এই ধারণার বশবর্তী গান্ধি,স্যাংগারকে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে
মাত্রাতীত যৌন-পিপাসা কতটুকু কী, কেন
তা পাপ।অসংখ্য সন্তানের জন্ম ভারতের মতো গরীব দেশে অবশ্যই কাম্য নয়, তবে যৌনসংগম থেকে স্বেচ্ছায় বিরত থাকাই
জন্মনিয়ন্ত্রণের স্বাভাবিক সমাধান।কৃত্রিম উপায়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ মানুষকে নিরর্থক যৌনতার দিকে ঠেলে দেয় বলে
তাঁর ধারণা।
স্যাংগার গান্ধিকে পাল্টা প্রশ্ন করেন, যৌনাকাঙ্খা জাগলে কোনো দম্পতির পক্ষে
সংযত থাকা কী করে সম্ভব? শুধুমাত্র
সন্তান কাঙ্ক্ষিত যৌন, অবাস্তব
নয় কি?অসম্ভব বলে মনে হওয়াই তো স্বাভাবিক?
উত্তরে গান্ধিজি বলেন তা সম্ভব। জনবহুল ভারতের প্রেক্ষিতে তাঁর মতে, জন্মনিয়ন্ত্রণ চার সন্তানে সীমিত রাখা
উচিৎ,
অধিক সন্তানের জন্ম দেওয়া অনৈতিক
এবং চার জন সন্তানের জন্মের পর স্বামী-স্ত্রীর পৃথক শয্যায় শয়ন করা
উচিৎ।প্রসঙ্গত,
১৯৪৪ খ্রিঃদে গান্ধিজির স্ত্রী
কস্তুরবার মৃত্যুর পর গান্ধি ব্রহ্মচর্যে কতটুকু সফল তা পরীক্ষা করার জন্য তাঁর
দুই নিকটতম আত্মীয়া কুড়ি-নিম্ন বয়সের আভা ও মনুর সাহায্য নেন। গান্ধির থেকে তারা
৬০ বছরের ছোটো।রাতে বিবস্ত্র অবস্থায় এই দুই নারীকে তাঁর শয্যার দুপাশে রেখে নিজেও
বিবস্ত্র থেকে তাদের মাঝখানে শুয়ে তা পরীক্ষা করতেন এবং পরীক্ষায় সমহিমায় উত্তীর্ণও হোন
তিনি।আভা ও মনুর কাঁধে হাত রেখে তাঁর চলাফেরা করার ছবি রয়েছে কিন্তু শয্যার দৃশ্য
আজ অবধি কোথাও দৃশ্যত হয়নি,কেউ
তুলে রাখার সুযোগ হয়তো পায়নি।এ’সমস্ত
কিছুর পরও আভা ও মনুর পরম শ্রদ্ধা ছিল গান্ধির প্রতি।
বিশ্বের তাবড় সংবাদ সংস্থা গান্ধির
যৌনাচার নিয়ে কম ঘাটাঘাটি করেনি, কিন্তু
কোথাও কোনো ব্যভিচারীতা তাঁরা শত চেষ্টায়ও খুঁজে পায়নি।এই প্রেক্ষিতে বার বার আভা
ও মনুকে প্রশ্ন করা হয়েছে কিন্তু প্রতিবারই তাঁদের মুখে মহাত্মার মহত্বই প্রকাশ
পেয়েছে।
গান্ধি চার সন্তানের কথা বলেছিলেন তাঁর
সময়ের প্রেক্ষিতে।সেই সময় গড় হিসেবে প্রতি দম্পতির সন্তান সংখ্যা ১০/১২ হয়েও
যেত।বহু সন্তানের পিতা-মাতাদের সমাজে বিশেষ সম্মানের চোখে দেখা হতো।সেই সময়ে অধিক
সন্তানদায়ী মাতাকে ভাগ্যবতী বলা হতো।এখনকার ধারণার একেবারে বিপরীত।দেশ কালের
প্রেক্ষিতে জন্মনিয়ন্ত্রণে প্রশ্ন আসে। রাশিয়া ও ক্যানাডায় বর্তমানে জন্মনিয়ন্ত্রণ
নেই, কারণ তাদের জনসংখ্যা ক্রমহ্রাসমান।রাশিয়া
ছাড়াও ইউরোপে আরো কয়েকটি দেশ এই পথ অনুসারী।সেই সব দেশগুলোতে তাদের সরকার সন্তানের
জন্মের জন্য ভাতা দিয়ে থাকে এবং গর্ভবতী মায়ের পরিচর্যার জন্য নিখরচায় চিকিৎসার তো ব্যবস্থা রয়েছেই, শুশ্রুসারও ব্যবস্থা আছে।বলা বাহুল্য, ঐ দেশ গুলোতে প্রতি নাগরিকের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনে কোটি টাকা খরচ করতেও সরকার দ্বিধা করে
না।
যৌনতা ও জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়ে মহাত্মার মনোভাব স্যাংগারের সংগে সাক্ষাৎকারের প্রায় এক
দশক আগে ১৯২৫-এ ‘ইয়ং
ইন্ডিয়া’-তে এক প্রবন্ধে প্রকাশিত হয় এবং গান্ধির মতবাদ কেউই
মেনে নিতে পারেননি। স্যাংগার তখনই এক প্রতিবাদি নিবন্ধ লেখেন এবং গুরুদেব রবীন্দ্রনাথকে এ ব্যাপারে তাঁর
মতামত চেয়ে চিঠি লিখেন।স্যাংগার-এর
সমর্থনে তৎক্ষণাৎ রবীন্দ্রনাথ যে চিঠিটি পাঠান, তা গান্ধি-ভাবনার সম্পূর্ণ বিপরীত— মানুষের কবে নৈতিক বোধ জাগ্রত হবে, তার অপেক্ষায় বসে থেকে অসংখ্য শিশুকে
অভাব ও অকালমৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া চরম অন্যায়,এই ছিল রবীন্দ্রনাথের চিঠির সার কথা।
রবীন্দ্রনাথ এবং স্যাংগার, কেউই যে গান্ধিজিকে তাঁর দীর্ঘলালিত
ধারণা থেকে বিন্দুমাত্র সরাতে পারেননি, তা দশ বছর পরে গান্ধির সংগে স্যাংগারের কথোপকথনে স্পষ্ট হয়ে যায়। মূলকথা গান্ধিজি কখনো তাৎক্ষণিক ফলাফল
চাইতেন না,
তিনি চাইতেন সুদূরপ্রসারী
পরিণতি।ভারতের স্বাধীনতার লড়াইয়েও তা স্পষ্ট।দেশের মানুষদেরে নৈতিকতায় উন্নীত করা
তাঁর এক দিশা ছিল।অনৈতিক মানুষের উপর দেশের ভার দিলে দেশ রসাতলে যাবে, একথা তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন।গান্ধি
বুঝতেন,সামাজিক পরিবর্তনের মাধ্যমে স্বাধীনতা
না এলে,এই স্বাধীনতার কোনো মূল্য থাকবে
না।রাজনৈতিক স্বাধীনতা যথার্থ স্বাধীনতা নয়।তাই গান্ধি তড়িঘড়ি করে স্বাধীনতা লাভের
পক্ষে ছিলেন না,ব্রিটিশের সংগে আলাপচারিতার মাধ্যমে যে
স্বাধীনতা আমরা পাই, তাতে
গান্ধিজির সায় তেমন ছিল না।উল্লেখ্য, গান্ধিজি খণ্ডিত ভারত চাননি।তাঁর এই মননশীলতা, সার্বিক মঙ্গলের মনোভাব, তাঁর প্রতি কাজে প্রতিফলিত হয়, জন্মনিয়ন্ত্রণেও এর ব্যত্যয় নয়।
প্রাসঙ্গিক আর একটি ঘটনা এখানে জুড়ে
দিতে চাইছি।১৯৩৪ সাল।স্যাংগার-গান্ধি
সাক্ষাতের আগের বছর। বিহার এবং নেপাল ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত। পাটনা ধূলিসাৎ, স্রেফ একটি প্রাসাদ টিকে ছিল। বিহারে মৃতের সংখ্যা সরকারি হিসেবে
৭২৫৩।
ঘটনার অব্যবহিত পরে গান্ধিজি এক প্রেস
বিবৃতিতে জানান, হরিজনদের সংগে বিহারে যে ব্যবহার করা
হয়, অর্থাৎ অস্পৃশ্যতা, সেই পাপের শাস্তি এই ভূমিকম্প।গান্ধির এই মন্তব্য ‘হরিজন’ পত্রিকায় ছাপা হলো।গান্ধির এহেন বয়ানে রবীন্দ্রনাথ বিচলিত
হলেন,এযেন তাঁর জানা গান্ধি নন, অন্য কেউ। প্রথমে তিনি গান্ধিকে এক
ব্যক্তিগত চিঠি লিখে জানতে
চাইলেন খবরে যা বেড়িয়েছে তা সত্য কি-না। যদি তাঁর প্রকৃত বক্তব্য এটি হয়, তবে খোলাখুলি বিরোধিতা করা উচিত এবং
তিনি তা করবেন।
রবীন্দ্রনাথ গান্ধির এই ব্যাপারটা অবৈজ্ঞানিক
বলে মন্তব্য করেন।ভূমিকম্পের সংগে ঈশ্বরের অভিশাপের সম্পর্ক তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি, অন্তত মহাত্মার কাছ থেকে এমনটা আশা
করেননি।পরে তিনি গান্ধির জবাবে গান্ধির এমন অবৈজ্ঞানিক মন্তব্যের কারণ বুঝতে পেরে
নীরব থাকেন।
গান্ধি জানতেন কোন দেবতা কোন ফুলে
তুষ্ট।গণদেবতার মানসিকতা মহাত্মার ভালই জানা ছিল।এই প্রসঙ্গে
বারট্যান্ড রাসেলের একটি কথা মনে পড়ে।রাসেল বলেন, প্রয়োজনে মানুষকে ডিপ্লোম্যাটিক
হওয়া দরকার(ডিপ্লম্যাটের কোনো উপযুক্ত বাংলা শব্দ এই লেখকের জানা নেই। বাংলা
অভিধানে যা আছে তা ডিপ্লম্যাট শব্দের যথার্থ অর্থ ও ব্যঞ্জনা কোনটাই বহন করে
না।‘কূটনীতি’ ডিপ্লম্যাটের বাংলা-করন হতে পারে না।)ঘরেবাইরে সর্বত্র।আসলে
ডিপ্লোম্যাসিতে রাজনীতি নেই।রাজনীতিতে মিথ্যাচার চলতে পারে, কিন্তু ডিপ্লোম্যাসিতে
কখনো নয়।পরিবার, দেশ, সমাজের ক্ষতি না করে মানুষের মঙ্গলার্থে যে বুদ্ধি প্রয়োগ
করা হয়, তাই ডিপ্লোম্যাসি।মানুষে মানুষে সাধারণ এডজাস্টম্যান্টেও ডিপ্লোম্যাসির
প্রয়োজন, রাজনীতি নয়।ডিপ্লম্যাসি পুরোটাই ধনাত্মক, রাজনীতি ধনাত্মক ঋণাত্মক
মিশ্রণে।গান্ধি পৃথিবীর তাবড় ডিপ্লোম্যাটদের মধ্যে একজন। মূলকথা, মানুষের বদ্ধমূল ধারণার বাইরে গিয়ে
কোনো কিছু মন্তব্য করা উচিত নয় বলে তাঁর ধারণা।যে অসত্যে আপামর জনসাধারণ বোঁদ হয়ে
আছে তা সহজে হটানো যায় না, বরং
তড়িঘড়ি করে হটাতে গেলে হীতে বিপরীত হতে পারে।মানুষের দীর্ঘ লালিত ধারণা সমাজ
সংস্কারের মাধ্যমেই সমূলে উৎপাটন করা সম্ভব এবং তা করা সময় সাপেক্ষ।গান্ধির এই
মনোভাবই বোধ করি, তাঁর
অহিংস আন্দোলন আর সময় সময় উপোস থাকতে তাঁকে সাহায্য করে যা ইংরেজের কাছে
ধারণাতীত।তাই পশ্চিম মহাত্মার মধ্যে যিশুর প্রতিরূপ দেখতে পায়।বিহারে ভূমিকম্পের
প্রেক্ষিতে গান্ধির মন্তব্য অস্পৃশ্যতা নিবারণের এক হাতিয়ার মাত্র,যদি এই কুসংস্কার অর্থাৎ “ভূমিকম্প পাপের ফল” জেনে মানুষ অস্পৃশ্যতা ত্যাগ
করে।মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, উচ্চ-নীচ
আর ছুঁয়াছুঁত কী করে নিবারণ করা যায়,এ’ব্যাপারে গান্ধি সর্বদাই প্রয়াসী
ছিলেন।
মহাত্মার প্রতি কাজে ভারতীয় পরম্পরায়
যা কিছুতে অভ্যস্ত মানুষ তা কাজে লাগিয়ে সমস্যার সমাধান করতে চাইতেন, এর বিপরীতে গিয়ে সমাধান চাইলে হীতে
বিপরীতও হতে পারে, একথা
বুঝি তিনি মনে করতেন।বৈষ্ণব ও জৈন ধর্মের প্রভাবে উপোস থাকা গুজরাটিদের অভ্যেসে
পরিণত হয়ে গিয়েছিল।হিন্দু ধর্মাচরণের অন্তর্গত হয়ে ওঠে উপোস।সেইজন্য স্বাধীনতা
আন্দোলনে আপামর ভারতীয়ের স্বভাবসিদ্ধ অভ্যাসকেই হাতিয়ার হিসেবে গান্ধি কাজে
লাগান।মধ্যবিত্ত ও সাধারণ সনাতনীদের আক্রমণ-প্রত্যাক্রমণ সভাবসিদ্ধ নয়।প্রসংগত,নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু পরিচালিত
স্বাধীনতা আন্দোলনে লড়াই ছিল গড় ভারতীয় স্বভাবের বিপরীতে।মহাত্মার আন্দোলন গড়
ভারতীয় স্বভাবের অনুকূলে।যৌন সংযমের নির্দেশ ঋষি পতাঞ্জলি দিয়ে গেছেন এবং এই
সংযমের কথা আমরা বাল্যকাল থেকে লোকোমুখেও শুনে আসছি।অসংযমী যৌন জীবন, জীবন বিপন্ন করে, সমাজ উচ্ছন্নে যায়—এ-ই আমরা শুনে আসছি।গান্ধি জন্মনিয়ন্ত্রণে
এই বোধকে কাজে লাগাতে চেয়ে ছিলেন।
স্যাংগার ব্যক্তিগতভাবে মহাত্মার
জন্মনিয়ন্ত্রণ ফর্মুলা মেনে নিতে না পারলেও, গান্ধির প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা
অটুট থাকে। স্যাংগার তো শুধু একজন পত্রকারই ছিলেন না, মানবিক নানা কাজে তিনি নিজেকে নিযুক্ত
রাখতেন।গান্ধির সংগে তাঁর মতানক্য জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে,গান্ধির এই মনোভাবে তিনি
দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন।সেই দুশ্চিন্তাই তাঁকে সুদূর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতে
নিয়ে আসে আর ফলে আমরা পাই মহাত্মা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধির অন্য একটা দিকের
সন্ধান।
Sources:
1.Margaret Sanger, “Gandhi and Mrs.
Sanger Debate Birth Control,” Nov 1936.
Published article source Vol
26No. 11, Nov.1936, pp.698-702.
2. An Autobiography:The story
of My Experiments with Truth.
স্মৃতির ভেতরে স্মৃতি
--সমরবিজয়
চক্রবর্তী
প্রায়
তিন দশক অধরচাঁদে কাটিয়ে ২০১৫খ্রিঃ-এর সেপ্টেম্বর মাসে চাকরি থেকে রেহাই পেলাম,
হলাম নিজেই নিজের রাজা। আমার কোনও কালেই চাকরি পছন্দের ছিল না, স্বাধীনচেতা কিনা।
তবে এই স্বাধীনতা অন্যের ক্ষতি করে নয়।
অধরচাঁদে
আসি আমি বিহারা বাজার যুধিষ্ঠির সাহা হাইয়ার সেকন্ডারি স্কুল থেকে বদলি হয়ে
১৯৮৬তে।তখন অধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলেন স্বর্গীয় অজিত রায়।আমি পলুদা(স্বর্গীয়
মৃণালকান্তি দত্ত বিশ্বাস)র কাছে আমার বদলি-পত্র দেখিয়ে একটি কপি
তাঁর হাতে সমঝে দিই।তাঁর বয়ানেই জয়েনিং রিপোর্ট লিখি। প্রথম দর্শনেই তাঁকে
আপন মনে হল।সহজে স্বাভাবিক হতে পারলাম তাঁর কাছে।আমি স্বভাবত আমার চেয়ে বয়স্কদের
প্রতি মান্যতা বজায় রেখে চলি। এ যে আমাদের পারিবারিক শিক্ষা।আমার চেয়ে বয়সে তিন
মাসে বড় আত্মীয় কেও বাবার নির্দেশে প্রণাম করতে হয়েছে।সকল বয়স্কদের কাছে নত হওয়া
আজকের দিনে বড় কঠিন,কারণ,কার কাছে নত হই, কে কত মানুষ না মানুষ সেজে আছে।
বড়
হয়ে এ বিষয়ে বেশ বেগ পেতে হত, কারণ বয়স্কদেরে অনুকরণীয় ভাবতাম কিনা। কিন্তু বেশির
ভাগ ক্ষেত্রেই দেখতাম এঁরা মুখোশ পরে
আছেন, আমাদের সমাজে বেবাক মানুষকে দেখি ভেতরে ও বাইরে মোটেও এক নন।দু-একজন বেশ
কিছু “ভেতরে বাইরে অন্তরে
অন্তরে” যে পাইনি,এমন
নয়,তবে তাঁরা নিছক খ্যাতি লোভিদের ভিড়ে চাপা পড়ে আছেন।
মাঝে
মাঝে প্রশ্ন জাগে নিজের অজান্তে আমিও কি ঐ সব মুখশধারি
মানুষদের
মতো হয়েগেছি? কারণ রোমে থাকলে তো রোমানদের মতো হয়ে
যেতে
হয়!কিন্তু না, রোমানদের চরিত্রে নঞর্থকতার আধিক্য থাকলে কখনও
নয়,
সে যে কোনও সমাজ-ধর্ম-দেশের মানুষই হোক,এঁদের থেকে যতটা
পারা
যায় দূরে থাকা বাঞ্ছনীয়, নইলে নিজকে ক্যাটালিস্ট করে গড়ে তোলা
চাই।
মোদ্দা কথা,এই মানুষগুলো চির দুখি, আনন্দ তাঁদের ধারে কাছে
ছায়াটুকুও
ফেলে না।এঁরা পরশ্রীকাতর ও নিন্দুক।দুখিকে সাথি করলে নিজেই
দুখি
হবে, হয় তাদের মানসিকতা পালটাও, নইলে তাদের থেকে নিজেকে
নিরাপদ
দূরত্বে রাখো।
চাকরি
সূত্রে অধরচাঁদে আমার যাপন দিনগুলির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে
প্রাসঙ্গিক
এটা
ওটা বলতে হচ্ছে।প্রেক্ষাপট রচনারও প্রয়োজন পড়ে।
আমার
কৈশোর অব্দি কাটে চা বাগানে। পাঠশালা স্কুল অবধি কাটে দিগরখালে,সেটাও চা বাগান
শ্রমিক-বস্তির পাশে শ্রীনগর কলোনিতে।আমাদের বাড়ির এক পাশে বিস্তর চা বাগান।বলে
নেওয়া ভালো, মানুষের কলুষ দিক দেখার সুযোগ আমার কম ছিল।তবে বাল্যকালে কিছু
রক্ষণশীলতা এবং কুসংস্কারের শিকার হতে হয়েছে।এনিয়ে অনেক দৃষ্টান্ত খাঁড়া করা
যায়।এখানে একটা ঘটনা তুলে ধরছি।এক শীতের সকালে মাঠে খেলা সেরে বাড়ি ফিরছি।এক দর্জির
দোকানের পাশ দিয়ে মুরগির ডাক দিতে দিতে যাচ্ছিলাম। দর্জিদাদা আমাকে ডেকে বললেন—
তুমি
বাহ্মণের সন্তান, তুমি মুরগির ডাক দিচ্ছ! আজকাল আর ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণ রইল না।
আমি
ভেবাচেখা খেয়ে গেলাম।নিশ্চিত আঘাত পেলাম।আমি বেশ হাঁস, পায়রা,ডাহুক, কোকিল, কুকুর,
বেড়াল,শেয়াল,ছাগল,গরু ইত্যাদি পশুপক্ষীর ডাক দিতে পারতাম ঐ শিশু বয়সেই।ঐ দিন থেকে
এ সব অনুকরণ আমি ছেড়ে দিলাম।এরকম অনুকরণ করে আওয়াজ তোলা মিমিক্রি শিল্পের
অন্তর্গত,মিমিক্রি তো বিশ্ববন্দিত শিল্প।এভাবে শিক্ষক হিসেবে না জানি কত
ছেলে-মেয়ের স্বাভাবিক প্রতিভা আমরা নষ্ট করছি।স্বাভাবিকভাবে বড় হওয়ার পথ আমরা
রুদ্ধ করছি,অন্তর-মনের মুক্তির স্বাধ-পাওয়া থেকে আমরা তাদের বিরত করছি।এ আমার কাছে
এক ধরণের হত্যা বলে মনে হয়।এ রকম—না,
না, পারে না—বলে, কপি-পেস্ট
করিয়ে কত ছেলের যে জীবন আমরা নষ্ট করছি।
বাবা-মা-এর
মন নিতান্ত “স্বর্ণযুগের”
মানুষের মত।আমার অন্যান্য ভাইবোনেরা অন্যত্র পড়াশোনা করেছেন। আমি আর আমার ছোটবোনের
কৈশোর অব্দি জীবন কাটে নিরবিচ্ছিন্ন ধারায় চা বাগানে।চা বাগানের শ্রমিকদের ছেলেদের
সিঙ্গে মেশা বারণ ছিল।আমি ছাড়া বাগানে কোনও বাবুর ছেলে ছিল না।জীবন ছিল এক ধরণের,
একপেশে।জীবনের বৈচিত্র অনেকাংশেই বই পড়ে জানা।ভাইবোনদের ঘরে ফেরা,বিশেষ আত্মীয়দের
উপস্থিতি বাড়িতে আনন্দের অন্য মাত্রা নিয়ে আসত।
আমার
কলেজ কাটে শিলচরে, শিলচরকে ভালবাসতে পারিনি তত,যতটা শিলঙকে ভালবাসতাম।শিলঙে তো
একনাগাড়ে থাকিনি, ঘুরতে যেতাম। বড় জোর এক মাস।প্রসঙ্গত, আজো শিলং, এ দেশে আমার
কাছে, শ্রেষ্ঠ শহর।এর
একটা কারণ হয়তো শিলঙে ক্লামজি মনের মানুষের সংগে আমার দেখা হয়নি, তবে আক্রমণকারী
খাসির খোপরে পড়তে হয়েছিল।তবুও শিলং আমার কাছে রূপকথার মত,রূপকথার আমেজে
পুষ্ট।ক্লাস নাইনে পত্রমিতা পেতে ছিলাম সিমলার মেয়ে অনুপমা নটিয়ালের সংগে।বহু বছর
পর অনুপমার সংগে চাক্ষুস দেখা শিলঙে।শিলং আমাকে পৃথিবীর পথে হাঁটতে শিখিয়েছে।
দুই
ব্যক্তি
বিশেষের কোনও জীবনদর্শণ কোনও কাজের নয়,যদি
সমাজ তা গ্রাহ্য না করে।মানবতাবোধনিস্ট সামাজিক কিছু নির্দিষ্ট নীতির প্রয়োজন যা ঐ
সমাজে বাসকরা প্রতিটি ব্যক্তি পালন করে চলবে।এর মধ্যে নির্দিষ্ট ব্যবহার বিধি
অন্যতম।অধরচাঁদ কোন্ কোন্ নীতির উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হচ্ছিল,তা জানার চেষ্টা
করেছি।বেবাক বাংলা মাধ্যমের স্কুলগুলোর মতই তো অধরচাঁদ, কোনও রকমফের নেই। রকমফের
আছে শুধু রেজাল্টে।উল্লেখ্য, স্কুলে কিছু অসাধারণ ব্যক্তিত্বশালি জ্ঞানী শিক্ষকের
সমাহার ঘটেছিল।প্রত্যেকেই দেখতাম রেজাল্ট-ওরিয়েন্টেড শিক্ষার প্রতি নজর দিতেন।অভিবাবকরাও
রেজাল্ট-ওরিউএন্টেড শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছেন।আমাদের সমাজে চরিত্র গঠন কী
করে করা যায় এর কোনও নির্দিষ্ট সিস্টেম নেই।এ কথা ঠিক নির্দিষ্ট জীবনদর্শনই যদি না
থাকে তা হলে চরিত্র গঠনের কথাই তো বৃথা।শিক্ষাক্ষেত্রেও এর প্রতিফলন
ঘটেছে।শিক্ষকদেরেই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে দুর্নীতির আওয়তায় শিক্ষা দিতে হয়,এই
বিষবাস্পের মধ্যে ছাত্রের চরিত্র গঠন কী করে সম্ভব।অনেক মেধাবী ছাত্রের বৃদ্ধ
পিতা-মাতার প্রতি আচরণ দেখে স্তম্ভিত হতে হয়, একী শিক্ষা।শুধু রেজাল্ট-ওরিউএন্টেড
শিক্ষাদ্বারা দেশ-সমাজ গড়া যায় না,নীতি-বহির্ভূত উন্নত সমাজ গঠন করা সম্ভব নয়,এই
নীতির তালিম নিতে হয় স্কুল জীবনে। তাই শুধুমাত্র
রেজাল্ট-ওরিএন্টেড শিক্ষা আমাদের নিষ্প্রাণ সমাজে “মানুষ
মানুষের জন্য” মহান কথা তোতা
বুলির মতো মুখে মুখেই উচ্চারিত হয়। যে দেশে সমাজ কোনও নির্দিষ্ট শুভ নীতির উপর
ভিত্তি করে গড়ে ওঠে না,সে সমাজে প্রতিটি মানুষই অসুস্থ হতে বাধ্য—শরীর
ও মন দুটোই ভোরের তাজা রোদ পোহাতে পারে না।তাই তো মানুষের মুখে স্বাভাবিক হাসির
অভাব।প্রথম বিশ্বে যাবার দরকার নেই, আমাদের পাহাড়ি অঞ্চলে ঘুরুন,এতো সব অসুবিধের
মধ্যেও মানুষের মুখে আনন্দের ছাপ দেখা যায়।অগ্রন্থিত সমাজে আমাদেরে বড় হুঁশিয়ারে
থাকতে হয়,ওই যদি কেউ মন্দ কথা
কয়।আমাদেরে বড় পোশাকি থাকতে হয়
ওই যদি কেউ মন্দ কথা কয়।আমার মনে হয়,আমাদের এতো ওষুধ গিলতে লাগত না, যদি আমরা
সুস্থ সমাজে বাস করতাম।
তিন
অধরচাঁদে
এসেম্বলির কোনও বালাই ছিল না, অথচ
এসেম্বলি ছাড়া শিক্ষা অসম্পূর্ণ হয়ে পড়ে। এসেম্বলি, হাউস সিস্টেম—এ
সব, ছাত্রের সমবেতভাবে চরিত্র গঠনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম।সুষ্ঠ সমাজের নীতিগুলো
এসেম্বলির মাধ্যমে সহজে ছাত্রদের কাছে পৌঁছোতে পারে।অবলীলাক্রমে এই নীতিগুলো তাদের
প্রাত্যহিক জীবনচর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।এসেম্বলি ও হাউস সিস্টেমের মাধ্যমে
শিক্ষকরাও নিজেদেরকে এক সুস্থ সমাজের সদস্য হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন এবং তা অনায়াসে
সম্ভব।বলতে দ্বিধা নেই,আমাদের বিদ্যানিকেতনগুলো কোনও নির্দিষ্ট শুভ নীতির উপর
ভিত্তি করে সমবেত চেষ্টায় বাস্তবায়িত হয় না বলে, আজ বাংলাভাষীর এ হাল, দেশের-দশের
এ হাল।বহু রেনেসাঁ ব্যক্তিত্ব এই দেশে জন্মেছেন, উন্নত নীতিকথা মূলক, উচ্চ
দর্শণ-সম্বিলিত বইপত্রের অভাব নেই, অভাব শুধু সিস্টেমের।বিজ্ঞানভিত্তিক
সিস্টেমের।এই অভিলাষেই সমীর রায় চৌধুরীর অধ্যক্ষের দায়িত্বে থাকা কালীন সময়ে, ১৯৯৪
খিস্টাব্দে নিজ উদ্যোগে প্রথম অধরচাঁদে
এসেম্বলির ব্যবস্থা করি।কদিন চললও।এ ব্যাপারে সপ্রণোদিতভাবে এগিয়ে আসেন দু একজন
শিক্ষক।এদের মধ্যে নিতাই দত্ত ও মিহির চক্রবর্তীর নাম উল্লেখ না করলেই নয়। কদিন
চলার পর, অধ্যক্ষ মশাই আমাকে ডেকে এসেম্বলি বন্ধ করে দিতে বললেন। কারণ জানতে চাইলে
বললেন, বিশিষ্ট কজন শিক্ষক এর পক্ষে নন।কেন পক্ষে নন?—এই
সিস্টেমটা তাঁদের মনোপুত নয়।এতে করে, হয়তো তাঁরা ভেবেছেন,ছাত্রদের পড়াশোনায়
ব্যাঘাত ঘটবে।সুতরাং নিরস্ত হলাম।
আমার
অবসর নেবার কয়েক বৎসর আগে সরকারি নির্দেশে এসেম্বলি আবার শুরু হল।এ মর্মে এক সভা
ডাকা হয়, আমাকে এসেমবলি গড়ার কাজে প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।আমার সংগে ছিলেন
কৃষ্ণা ভট্টাচার্য ম্যাডাম।তিনি আমার আগে চাকরি থেকে অবসরে যান।প্রত্যেকের
সহযোগিতায় এসেম্বলি জোর কদমে চলতে লাগল।ক্রমে স্কুলের জন্যে একটা স্কুল সঙ্গীতের
একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়ে, দায়িত্বে থাকা প্রাক্তন অধ্যক্ষ মুক্তা দাসের অনুরোধে
একটা স্কুল সঙ্গীত রচনা করি।গানটি তৈরি করে প্রথমে আনন্দময়ী ভট্টাচার্য,মৈত্রেয়ী দাম,শুভপ্রসাদ
নন্দিমজুমদার,কালিকাপ্রসাদদের মতো বিদগ্ধ সঙ্গীত শিল্পী ও সঙ্গীত বিশেষজ্ঞদেরকে
শুনাই, তাঁরা এক বাক্যে প্রস্তাবিত বিদ্যালয় সঙ্গীতটির ভূয়সী প্রসংশা করেন।বিশেষ
করে আনন্দময়ী দেবী(উপরে উক্ত সকলেরই সঙ্গীত গুরু)র পরামর্শে সুরের দিকটায় খানিক
এদিকওদিক করি।এ ছাড়াও, বর্তমানে বাংলা গানের জগতে সুখ্যাত গান লেখক অরনা(কণ্ঠ
শিল্পী শ্রীকান্ত আচার্যের স্ত্রী)একবার আমার শিলচরের বাড়িতে এসেছিলেন, তিনি এই
লিরিকের প্রশংসা করে গেছেন।অপরদিকে, স্কুলের ইনচার্জ অধ্যক্ষ মুক্তা দাস সমেত এক
বাক্যে প্রত্যেকেই গানটির তারিফ করলেন এবং এসেম্বলিতে গাওয়ানও হল।একদিন আচমকা
অধ্যক্ষ আমাকে বললেন গানটি যাতে এসেম্বলিতে আর গাওয়ানো না হয়।গানের মধ্যে তো স্কুলের গুণগান রয়েছে,
নিছক গানের জন্যে তো অন্তত গানটি গাওয়ানো যেতো।তাঁর অনুরোধে লেখা, তাঁর এতো তারিফ
করা গান—ছাত্রদেরে গাওয়ানো
আর হল না।বাঁধা ডিঙ্গিয়ে আমি আর গাওয়ালাম না, কারণ তা উচিৎ ছিল না।যাক,আমি
এসেম্বলি চালিয়ে গেছি দীর্ঘ দিন।শিক্ষকদের অনেকেই আমাকে সক্রিয় সহযোগিতা করলেন।
রোটিন বানিয়ে দিয়েছি, কে কোন দিন এসেম্বলির দায়িত্বে থাকবেন। সে ভাবে এসেম্বলি
চলতে লাগল। এসেম্বলির গুনাগুণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রকাশ পেতে
লাগল।পরিস্কারপরিচ্ছন্নতা এবং শৃঙ্খলা বোধে স্কুলে নতুন জোয়ার এলো।কিন্তু সবগুলো
নীতি কারয্যকরি করার মতো মনের অবস্থা আর রইল না।সবাইকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে নিজেকে আড়াল
করলাম।পারলাম না নৈতিকতার উপর ভিত্তি করে স্কুলে একটা সমাজ গঠন করতে।ছেলেগুলো
জীবনের নিয়ম-নীতি না জেনেই পাশ করে চলে যাচ্ছে। একত্রিতভাবে চলার নিয়ম-নীতি তাদের
মধ্যে পুরোদমে চর্চিত হবার আগেই সব ভেস্তে গেল।এই কচিকাঁচা নিষ্পাপ ছেলেদের জন্যে
দুঃখ হয়—তাঁরা কী
শিখছে!অধরচাঁদে বেশিরভাগই বস্তি এলাকার ছাত্র। তাদেরে দেখে কষ্ট হতো—দিশাহীন,কোনও
মূল্যবোধহীন জনগোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে হাবুডুবু খেয়ে আর সবার মতো নিজেকে বাঁচিয়ে
রাখবে, এই যা।আমি তাদের জন্যে কিছু করতে পারলাম না, এ আফসোস আমার রয়ে গেলো।যাক,
বর্তমানে এক বেসরকারি স্কুলে যতটা সম্ভব মনের
মতো করে এক উন্নত স্কুল-সমাজ গঠন করার প্রক্রিয়ায় রয়েছি।আশা আমার
দুর্নিবার।
প্রসঙ্গত,এ
কথা না বললেই নয়—আজকাল
ছাত্রদেরে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি প্রদান করা সরকারিভাবে নিষেধ।সুতরাং কোনো কোনো
স্কুল-প্রধান নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই নিয়ম পালন করার চেষ্টা করছেন।মানুষ তো আর
যন্ত্র নয়,শাস্তি না-দেওয়ার কারণের পেছনে যে নৈতিক দিক রয়েছে এ ব্যাপারে আমাদেরে
ওয়াকিবহাল থাকা চাই। একটা ছেলেকে নিলডাউন করালে,বিশেষ করে তাঁর সহপাঠিদের
সামনে,তাঁকে কিন্তু সারা জীবনের জন্যে ন্যুব্জ করে দেওয়া হল।শাস্তি পেতেপেতে তাকে
এক ধরণের অস্তিত্ব সংকটের মধ্যে জীবন কাটাতে হয়।এক সময় স্ট্রাকচারেলি সে বড় হয়ে যেতে পারে অর্থাৎ চাকরি কিংবা ব্যবসায়ে সে
অনেক উন্নতি করতে পারে,কিন্তু তার পক্ষে মানুষ হওয়া দুষ্কর।বিবেকরহিত মানুষ হবে
সে।ঘুষ-খাওয়া থেকে শুরু করে সকল প্রকার কুরুচিপূর্ণ ধ্বস্ত জীবনে সে তলিয়ে যাবে।
মানুষের প্রতি ,সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতা থাকবে না। মুখে মিষ্টি, ভেতরে বিচ্ছু—এ
রকম মানুষই তো আমরা গড়ছি, আমরা নিজেরাও হচ্ছি বা হয়ে গেছি।এ রকম ভয়ে ভীত, ত্রস্ত,
পলায়ন মনোবৃত্তির মানুষ একটা সুঠাম সমাজের ফসল হতে পারে না।সেই জন্যেই শিশুদেরে
শাস্তি প্রদান করতে নেই।এ সমস্ত কারণে আমরা সুস্থ মানুষ গড়তে পারছি না।মূল যেখানে
সেখানেই যদি গণ্ডগোল, তা হলে আর কী করা।
শিক্ষা
বিভাগই তো দুর্নীতির আখড়া—এটা
ওপেন সিক্রেট।তা হলে দেশ-সমাজের কী ভবিষ্যৎ!ছেলে-ছোকরারা কথা শুনে ততটা শেখে না,
শেখে দেখে—শিক্ষক,
পিতামাতা,বড়দের ক্রিয়াকলাপ ও আচরণ দেখে।
চার
আমার প্রাণচঞ্চল ছেলেদেরে বেশি ভাললাগে, সে কথা
কাটাকাটি করুক, দুর্বিনীত হোক আপত্তি নেই।ঘরে-বাইরে বকুনি ও শাস্তি পেয়ে পেয়ে এই
প্রাণময় ছেলেগুলো বেপথে চলে যেতে পারে।বেবাক লোক তাদেরে বলেন নষ্ট ছেলে।আরে নিজেরা
যে কতটা নষ্ট সেটা কী আমরা দেখি? সুযোগ পেলে ঘুষ দিতে-নিতে এক পায়ে খাঁড়া।আমরা বলি
আবার,ছেলেটা নষ্ট হয়ে গেছে।“আপনি
আচরি ধর্ম পরেরে শেখায়”।বলতে
দ্বিধা নেই, প্রথম আমি পলুদার আমলে স্কুলে এক প্রাণময় আবহ পাই।তিনি সব সময় হেসে
কথা বলতেন।সমিরন স্যার, সুনীল স্যার—এই
ইনচার্জ প্রিন্সিপালদ্বয় হাস্যময় কিন্তু
পাঠক্রম বহির্ভূত কার্যক্রমে তাঁদের মন তেমন ছিল না।তবে সত্যি কথা বলতে কী, আর যাই
হোক প্যাঁচপুঁছ এঁদের মধ্যে পাইনি।“মানুষে
বিশ্বাস হারানো পাপ”,
কথাটা তাঁদের বেলায় অনেকাংশে খাটে।সুশীল দে,ইনচার্জ প্রিনসিপাল, বলতে দ্বিধা নেই,
আর যাই হোক হাসিমুখো ছিলেন না।
তিনিও সংস্কৃতির তেমন ধার ধারতেন না।আমাদের মতো সংস্কৃতি মনস্ক, মননশীল ও সৃজনশীল
মানুষের পক্ষে খাপখাওয়ানো অসুবিধের ছিল।সুতরাং কমিউনিকেশন গ্যাপ থাকা স্বাভাবিক
ছিল।
হাইয়ার
সেকন্ডারি সেকশনে রেজাল্ট-ওরিয়েন্টেড উন্নতির জন্যে যার নাম স্মরণ না করলেই না হয়,
তিনি ছিলেন, জগদীশ চক্রবর্তী।এ ছাড়াও একটা সমাজনিষ্ট মন ছিল তাঁর।প্রাণ শক্তিতে
ভরপুর এই মানুষটা।
মনে
পড়ে অমরেন্দ্র গোস্বামীর কথা।বাংলাভাষার ব্যাকরণ তাঁর ঠোটস্ত ছিল।সংস্কৃতে তাঁর
দখল ছিল ভাল।এটা-ওটা জানার জন্যে আমি যখনই সুযোগ পেতাম তাঁর সংগে দেখা করতাম, মত
বিনিময় হতো। বলতে দ্বিধা নেই, এ রকম একজন ব্যক্তি যতটুকু তাঁর মর্যাদা পাওয়ার কথা
ছিল,এর সিকি ভাগও পাননি।তিনি হৃদ-রোগে আক্রান্ত ছিলেন।এক দিকে চিকিৎসা, অন্যদিকে
বাড়ি করবেন।ব্যাঙ্কের লোনের কোনও গেরান্টার পেলেন না।শেষমেশ এই অধমের কাছে।খানিক
ইতস্তত করেছি নিশ্চিত। তবে ভেতর থেকে নির্দেশ এলো,এ আমার হয়(সঙ্কটকালে অশরীরী কেই
যেন এসে আমাকে বলে যান),আমি পালন করলাম,সিগনেচার দিলাম। গেরান্টার হোলাম।এই সজ্জন
লোক, পণ্ডিত-মানুষ আজ আর ইহ লোকে নেই।তিনি ব্যাঙ্ক-ঋণ শোধ করে গেছেন।
গায়ত্রী
ভট্টাচারয্য—একেবারে নিজের দিদি
মনে হত।কোনও দিন কোনও কটু কথা তাঁর মুখে শুনিনি।কোনও এক ঘটনার প্রেক্ষিতে তাঁর
মুখে আমার মায়ের বাণী শুনলাম—“
দেখে শুনে মাতে না, কোনও আপদে পায় না।”
আর একটা কথা, বলতে ইতস্তত করছি তবে বলে নেওয়াটা ভালো বলে মনে করি।আমার ইংরেজিতে
লেখা ছোটো গল্প বেরোয় সাহিত্য অকাদেমির পত্রিকা “ইন্ডিয়ান
লিটারেচার”এ।স্থানীয় পত্রিকার
প্রথম পৃষ্ঠায় ফোলাও করে সংবাদটা উঠলো।সেই সকালেই গায়ত্রীদি আমাকে অভিনন্দন
জানান।অভিনন্দন জানান তেজপুর থেকে গায়ত্রীদির বাবা(মেশোমশাই)।
সুমিত্রাদির
কথা মনে পড়ে।তিনি সক্রিয় ফেসবুকে—তাঁকে
পাই।গায়ত্রীদিকেও পাই ফেসবুকে, বড় আনন্দ পাই, তবে তিনি কোনও মত প্রকাশ করেন না।
দেশেরদশের ক্রুসিয়াল সময়ে তাঁর কোনও মত নেই, কানে শুনতে পাই—“
দেখে শুনে মাতে না, কোনও আপদে পায় না।”
আমার
অবসরে যাওয়ার কয়েক মাস আগে এলো প্রদীপ্তা সেন, তারপর এলো বাপি।প্রদীপ্তা খুশ মেজাজি
মেয়ে, প্রতিবাদী।এরা দুজনই প্যাঁচপুঁছের ধারে কাছে নেই।বাপির সংগে আমার আত্মীয়তার
সম্পর্কও রয়েছে।বিমল দে, পার্থ গোস্বামী বিশেষ কারণে সুখস্মৃতিতে লালিত।অনিতা—সোফেস্টিকেটেড
লেডি,স্বপ্ন দেখতে জানেন।শীপ্রা—সাংস্কৃতিক
কর্মকাণ্ডে এক পা বাড়িয়ে।আর ওদিকে অফিসে মঞ্জু দাস, মিত্রা দেবী,শ্রীমতী দেশমুখ—এঁরা
যথার্থ হেল্পফুল।বিশ্বস্থ হিরণ্ময়—চতুর্থ
শ্রেণীর কর্মী!সুকেশ আসে অনেক পরে, সেও ভালো লাগার ছেলে।মনে পড়ে ল্যাব
এসিস্ট্যান্ট অরবিন্দ, বিশ্বজীৎ আর দেবনাথদার কথা, তাঁরা ল্যাবের কাজ ছাড়াও স্ব
স্ব গুণে গুণান্বিত।বর্তমান ইনচার্জ অধ্যক্ষ প্রশান্ত নাথ—বাস্তবে
“প্রশান্ত”
নামের যথার্থতা পাই।তাঁর সাথে পরিচয় আমার অনেক আগের।আমরা একই ইউনিভারসিটি থেকে
মাস্টার্স করি।
স্মৃতিতে
আরও রয়েছেন,সকলের নাম না লিখলেও, তাঁরা সকলেই আমার আপন ছিলেন এবং রয়েছেনও।ছাত্রদের
সংগে আমার বরাবরই ভালো সম্পর্ক।ইংরেজি পড়ানর সুবাদে তাদেরে আমি পাঠের সূত্র ধরে
বিদেশ ঘুরিয়ে আনতাম।আমি দেখেছি পাঠ-প্রাসঙ্গিক ইতিহাস, ভূগোলের মাধ্যমে ছাত্ররা পাঠ বুঝে ভালো।মনের জানালা
খোলে।
স্মৃতিও
তো জীবনের ধন
যা
নিয়ে এগোয় জীবন
কিছু
স্মৃতি দুঃখময়
আর
সব সুখ
দুঃখ
ঝেড়ে ফেলে দিলে
সবই
তো সুখ।
------------------------------------------------
বাংলাভাষার সংকটজনক অবস্থান ও সমাধান
সমরবিজয় চক্রবর্তী
প্রয়োজনীয়তার ওপর নির্ভর করে বাঁচা-বাড়া—ভাষার ক্ষেত্রেও
তা।স্বাধীনতাপূর্ব ভারত উপমহাদেশে বাংলার অবস্থান এক, আর স্বাধীনোত্তর
খণ্ডিত ভারতে অন্য।তখন অবাঙালি অঞ্চলে কোথাও কোথাও স্কুল, কলেজে এমনকি
বিশ্ববিদ্যালয়স্তরেও বাংলা পঠন ছিল।অবাঙালি অঞ্চলে কোথাও কোথাও গ্রন্থাগারেও বাংলা বই পাওয়া যেত।অবাঙালির বাংলায় কথা
বলা গর্বের ছিল।ষাটের দশক অবধি, দেখা যায়, দেশের
সর্বত্র এমনকী রাজধানী দিল্লিতেও বাংলার একটি মান ছিল, অবশ্য
প্রাকস্বাধীন ভারতের সেই অত্যুঙ্গ গর্বের জায়গায় বাংলা এখন
আর নয়।এখন,স্বাধীন ভারতে বাংলার বিপরীত অবস্থান,বাঙালির
নির্দিষ্ট প্রদেশ পশ্চিমবঙ্গেই আজ বাংলা নানা ক্ষেত্রে উপেক্ষিত।পরবর্তী
প্রজন্মের বাঙালি বাংলায় কথা বলতে স্বাছন্দ্য বোধ করে না।এ যদি খুদ পশ্চিমবঙ্গে
হয়ে থাকে, তাহলে অন্যত্র কী তা বলার অপেক্ষা রাখে না।এমন কেন হবে, অসুখটা কী তা
জেনে নিলে নিরাময়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।সুতরাং প্রথমে অসুখের লাক্ষণিক দিকগুলো
জেনে নিতে হয়।
স্বাধীনতাপূর্ব ভারতে সরকারি দৃষ্টিতে ভারতীয় সকল
ভাষার একই মান ছিল।স্বাধীনোত্তর
ভারতে ভাষার মান বিচারে বিভাজন রয়েছে, এবং সে
অনুযায়ী সরকার বেড়ি পরিয়ে রেখেছে,প্রাক স্বাধীন ভারতে ভারতীয় সকল ভাষার সমান ও অবাধ অধিকার
ছিল।স্বাধীনতায় পেয়েছি চাকরি সংরক্ষণের মতো ভাষায়ও সংরংক্ষণ, সংরক্ষণ প্রায়
প্রতিটা ক্ষেত্রে—এমনতর সংরক্ষণ পৃথিবীর কোথাও নেই বলে জানি।স্বাধীন ভারতে হিন্দি
পাচ্ছে সরকারের সর্বোচ্চ মান, অর্থাৎ হিন্দি পাচ্ছে রাষ্ট্রের মুখ্য
পৃষ্ঠপোষকতা।দেশে উর্দুভাষী কোনও রাজ্য নেই, তথাপি ভারতীয় সকল ভাষার মধ্যে উর্দু
পাচ্ছে দ্বিতীয় স্থান এবং তা অলিখিত।কেন্দ্রীয় সরকার দিল্লিতে উর্দুর জন্য আলাদা
চ্যানেল খুলে রেখেছে।
আজ বাংলা রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিতে মনিপুরি, বোড়ো, সাঁওতালি ইত্যাদি ভাষার সমতুল্য। আজ বাংলা রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে আঞ্চলিকভাষা। নিজ গুণে যে
রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেয়েছিল বাংলা, আজ সে মর্যাদা নেই। রাষ্ট্রশক্তি পেছনে না থাকলে বাংলা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেতে পারে না।যদিও বাংলা আন্তর্জাতিকস্তরে অন্যতম উন্নত ভাষা,ভারতীয় সংবিধানে অষ্টম তপসিলভুক্ত ‘আঞ্চলিকভাষা’
অবিধা ব্যতিরেকে বাংলার কোনও স্থান দেওয়া হয়নি।তাই এই রেনেসাঁ ভাষা সরকারি বিশেষ
সাহায্য থেকে বঞ্চিত।আমাদের চাই সংবধানে অষ্টম তালিকাভুক্ত অবস্থানের
অতিরিক্ত বাড়তি মান,যাতে করে সরকারি বারতি
সুযোগ-সুবিধা বাংলা পেতে পারে,যে ভাবে হিন্দি পাচ্ছে।বাংলা পেতে পারে এদেশে
দ্বিতীয় সংখ্যাগুরু ভাষার স্বীকৃতি।দেশে বাংলা দ্বিতীয় সংযোগী ভাষার সাংবিধানিক
স্বীকৃতি পেয়ে যেতে পারত—এদিকে এগোচ্ছি না।যা বলার,ব্রিটিশ আমলে কোনও রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা ছাড়াই ভারতীয় উপমহাদেশের সকল ভাষার পথীকৃৎ হয়ে
ওঠল বাংলা।
তামিল, তেলেগু, মালয়ালম,কন্নড় এবং ওড়িয়া আদায় করে নিয়েছে
ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি, এখন এ’তাদের রক্ষা কবচ।নইলে কার্য-কারণ বশত এই পাঁচটি
ভাষাও হিন্দি আর ইংরেজির কবলে বাংলার মতো বগলদাবা হয়ে থাকত।ইংরেজির প্রভাব থেকে মুক্ত পৃথিবীর কোনও ভাষাই নয়,
জার্মান, ফরাসি, রাশিয়ার মতো ইউরোপের তাবড় ভাষাও শঙ্কিত।আমাদের বাড়তি শঙ্কা
হিন্দিকে নিয়ে।ব্যাপারটা তামিল আগে বুঝেছিল বলে, সর্বপ্রথম ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি
পায়, এতে হিন্দির আগ্রাসন থেকে তামিল অনেকটাই নিরাপদে অবস্থান করছে।সরকারের চরম
মদতপুষ্ট হিন্দির থাবা থেকে বাংলা কিন্তু মুক্ত নয়।
বাংলা সংবিধানের অষ্টম অনুচ্ছেদেই পড়ে রইল।
বাংলাভাষী কোনও দিন এব্যাপারে সরকারের সংগে বসেছে বলে এই নিবন্ধকের জানা নেই।এব্যাপারে
পশ্চিমবঙ্গ সমেত ত্রিপুরা,আন্দামান-নিকবর দ্বীপপুঞ্জ, ঝাড়খণ্ড ইত্যাদি বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলি থেকে তেমন কোনও
সাড়া পাওয়া যায়নি।তারা বাংলার প্রাদেশিক স্থান আদায় করতেও ব্যর্থ।এব্যাপারে আসামের
বরাক উপত্যকা দৃষ্টান্ত রেখেছে। ১৯৬১-এর ১৯ মে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে রেলপথ অবরোধের সময় আসাম পুলিশের একটি ব্যাটালিয়ন বাংলাভাষা আন্দোলনকারিদের উপর নির্বিচারে
গুলিবর্ষণ করে, এর ফলে ১১জন
ভাষাসৈনিক ঘটানাস্থলে শহিদ হন এবং আহত হন অর্ধশতাধিক।এভাবে এগার শহিদের রক্তের বিনিময়ে বরাক
উপত্যকা বাংলার সরকারি স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে যে বরাক উপত্যকার সরকারি ভাষা
বাংলা। গোটা আসামে বাংলা সরকারিভাবে অন্তত দ্বিতীয় স্থানে থাকার কথা ছিল। বরাকের
ভাষা আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়নি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালিরা।তৎকালীন গোয়ালপাড়া
অঞ্চল কিছুটা আন্দোলিত হয়েছিল, কিন্তু আসাম সরকার তা সহজে দমিয়ে দেয়।
বলাবাহুল্য,ইতিহাস লিখতে
গিয়ে দেখা যায় কিছু কিছু লেখক সত্যকে গোপন
রাখার চেষ্টা করেন, এতে ইতিহাস কুন্ঠিত হয়, সত্য লুণ্ঠিত হয়—তা সকল বিদ্বজ্জনদের
জানার কথা যে এদেশে তা হয়ে আসছে।’৬১র
ভাষা আন্দোলনে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় এক শ্রেনির বাংলাভাষীরা অসমিয়াদের
সাথে যোগ দিয়ে বাংলাভাষার নায্য দাবি
আদায়ের বিপক্ষে কাজ করে।শুধু তাই নয়, তারা “বঙ্গাল-খেদার” পক্ষে দাঙ্গায় লিপ্ত হয়।
বাংলা ভাষার বিরুদ্ধাচরণ ঐ শ্রেনির বাংলাভাষী বরাকেও করে, শুধু তাই নয়,এখানেও ধর্মভিত্তিক
দাঙ্গা করানো হয়।ঐ শ্রেনির একজন প্রভাবশালী বাংলাভাষী মন্ত্রী বরাকের এই ভাষা
আন্দোলনের বিরোধিতা করেন, তাঁর বিরদ্ধে এও অভিযোগ যে, তিনি নাকি দাঙ্গা
সংঘটিত করার পক্ষে মদত দিয়ে যান।বাংলাভাষা দাবির বিরুদ্ধে যারা সক্রিয় ছিলেন তাদের
নাম স্পষ্টত ইতিহাসভুক্ত হওয়া চাই।সুতরাং ’৬১র ভাষা আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস এখনও
লেখার বাকি।সময়ের সাথে প্রামাণিক তথ্য না হারালেই হয়।
উল্লেখ্য,বাংলা সাহিত্যে যে
রেনেসাঁস এসে ছিল উনবিংশ শতকে,
বিংশ শতকের
সত্তরদশক অবধি এর প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছে ভারতের প্রায় প্রতিটি ভাষা।হিন্দিভাষার
দৃষ্টান্তই দেওয়া যাক, যারা হিন্দিভাষা-সাহিত্যের ইতিহাস পড়েছেন, তাঁরা নিশ্চিত
লক্ষ করেছেন বাংলা সাহিত্যের প্রভাব হিন্দি সাহিত্যে কত,বাংলা সাহিত্যিকের নাম,বাংলা সাহিত্যমানের
গুণ-কীর্তন হিন্দি সাহিত্যের ইতিহাসে পরতে
পরতে মেলে, তবুও বাংলা ভারতের সংবিধানে আঞ্চলিক
ভাষামাত্র।
প্রসঙ্গত,বাংলাভাষা আর মৈথিলীভাষার
হরফ একই ছিল, কিন্তু বর্তমানে মৈথিলীদের ভাষার বর্ণলিপি দেবনাগরী।এব্যাপারে
হিন্দিভাষার ঔপনিবেশিকতা কাজ করেছে
বলে মনে করি। মৈথিলীদের অজান্তেই অনায়াসে হিন্দি
বর্ণমালা এসে গ্রাস করেছে তাঁদের নিজস্ব
বর্ণমালা।বোড়োভাষার
বর্ণমালা ছিল অসমিয়া( অসমিয়া বর্ণমালায় ‘র’-এর
পেট কাটা ছাড়া আর সবই তো বাংলা বর্ণমালার সঙ্গে মিলে যায়),এখন হয়েছে
দেবনাগ্রী।মনিপুরিভাষার বর্ণমালা ছিল বাংলা, এখন আর বাংলা নয়। বাংলা হরফের
গ্রহণযোগ্যতা হ্রাসপাওয়া বাংলাভাষার জন্যে ঋণাত্মক-সূচক তো বটেই।
আবার বৃটিশশাসিত বাংলায় সরকারি কাজকর্ম ও শিক্ষাব্যবস্থা ইংরেজি ভাষার
মাধ্যমে চললেও ধর্মসংস্কার ও সমাজ সংস্কার আন্দোলন, দৃষ্টান্তমূলক
উন্নত সাহিত্যসৃষ্টি ও সাংস্কৃতিক সৃজন হয়েছে বাংলায়।সেই সময় স্বাধীনতা আন্দোলন, জনগণের মুক্তিসংগ্রাম ও ভবিষ্যৎ চিন্তার অবলম্বন ছিল বাংলাভাষা।তখন
জনসাধারণের মধ্যে দেশপ্রেম, স্বাজাত্যবোধ ও জাতীয় উন্নতির আকাঙ্ক্ষা ছিল প্রবল। সে
অবস্থায় বাঙালির চিন্তাধারা বাংলাভাষা ও বাংলা সাহিত্যের বিস্ময়কর রকম উন্নতি
হয়েছিল। সেদিন বাংলাভাষার ভাবুক ও কর্মীদের চালিকাশক্তি ছিল অন্তঃস্থিত
রেনেসাঁসা
জোয়ার, উন্নত জীবন ও সমাজ গড়ার অদম্য স্পৃহা। বাঙালি
জীবনে তখন সাধনা ছিল, সংগ্রামও ছিল। উন্নতির লক্ষ্য ছিল।তখন
কলকাতা ছিল শুধু মাত্র বাঙালির নয়, গোটা ভারতের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির
কেন্দ্রস্থল।১৯১১-এ কলকাতা থেকে ভারতের রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ার পরও স্বাধীনতার
প্রাককাল অবধি কলকাতা ছিল এদেশের প্রাণকেন্দ্র, দেশের আদর্শ স্থল, দেশের পাথেয়,আর্থিক-সামাজিক-নৈতিকগুণে গুণান্বিত
সর্বভারতের অনুসরণীয়,বাংলাভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির পিঠস্থান।দিল্লি দেশের রাজধানী হওয়া
সত্বেও আদর্শগত ভাবে সারা দেশের প্রতিভূ হয়ে ওঠতে পারেনি, এখনও কি পারছে ? সে থাক ।
দুই
সামাজিক ও বানিজ্যিক মূল্য হারালে ভাষার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি কখনোও সম্ভব হওয়ার নয়।ভাষার উন্নতি মানে সাহিত্য সমেত নানা শিল্প
ক্ষেত্রে মান বাড়া। অর্থ ছাড়া ভাষা মূলত মৌলিক ক্ষেত্রে উন্নত থাকলেও সে’ ভাষায় সৃজনমান বাড়তে পারে না।
দেখা গেছে, যে ভাষা রাজকার্যে ব্যবহার হয়, যে ভাষা বানিজ্যে
ব্যবহার হয় সে ভাষার উপনিবেশিক শক্তি বেশি এবং এভাষাগুলোরই বাঁচা ও উন্নতির
সম্ভাবনা বেশি। স্বভাষীক
গোষ্ঠী ছাড়াও অন্য ভাষীক গোষ্ঠীও যদি সে ভাষা প্রয়োগ করে, তা হলে সে ভাষার বাঁচা-বাড়ার সম্ভাবনা প্রবল। এক সময় বাংলা, বিশেষ করে
পূর্বাঞ্চলে নানা
ভাষীক মানুষের মধ্যে বাক্যালাপে আদান-প্রদানের মাধ্যম ছিল, বাংলা এজায়গা ক্রমশ
হারাচ্ছে।বলতে
দ্বিধা নেই যদিও বৈশ্বিক আদর্শগত দিক থেকে তা অনৈতিক তবে তা বাস্তব সত্য,
কথাটা হলও এই,যে ভাষার
উপনিবেশিক চরিত্র নেই, সে ভাষার স্থায়িত্বও নেই, এতো ঐতিহাসিক সত্য। এক সময় বাংলা
সর্বভারতে এবং বাইরে বৌদ্ধিক মহলে স্থান
পেয়েছিল,আজ তা প্রায় একেবারেই নেই।এক সময় বাংলার বাইরে অনেক অবাঙালিরাও বাংলায় লিখতেন, বিদেশিরাও লিখেছেন,
পত্রপত্রিকা বেরতো ভারতের নানা স্থান থেকে, আজ এসব নেই বললেই চলে,নিজ ভূমেই বাংলা প্রবাসী যেন।
উল্লেখ্য,বানানে
পরিবর্তন বাংলার অগ্রগতিতে অন্যতম বাঁধা বলে মনে করি।দুই বাংলায় দুরকম
বানান আবার কোনও কোনও
পত্রিকার
নিজস্ব বানান বিধি।কই ইংরেজির মতো বিশ্বজনীন
ভাষায় তো এমনটি
নয়, শত শত বছর ধরে চলে আসা বানান আজও বৈধ।হ্যাঁ, দু’এক সামান্য পরিবর্তন লক্ষ করা
যায়,
যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে colour
হয়েছে color,behaviour হয়েছে
behavior, এ রকম।আবার ‘আসাম’ কেন ‘অসম’
হবে?অসমিয়ারা ‘বাঙালি’কে
‘বঙাল’ বলে,
বলে কি আমরাও ‘বঙাল’ বলব?প্রতিটি ভাষাই তার চরিত্র মেনে চলে।বাংলায় ‘ইংলিশ’ হয়েছে ‘ইংরেজি’ বা ‘ইংরাজি’।শব্দের
ব্যুৎপত্তি বিবেচনায় যাইহোক না কেন,দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত শব্দের মৃত্যু ঘটানো উচিৎ নয় বলে মনে করি।
এতো সব বাংলা বাধাবিপত্তি থাকা সত্বেও কিছু ধনাত্মক দিকও
রয়েছে—ভারতে রাষ্ট্রশক্তি বাংলার পক্ষে যতটুকু থাকার কথা ততটুকু না থাকলেও, ভারতের জাতীয় সঙ্গীত বাংলায়, বাংলাদেশের তো
আছেই। সিয়েরা লিয়ন
রাষ্ট্রে বাংলা
অন্যতম সরকারি ভাষা। আমেরিকায় নির্বাচনী প্রচারে বাংলাদেশী এবং ভারতীয় অভিবাসী বাঙালিদের জন্য বাংলাভাষায় প্রচার থাকছে। শিকাগো, নিউ ইয়র্কে বাংলা নামের সাইন বোর্ড অব্দি আছে দোকানে দোকানে— ঢাকা মিষ্টান্ন ভান্ডার, সুরুচি,গুলশন কাফে ইত্যাদি। লন্ডনের ব্রিক্ লেনে বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড বেশ কয়েকটা দেখলাম।লন্ডন
ও কোভেন্ট্রি মহানগরে পাবলিক গ্রন্থাগারে বাংলার জন্য আলাদা সেকশন দেখলাম।ব্রিটেনে কোনও কোনও শিক্ষায়তনে বাংলা ঐচ্ছিক ভাষা হিসেবে সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত বলে জানলাম,অবশ্য,সৌজন্যে বাংলাদেশ।
তবে বাংলাদেশের
মতো
একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র থাকা সত্বেও আগামি দু’
এক দশক পরে স্বমহিমায় বাংলাভাষা সেদেশেই টিকে থাকবে কি-না, এ’
নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।যেভাবে বাংলাকে ইসলামিকরণ করা হচ্ছে,
আরও কয়েক দশক পরে বাংলা আর
বাংলা চরিত্রে থাকতে পারছে না।এও উল্লেখ্য, যে সমাজে মুক্তচিন্তার অবকাশ নেই বা ক্ষীণ, সে সমাজ তো পঙ্গু, সে সমাজে
কোনও উন্নতিই সম্ভব নয়।বাংলার মতো
বিশ্বমানের ভাষা টিকে থাকাই তো শেষ কথা নয়। বাংলাদেশে বাংলা টিকে
থাকবে ঠিক কিন্তু ‘মানে’ থাকবে না বলে আশঙ্কা আছে। সুতরাং যা করার এই ভারত
ভূখণ্ডের বাঙালিদেরই করা চাই।
প্রসঙ্গত, বাংলাভাষা ও সাহিত্যের একসময়
কেন্দ্রীয় স্থল ছিল কলকাতা, আজ তা প্রায় অস্তমিত সুর্যের মতো। বাঙালির আবেগিক আশ্রয় কলকাতা আর নয়, কলকাতা বিপন্ন। তাহলে বাংলা বাঁচে-বাড়ে কী করে!
জাতি-ভাষা-শিল্প-সাহিত্যের একটা কেন্দ্রস্থল
চাই।
আবার,পৃথিবীর যে কোনও ভাষার বিকাশ ঘটেছে
মধ্যবিত্তের হাতে, আবার মধ্যবিত্তের উপেক্ষা ও অনীহা সে ভাষার মৃত্যুও ডেকে
এনেছে।মধ্যবিত্তের সন্তানদের
পড়াশোনার ব্যাপারে তাদের অভিবাবকদের মনোভাব
নিয়ে কয়েকটি কথা বলতেই হয়।
এক, আপনার সন্তান আমার সন্তান কোন স্কুলে ভর্তি হয়েছে
?
দুই, আমাদের সন্তানরা কি ঠিকভাবে বাংলা বলতে ও পড়তে
পারছে ? প্রথম প্রশ্নটির সাধারণ উত্তর : ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে।
দ্বিতীয় প্রশ্নটির
সাধারণ উত্তর : ওরা আসলে ইংরেজিতেই বেশি ‘কমফোর্ট ফিল’ করে।
দ্বিতীয় প্রশ্নটির আরও
একটি উত্তর : ওরা হিন্দিতেও বেশ ভালো। কিছু উল্লেখযোগ্য
ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই রয়েছে।
এই পরিবর্তিত অবস্থাটির
জন্য সন্তানদের দোষারোপ করা অর্থহীন। কোন স্কুলে ভর্তি হবে, কোন বই পড়বে শৈশবের এই
সিদ্ধান্তগুলো তাদের নিজেদের নেওয়া নয়।কাজটা অভিবাবকরাই
করেন।
নিজেদের কাজের সমর্থনে
পর্যাপ্ত যুক্তি বাপমায়ের রয়েছে, যুক্তিগুলো যথেষ্ট
যুক্তিসম্মতও। ইংরেজি ও হিন্দি জানা
প্রার্থী চাকরিতে ও পদোন্নতিতে অগ্রাধিকার পান।
কিন্তু ভালো বাংলা জানা
প্রার্থীর অগ্রাধিকার রয়েছে এমন কোন চাকরির বিজ্ঞাপন গত চল্লিশ বছরেও চোখে পড়েনি, কিংবা ভালো বাংলা জানা
প্রার্থী পদোন্নতিতে অগ্রাধিকার পেয়েছেন তাও শুনিনি।
আসলে
সকল বাঙালিকে বাংলা স্কুলে পড়তে হবে, বাংলাভাষা শিখতে হবে,“ মাতৃভাষা মাতৃ দুগ্ধ
সমান”—এসব কথা নীতিগত দিক
থেকে ঠিক আছে, কিন্তু বাস্তবে দাঁড়িয়ে নিছক আবেগিক বলে মনে হয়,বাস্তব অন্য কথা
বলে। আবেগ ক্ষণস্থায়ী।আবেগ যদি বাস্তবের সাথে না মেলে, তখনই মুশকিল।শুধু বাঙালি নয় অবাঙালির মধ্যেও, বিশেষ করে বাঙালি
সংখ্যাগুরু অঞ্চলে বাংলাভাষার উপযোগিতা সৃষ্টি করা চাই।একাজ জোরে হয় না, আবেগতাড়িত
হয়েও হয় না, একাজ বাস্তবমুখি।ইংরেজি আর হিন্দির আগ্রাসন থেকে বাংলাকে বাঁচাতে হবে,
এসমস্ত কথা বলে কী লাভ, এ বলেইকী বাঙালি বাংলা রক্ষা করতে পারবে,বাংলার উত্তরোত্তর
উন্নতি ঘটাতে পারবে?ব্যাপারটা যুক্তিবুদ্ধির আর কাজের।
একটা পথ আছে,যা আগেও বলা হয়ে গেছে যে বাংলাভাষার জন্য
রাষ্ট্রের বিশেষ প্রাধান্যতা আদায় করে নেওয়া চাই।ভারতীয়
সংবিধানে বাংলাভাষার আঞ্চলিক অবস্থানের অতিরিক্ত একটি মূল্যবান স্থান পাওয়া একান্ত প্রয়োজন,বাংলা এই সুযোগ পাওয়ার যোগ্যতা
রাখে।বাংলাভাষা দ্রুপদী ভাষার মর্যাদা পেতে পারে কিনা, এনিয়ে ভাষাবিদরা বলবেন।যদি
বাংলা ভারতীয় সংবিধানে ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়,তাহলেও হয়।একরে
নিতে পারলে,বাংলা
আগের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কাও অনেকটাই ফিরে পাবে।বাংলার কেন্দ্রীয়
আর্থিক সহায়তা অনেকগুণ বেড়ে যাবে, একই সাথে বাড়বে বাংলার প্রায়োগিক ক্ষেত্র,
বাড়বে বানিজ্যিক মূল্য।বাঙালি
অবাঙালি অঞ্চলে থাকলেও, বাংলা এবং বাঙালিত্ব বেঁচেবর্তে ভালই থাকবে।মোদ্দাকথা,
ভারতীয় সংবিধানে বাংলাভাষার এক বিশেষ স্থান পাওয়া বাঞ্ছনীয়,আপাতত এ-ই হবে বাংলার
রক্ষাকবচ।
বাঙালির
সমবেত জাতীয় নৃত্যের সন্ধানে
সমর
বিজয় চক্রবৰ্তী
ডাণ্ডিরাস৷
নবরাত্ৰির জ্যোৎস্না বন্যায় আমি দেখেছি গুজরাট কীভাবে মেতে ওঠে৷ সে কী অপূৰ্বত
মুকুলবাবুর
কথার রেশ ধরে ভাসতে থাকি৷ হারিয়ে যাই ডাণ্ডি হাতে চাদ ঢালা রাতের সঙ্গে৷ হারিয়ে
যাই দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে৷
পরুষ
ও নারীর এই নৃত্য, অথচ কাছাকাছি থেকেও তারা দুরে৷ পুরুষ ও প্ৰকৃতি যেহেতু আপাত
দৃষ্টিতে পাৰ্থক্যে আশ্ৰিত, ফলে তীব্ৰ মিলনেচ্ছা নিয়ে উভয়ে ভেসে বেড়ায়৷ গুজরাটি
জাতিসত্তা রক্ষায় এ নাচের ভূমিকা অসামান্য৷ সমবেত সামাজিক নৃত্য শুধু বিনোদন নয়,
সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করে৷
এ
কথা বলতেন মুকুন্দদাস ভট্টাচাৰ্য৷ শুধু বলতেনই না, বিশ্বাস করতেন, মনে-প্ৰাণে, যে
বিশ্বাসের প্ৰতি দায়বদ্ধতায় আজীবন ব্ৰত ছিলেন তিনি৷
পঞ্জাবের
ক্ষেত্ৰেও এই একই কথা৷ পঞ্জাবিরা যে কোন অনুষ্ঠানে ভাংড়া নৃত্য করে৷ এতে বড় ছোটর
বালাই নেই৷ অসমিয়া সমাজে বিহু নাচের ভূমিকাও তদ্ৰুপ৷ পাহাড়ের উপজাতিদের দিকে তাকান,
দেখবেন সার সার নারী-পুরুষ হাত ধ্বাধরি করে নৃত্য করে৷ এদের দেখলে মনে হয়, তাদের
নিজস্ব জগৎ বড়ই নিরুদ্বিগ্ন, নিরাপদ ও সুন্দর৷ তাদের নাচ শীলিত মাৰ্জিত, যেমন
তাঁদের সহজ-সরল জীবন৷
জাতিসত্তা
বাঁচিয়ে রাখতে পরম্পরাগত সমবেত নৃত্যের গুরুত্ব অনেক বেশি৷ বাঙালি এখানটায় মার
খেয়ে গেল৷ দড়ির সাঁকো পেরোনোর মত বিপদসীমায় আজ গোটা বাঙালি জাতি৷ মুকুন্দবাবুর
সান্নিধ্য পেয়ে বুঝতে পেরেছি, এ ব্যাপারে তাঁর অন্তরে রয়ে গেছে নানা তাঁর ব্যক্ত
অব্যক্ত কথা৷
বিহু
নাচ থেকে পাওয়া যায় অসমিয়া রোমান্টিক মেজাজ, কচিসবুজ পাতার মত, কিংবা ফুলের পাপড়ির
মত নৃত্যাঙ্গনে অসমিয়া নারীদের কমনীয়তা৷ পোশাকে চাকচিক্য নেই, চাকচিক্য মেলে
ভাংড়া, ডাণ্ডিতে৷ সরল প্ৰকৃতির মত বিহু৷ এর কিছু-না-কিছু ছাপ তাদের সাৰ্বিক জীবনে
আজও মেলে৷
পঞ্জাবের
ভাংড়াতে ফুটে ওঠে তাদের শৌৰ্য-বীৰ্য, ডাণ্ডি মিলনেচ্ছুআগেই বলা হয়েছে৷ আগা গোড়া
রোমান্টিক স্পেকটাকুলার৷ যাদের দৃষ্টি মনন সূক্ষ, অনুভূতিশীল তারা নিশ্চিত দেখেন
রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় কত বৰ্ণময় নকসা ফুটে ওঠে রাত ভর৷ এ নকসাগুলিকেই বুঝি
বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন, প্ৰজাপতির পাখনায়, ফুলের পাপড়িতে৷ গুজরাটি জীবনও তেমনি
বৰ্ণময়৷
সংঘবদ্ধ
নৃত্যের একতায়নের কথায় ভাসতে ভাসতে পুলকিত হয়েছি চাঁদনি রাতের নাচে৷ ভেসে ফিরেছি
আবার বরাক -সুরমার পারে মুকুন্দবাবু বললেন- আমাদের দেশেও এক সময়ে কীৰ্তন নাচের
ব্যাপক প্ৰচলন ছিল, এ ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার এতে সমাজের সকল শ্ৰেণীর লোক যোগদান
করতে পারত, বরাক - সুরমার কীৰ্তনের মত এমন সুশোভন নৃত্য বুঝি বাংলার আর কোথাও নেই৷
ঠাট
কীৰ্তন সম্পৰ্কে মুকুন্দবাবুর উক্তি, ‘ভারতীয় দ্ৰুপদী সঙ্গীতের প্ৰবাদপ্ৰতিম পুরুষ
সঙ্গীত সাধক প্ৰয়াত পদ্মভূষণ শ্ৰীকৃষ নারায়ণ, রতনজঙ্কর এই নৃত্যের একক ক্রিয়া কৌশল
দেখে যারপর নাই আনন্দ ও সন্তোষ প্ৰকাশ করেন, এই রকম একটি ধ্ৰুপদী তালের ওপর কেবল
মাত্ৰ অঙ্গ চালনে নৃত্য সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের নৃত্যচৰ্চা ও লোকনৃত্যের ঐতিহ্যই প্ৰকাশ
করে৷’ (পৃ: ২০৷ বরাক উপত্যকার লোকনৃত্য গ্ৰামীণ নৃত্যকলা : মুকুন্দ দাস
ভট্টাচাৰ্য৷)
‘ঠাট
কীৰ্তন এখন লুপ্তপ্ৰায়৷ তবে পদকীৰ্তন এখনও রয়েছে এত সংযত ছন্দোবদ্ধ অথচ
মুক্তছন্দের আবার এক সঙ্গে অনেকজনের সমবেত নৃত্য, .....কীৰ্তন নৃত্যে এই অঞ্চলের
প্ৰচলিত অন্যান্য লৌকিক নৃত্যধারার একটা প্ৰচ্ছন্ন ছাপ থাকে তবে বেশীভাবে আশ্ৰিত
থাকে ধামাইল নৃত্য আঙ্গিকে৷’ (পৃ : ২৩ বরাক উপত্যকার লোক গ্ৰামীণ নৃত্যকলা :
মুকুন্দ দাস ভট্টাচাৰ্য৷)
কীৰ্তন
বরাক-সুরমার সমাজকে পুরোপুরি ধরে রেখেছিল- জীবনযাপনের উন্মাদনাকে ধরে রেখেছিল,
সমবেত সাৰ্বজনীন আনন্দ, মানে কীৰ্তন৷ কোথা থেকে এলো ঝড়ো হাওয়া, বামপন্থী হাওয়া৷
মধ্যবিত্ত শিক্ষিতজন গেঁয়ো এবং সাম্প্ৰদায়িকতার তকমা এঁটে দিল কিৰ্তনে৷
অথচ
বাঙালির চাই কমন নৃত্য, সাৰ্বজনীন সমবেত নৃত্য৷ বরাক সুরমার কীৰ্তন নৃত্যে বিশেষ
অনুশীলনের প্ৰয়োজন, এ কীৰ্তন বাঁচিয়ে রাখার জন্যে পাঠ্যক্রমের অন্তৰ্ভুক্ত করা
চাই৷ বোঝা গেল কীৰ্তন আর বাঙালির কমন নৃত্য হবার নয়, কিন্তু তা তো পরম্পরাগত
নৃত্য, লোকনৃত্য৷
রবীন্দ্ৰনৃত্য
নানা নৃত্যের সময়ে নানাজন নানাভাবে কোরিওগ্ৰাফি করে পরিবেশন করেন৷ লোকনৃত্য
শাস্ত্ৰীয়নৃত্যের আকর৷ লোকনৃত্যে পাওয়া যায়, শেকড়ের টান৷
মনে
আছে, একদিন সকালে একালের মণিপুরি নৃত্যের পুরোধা গুরু বিপিন সিংহ মুকুন্দবাবুর
সঙ্গে আলাপচারিতায় যুক্ত হন৷ মুকুন্দবাবু একসময় বললেন, ধামাইলকে বাঙালির
সৰ্বগ্ৰাহ্য নৃত্য করে তোলা যেতে পারে৷ বিপিনবাবু তৎক্ষণাৎ মাথা নেড়ে বললেন, আপনার
ও আমার ভাবনা মিলে গেছে৷ এ প্ৰস্তাব কিন্তু আমি কলকাতায় অনেকের কাছেই দিয়েছি৷
মুকুন্দবাবু বললেন, তবে এটি তো মূলত স্ত্ৰীলোকের নাচ৷ ধামাইল নৃত্য প্ৰদৰ্শন
শুধুমাত্ৰ নারীরাই করবে৷ নারী-পুরুষ সময়ে এটি মঞ্চস্থ করলে শুদ্ধতা বজায় থাকবে তো?
না কি পরম্পরাকে অস্বীকার করা হবে? এ নৃত্য নারী অঙ্গে ফোটে ভাল৷ বিপিন সিংহ
বললেন, যুগের পরিবৰ্তনে৷ পরিবৰ্তন হয় অনেক কিছু এ পরিবৰ্তন মেনে নিলেই হয়৷
মুকুন্দবাবু স্মিত হাসলেন৷ নারীপুরুষ সময়ে ধামাইল নাচ তাহলে কি তিনি মেনে
নিয়েছিলেন? জানি না, আজ আর জানতেও পারব না৷ তবে আজকাল এ প্ৰবণতা দেখা যাচ্ছে,
সৰ্বত্ৰ- এতদঞ্চলে প্ৰায় বিয়ে বাড়িতেই ধামাইল নাচ করা হয়৷ এতে পুরুষদের ডেকে আনা৷
হয় বা স্বতস্ফূৰ্তভাবেই তারা এসে যোগ দেয় নৃত্যে৷ এভাবে একদিন হয়তো গোটা বাঙালি
সমাজের কাছেই জাতীয় নৃত্য হয়ে উঠবে ধামাইল নৃত্য৷ তবে প্ৰাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির
প্ৰয়োজন৷
উল্লেখ্য
বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সলিনে ১৪১৩ বৰ্ষবরণ উৎসবে কিন্তু নারী-পুরুষ
মিলে ধামাইল নৃত্য করা হয়েছিল৷ আপনিতেই সবাই মিলে নাচ করতে শুরু করেন
ধামাইলধামাইলে অনভ্যস্থ পুরুষ৷ মুদ্ৰা ও অঙ্গভঙ্গিতে প্ৰসার ও সঙ্কোচনে বুঝেছি ঠিক
ততটুকু ধামাইল হয়ে ওঠেনি, তবে উদ্বেলিত আনন্দে সবাই ভেসেছি৷ আমাদের জাতিসত্তার
নিগুঢ় অনুভূতি রক্তে রক্তে অনুভব করেছিলাম সেদিন৷
ধামাইল
নাচে রয়েছে কমনীয় সৌন্দৰ্য৷ বাঙালি পুরুষের চেহারাও তো বীর বিক্রমী নয়, তাতে ক্ষতি
কী৷ পুরুষ-নারী মিলে ধামাইল হয়ে উঠতে পারে কি বাঙালীর জাতীয় নৃত্য?
মুকুন্দবাবর
যাপিত জীবনের পুরোটাই তো ছিল নৃত্যময়, গতিময়, ফুৰ্তি ও আনন্দের হাওয়া চোখেমুখে
লেপে থাকত সারাক্ষণ৷ অমোঘ মৃত্যুও তাঁর আনন্দ ছিনিয়ে নিতে পারেনি, অপরপক্ষে
সাংসারিক টানাপোড়েনে ফিকে হয়ে আছে সারাৎসার বাঙালী জীবন আজ; এর উদ্ধারে ধামাইল
হয়তো কাজ করতে পারে ঔষধ্বি মতো৷
মুকুন্দদাস
ভট্টাচাৰ্য আজীবন এই লক্ষ্যেই কাজ করে গেছেন৷ অক্লান্ত এক রাণার সন্ধান করে গেছেন
বাঙালির এক সমবেত জাতীয় নৃত্যের৷ প্ৰান্তিকায়িত এক উপত্যকায়, মাটির টানে, নিজের
কৰ্মময় জীবনকে আবদ্ধ রেখেছিলেন তিনি, হয়ত তাই এ- জীবনে রাণারের সন্ধান সঠিক সাকিন
খুঁজে পায়নি৷ তা বলে কোনও দিনও তা পাওয়া যাবে না, তা কি হয়? নাকি, আমাদের তা হতে
দেওয়া উচিত?
দেবী
সরস্বতী গানে, কবিতায়, ছড়ায়...
সমরবিজয়
চক্রবৰ্তী
শিক্ষার
নানা ক্ষেত্ৰে দেবী সরস্বতীর ভাবচিত্ৰ বিধত৷ আমাদের মনে-প্ৰাণে বিদার আরাধ্যা দেবী
হিসেবে তিনি অবস্থিত৷ অনেকের পড়ার টেবিলে সরস্বতীর ছবি অথবা ছোট মূৰ্তি রাখা হয়৷
বিদ্যার সকল শাখা, আমাদের সৌন্দৰ্য বোধ, সঙ্গীতে ও চিত্ৰাঙ্গন, ভাস্কৰ্যএ সমস্ততেই
দেবী সরস্বতী যেন আমাদের অতীন্দ্ৰিয় অভিভাবক, তাকে ছাড়া আমাদের চলে না৷ দেবী
সরস্বতী ধৰ্মের গণ্ডি ছাড়িয়ে গোটা বিশ্বে বন্দিত৷ অনেকটা গ্ৰীসের আলমপিয়াড়-এ
সূৰ্যদেবের মন্দিরে অধিষ্ঠিত সূৰ্যের মত৷ উল্লেখ্য, অলিমপিয়াড-এ অবস্থিত সূৰ্য
মন্দির থেকে নেওয়া সূৰ্যের আগুন জ্বালিয়ে অলিম্পিক খেলা শুরু হয়৷ এতে ধৰ্মের বাধন
ছিন্ন হল বলে এই নিবন্ধকের মনে হয়৷ সরস্বতী দেবীর অবস্থানও এরকম৷ ইন্দোনেশিয়ার মত
মুসলম দেশেও তিনি বিদ্যা ও সঙ্গীতের অধিষ্ঠাত্ৰী দেবী৷ এ ছাড়াও মিয়ানমার,
কম্বোডিয়া, ফিলিপাইন্স ইত্যাদি দেশে দেবী সরস্বতী পূজিত৷ বিদ্যা দেবীর আরাধনা মাঘ
পঞ্চমীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সৰ্ব-ধৰ্ম-নিৰ্বিশেষে করা হয়ে থাকে৷ ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে সরস্বতীর একখানা স্থাপিত মূৰ্তি রয়েছে৷ এই মূৰ্তিতে
বিশ্ববিদ্যালয়ের ও বাইরের অনেকেই অঞ্জলি প্ৰদান করেন৷ এই পূজার বৈশিষ্ট্য হল এতে
কোন পুরোহিত পূজা করার জন্যে নিয়োজিত হন না৷ বিশেষ করে কাতারে কাতারে
ছাত্ৰ-ছাত্ৰীরা হাতে ফুল নিয়ে একে সরস্বতীর পায়ে ফুল অৰ্পণ করেন৷
সরস্বতী
এতো বেশি পূজীত ও আদৃত বলে বোধহয় বার বার সৃষ্টিশীল মানুষের রচনায় তিনি ধ্বা
দিয়েছেন৷
লোকসঙ্গীত
ও নাট্যের আসর বন্দনায় সরস্বতীর স্তুতি করা হয়৷ বিভিন্ন মঙ্গল কাব্যে সরস্বতী
বন্দনা রীতি অনুসৃত হয়েছে৷ এই রীতি মূলত মধ্যযুগীয় লোক কবি এবং সাহিত্যিকেরা
অনুসরণ করলেও আধুনিক কালেও তার কিছুটা পাওয়া যায়৷ মধ্যযুগীয় অখ্যানধৰ্মী কাব্যের
তুলনায় আধুনিক কাব্যে৷ সরস্বতী বন্দনায় রূপগত, আঙ্গিকগত ও আদৰ্শগত পাৰ্থক্য দেখা
যায়৷ লোকসাহিত্য থেকেই সম্ভবতঃ মধ্যযুগের লিখিত সাহিত্য থেকে বন্দনাগীত গৃহিত
হয়েছিল৷ চৰ্যাপদে কোনো ধ্বণের কোনো দেব দেবীর বন্দনা করা চৰ্চিত ছিল না৷ সুতরাং
সরস্বতী বন্দনার প্ৰই ওঠে না৷ ৰ্ষোড়শ শতকের কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবৰ্তী
‘চন্ডী’-র বন্দনা খণ্ডে সরস্বতীর বন্দনা করেছেন৷ সেখানে কিন্তু বাহন রূপে হাঁসের
উল্লেখ নেই, বরং বলা হয়েছে শ্বেতপদ্মে অধিষ্ঠাত্ৰী দেবী
পুস্তক
লইয়া করে উড়ো দেবী এ আসরে
বীজ
মুখে বেদবাণী বন্দো দেবী বীনাপাণী
শ্বেতপদ্মে
অধিষ্ঠান শুক্ল ধূতি
পরিধান
শ্ৰবণে
কুন্ডল দলে কপালে বিজুলি খেলে
অনতনু
রুচি খন্ডে অন্ধকার৷৷
শিরে
শোভে ইন্দুকলা করে শোভে
জপমাল
সুখ
শিশু শোভে বাম করে৷৷
নিরন্তর
আছে সঙ্গী মসীপাত্ৰ পুথি খুঙ্গী
স্মরণে
জরিমা যায় দূরে৷৷
ভারতচন্দ্ৰের
অন্নদামঙ্গল কাব্যে সরস্বতীর বাহনরূপে হাস অবতীৰ্ণ৷ উল্লেখ্য পুরাণে লিখিত
সরস্বতীর বাহন সম্পৰ্কে আমরা জানতে পারি যে তিনি বারে বারে বাহন পাছেন, সৰ্বশেষে
ব্ৰহ্মার বাহন হংসে স্থায়ী আসন গ্ৰহণ করেছেন৷ ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে সরস্বতী কে
বেদ, বিদ্যা, তন্ত্ৰ-মন্ত্ৰ, নৃত্য, গীত ও বাদ্যের অধিষ্ঠাত্ৰী দেবী রূপে দেখানো
হয়েছে৷ বন্দনাখন্ডে সরস্বতীকে ‘প্ৰকৃতি প্ৰধান’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে
আগমের
নানা গ্ৰন্থ আর যত
গুণপন্থ
চারিবেদ
আঠার পুরাণ৷
ব্যাস
বাল্মীকাদি যত কবি সেবে
অবিরত
তুমি
দেবী প্ৰকৃতি প্ৰধান
‘অভয়মঙ্গল’
কাব্যে সারদা বন্দনায় দেবী সরস্বতীর কাছে সঙ্গীতে তালভঙ্গ দোষ এবং অশুদ্ধতার জন্য
কবি দ্বিজরাম মাৰ্জনা ভিক্ষা চেয়েছেন
উপবিশ
আসনে সারদা বরাদনে
ঘটে
আসি কর অধিষ্ঠান৷
যুগপানি
হইয়া দাসে তোমার চরণে
ভাসে
শুনো
এ আপনা গুণগান৷৷
সেবকে
নিবেদে পাত্ৰ শুনোহ জগৎ
মাত্ৰ
কিংকরের
চাহি পরিহার৷৷
তালভঙ্গ
দোষ যেত অশুদ্ধ গাইমু কথ
অপরাধ
ক্ষেমিবা আমার৷৷
মধুমালতী
কাব্যের সূত্ৰপাতে মহদ কবীর সরস্বতীর বন্দনা করেছেন
সরস্বতী
পদে করহ নমস্কার৷ পৃথিবী
হইল নৌকা সংসার অপার
শির
রাখি প্ৰণমি এপদে করতার৷৷
রূপরামের
‘ধৰ্মমঙ্গল’ কাব্যে সরস্বতী বন্দনায় দেবীর বেশ-ভুষার বিবরণ রয়েছে৷ এখানে দেবীর
বাহন কিন্তু কোকিল৷ সঙ্গীতের অধিষ্ঠাত্ৰী দেবী রূপে এখানে তার অবস্থান স্পষ্ট
বন্দোমাতা
সরস্বতী তোমাবিনে নাঞি গতি
আসরে
আসিয়া দেহবার৷
রাতুল
চরণ সেবি কি আর কহিব কবি
ভরসা
করিব আমি কার৷৷
কবি
দ্বিজমাধ্ব দেবী সরস্বতীকে ঘটে এসে অধিষ্ঠান করার জন্য প্ৰাৰ্থনা জানিয়েছেন৷ আমরা
‘মঙ্গলচন্ডী’-তে এই প্ৰাৰ্থনা পাই
ভাবিয়া
সারদা মায়ে দ্বিজমাধবে
গায়ে৷
তরিবারে
সংসারের ধন্ধ৷৷
করিয়া
পুস্পাঞ্জলি মন মোর হইয়া অলি
(মাগো)
দুৰ্গার চরণ - মকরন্দ৷৷
‘মনষামঙ্গল’
কাব্যে কেতকা দাস ক্ষেমানন্দ সরস্বতী বন্দনা করতে গিয়ে নিজেকে সরস্বতীর পুত্ৰ বলে
গণ্য করতে চেয়েছেন
অবলা
তনয়া ডাকে পদছায়া দেহ
তাঁকে
বৈশ
মোর কণ্ঠে উপর৷
মৃদঙ্গ
মন্দিরা ধ্বনি মিশাইয়া বাৰ্গবাণী
কণ্ঠে
বসি সুবচন৷
রাগমস্ত
তালবান কিছু মোর নাই জ্ঞান
তব
পদে লইলাম শরণ৷৷
আমরা
নানা লৌকিক ছড়ায় সরস্বতার অবস্থান পাই৷ শ্ৰীহট্টীয় অঞ্চলে এক সময় মাঘব্ৰত প্ৰসিদ্ধ
ছিল৷ বননায় নয় চিত্ৰকপ্লে আছে সরস্বতীর উজ্জ্বল অবস্থান
(১)
যে জল ছোঁয়ে না লো কাগে আর বগে৷
সে
জল ছুুঁই মোর দূরবার আগে৷৷
দূৰ্বা
দূৰ্বা সরস্বতী নড়ে আর চড়ে,
নড়িয়া
চড়িয়া কি বর মাগে?
সাত
সতীনের পায়ে পড়ে৷ (মাঘ ব্ৰতের ছড়া)৷
(২)
ধলা মাইয়া সারিন্দা হাতে
সোনার
বরণ কলসি কাঁখে
পাশে
বইস্যা পাঁচা (মুসলমানী ছড়া, ঢাকা)
মূলত,
শিপ্লীদের কাছে শিপ্লই প্ৰধান হয়ে দাঁড়ায়শিপ্লই ব্ৰহ্ম, শিপ্লই দেবাত, শিপ্লই
দেবী৷ এ ব্যাপারে দেখা যায় ভিন্ন ধৰ্মাবলম্বী হওয়া সত্বেও কবি শিপ্লীদের মধ্যে
সাম্প্ৰদায়িক ভেদবুদ্ধি স্থান পায় না৷ বিভেদটা আসে ধৰ্মের মুখোশধারী নেতাদের কাছ
থেকে৷ দেশজ পরম্পরাগত সংস্কৃতির প্ৰতি সকল শিপ্লীরই আকৰ্ষণ তাদের সৃষ্টিতে
প্ৰত্যক্ষ করা যায়৷
কাজি
নজরুল ইসলামের লেখা আসর বন্দনায় সরস্বতীকে বাদ্যযন্ত্ৰের অধিষ্ঠাত্ৰী রূপে বন্দনা
করা হয়েছে
এসো
গো মা সরস্বতী সৰ্বমঙ্গলা৷
তোমার
আসরে বাজে হারমনি বেহালা৷৷
আমার
আসরে বাজে বামা আর তবলা৷
আমার
আসরে থাকে ভাইবোন একইজনা৷৷
বুমর
গানেও আমরা সরস্বতীকে পাই
সরস্বতী
বন্দনা স্মরণ করি আউলি আখড়েয়
ভেঙ্কচি
লাগায়ে দিলি
করে
সব মিনতি৷
ওঝাদের
মন্ত্ৰেও সরস্বতীকে পাই
আকৰ্ণ
পুরি এজুড়ি বাল্মীকির বাণ৷
দেবতা
অসুর কাপে নহি সহে ঠান৷৷
ইন্দ্ৰের
ঘরণী কাপে পাতালে বসুমতি৷
চৌষট্টি
ভৈরবী কাপে লক্ষ্মী সরস্বতী৷৷
টুসু
গানেও সরস্বতীকে পাওয়া যায় তবে সঙ্গে লক্ষ্মীও রয়েছেন
শাক
দিলাম সলিতা দিলাম
সঙ্গে
দিলাম বাতি গো
একে
একে সন্ধ্যা নিন মা লক্ষ্মী সরস্বতী গো৷
আমরা
বাংলা চলতি কথা ও প্ৰবাদ বাক্যে সরস্বতীর উপস্থিতি পাই
১
আচারে লক্ষ্মী বিচারে সরস্বতী
(২)
সরস্বতী বর পুত্ৰ৷
৩)
দুষ্ট সরস্বতীর ঘাড়ে চাপা৷
বিশ্বকবি
রবীন্দ্ৰনাথের সষ্টি নানা কাব্যে সরস্বতীর স্নিগ্ধ প্ৰকাশ প্ৰত্যক্ষ করা যায়৷
‘বাল্মীকি প্ৰতিভা’-য় বাল্মীকির প্ৰতি সরস্বতীর উক্তিতে কবি বীণাপানিকে মানুষ
সমাজের শিক্ষিকা রূপে চিহ্ন করেছেন
আমি
বীণাপানি তোরে এসেছি শিখাতে গান৷
তোর
গানে গলে যাবে সমগ্ৰ পাষাণ প্ৰাণ৷৷
রবান্দ্ৰনাথ
থেকে আরো একখানা উদ্ধৃতি দেবার লোভ সংবরণ করতে পারছি না৷ ‘সোনার তরী’ কাব্যগ্ৰন্থে
‘পুরস্কার’ কবিতায় রবীন্দ্ৰনাথ সরস্বতীর চিত্ৰরূপ দিয়েছেন এরূপ
বিমল
মানস সরস বাসিনী
শুরু
বসনা শুভ্ৰ হাসিনী
বীণা
গঞ্জিত মধুভাষিনী
কমল
কুঞ্জাসনা৷
মোহিতলাল
মজুমদারের ‘শ্ৰীপঞ্চমী’ কবিতায় কবি সরস্বতীকে বসন্তের অধিষ্ঠাত্ৰী দেবী রূপে
কপ্লনা করেছেন৷ ‘বিশ্বরমাকন্যা’ রূপে কবি সরস্বতীকে দেখেছেন
যে
বাণী বিনসী উঠে বরণে গন্ধে গানে
ধ্বণীর
মধুবন, নিতুই নৃতন
সেই
তিনি-শ্ৰীপঞ্চমী-রূপে আজি তুমি
মুছাও
তুহিন-কণা কৃপানের প্ৰাণে,
সরষ
কটাক্ষ শুধা করিয়া সিঞ্চণ৷
আদ্ৰ
করো রসিকের মনোবন ভূমি৷
প্ৰমথ
চৌধুরী ‘ফাুন’ নামের প্ৰবন্ধে লিখেছেন
বসন্ত
যদি অতঃপর আমাদের অন্তরে লাট খেয়ে যায়, তাহলে সরস্বতী সেবকেরা নিশ্চয়ই স্ফীত হয়ে
উঠবে, তাতে করে বঙ্গসাহিত্যের জীবন সংশয় ঘটতে পারে৷ এস্থলে সাহিত্য সমাজকে স্মরণ
করিয়া দিতে চাই যে, একালে আমরা যাকে সরস্বতী পূজা বলি, আদতে তা ছিল বসন্ত উৎসব৷
বাঙালিদের
একটা ধারণা আছে যে, সরস্বতী ও লক্ষ্মীকে একসাথে পাওয়া খুব দস্কর কিন্তু ছড়াকার
অন্নদাশংকর রায় লিখলেন, সরস্বতী পূজা করলে ধনবান হওয়া যায়
সরস্বতী
পূজলে পর৷
লক্ষ্মী
এসে দেবেন বর৷৷
তাইতো
শুধি বাণীর ঋণ৷
বৎসরেতে
একটা দিন৷৷
পরের
দিনই বিসৰ্জন৷
বাকী
বৎসর বিস্মরণ৷৷ (সরস্বতী শালীধানেরচিড়ে)
এভাবে
দেবী সরস্বতী ছড়িয়ে আছেন লোকগান, কবিতা, ছড়া, নানা গদ্যরচনায়৷ একটা স্মরণিকার ছোট
পরিসরে লেখা দীৰ্ঘ করা সমীচীন হবে না বলে এখানে শেষ করছি৷
ইংরেজি
কথা বলা শেখা
সমর
বিজয় চক্রবৰ্তী
প্ৰথমেই
বলে রাখা ভালএই নিবন্ধটি ছাত্ৰ-ছাত্ৰীদের উদ্দেশ্যে লেখা৷ এটি ইংরেজি কথা-বলা
শেখার একটি পাঠ মাত্ৰ৷ সংক্ষেপে জড়ো করছি কিছু আবশ্যক কথা৷
শোনা,
বলা, পড়া, লিখাএই চারের সময়ে ভাষা বলা শেখা৷ একটিকে বাদ দিয়ে আর একটি নয়৷ আলাদা
করে অ-ইংরেজি স্থানে শুধুমাত্ৰ কথা-বলা শিখব বলে ইংরেজি লিখা শিখব না, পড়া শিখব
না, রেডিও, টিভিতে ইংরেজি শুনব নাএমনটি নয়৷ শুনে বুঝা, প্ৰ করা ও উত্তর দেওয়া
শিখলেও বুঝে নিতে হবে কথা-বলা পাঠের অনেকটা হ’ল৷ শেখার শেষ নেই৷
আগাম
একথাও বলতে চাইছি যে, কিছু কিছু ইংরেজি শব্দ বাংলায় মিশে গেছে৷ এ তেলে-জলে মিল
নয়বাংলাই হয়ে গেছে৷ যেমন টেবিল, চেয়ার, স্কুল, ক্লাস ইত্যাদি৷ কিন্তু আমরা কি
ইংরেজির সঠিক উচ্চারণে এ শব্দগুলি উচ্চারণ করি? না৷ কারণ আমরা বাংলা বলার সময় এ
শব্দগুলো অনায়াসে বাংলার মত করে বলি৷ এটাই ঠিক৷ ইংরেজি বলার সময় ইংরেজির মত করে
বলাই স্বাভাবিক৷ যেমন, আমি English-ইংলিশ-না বলে ইংরেজি বলছি যে কারণে সে কারণে
যেসমস্ত ইংরেজি শব্দ বাংলায় চলে এসেছে, আমরা বাংলা বলার সময় বাংলার মত করে বলতে
পারি৷ আমার মনে আছে, একটি ছেলে বেঞ্চ - Bench - কে বেঞ্চি বলেছিল বলে সে বকুনি
খেয়েছিল৷ আমার মনে হয় সেটা ঠিক নয়৷ সে তো বাংলায়ই বলছিল বাংলায় তো বেঞ্চিই বলি৷ ইংরেজরা রেস্তরা তো বলে
না, বলে রেস্টোর্যাণ্ট (Restaurant)৷ সংস্কৃত কিংবা হিন্দিতে আত্মা উচ্চারিত হয়
আত্মা’-ই৷ কিন্তু বাংলায় আত্মা উচ্চারণ করা বেমানান৷ একটি ভাষার শব্দভাণ্ডার
সমৃদ্ধ হতে থাকে যতবেশি অন্যান্য ভাষা থেকে শব্দ এসে এই ভাষার অন্তৰ্গত হবে৷
বাংলার ক্ষেত্ৰেও একই কথা প্ৰযোজ্য৷ কিন্তু অ-বাংলা শব্দ বাংলায় আত্মীকরণ হলেই
বাংলা শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ হবে৷ হুবহু কোন বিদেশি শব্দ বাংলায় উচ্চারিত হলেঅৰ্থাৎ
বাংলার স্বরতরঙ্গ, শ্বাসাঘাত, উচ্চারণ যদি এই শব্দগুলিতে না আসে তাহলে বাংলার বিপদ
বলে আমার মনে হয়৷ বাংলার চরিত্ৰগত বৈশিষ্ট্য রেখে স্বাভাবিকভাবে এইগুলো উচ্চারণ
করা চাই৷
এখন
ইংরেজি বাক্য কীভাবে উচ্চারণ করবএ নিয়ে কিছু কথা বলি৷ ইংরেজি পুরুষ-ভাষা Masculine
Languageব্যঞ্জনধ্বনি Consonant Sound এ ভাষায় প্ৰাধান্য পায়৷ বাংলা,
ফরাসিস্ত্ৰী-ভাষা৷ ব্যঞ্জনধ্বনি এ ভাষাদ্বয়ে গৌণ৷ ব্যঞ্জনধ্বনি বুঝি মস্তিষ্কের
বাঁ-পাশে খেলে ভাল৷ যারা বাঁ হাতে লিখেন তাদের পক্ষে ইংরেজি, জৰ্মন ইত্যাদি পুরুষ-ধ্বনির
ভাষা শেখা তুলনায় সহজ৷
টিভিতে
যেমন অনেকগুলি চ্যানেল থাকে, সেরকম আমাদের মস্তিষ্কে প্ৰতিটি ভাষার আলাদা চ্যানেল
খোলা চাই৷ তা কী করে সম্ভব?শুনতে হবে৷ অ-ইংলিশ পরিবেশ-পরিস্থিতিতে বৈদ্যুতিন
মাধ্যম কথা বলা শেখার পক্ষে সহায়ক হতে পারে৷
অঞ্চলভেদে,
দেশভেদে ইংরেজি নানা উচ্চারণে বলা হয়ে থাকে৷ ইংরেজ যে দেশগুলোতে উপনিবেশ গড়েছিল,
সেই দেশগুলোতে 'Received Pronunciation সংক্ষেপে RP উচ্চারণ-রীতি প্ৰচলিত৷ এ দেশে
বৈদ্যুতিন মাধ্যমে ইংরেজি ভাষ্যকার, সংবাদপাঠক বা এধ্বনের কাজ করতে হলে RPতে
পারদৰ্শিতা চাই৷ আজকাল RP একজন ব্ৰিটিশকেও শিখতে হয়৷ তাঁর মত করে তাঁদের আঞ্চলিক
উচ্চারণে কথা বললে তা আন্তৰ্জাতিক ক্ষেত্ৰে পাতে ওঠে না৷ ভারতীয়রা আজকাল ভালই
ইংরেজি বলেনএর প্ৰমাণ তো ক্রিকেট সম্প্ৰচারেই আমরা ইংরেজি বলা মানে RP তে ইংরেজি
বলা৷
কম
করে দিনে আধঘণ্টা তো ইংরেজি শোনা চাই৷ ইংরেজি ভাষায় সংবাদ শোনা চাই৷ আলোচনা শোনা
হই৷ ভাষ্য শোনা চাই৷ চলচ্চিত্ৰ? ইংরেজি চাল-চিত্ৰ আমাদের জীবনের চালচিত্ৰের সঙ্গে
মেলে না; মিললেও তা গত সামান্য এবং উচ্চারণ সৰ্বতো RP - না ও হতে পারে৷ অ্যাটেনবরো
পরিচালিত গাঁধী গোটাটাই RP তে করা৷ কারণ ইংরেজি ছবি RP তে করার প্ৰচলনও রয়েছে৷
RPতে করা ছবি দেখা যেতে পারে৷
ইংরেজি
গান, বিশেষ করে পল্লিগীতি Country Music শোনা যায়৷ উপাসনা সঙ্গীতও ভাল লাগার কথা৷
ইংরেজিতে গান শোনা মানে ইংরেজি ভাবজগতের সঙ্গে পরিচিত হওয়া৷ ইংরেজি গান শুনতে
শুনতে এসময় মনে হবে ইংরেজি মোটেই বিদেশি নয়, ইংরেজি আপন ভাষা৷ সুতরাং ইংরেজি ভাষায়
গানও শোনা চাই৷ সঙ্গত শিপ্লের শ্ৰেষ্ঠ মাধ্যম, একে-অন্যে জুড়ে দেওয়ারও শ্ৰেষ্ঠ
মাধ্যম বলে বোধ করি৷৷
কীভাবে
মস্তিষ্কে ইংরেজি চ্যানেল খুলব? আগেই বলেছিশুনে, বিশেষভাবে শুনে৷ বলা হয় আমরা না
কি ভাষা ৪০ শতাংশ শুনে শিখে ফেলি৷ আমার অভিজ্ঞতা বলে আমরা প্ৰায় ৬০ শতাংশ ভাষা
শুনে শিখি৷ অৰ্থাৎ কথা-বলা শেখার পক্ষে শোনাও একান্ত আবশ্যক৷ শুনে শুনে মুখ খুলতে
হয়৷ ভাষা অনুরণিত হতে থাকে ভেতর ভেতর৷ আর এভাবে আমরা গড়ে ফেলি ভাষার ঘর-বাড়ি
আমাদের মস্তিষ্কে৷ এটি একটি প্ৰাসাদে পরিণত হয়ে ওঠতে পারে যদি সেরকম চৰ্চা আমরা
চালিয়ে যেতে পারি৷ বুঝতেই পারছ আমি বলছি - ইংরেজি ভাষার চ্যানেলের প্ৰাসাদ৷ বাংলায়
কথা বলবে? বাংলা চ্যানেলের বোতাম টিপলেই বাংলায় কথা বলতে থাকবে৷ ইংরেজি বলবে?
ইংরেজি চ্যানেলের বোতাম টেপো৷ এ নিয়ে আর এগোচ্ছি না৷
অনুবাদের
মাধ্যমে ইংরেজি শিখলে মুশকিলতখন ইংরেজির ভিতটা নড়-বড়ে হতে বাধ্য৷ অনুবাদ প্ৰাথমিক
সহায়ক হোক তবে সব সময় অনুবাদ নয়৷ বাংলা বলার সময় তোমরা কি অন্যভাষা থেকে অনুবাদ
করো? হিন্দি বলার সময় বাংলা থেকে অনুবাদ করে হিন্দি বল? অসমিয়া? নিশ্চয়ই নয়; তবে
ইংরেজির বেলায় কেন?
হাঁটা,
সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা পুরোপুরি শেখানো যায় নানিজগুণে শিখতে হয়৷ একজন তোমাকে
গাইড করতে পারবে শুধু৷ কিন্তু আসল শেখা তো তোমার নিজের৷ সুতরাং ভেতরের তাগিদই
তোমাকে শেখাতে পারে ইংরেজি কথা বলা৷ মনকে আগে তৈরি করতে হবে৷ শিশুর মন প্ৰস্তুতির
তেমন প্ৰয়োজন পড়ে নাসে যে কাচা মাটির ঢেলা৷ শৈশব পেরোলে প্ৰয়োজন মন-প্ৰস্তুতির৷৷
শোনার
সঙ্গে সঙ্গে যুগপৎ চলা চাই বলা, লিখা এবং পড়া৷ অ-ইংলিশ স্থানে পড়া-লিখা হয়ে যেতে
পারে কিন্তু বলার কাজটা সারতে গেলে কিছু টিপস মনে রাখা প্ৰয়োজন৷ নিজেদের মধ্যে যা
মন চায় বলে যেতে হবে৷ শোনে বুঝতে পারলে প্ৰত্যুত্তর দেওয়া তেমন বড় কথা নয়৷ প্ৰরে
উত্তর তো Yes/No বলে বেশিরভাগ ক্ষেত্ৰে কাজ সারানো যায়৷ কোন কোন ক্ষেত্ৰে দু’এক
শব্দ বললেই কাফি৷ কেউ যদি প্ৰ করে What's your name?" উত্তরে তোমার নামটা
বললেই তো চলে৷ অ-বাঙালি স্থানে ডাক্তার দেখাবে৷ ডাক্তার বললেন, "What's the
problem?" বা "What's happened?" ধরো তোমার পেটে ব্যথা৷ চি চি
ব্যথা সারাক্ষণ লেগেই আছে৷ "Pain, stomach pain ... always little little
stomach pain" বলেও তো সারা যায়৷ সুতরাং অপরের কথা বোঝাটা বড় কথা৷ ভাল করে
শুদ্ধ ইংরেজি না বলতে পারলেও কাজ সারানো যেতে পারে৷ এখন বলি আজকের দিনে দাঁড়িয়ে
একজন ইংরেজ কিন্তু আমার পেটব্যথা করছে এ কথাটি বলবে "I've got a
stonachache." এখানে 'got' শব্দটা জুড়ে দেওয়া আমেরিকার প্ৰভাব৷ আজকাল খুব করে
চলে৷
এখন প্ৰশ্ন যেমন-খুশি
বুঝিয়ে দিতে পারলেই হলএই মনোভাব থাকা কি ঠিক? সানজনক মাত্ৰায় ভাষাটা তো বলা চাই?
বলতে
বলতে বলা৷ অবাঙালি বা বাংলায় কথা বলেন না এমন ভারতীয় পেলে অনেকেই দেখেছি হিন্দি
ভাষায় কথা বলেন আজকাল৷ তিনি যদি শিক্ষিত হন, ইংরেজিতে বলে দেখা যাক না, হয়ত
ইংরেজিতে উত্তর আসতে পারে৷ এভাবে ইংরেজিকে প্ৰত্যক্ষ প্ৰয়োগে লাগাতে হবে৷ বাংলায়
কাজ না হ’লে ভাষার মাধ্যম হিসেবে lingua franca ইংরেজি করে নেওয়া চাই৷
মনে
প্ৰাধান্য না পেলে কোন কিছুরই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়৷ বলা হয়, ইংরেজিকে দ্বিতীয়
মাতৃভাষা হিসেবে মনে স্থান দিতে হবে৷ প্ৰথম স্থানে রয়েছে মাতৃভাষা৷ ইংরেজিকে দেবো
দ্বিতীয় স্থান৷
ইংরেজিতে
কথা বলতে হ’লে, মোটামুটি শিখতে গেলে কত শব্দ জানা চাই? যে কোন স্ট্যান্ডাৰ্ড
অভিধানে শব্দসংখ্যা রয়েছে ১,৪০,০০০ এর মত৷ এরই মধ্যে বৃত্তিয় শব্দও ধরা রয়েছে
যেগুলো দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করা হয়৷ Oxford Advanced Learners' Dictionary তে
প্ৰায় ৪০০০ শব্দ আলাদা করে তালিকাবদ্ধ করা হয়েছে৷ এই শব্দগুলো প্ৰত্যেকেরই জানার
কথা৷ জানার কথা মানে বাক্যে ব্যবহার করতে পারা৷ শুধুমাত্ৰ এই শব্দগুলোর যথাৰ্থ
ব্যবহারে ভারতের সংসদ কেন আমেরিকার সংসদেও ঝড় তোলা যায়৷
আমরা
প্ৰতিদিনের ভাষাতে ‘রবি পূৰ্বদিশায় উদিত হয়’ কিংবা ‘ওহে কৰ্ণধার, তরণী তটসংলগ্ন
কর’ এরকম কি বলতে পারি? আমরা বলি সূৰ্য পূৰ্বদিকে (বা পুবদিকে) ওঠে৷ মাঝি, নৌকা
পাড়ে লাগাও৷ সুতরাং কোন্ শব্দ আমাকে জানতেই হবে বুঝে নেওয়া চাই৷ প্ৰতিদিনের
প্ৰয়োজনে যেসব শব্দ জানা চাই, এই শব্দগুলো উপরে উক্ত তালিকায় রয়েছে৷ ‘‘অধীকন্তু ন
দোষায়’’৷ আমাদের স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে রয়েছে শব্দ, পত্ৰ-পত্ৰিকায় রয়েছে শব্দ
এবং নানা ধ্বনের বই পড়ে আমরা শব্দ জেনে নিতে পারি৷ নিজের শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ করাই
শেষ কথা নয়, শব্দকে বাক্যে ব্যবহার করাই বড় কথা৷ রীতিমত চৰ্চার প্ৰয়োজন৷ কোন এক
ধারণাকে ভাষাতে রূপান্তর করা মাত্ৰ, অনুবাদ নয়৷ যেমন ‘ফোনটি ধ্ব’৷ এই কথাটা
ইংরেজিতে কীভাবে বলা হয়? ধ্বা আমরা জানি 'catch' নয়তো 'hold'৷ কিন্তু এই দুই
শব্দের একটিও ‘ফোনটি ধ্ব’যে অৰ্থে আমরা ব্যবহার করে থাকি সে অৰ্থে ব্যবহার করা
যাবে না৷ একজন ইংরেজ এই কথাটা কিভাবে বলবেন? "Answer the phone". আমাকেও একথাটাই বলতে হবে৷ শব্দের প্ৰয়োগ-রীতি,
শব্দ প্ৰয়োগের কিছু খুঁটি-নাটি, আমরা শুনে-পড়ে জেনে নিতে পারি৷
প্ৰতিদিন
আমরা কী কী কথা বলি? আমরা সাধারণ মানুষ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখা গেছে মাত্ৰ দশটি ধারণা’
(idea) নানাভাবে ইনিয়ে বিনিয়ে বলি৷ জিনিয়াসদের কথা আলাদা৷ বিভিন্ন বৃত্তিয়
কথা-বাৰ্তা আলাদা৷ বিশেষ সাহিত্যিক, ভাষা-বিশেষজ্ঞদের বাক্যালাপ প্ৰায়ই অন্যমাত্ৰা
পায়৷ তাঁরা ‘সবুজ’ বলতে ‘প্ৰাণবস্তু’ও বোঝাতে পারেন৷ সুতরাং তাঁদের কথা এখানে এনে
লাভ কী? আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ভাষা কী হওয়া চাই, এটাই বড় কথা, এবং এই নিবন্ধেরও
অন্যতম উপজীব্য৷
অ-ইংরেজি
স্থানে ব্যাকরণ অনুসরণ একান্ত প্ৰয়োজন যদিও আমাদের structural approach অবলম্বনে
ইংরেজি শেখার কথা বলা হয়৷ structure এর সঙ্গে সঙ্গে ব্যাকরণ বিধিও কিছুটা জানা
প্ৰয়োজন৷ শিখতে হবে Tense৷ Tense হচ্ছে বাড়ির খুঁটির মত৷ শিখতে হবে Degree,
Gender, Voice, Narration, Noun, Adjective, Adverb, Preposition, Possessive,
Phrases and Idioms, অন্ততঃ প্ৰায়োগিক ক্ষেত্ৰে এগুলো কাজে লাগাতে পারলে ইংরেজি
শেখা হয়ে ওঠে৷
Preposition
- সম্পৰ্কে কিছু বলতে হয়৷ Preposition প্ৰায়ই আমাদের বেকায়দায় ফেলে৷ Preposition -
এর সঠিক প্ৰয়োগ না জেনে Preposition ব্যবহার করা ঠিক নয় এতে বাক্যের অৰ্থই পা েযেতে পারে৷ কোন কোন
ক্ষেত্ৰে Preposition ব্যবহার না করেও সুন্দর বাক্য গঠন সম্ভব৷ I am going school.
'going'-এর পর 'to' কথা বলার সময় না বললেও চলে৷ I am going in school. ভুল হয়ে গেল৷ অৰ্থাৎ Preposition সম্পৰ্কে
সম্যক জ্ঞান না হলে বাক্যে Preposition ব্যবহার করা মুশকিল৷ কোন কোন শব্দের পর
Preposition ব্যবহারই আজকাল হয় না৷ 'Attend'-এর পর on / to এ দুটিই ব্যবহার করার
কথা আমাদের ব্যাকরণ তা বলে আসছে৷ I
attended the speech of our principal at Silchar District Library Auditorium yesterday
evening. এবাক্যে 'attend' - এর পর 'to' লাগানোর কথা, কিন্তু আজকাল দেখা যায়
'attend' - এর পর 'to' ব্যবহার করা হয় না৷ কিন্তু at District Library Auditorium
কেন? এখানে 'at' না হয়ে 'in' হল না কেন? চার দেওয়ালের মাঝখানে বক্তৃতা শোনলাম অথচ
in' ব্যবহার না করে 'at' ব্যবহার করলাম৷ ভুললে চলবে না যে, এটাই হচ্ছে
usageশব্দরাতি৷ এরকম বিল্ডিং-টিলডিং - এ 'at' ই ব্যবহার করার রীতি৷
বাক্যালাপের
সঙ্গে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ যুক্ত, সুতরাং বলার সময় you're going to the cinema বলে নিতে পার প্ৰরে মত করে৷ কিন্তু লিখার সময়তো
অন্যরকম, Are you going to the cinema ? - করতে হবে৷ বাক্যালাপে অনেক কথাই আড়ালে
থেকে যায়৷ এর একটি উদাহরণ দিচ্ছি৷ ধরো তুমি আর তোমার বন্ধু মিলে একটি সিনেমা
দেখবে৷ বন্ধুকে তুমি বললে,রতন, আমি কিন্তু ঠিক সাড়ে চারটায় তোর বাড়ি আসব৷ তুই রেডি
থাকিস৷
রতন
তোমাকে প্ৰত্যুত্তরে বলল, ঠিক আছে, আমি রেডি থাকব৷ তুমি মানে অভি পরদিন সাড়ে
চারটায় এসে রতনের বাড়ির বসার ঘরে ঢুকে পড়লে৷ রতন ভেতরে৷ তুমি হাঁকলেরতন রেডি তো৷
এই
কথোপকথনের মধ্যে কত কথা লুকিয়ে আছে৷ একজন তৃতীয় ব্যক্তি কিন্তু তাদের সব কথা বুঝে
নিতে পারছে না৷ রতন এবং অভি জানে তারা কোন সিনেমা হলে সিনেমা দেখবে৷ কোন সিনেমা
দেখবে৷ আমরা যতটুকু শুনলাম এতে এই দুটি কথা উহ্য থাকল৷ যতটুকু শুনলাম এই কথা
বুঝিয়ে গুছিয়ে লিখতে গেলে অনেক কিছুই লিখতে হবে৷ অন্য কাউকে জানাতে গেলে রতন-অভির
সিনেমা দেখার ব্যাপারটা এরকম দাঁড়াতে পারে৷
রতন
ও অভি সোনার কেল্লা সিনেমাটি দেখবে শিলচরের দেবদূত সিনেমা হলে৷ অভি রতনকে বলল, রতন
যাতে বিকেল সাড়ে চারটায় রেডি থাকে কারণ অভি আসবে রতনের বাড়ি ওই সময়৷ তারা দেখছে
ইভনিং শো৷ যথারীতি অভি এলো পরদিন বিকেল সাড়ে চারটায় রতনের বাড়ি৷ রতন বাড়ির ভেতরে
ছিল৷ অভি রতনের বাড়ির বসার ঘর থেকে রতনকে উচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করল, রতন কি ইভনিং শো
দেখার জন্য রেডি হয়ে আছে৷ ইংগিত এরকম যে, রেডি হয়ে গেলে একটুও দেরি না করে বেরিয়ে
পড়া চাই৷
লিখতে
গেলে কথার আড়ালের কথা না লিখলে বিষয়টা ঠিক ঠিক বোঝা যাবে না; গোলমেলে ঠেকবে৷
সুতরাং কথাবাৰ্তা এবং লিখার ভাষায় পাৰ্থক্য থাকা স্বাভাবিক৷ কথা-বলা কথা বলে বলে
শিখে নিতে হবে৷ আবার বলছিকথা শোনে বোঝতে হবে৷ তাহলে কথা বলা সহজ হবে৷ সামনাসামনি
বডি ল্যাঙ্গুয়েজ অনেক কথা বলে ফেলে৷
ইংরেজি
চেঁচিয়ে বলতে নেই৷ চেঁচিয়ে পড়তেও নেই৷ ইংরেজি - চেঁচাননা মানে স্থানীয় বাংলায় আমরা
ইংরেজির চেঁচানোর মতই আমাদের স্বাভাবিক কথা বলি
আমার মনে হয়৷ এটা আমাদের ভাষা বলার বৈশিষ্ট্য৷ তবে ইংরেজি এরকম উঁচু স্বরে
বললে চলবে না৷
ভালমন্দ
তো আপেক্ষিক৷ যে যে ধাঁচে অভ্যস্ত সেটাই তার কাছে ভালো৷ ভাষা শেখা থেকে সরে আমার
ইচ্ছে করছে আনুসঙ্গিকে আরো একটু বলি৷ জাপানে নাকি মুখে শব্দ করে খেতে হয়, নইলে তা
অভদ্ৰতা৷ আসলে নিঃশব্দে খাওয়াটা পশ্চিমি রেওয়াজ৷ হাততালির মত এটিও এদেশে
আমদানিকৃত৷ সুতরাং সিলেটি বলার সময় উচ্চস্বরে বলা চলে৷ তা স্বাভাবিক৷ ভাষার
স্বভাবগত চালে এটি স্বাভাবিক৷ কিন্তু আজকের বিশ্বায়ণের যুগে উচ্চস্বরে কথা বলা
শুধু বেমানানই নয়, অসভ্যতাও৷ আমাদের স্বাভাবিকত্ব আমরা গ্ৰামে-গঞ্জে আজও পেয়ে
থাকি৷ শহুরে লোক আমরা, শহুরে পোষাক মোড়ে থেকে থেকে প্ৰ-আমেরিকা বা প্ৰ-ইউরোপিয়
চরিত্ৰের দিকে এগোচ্ছি৷ এটি বোধকরি আজকের ভুবনানয়নের প্ৰভাব৷
শেষটায়
বলি, শেখা মূলতঃ নিৰ্ভর করে নিজের ওপর৷ এ্যপ্ৰোচ্টা তোমার নিজস্ব৷ শিক্ষক তো গাইড
মাত্ৰ৷ নিজের পায়ে নিজেই হাঁটতে হয়৷ তবে প্ৰথম কয়েক ধাপ গুরুর সাহায্য নিয়ে হাঁটতে
হবে৷ এতে পথ চলা সুগম হবে৷
১.
Received Pronunciation সম্পৰ্কে জানতে গেলে Daniel Jones-এর The Pronunciation of
English বইটি দ্ৰষ্টব্য৷
২.
Living English Structure by W. Stannard Allen.
৩.
ইংরেজি Cirena মানে যে প্ৰেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্ৰ দেখানো হয়৷ বাংলায় আমরা বলি সিনেমা
হল এবং film / movie কে বলি সিনেমা৷
নৃত্যতরঙ্গ
সমরবিজয়
চক্রবৰ্তী
সারাটা
জীবন নৃত্যগুরু মুকুন্দদাস ভট্টাচাৰ্য নৃত্যের খোঁজে কাটিয়ে দিলেন৷ সে খোজ নৃত্যকে
কেন্দ্ৰ করে নৃত্যের আনুষঙ্গিক উপাদানেরও খোঁজ৷ সংস্কৃতির নানাধারা এসে মিলেছে তার
অবারিত খোঁজে৷ লুপ্তপ্ৰায় গ্ৰামীণনৃত্য, আনুষঙ্গিক আচার-অনুষ্ঠান তার সৃজনশৈলীর
সহজ ও স্বছন্দ প্ৰয়াসে ফুটে উঠেছে৷ সে খোঁজ শুধু লোকনৃত্য, লোকশিপ্লে সীমায়ীত নয়,
সৃজনশীল নৃত্যনিৰ্মাণেও সষ্টি ছিলেন তিনি৷ মুকুন্দদাস ভারতের প্ৰতিটি ধ্ৰুবপদী
নৃত্যের সঙ্গেও সমানভাবে পরিচিত ছিলেন৷ তবে তার সৃজনশীল নৃত্যরচনার ভিত্ ছিল
মনিপুরি নৃত্য ও লোকনৃত্য৷ ১৯৪৬-১৯৬১ সাল অব্দি তিনি ভারতীয় গণনাট্য সংঘের
হোলটাইমার হিসেবে কাজ করেন৷ সেই হেতু বোধকরি তার প্ৰতিটি নৃত্যালেখ্য, নৃত্যনাটক
লোকসংস্কৃতির অসাম্প্ৰদায়িক, অমৌলবাদী ও মানবিক উত্তাপে সমৃদ্ধ এবং এতে ঐতিহ্যের
ভাবনাও অতি রয়েছে৷
মুকুন্দদাসের
বিস্তর নৃত্যরূপায়ণের ক্ষেত্ৰকে চারটি স্তরে ভাগ করা যায়৷ এক, লোকনৃত্য; দুই,
রবীন্দ্ৰনৃত্য; তিন, সৃজনশীল নৃত্য এবং চার, নৃত্যালেখ্য ও নৃত্যনাটক বা নাটিকা৷
রবীন্দ্ৰনৃত্যকে সৃজনশীল নৃত্য হিসেবে সচরাচর ধ্বা হয়ে থাকে৷
রবীন্দ্ৰনৃত্য
তার নিজস্ব এক চেহারা পেয়েছে এবং সেই চেহারার প্ৰেক্ষিতে একে শাস্ত্ৰীয়নৃত্য
হিসেবে গণ্য করা যায় কি নাবিষয়টি মুকুন্দদাসকে বিস্তর সংশয়ে ফেলেছিল৷
রবীন্দ্ৰসংগীত-বিযুক্ত রবীন্দ্ৰনৃত্য পরিবেশনেও রাবীন্দ্ৰিক পরিচয় অক্ষুণ্ণ থাকে৷
পোশাক, করণ ও অঙ্গহার, মুদ্ৰা, আঙ্গিক-অভিনয় ইত্যাদির সময়েও ফুটে ওঠে
রবীন্দ্ৰনৃত্যের রূপ৷ সুতরাং বিষয়টি বিশেষ ভাবনা দাবি করে৷ মুকুন্দদাস ও দিল্লির
নামী সংস্কৃতিশিপ্লী বাল্মিকী বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে এ বিষয়ে সংলাপ ও চিঠি বিনিময়
প্ৰণিধানযোগ্য৷
বিশেষ
ভাবনা-চিন্তার পর মুকুন্দদাস তার লিখিত বয়ানে বলে গেছেন রবীন্দ্ৰনৃত্যে যেহেতু
নানা পরিবৰ্তন আনা যায়, ফ্লেক্সিবিলিটি বেশি এবং তা বিশেষ কোন লোকনৃত্যকে ভিত্
করে গড়ে ওঠেনি, যা অন্যান্য শাস্ত্ৰীয় নৃত্যের ব্যাপারে ঘটেছে, সেইহেতু
রবীন্দ্ৰনৃত্যকে শাস্ত্ৰীয় নৃত্য আখ্যা দেওয়া সমীচীন হবেনা৷ বলা বাহুল্য,
রবীন্দ্ৰনৃত্য মুকুন্দদাসের জীবনে অন্যতম এক উজ্জ্বল অধ্যায়৷ সুতরাং, তার রূপায়িত
রবীন্দ্ৰনৃত্য সম্পৰ্কে পৃথকভাবে আলোচনা করা আবশ্যক বলে মনে করি৷
লোকনৃত্য :
ও লুপ্তপ্ৰায় লোকনৃত্য এবং লোকনৃত্যের নানা উপাদানের সন্ধান, সংগ্ৰহ ও উদ্ধার
মুকুন্দদাসকে বিরল সানের আসনে বসিয়েছে৷ আর কোন কিছুতেই না হোক, তিনি বেঁচে থাকতে
পারেন এই লোকনৃত্যের জন্যে৷ বোধ করি এমন কোন বিশেষজ্ঞ নেই যিনি লোকনৃত্যের আঙিনায়
মুকুন্দদাসের সমান্তরালে বসাতে পারেন আর কাউকে৷
মুকুন্দদাসের
লোকনৃত্য সংগ্ৰহ, যথাৰ্থ স্বীকৃতি প্ৰদান, লোকসমক্ষে ;উপস্থাপন করা ইত্যাদি একটি
জাতির অস্তিত্ব বেঁচে থাকার সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ কারণ লোকনৃত্য সেই জাতিগোষ্ঠীকে একই
মঞ্চে নিয়ে আসতে সাহায্য করে৷ মুকুন্দদাসের ভাষায়‘লোকনৃত্যের প্ৰধান আদৰ্শ হল
বিবিধ্বে মধ্যে ঐক্য স্থাপন করা৷ সবাইকে একসূত্ৰে গেঁথে নিয়ে একটা সুন্দর সরল সংহত
কৰ্মবহুল সমাজ গঠন করা৷’
তিনি
আবার বলেছেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে সারা ভারতবৰ্ষের অঞ্চলের ১০-১২টি লোকনৃত্য
পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি৷ এই সবগুলোই দীৰ্ঘদিন সমাজে জনপ্ৰিয় ও প্ৰচলিত ছিল৷
শুরু
করা যাক ৰ্তার বরাক ও সুরমা উপত্যকার লোকনৃত্য পুনদ্ধার ও সংগ্ৰহ সম্পৰ্কে৷ তিনি
এই অঞ্চলের বাঙালিদের এ সবগুলি লেকনৃত্য এবং তৎসহ লোকনৃত্যের নানা উপাদান
সন্নিবিষ্ট করে সৃষ্টি করেন ‘তবু রঙ্গে ভরা’৷ এই নৃত্যলেখ্যটি এই অঞ্চলের
নৃত্যগাথার এক জীবন্ত সংগ্ৰহশালা (লিভিং আৰ্কাইভ) বলা যেতে পারে৷ এই নাচগুলির
সঙ্গে ওতপ্ৰোত জড়িত গ্ৰামীণ সংস্কার, পরম্পরাগত আচার-আচরণ ও অনুষ্ঠান৷ এই
নৃত্যালেখ্যের মাধ্যমে সিলেটিদের মূল সংস্কৃতি কী, কিসের উপর দাঁড়িয়ে আছে এই
বাঙালি জনগোষ্ঠী এর এক সম্যক পরিচয় পাওয়া যায়৷ এতে এ অঞ্চলের ইসলাম ধৰ্মাবলম্বী
বাঙালিরাও, আংশিক হোক, বাদ পড়েন না৷ বউনাচ, জারি নাচ, চরকের নাচ, ওঝা নাচ, ছাদ
পেটার নাচ, নৌকা বাইচের নাচ, ধামাইলএইনাচগুলো এই আলেখ্যের এক একটা স্তম্ভ বলে ধরে
নেওয়া যায়৷
এই
নৃত্যালেখ্যটি ‘কাছাড়ের বারো মাসি’ নামে ১৯৬১ সালে শিলচর গভৰ্নমেন্ট বয়েজ স্কুলে
প্ৰথম মঞ্চস্থ হয়৷ সেই থেকে দেশের নানা স্থানে সৰ্বমোট পঞ্চাশবার এটি অনুষ্ঠিত হয়৷
ক্রমে ক্রমে এটির পরিবৰ্তন ও পরিবৰ্ধনও করা হয়; নামও পালটায়৷ পরবৰ্তীতে এর নামকরণ
করা হয় ‘তেরপাৰ্বণ’, ‘হাটে ঘাটে মাঠে’ এবং সৰ্বশেষে এ অঞ্চলের বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ ও
সংগীতশিপ্লী শ্যামাপদ ভট্টাচাৰ্যের নামকরণ ‘তবু রঙ্গে ভরা’য় স্থিত হল৷ মুকুন্দদাস
এটি সৰ্বশেষ উপস্থাপন করেন ৪ মাৰ্চ ২০০৭ সালে কলকাতার রবীন্দ্ৰসদন মঞ্চে
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের আমন্ত্ৰণে৷ এর প্ৰায় চার মাস পর তার
মৃত্যু হয় ২০০৭এর ৬ আগস্ট)৷ উপরে উক্ত নাচগুলি ছাড়াও ‘তবু রঙ্গে ভরা’য় রয়েছে ঠাটের
নাচ, নৌকা বাইচের নাচ, বরুণব্ৰত নাচ, ছাদ পেটার গান, রাখালের আই৷ এ সমস্ত নাচ-গান
এ অঞ্চলের অবলুপ্ত পটুয়া বৰ্ণনকে কেন্দ্ৰ করে হয়েছে৷ পটুয়ার পটকথা বৰ্ণন নানাভাবে
বাংলার নানা জায়গায় প্ৰচলিত ছিল৷ মুকুন্দদাস এ অঞ্চলের পটুয়ার বৰ্ণনে যে বৈচিত্ৰ্য
পান, সেটা হল পটুয়ার মুখে বৰ্ণনা চলাকালীন শরীরী ভঙ্গিমা; এতে ফুটে ওঠে শিপ্লিত
রূপ৷ অন্যান্য অঞ্চলে পটুয়ারা বসে পটের চিত্ৰ বৰ্ণনা করত, কিন্তু এ অঞ্চলের
পটুয়ারা এ কাজটি করত চিত্ৰ প্ৰাসঙ্গিকতা বজায় রেখে৷ সমাজ সংস্কার ও লোক শিক্ষায়
পটুয়ার অবদান অনস্বীকাৰ্য৷
‘মুঝে
জীনে দো’-খ্যাত চলচ্চিত্ৰকার মণি ভট্টাচাৰ্যের কিঞ্চিত অবদান রয়েছে এই আলেখ্যের
পরিবৰ্তন-পরিবৰ্ধন ও মঞ্চরূপায়ণে৷ নৃত্যগুরুর অনুজভ্ৰাতা অনন্তকুমার ভট্টাচাৰ্যের
সংগৃহীত কয়েকটি গান এই আলেখ্যে সংযুক্ত করা হয়৷
‘তবু
রঙ্গে ভরা’ নিশ্চিত এক বিশদ গবেষণার বিষয়৷ মুকুন্দদাস স্বয়ং পটুয়ার অভিনয় করতেন
কারণ
এটি হচ্ছে ভিত, শিরদাঁড়া, মাথাযাই বলুন৷ প্ৰথম প্ৰথম তিনি ধুতি পরে এটি করতেন,
পরবৰ্তীতে মুসলমান বেশে করতেন৷ হয়তো হিন্দু-মুসলমান সময়ের কথা মাথায় রেখে এ কাজটি
করতেন৷ বাস্তবে এ অঞ্চলে পটুয়া বরাবরই ছিল হিন্দু৷ এই অঞ্চলের বারো মাসের নানা
পৰ্ব, অনুষ্ঠান এই নৃত্যালেখ্যে তুলে ধ্বা হয়েছে গ্ৰামীণ নৃত্য সহযোগে৷ হাজার
যন্ত্ৰণার মধ্যেও বিচিত্ৰ, উদ্দীপ্ত ও আনন্দময় আমাদের এ অঞ্চলের বাঙালি সমাজঅন্তত
মুকুন্দদাসের নিরিখে এটাই ধ্বা পড়েছে এই নৃত্যালেখ্যে৷
মুকুন্দদাস
তার ‘পরিক্রমা’ নামক নৃত্যালেখ্যে অন্তৰ্ভুক্ত করেন তার উদ্ধারকৃত ভারতের অন্যান্য
অঞ্চলের নৃত্য৷ ‘পরিক্রমা’ও বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে সমাজে বিলুপ্ত ও
বিলুপ্ত-প্ৰায় নৃত্যগুলি৷ মুকুন্দদাস বরাক-সুরমা সমেত অন্যান্য অঞ্চলের তাঁর
উদ্ধারকৃত নৃত্যগুলি তাঁর সৃষ্ট লক্ষৌ-এর ভাতখণ্ডে সংগীত বিদ্যাপীঠের সিলেবাসে
অন্তৰ্ভুক্ত করেন৷ প্ৰসঙ্গত উল্লেখ্য, মুকুন্দদাসই সৰ্বপ্ৰথমে ভারতের নানা অঞ্চলের
লোকনৃত্য অন্তৰ্ভুক্ত করে বিজ্ঞানসত একটি পাঠক্রম গড়ে তোলেন৷ যতটুকু জানা যায়, এর
পূৰ্বে কেউ লোকনৃত্যের কোন সিলেবাস তৈরি করেননি৷
মুকুন্দদাসকে
নৃত্য সংগ্ৰহ করতে গিয়ে কোন কোন সময় জীবনের ঝুঁকিও নিতে হয়েছে৷ বিশেষ করে রাই ও
শেইরা নৃত্য দুটির পুনরুদ্ধারের প্ৰক্রিয়া বিশেষ রোমাঞ্চকর৷ উত্তর প্ৰদেশের
অন্তৰ্গত বুন্দেলখণ্ডে সেই সময় কুখ্যাত দুবৃত্তদের বসবাস ছিল৷ তিনি ওই অঞ্চলে
ঘোরাফেরা করে এদের কাছ থেকে পুরুষ নৃত্য শেইরা শেখেন৷ রাই নৃত্যটি তোলেন তিনি লীলা
বেরনির কাছ থেকে৷ পরবৰ্তীতে লীলা বেরনি তাঁরই অনুপ্ৰেরণা ও সাহায্যে রাই নৃত্যের
পুরোধা শিপ্লীরূপে প্ৰতিষ্ঠিত হন, সরকারি সাহায্য ও বিশেষ দু-একটি পুরস্কারও লাভ
করেন৷ শেইরা নৃত্য করেন এমন দুবৃত্তের জীবনও শুধরে যায়৷ এদের কেউ কেউ আবার
দুবৃত্তের কাজ ছেড়ে দিয়ে সংগীতকে পেশা করে নেয়৷ সঙ্গত কারণে বরাক-সুরমা অঞ্চলের
তিনটি শীৰ্ষস্থানীয় নৃত্য সম্পৰ্কে অপ্ল-বিস্তর আলোচনা করে লোকনৃত্যের পৰ্যায় শেষ
করছি৷ এই তিনটি নৃত্য হলওঝা নৃত্য, বধূ নৃত্য ও ধামাইল৷
ওঝা নৃত্য :
মুকুন্দদাস বরাক-সুরমা উপত্যকার ওঝা নৃত্যে শাস্ত্ৰীয় নৃত্যের উপাদান খুঁজে পান৷
তিনি তাই নৃত্যটিকে শাস্ত্ৰীয় নৃত্যে উন্নীত করতে সচেষ্ট ছিলেন৷ গুরমির প্ৰচলন আজ
গ্ৰাম-গঞ্জে নেই বললেই চলে৷ কারণ গুরমি বা প্ৰচলিত মুখের ভাষায় আমরা যাকে বলি
হিজরা, হিজরাদের এই নাচ৷ এ অঞ্চলের হিজরারা এই নাচটি করত কারণ তারা এই নাচের
অধিকারী ছিল৷ প্ৰায় প্ৰতিটি উন্নতমানের নাচের উৎপত্তি অবশ্য সমাজচ্যুত ও অবহেলিত
সম্প্ৰদায়ের মধ্যে হয়েছেসে কত্থকই হোক, ভারত নাট্যম, কুচিপুরি যা-ই বলুন৷
ব্যতিক্রমও রয়েছে, যেমন মণিপুরি নৃত্য৷
আমাদের
সাধারণ চোখে ওঝানৃত্য, যা হয়ত কেউ কেউ গ্ৰামে দেখে থাকবেন, মনসাপূজার সময় এ নৃত্য
করা হয়, তেমন ভাললাগার হয়ে ওঠে না৷ তার একটি কারণযিনি নৃত্য করছেন, দেখা যেতে পারে
তার পায়ের গোড়ালি ফাটা, অবিন্যস্ত তাঁর সাদা আলখাল্লা অৰ্থাৎ ওঝা নৃত্যের
স্বাভাবিক পোশাক৷ নৃত্যশিপ্লীর চেহারাও আকৰ্ষণ করার মত নয়৷ এর সঙ্গে যোগ দিয়েছে
গ্ৰাম্য উচ্চারণে অমাৰ্জিত কণ্ঠে সংগীত পরিবেশন যা শহুরে বাবুদের কৰ্ণগোচরে
শ্ৰুতিকটু হয়ে ওঠে৷
এখানটায়ই
বোধ করি মুকুন্দদাসের কৃতিত্ব৷ তিনি শুধু এ নাচটি সংগ্ৰহ করেননি, এটিকে তিনি
আকৰ্ষণীয় করে তুলেছেন তাঁর প্ৰধান বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে৷ পোষাকে এনেছেন সামান্য
পরিবৰ্তন৷ আলতো গোলাপি আভার পোষাক পরিয়ে দেখেছেন; এর মধ্যে জড়ির কাজ জুড়ে দিয়েছেন৷
ওঝা নৃত্যের মূল সাদা পোশাকেও জড়ির সংযুক্ত করেছেন৷
মুকুন্দদাসের
ইচ্ছে ছিল ওঝানৃত্য ১০০-২০০ ছেলে-মেয়েদের দিয়ে তিনি করাবেন৷ দিল্লিতে প্ৰজাতন্ত্ৰ
দিবসে এটি করানোর আকাঙক্ষা তাঁর ছিল৷ (এ বিষয়ে ‘নৃত্যগু মুকুন্দদাস ভট্টাচাৰ্য,
বাঙালিত্ব, সত্তা ও স্বীকৃতি’ দ্ৰষ্টব্য৷ সাময়িক প্ৰসঙ্গ, আগ ১৯, ২০০৭
ধামাইল :
‘বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’ সঞ্জীবচন্দ্ৰ চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত এই
উক্তি সব ক্ষেত্ৰে হয়ে গ্ৰহণীয় হয়ে ওঠে না৷ বনে নানান ফুল অবিন্যস্ত অবস্থানে গাছে
পড়ে থাকে৷ অবিন্যস্ত কেন? আমরা নগর সভ্যতার লোক, আমাদের জানা সৌন্দৰ্যের শৃঙ্খলায়
ফুলের অবস্থান দেখতে পাই না বলে৷ এই ফুল গাছ আমরা ঘরে এনে যখন রোপন করি তখন আমাদের
মনের জ্যামিতিক শৃঙ্খলায় তা করি৷ যে কোন গাছ-গাছড়ার ব্যাপারেও এরকম৷ ফুলদানিতে ফুল
সাজানোর ব্যাপারও আমরা আমাদের নন্দন চেতনার নিরিখে করে থাকি৷ এত কথা বললাম এই
কারণে যে, গ্ৰামে ধামাইল যারা করেনএক, তাদের পোশাক অতি সাধারণ এবং অধিক পরিধানে
এতে দীনদশা এসে যায়৷ এটির কারণ মনে করি রুচির চেয়েও দারিদ্ৰ৷ দুই, যৌথ নৃত্যে
সমানুপাতিকতা বজায় থাকতে হয়; কিন্তু এখানে তা থাকছে না, যে কেউ এতে যোগ দিতে
পারছেন৷ এতে যোগ দিতে সুন্দর অসুন্দর নারীর বালাই নেই৷ তিন, যার কণ্ঠে সুর নেই
তিনিও গীত করছেন এবং কারো গলা সাধা থাকে না৷ আসলে গীত গাওয়া নিয়ে কোন প্ৰশিক্ষণও
তারা পান না৷ ধামাইল নৃত্য মঞ্চস্থ করতে গেলে এদিকগুলো দেখে নেওয়ার রয়েছে এবং তা
পাঠ্যক্রমে অন্তৰ্ভুক্ত করা চাই৷ মুকুন্দদাস শোধন করলেন নৃত্যটি; নিপুণ রচনাবৰ্তের
পরম্পরা রক্ষা করে সৃষ্টি করলেন তাঁর উপলব্ধির রূপময়তা৷ গীতে আনলেন সুর, সংগীত ও
সমতানের রসরঞ্জনা৷
বাঙালির
কোন জাতীয় নৃত্য নেই৷ এই দৃষ্টিকোণ থেকে ধামাইল বাঙালির জাতীয় নৃত্য হয়ে উঠতে পারে
কি না এনিয়ে মুকুন্দদাস ভাবনা চিন্তা করেন
(দৈনিক যুগশঙ্খ, শিলচর ১৭ আগস্ট, ২০০৭, ‘বাঙালির সমবেত জাতীয় নৃত্যের সন্ধানে এক
অক্লান্ত রানার’)
বৌনাচ
: এই নৃত্যের পুরস্পরাগত আনুষ্ঠানিক প্ৰচলন আজ আর নেই বললেই চলে৷ এর কারণ এ অঞ্চলে এখন আর কম বয়সি
অথাৎ ঋতুমতি হয়েছে মাত্ৰ এমন তরি বিয়ে হয় না৷ তা প্ৰায় ৬০৭০ বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে
গেছে৷ মুকুন্দদাস এই নৃত্য প্ৰথম বাঙালি-অবাঙালি মিশ্ৰ দৰ্শকের সমক্ষে তুলে ধরেন
১৯৫৩ সালের ৯ সেম্বের টিটাবরে অনুষ্ঠিত সৰ্বভারতীয় বুনিয়াদি শিক্ষা সলিনীতে৷ নাচটি
করেন রেবা নাথ৷ অনুষ্ঠানটি উপস্থাপন করে শিলচর সংগীত বিদ্যালয়৷ এর পরের বছর
নৃত্যগুরু এটি উপস্থাপন করেন নওগাঁ-এ সংগীত নাটক একাডেমির সলেনে ৫ মে, ১৯২৪ সালে৷
রেবা নাথকে দিয়েই এ নাচটি পরিবেশন করান তিনি৷ দৰ্শক আসনে বসা নৃত্যলোকের রাজপুত্ৰ
উদয়শঙ্কর৷ তিনি এই নৃত্য দেখে অভিভূত হন এবং শিলচর সংগীত বিদ্যালয়ের রিমাৰ্ক বই-এ
তিনি তার উজ্জ্বল মন্তব্য রেখে যান৷ উদয়শঙ্কর এই নাচটি মুকুন্দদাসের কাছ থেকে তুলে
নেন৷ আজ মুকুন্দদাসকৃত সংস্কৃত বধুনৃত্য মঞ্চস্থ হলে পাইশরীরী হয়ে ওঠা সংহত ছবি ও
স্থাপত্যের সুষমব্যঞ্জনা৷ সংগীত, নৃত্য ও ছন্দের বিশিষ্ট বিভঙ্গে অনন্য এক
রূপভাবনা৷ বাংলার রূপ ও লাবণ্য মনে হয় এই পল্লীবধূ-বালায় ফুটে ওঠে৷ বধূনৃত্যের এত
লাবণ্যস্নিগ্ধ ব্যঞ্জনা আর কোন লোকনৃত্যে দৃষ্ট হয় নাঅন্তত এই নিবন্ধকারের গোচরে
আসেনি৷
সৃজনশীল
নৃত্য : সৃজনশীল নৃত্যের সম্ভারে বোধ করি প্ৰথমেই উল্লেখ করতে হয় রানার৷ জনমানসে
নৃত্যগুরু মুকুন্দদাস ভট্টাচাৰ্য ও রানার একাত্ম হয়ে আছে৷ কবি সুকান্ত
ভট্টাচাৰ্যের ‘রানার’ কবিতা অবলম্বনে এই নাচটি করতেন মুকুন্দদাস৷ কবিতাটিতে
সুরারোপ করেন সলিল চৌধুরী৷
গানটি
প্ৰথম যন্ত্ৰস্থ হয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে৷ আইপিটিএ-আন্দোলনের সঙ্গে
সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকার সময় মুকুন্দদাস এই নাচটি তোলেন কলকাতার শম্ভু ভট্টাচাৰ্যের
কাছ থেকে৷ তারপর ক্রমায়ে এতে তাঁর নিজস্বতা গড়ে তোলেন৷ ফুটে ওঠে সুকান্তের কবিতার
চিত্ৰকপ্ল দেহভঙ্গির হিল্লোলে, অঙ্গ সঞ্চালনে৷ দেহের বিচিত্ৰ বিভঙ্গে শিপ্লায়িত
করেন মুকুন্দদাস৷
রানারের
সরাসরি কোন প্ৰাসঙ্গিকতা আজ আছে কি? রানার বা ডাকহরকরার প্ৰচলন আজ নেই৷ যোগাযোগ
ব্যবস্থা নানাভাবে উন্নত হওয়ায় ডাকহরকরার প্ৰয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে৷ দুৰ্গম অঞ্চলে
ডাকহরকরা নিজের ও তার পরিবারের জীবন ধারণের প্ৰয়োজনে এ কাজটি করত৷ অনেক সময়
বিপদসংকুল অবস্থার মোকাবিলাও তাকে করতে হত৷ এতে তার প্ৰাণ যাবার সম্ভানা থাকত৷
মানুষের অৰ্থ বহন করতসে অথচ সে কাজ করত অতি অপ্ল অৰ্থের বিনিময়ে৷ মানুষের
সুখ-দুঃখের চিঠির বোঝা সে বহন করে নিতঅথচ তার সুখ-দুঃখের খবর থাকত আড়ালে৷ গানটির
এসমস্ত ভাব-অৰ্থ মুকুন্দদাস তার নৃত্যে এমনভাবে ফুটিয়ে তুলতেন যে এর ব্যঞ্জনা যে
কোনো শোষিত বঞ্চিত মানুষের বঞ্চনার প্ৰতীক হয়ে দাঁড়াত৷ প্ৰায় এক হাজার বার
মুকুন্দদাস তাঁর এই রানার নৃত্য প্ৰদৰ্শন করে গেছেন৷ এর কয়েকটি ভিডিও ও সিডি
সংগৃহীত রয়েছে৷
মুকুন্দদাস
নানা ধ্বনের অজস্ৰ গানে নৃত্যরূপ দিয়েছেন৷ তার সৃজন নৃত্যে তিনি নৃত্য
নন্দনতত্ত্বকে কখনও বোধ করি তাঁর সমাজ তত্ত্ব থেকে বিযুক্ত করেননি৷ তার সৃজনশীল
নৃত্যের সকল ধারায় পাই লোকনৃত্য৷ এতে করে জনমানসে স্থিত পরম্পরায় পাওয়া কপ্লচিত্ৰ
মুকুন্দদাসের কপ্লনার ভাস্কৰ্যে বিচ্ছুরিত হয়েছে প্ৰতিটি নৃত্য সৃজনীতে৷ এতে নাচগুলি
হয়েছে সরলজীবন্ত ও জীবনীশক্তির প্ৰাচুৰ্যে দীপ্ত৷ তাঁর ছিল ইতিবাচক দৃষ্টি৷
ব্যথাবেদনার মুৰ্ছনা তার শিয়ে শিপ্লিত হত ন্যুব্জতায় নয়অন্য ব্যঞ্জনায়৷ আলোর
প্ৰয়োজনে একটু আধটু আঁধারের প্ৰয়োজনএভাবেই প্ৰোথিত ব্যথা-শোক তাঁর নৃত্যে৷
রবীন্দ্ৰনৃত্য
: মুকুন্দদাস রবিঠাকুরের শতাধিক গানের চেহারা ফুটিয়ে উঠিয়েছেন৷ রবীন্দ্ৰনৃত্য
সৃজনে প্ৰায় প্ৰতি বাঁকে লোকনৃত্যের দেহভঙ্গির সুষম সৌন্দৰ্য প্ৰস্ফুটিত হয়ে
রয়েছে, বোধ করি, এ-ই তার রবীন্দ্ৰ নৃত্যশৈলীর প্ৰধান বৈশিষ্ট৷ এ ছাড়া মণিপুরি
নৃত্যের ছাপও তার নৃত্যরূপায়ণে ফুটে ওঠে৷ ‘মণিপুরী নৃত্যের সহজ সাবলীল ছন্দ,
স্বচ্ছ বিন্যাস ও মনোরম মৃদু ললিত সৌন্দৰ্যের সঙ্গে কবিকপ্লনার একাত্মতাই এর কারণ৷
কথক নৃত্যপদ্ধতি শান্তিনিকেতনে তার স্কুল আঙ্গিক সৰ্বস্বতার জন্য বিশেষ সমাদৃত
হয়নি৷ কবিগুরু নৃত্য প্ৰযোজনা কালে সৌন্দৰ্যরসের উদ্বোধন সম্পৰ্কে বিশেষ সতৰ্কতা অবলম্বন
করতেন বলে অনেকক্ষেত্ৰে শাস্ত্ৰীয় নৃত্যের বাহুল্য ও কলা-কৌশল বাদ দিতেন’৷
মণিপুরি
নৃত্যের প্ৰতি বিশেষ আকৰ্ষণের বশবৰ্তী হয়ে রবীন্দ্ৰনাথ এ অঞ্চল থেকে নিয়ে গেছেন
দুই তাবড় মণিপুরি নৃত্যশিপ্লীগুরু রাজকুমার সেনারিক সিংহ ও গুরু বিহারী সিংহ৷ এরা
দুজনই শিলচর শহরের অদূরে অবস্থিত সিংগারী বস্তির বাসিন্দা ছিলেন৷ প্ৰসঙ্গত
রাজকুমার সেনারিক সিংহ শান্তিনিকেতনের অধ্যাপনা থেকে অবসর নিয়ে শিলচর সংগীত
বিদ্যালয়ে মণিপুরি নৃত্য শেখানোর কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন৷ মুকুন্দদাস গুরু
রাজকুমার সেনারিক সিংহের কাছ থেকে মণিপুরি নৃত্য শেখেন৷
মণিপুরি
নৃত্যে স্বাভাবিক কারণে শ্ৰীচৈতন্যের ভাবধারা পরিস্ফুট হয়৷ বঙ্গভূমিতে বৈষব
আন্দোলনের প্ৰভাব অতি গভীরে৷ বাংলার সংস্কৃতি, সভ্যতা, বাংলার মেজাজ আপাত নরম ও
স্নিগ্ধ৷ শ্ৰীচৈতন্যের বৈষবধৰ্মের জন্ম বাংলার নরম মাটি, অজস্ৰ নদী-খাল-বিল-দীঘি
শ্যামলিমার পূৰ্ণ আবহে সৃষ্ট হয়েছিল৷ এই আবহের সঙ্গে যুক্ত প্ৰতিটি বাঙালি৷
রবীন্দ্ৰনাথও এর বাইরে নন৷ মণিপুরি নৃত্যের বৰ্তমানরূপ বাংলার শ্ৰীগৌরাঙ্গসৃষ্ট
বৈষবধৰ্ম অবলম্বনে৷ প্ৰতিটি নৃত্য রাধা-কৃষে সমৰ্পিত৷ আর সেই সম্পৰ্কটা হবে
প্ৰেমাশ্ৰিত৷ সে প্ৰেম জৈবিক হোক অথবা আত্মিক বা আধ্যাত্মিক৷ ‘প্ৰেম’ কঠিন হতে
পারে কি? ‘প্ৰেম’ স্বভাবত স্নিগ্ধ৷ ‘প্ৰেম’ দেহাভঙ্গে প্ৰকাশ পায় লীলায়িত রূপে৷ এ
সমস্ত কারণে, মুকুন্দদাস তার রবীন্দ্ৰনৃত্য রূপায়ণে, নৃত্যাঙ্গিক প্ৰয়োগ করেন৷
এককথায়, রবীন্দ্ৰমনন ধরে রেখেছেন তাঁর নৃত্য রচনায়৷ আজকাল প্ৰায়ই দেখা যায় এই মনন
রবীন্দ্ৰনৃত্য রচনায় আংশিক প্ৰয়োগ করা রবীন্দ্ৰধারা থেকে বিচ্যুত হয়
রবীন্দ্ৰনৃত্য৷ অনেক সাজ-পোশাকও রাবীন্দ্ৰিক হয় না৷ মুকুন্দদাসের এই আধুনিক
বিপৰ্যয়ে আক্ষেপ ছিল৷
মুুকুন্দদাস
রবীন্দ্ৰনৃত্য সৃজনে বা রাবীন্দ্ৰিক বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে এতে এনে দিয়েছেন এক টান-টান
ভাব, অৰ্থাৎ বিগলিত করুণা’র মত তার সৃষ্ট রবীন্দ্ৰনৃত্য নয়৷ একজন পুরুষও যদি তার
সৃষ্ট রবীন্দ্ৰনৃত্য করেন তাহলে তার ‘পুরুষ’ শব্দে এতোটুকুও খামতি থাকে না৷ অথচ
দেখা যায় স্ত্ৰী-পুরুষ নিৰ্বিশেষে রবীন্দ্ৰনৃত্য সচরাচর হয়ে ওঠে অবলা নারীর মূৰ্ত
প্ৰতীকের মত৷ এই সৰ্বস্ব বিগলিত ভাবের, অতি বিনয়ের৷ বৈপরীত্বে ছিলেন মুকুন্দদাস৷
মুকুন্দদাস
আঙ্গিক অভিনয়েও জোর দেন৷ শুধুমাত্ৰ সঠিক মুদ্ৰা, অঙ্গ সঞ্চালনা, ভঙ্গিমাতে আবদ্ধ
থাকতেন না৷ তিনিসাৰ্বিক প্ৰাণ প্ৰকাশে, আকৰ্ষণ ও দৃশ্যনন্দন করে তোলার জন্য শরীরী
ছন্দে ‘রসনিষ্পত্তি’রও সংযুক্তি রয়েছে৷ তাঁর রচিত রবীন্দ্ৰনৃত্যে৷ এ ক্ষেত্ৰে আমরা
পাই বরাক-সুরমার লোকনৃত্যের ছটা৷ এইভাবে রবীন্দ্ৰনৃত্যেও তিনি এক স্বতন্ত্ৰ ঘরানা
তৈরি করে ফেলেছেন বলা যায়৷ এখন তা গবেষণাসাপেক্ষ৷
নৃত্যালেখ্য
: মুকুন্দদাসের ‘তবু রঙ্গে ভরা’ সম্পৰ্কে পূৰ্বেই আলোচনা করা গেছে৷ ভারতের নানা
লোকনৃত্য সম্বলিত নৃত্যালেখ্য পরিক্রমাও মুকুন্দদাসের আর এক মাইলস্টোন৷ হাসিনা
বিবির কথা, অরুণ বরুণ কিরণমালা, সিংহ আউর শশক (হিন্দি), পানৈর পনা খান (অসমিয়া),
কলস্টু ড্ৰাম, ব্ৰহ্মপুত্ৰ এ্যাটোমিক এ্যনাব্জি ফর পিস্, শ্ৰমসংগীত-ছন্দ, সুর ও
ছন্দ পাক-মাৰ্কিন মিলিটারি এলায়েন্স, মহুয়া ইত্যাদি বেলে তার সৃষ্ট৷
রবীন্দ্ৰনাথের
প্ৰায় প্ৰতিটি নৃত্যনাট্যকে তিনি নৃত্যরূপ দিয়েছেন৷ মঞ্চ রূপায়ণেও তিন ছিলেন
সিদ্ধহস্ত৷ এ সমস্ত নৃত্যালেখ্য ও
নৃত্যনাটকে তিনি নৃত্য নিৰ্দেশ দিয়েই থেমে থাকেননি, সামগ্ৰিক উপস্থাপনেও তাঁর কৃতিত্ব
রয়েছে৷
রবীন্দ্ৰ
নৃত্যনাট্যে মুকুন্দদাস রবীন্দ্ৰধারা অনুসরণ করে গেলেও যেহেতু রবিঠাকুর সৃজনশীলতায়
স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন কয়েকটি শৰ্তে, যে শৰ্তগুলি মেনে চললে আমরা একে রাবীন্দ্ৰিক
বলি, লোক আঙ্গিকও তিনি তাতে অতি করেছেন৷ আজো তাঁর সৃষ্ট রবিঠাকুর রচিত চণ্ডালিকা,
রক্তকরবী, শ্যামা, তাসের দেশ, চিত্ৰাঙ্গদা, বাল্মিকী প্ৰতিভা, নটির পূজা ইত্যাদি
শুধু দৰ্শক নয় বিশিষ্ট সমালোচকদেরও প্ৰশংসা কুড়োয়৷
উল্লেখ্য
যে, মুকুন্দদাস কখনও ব্যক্তিগত দক্ষতা প্ৰদৰ্শনের আতিশয্য করে যাননি তাঁর করা
নৃত্যালেখ্য ও নৃত্যনাটকে এবং এই দোষে তিনি দুষ্ট নন তাঁর অন্যান্য একক বা
সমষ্টিগত নৃত্যরূপেও৷ তিনি নিশ্চিত বিশ্বাস করতেন রবীন্দ্ৰনাথের এই উক্তিতে ‘এক
রকমের গায়ে পড়া সৌন্দৰ্য আছে যা ইন্দ্ৰিয়তৃপ্তির সঙ্গে যোগ দিয়ে অতি লালিত্যগুণে
সহজে আমাদের মন ভোলায়৷ চোর যেমন দ্বারীকে ঘুষ দিয়ে চুরি করতে ঘরে ঢোকে৷ সেই জন্যে
যে আৰ্ট আভিজাত্যের গৌরব করে সে আৰ্ট এই সৌন্দৰ্যকে আমল দিতেই চায় না৷
কোন
রচনার মৰ্মকথাকে উপেক্ষা করে চোখ ধাঁধানো দৃশ্য, মনমাতানো নৃত্যভঙ্গিমা, ভেতর না
বুঝে শুধুমাত্ৰ বাহিরিয়ানার প্ৰদৰ্শন মুকুন্দদাসের সৃষ্টিতে মেলে না৷
শেষ
টানতে একথা বলতেই হয়, নৃত্যগুরু মুকুন্দদাস ভট্টাচাৰ্যের সংস্কৃতি-নৃত্য জীবনের
বিশাল অবয়ব নিয়ে আলোচনা একটি সাময়িকের কয়েকটি পৃষ্ঠায় ধরে রাখা দুষ্কর এবং এই
নিবন্ধকারের পক্ষে দুঃসাধ্যওএ বিনয় নয়, বাস্তব৷ সুতরাং এখানে এই বিশাল শিপ্লীর
রূপরেখা রচনার প্ৰয়াস মাত্ৰ করা গেল৷
নৃত্যগুরু
নৃত্যশৈলী
সমরবিজয়
চক্রবৰ্তী
সারাটা
জীবন নৃত্যগুরু মুকুন্দদাস ভট্টাচাৰ্য নৃত্যের খোঁজে কাটিয়ে দিলেন৷ সে খোজ নৃত্যকে
কেন্দ্ৰ করে নৃত্যের আনুষঙ্গিক উপাদানেরও খোঁজ৷ সংস্কৃতির নানাধারা এসে মিলেছে তার
অবারিত খোঁজে৷ লুপ্তপ্ৰায় গ্ৰামীণনৃত্য, আনুষঙ্গিক আচার-অনুষ্ঠান তার সৃজনশৈলীর
সহজ ও স্বছন্দ প্ৰয়াসে ফুটে উঠেছে৷ সে খোঁজ শুধু লোকনৃত্য, লোকশিপ্লে সীমায়ীত নয়,
সৃজনশীল নৃত্যনিৰ্মাণেও সষ্টি ছিলেন তিনি৷ মুকুন্দদাস ভারতের প্ৰতিটি ধ্ৰুবপদী
নৃত্যের সঙ্গেও সমানভাবে পরিচিত ছিলেন৷ তবে তার সৃজনশীল নৃত্যরচনার ভিত্ ছিল মনিপুরি
নৃত্য ও লোকনৃত্য৷ ১৯৪৬-১৯৬১ সাল অব্দি তিনি ভারতীয় গণনাট্য সংঘের হোলটাইমার
হিসেবে কাজ করেন৷ সেই হেতু বোধকরি তার প্ৰতিটি নৃত্যালেখ্য, নৃত্যনাটক
লোকসংস্কৃতির অসাম্প্ৰদায়িক, অমৌলবাদী ও মানবিক উত্তাপে সমৃদ্ধ এবং এতে ঐতিহ্যের
ভাবনাও অতি রয়েছে৷
মুকুন্দদাসের
বিস্তর নৃত্যরূপায়ণের ক্ষেত্ৰকে চারটি স্তরে ভাগ করা যায়৷ এক, লোকনৃত্য; দুই,
রবীন্দ্ৰনৃত্য; তিন, সৃজনশীল নৃত্য এবং চার, নৃত্যালেখ্য ও নৃত্যনাটক বা নাটিকা৷
রবীন্দ্ৰনৃত্যকে সৃজনশীল নৃত্য হিসেবে সচরাচর ধ্বা হয়ে থাকে৷
রবীন্দ্ৰনৃত্য
তার নিজস্ব এক চেহারা পেয়েছে এবং সেই চেহারার প্ৰেক্ষিতে একে শাস্ত্ৰীয়নৃত্য
হিসেবে গণ্য করা যায় কি নাবিষয়টি মুকুন্দদাসকে বিস্তর সংশয়ে ফেলেছিল৷
রবীন্দ্ৰসংগীত-বিযুক্ত রবীন্দ্ৰনৃত্য পরিবেশনেও রাবীন্দ্ৰিক পরিচয় অক্ষুণ্ণ থাকে৷
পোশাক, করণ ও অঙ্গহার, মুদ্ৰা, আঙ্গিক-অভিনয় ইত্যাদির সময়েও ফুটে ওঠে
রবীন্দ্ৰনৃত্যের রূপ৷ সুতরাং বিষয়টি বিশেষ ভাবনা দাবি করে৷ মুকুন্দদাস ও দিল্লির
নামী সংস্কৃতিশিপ্লী বাল্মিকী বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে এ বিষয়ে সংলাপ ও চিঠি বিনিময়
প্ৰণিধানযোগ্য৷
বিশেষ
ভাবনা-চিন্তার পর মুকুন্দদাস তার লিখিত বয়ানে বলে গেছেন রবীন্দ্ৰনৃত্যে যেহেতু
নানা পরিবৰ্তন আনা যায়, ফ্লেক্সিবিলিটি বেশি এবং তা বিশেষ কোন লোকনৃত্যকে ভিত্
করে গড়ে ওঠেনি, যা অন্যান্য শাস্ত্ৰীয় নৃত্যের ব্যাপারে ঘটেছে, সেইহেতু
রবীন্দ্ৰনৃত্যকে শাস্ত্ৰীয় নৃত্য আখ্যা দেওয়া সমীচীন হবেনা৷ বলা বাহুল্য,
রবীন্দ্ৰনৃত্য মুকুন্দদাসের জীবনে অন্যতম এক উজ্জ্বল অধ্যায়৷ সুতরাং, তার রূপায়িত
রবীন্দ্ৰনৃত্য সম্পৰ্কে পৃথকভাবে আলোচনা করা আবশ্যক বলে মনে করি৷
লোকনৃত্য
: ও লুপ্তপ্ৰায় লোকনৃত্য এবং লোকনৃত্যের নানা উপাদানের সন্ধান, সংগ্ৰহ ও উদ্ধার
মুকুন্দদাসকে বিরল সানের আসনে বসিয়েছে৷ আর কোন কিছুতেই না হোক, তিনি বেঁচে থাকতে
পারেন এই লোকনৃত্যের জন্যে৷ বোধ করি এমন কোন বিশেষজ্ঞ নেই যিনি লোকনৃত্যের আঙিনায়
মুকুন্দদাসের সমান্তরালে বসাতে পারেন আর কাউকে৷
মুকুন্দদাসের
লোকনৃত্য সংগ্ৰহ, যথাৰ্থ স্বীকৃতি প্ৰদান, লোকসমক্ষে উপস্থাপন করা ইত্যাদি একটি
জাতির অস্তিত্ব বেঁচে থাকার সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ কারণ লোকনৃত্য সেই জাতিগোষ্ঠীকে একই
মঞ্চে নিয়ে আসতে সাহায্য করে৷ মুকুন্দদাসের ভাষায়‘লোকনৃত্যের প্ৰধান আদৰ্শ হল
বিবিধ্বে মধ্যে ঐক্য স্থাপন করা৷ সবাইকে একসূত্ৰে গেঁথে নিয়ে একটা সুন্দর সরল সংহত
কৰ্মবহুল সমাজ গঠন করা৷’
তিনি
আবার বলেছেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে সারা ভারতবৰ্ষের অঞ্চলের ১০-১২টি লোকনৃত্য
পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি৷ এই সবগুলোই দীৰ্ঘদিন সমাজে জনপ্ৰিয় ও প্ৰচলিত ছিল৷
শুরু
করা যাক ৰ্তার বরাক ও সুরমা উপত্যকার লোকনৃত্য পুনদ্ধার ও সংগ্ৰহ সম্পৰ্কে৷ তিনি
এই অঞ্চলের বাঙালিদের এ সবগুলি লেকনৃত্য এবং তৎসহ লোকনৃত্যের নানা উপাদান
সন্নিবিষ্ট করে সৃষ্টি করেন ‘তবু রঙ্গে ভরা’৷ এই নৃত্যলেখ্যটি এই অঞ্চলের
নৃত্যগাথার এক জীবন্ত সংগ্ৰহশালা (লিভিং আৰ্কাইভ) বলা যেতে পারে৷ এই নাচগুলির
সঙ্গে ওতপ্ৰোত জড়িত গ্ৰামীণ সংস্কার, পরম্পরাগত আচার-আচরণ ও অনুষ্ঠান৷ এই
নৃত্যালেখ্যের মাধ্যমে সিলেটিদের মূল সংস্কৃতি কী, কিসের উপর দাঁড়িয়ে আছে এই
বাঙালি জনগোষ্ঠী এর এক সম্যক পরিচয় পাওয়া যায়৷ এতে এ অঞ্চলের ইসলাম ধৰ্মাবলম্বী
বাঙালিরাও, আংশিক হোক, বাদ পড়েন না৷ বউনাচ, জারি নাচ, চরকের নাচ, ওঝা নাচ, ছাদ
পেটার নাচ, নৌকা বাইচের নাচ, ধামাইলএইনাচগুলো এই আলেখ্যের এক একটা স্তম্ভ বলে ধরে
নেওয়া যায়৷
এই
নৃত্যালেখ্যটি ‘কাছাড়ের বারো মাসি’ নামে ১৯৬১ সালে শিলচর গভৰ্নমেন্ট বয়েজ স্কুলে
প্ৰথম মঞ্চস্থ হয়৷ সেই থেকে দেশের নানা স্থানে সৰ্বমোট পঞ্চাশবার এটি অনুষ্ঠিত হয়৷
ক্রমে ক্রমে এটির পরিবৰ্তন ও পরিবৰ্ধনও করা হয়; নামও পালটায়৷ পরবৰ্তীতে এর নামকরণ
করা হয় ‘তেরপাৰ্বণ’, ‘হাটে ঘাটে মাঠে’ এবং সৰ্বশেষে এ অঞ্চলের বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ ও
সংগীতশিপ্লী শ্যামাপদ ভট্টাচাৰ্যের নামকরণ ‘তবু রঙ্গে ভরা’য় স্থিত হল৷ মুকুন্দদাস
এটি সৰ্বশেষ উপস্থাপন করেন ৪ মাৰ্চ ২০০৭ সালে কলকাতার রবীন্দ্ৰসদন মঞ্চে
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের আমন্ত্ৰণে৷ এর প্ৰায় চার মাস পর তার
মৃত্যু হয় ২০০৭এর ৬ আগস্ট)৷ উপরে উক্ত নাচগুলি ছাড়াও ‘তবু রঙ্গে ভরা’য় রয়েছে ঠাটের
নাচ, নৌকা বাইচের নাচ, বরুণব্ৰত নাচ, ছাদ পেটার গান, রাখালের আই৷ এ সমস্ত নাচ-গান
এ অঞ্চলের অবলুপ্ত পটুয়া বৰ্ণনকে কেন্দ্ৰ করে হয়েছে৷ পটুয়ার পটকথা বৰ্ণন নানাভাবে
বাংলার নানা জায়গায় প্ৰচলিত ছিল৷ মুকুন্দদাস এ অঞ্চলের পটুয়ার বৰ্ণনে যে বৈচিত্ৰ্য
পান, সেটা হল পটুয়ার মুখে বৰ্ণনা চলাকালীন শরীরী ভঙ্গিমা; এতে ফুটে ওঠে শিপ্লিত
রূপ৷ অন্যান্য অঞ্চলে পটুয়ারা বসে পটের চিত্ৰ বৰ্ণনা করত, কিন্তু এ অঞ্চলের
পটুয়ারা এ কাজটি করত চিত্ৰ প্ৰাসঙ্গিকতা বজায় রেখে৷ সমাজ সংস্কার ও লোক শিক্ষায়
পটুয়ার অবদান অনস্বীকাৰ্য৷
‘মুঝে
জীনে দো’-খ্যাত চলচ্চিত্ৰকার মণি ভট্টাচাৰ্যের কিঞ্চিত অবদান রয়েছে এই আলেখ্যের
পরিবৰ্তন-পরিবৰ্ধন ও মঞ্চরূপায়ণে৷ নৃত্যগুরুর অনুজভ্ৰাতা অনন্তকুমার ভট্টাচাৰ্যের
সংগৃহীত কয়েকটি গান এই আলেখ্যে সংযুক্ত করা হয়৷
‘তবু
রঙ্গে ভরা’ নিশ্চিত এক বিশদ গবেষণার বিষয়৷ মুকুন্দদাস স্বয়ং পটুয়ার অভিনয় করতেন
কারণ
এটি হচ্ছে ভিত, শিরদাঁড়া, মাথাযাই বলুন৷ প্ৰথম প্ৰথম তিনি ধুতি পরে এটি করতেন,
পরবৰ্তীতে মুসলমান বেশে করতেন৷ হয়তো হিন্দু-মুসলমান সময়ের কথা মাথায় রেখে এ কাজটি
করতেন৷ বাস্তবে এ অঞ্চলে পটুয়া বরাবরই ছিল হিন্দু৷ এই অঞ্চলের বারো মাসের নানা
পৰ্ব, অনুষ্ঠান এই নৃত্যালেখ্যে তুলে ধ্বা হয়েছে গ্ৰামীণ নৃত্য সহযোগে৷ হাজার
যন্ত্ৰণার মধ্যেও বিচিত্ৰ, উদ্দীপ্ত ও আনন্দময় আমাদের এ অঞ্চলের বাঙালি সমাজঅন্তত
মুকুন্দদাসের নিরিখে এটাই ধ্বা পড়েছে এই নৃত্যালেখ্যে৷
মুকুন্দদাস
তার ‘পরিক্রমা’ নামক নৃত্যালেখ্যে অন্তৰ্ভুক্ত করেন তার উদ্ধারকৃত ভারতের অন্যান্য
অঞ্চলের নৃত্য৷ ‘পরিক্রমা’ও বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে সমাজে বিলুপ্ত ও
বিলুপ্ত-প্ৰায় নৃত্যগুলি৷ মুকুন্দদাস বরাক-সুরমা সমেত অন্যান্য অঞ্চলের তাঁর
উদ্ধারকৃত নৃত্যগুলি তাঁর সৃষ্ট লক্ষৌ-এর ভাতখণ্ডে সংগীত বিদ্যাপীঠের সিলেবাসে
অন্তৰ্ভুক্ত করেন৷ প্ৰসঙ্গত উল্লেখ্য, মুকুন্দদাসই সৰ্বপ্ৰথমে ভারতের নানা অঞ্চলের
লোকনৃত্য অন্তৰ্ভুক্ত করে বিজ্ঞানসত একটি পাঠক্রম গড়ে তোলেন৷ যতটুকু জানা যায়, এর
পূৰ্বে কেউ লোকনৃত্যের কোন সিলেবাস তৈরি করেননি৷
মুকুন্দদাসকে
নৃত্য সংগ্ৰহ করতে গিয়ে কোন কোন সময় জীবনের ঝুঁকিও নিতে হয়েছে৷ বিশেষ করে রাই ও
শেইরা নৃত্য দুটির পুনরুদ্ধারের প্ৰক্রিয়া বিশেষ রোমাঞ্চকর৷ উত্তর প্ৰদেশের
অন্তৰ্গত বুন্দেলখণ্ডে সেই সময় কুখ্যাত দুবৃত্তদের বসবাস ছিল৷ তিনি ওই অঞ্চলে
ঘোরাফেরা করে এদের কাছ থেকে পুরুষ নৃত্য শেইরা শেখেন৷ রাই নৃত্যটি তোলেন তিনি লীলা
বেরনির কাছ থেকে৷ পরবৰ্তীতে লীলা বেরনি তাঁরই অনুপ্ৰেরণা ও সাহায্যে রাই নৃত্যের পুরোধা
শিপ্লীরূপে প্ৰতিষ্ঠিত হন, সরকারি সাহায্য ও বিশেষ দু-একটি পুরস্কারও লাভ করেন৷
শেইরা নৃত্য করেন এমন দুবৃত্তের জীবনও শুধরে যায়৷ এদের কেউ কেউ আবার দুবৃত্তের কাজ
ছেড়ে দিয়ে সংগীতকে পেশা করে নেয়৷ সঙ্গত কারণে বরাক-সুরমা অঞ্চলের তিনটি
শীৰ্ষস্থানীয় নৃত্য সম্পৰ্কে অপ্ল-বিস্তর আলোচনা করে লোকনৃত্যের পৰ্যায় শেষ করছি৷
এই তিনটি নৃত্য হলওঝা নৃত্য, বধূ নৃত্য ও ধামাইল৷
ওঝা
নৃত্য : মুকুন্দদাস বরাক-সুরমা উপত্যকার ওঝা নৃত্যে শাস্ত্ৰীয় নৃত্যের উপাদান
খুঁজে পান৷ তিনি তাই নৃত্যটিকে শাস্ত্ৰীয় নৃত্যে উন্নীত করতে সচেষ্ট ছিলেন৷ গুরমির
প্ৰচলন আজ গ্ৰাম-গঞ্জে নেই বললেই চলে৷ কারণ গুরমি বা প্ৰচলিত মুখের ভাষায় আমরা
যাকে বলি হিজরা, হিজরাদের এই নাচ৷ এ অঞ্চলের হিজরারা এই নাচটি করত কারণ তারা এই
নাচের অধিকারী ছিল৷ প্ৰায় প্ৰতিটি উন্নতমানের নাচের উৎপত্তি অবশ্য সমাজচ্যুত ও
অবহেলিত সম্প্ৰদায়ের মধ্যে হয়েছেসে কত্থকই হোক, ভারত নাট্যম, কুচিপুরি যা-ই বলুন৷
ব্যতিক্রমও রয়েছে, যেমন মণিপুরি নৃত্য৷
আমাদের
সাধারণ চোখে ওঝানৃত্য, যা হয়ত কেউ কেউ গ্ৰামে দেখে থাকবেন, মনসাপূজার সময় এ নৃত্য
করা হয়, তেমন ভাললাগার হয়ে ওঠে না৷ তার একটি কারণযিনি নৃত্য করছেন, দেখা যেতে পারে
তার পায়ের গোড়ালি ফাটা, অবিন্যস্ত তাঁর সাদা আলখাল্লা অৰ্থাৎ ওঝা নৃত্যের
স্বাভাবিক পোশাক৷ নৃত্যশিপ্লীর চেহারাও আকৰ্ষণ করার মত নয়৷ এর সঙ্গে যোগ দিয়েছে
গ্ৰাম্য উচ্চারণে অমাৰ্জিত কণ্ঠে সংগীত পরিবেশন যা শহুরে বাবুদের কৰ্ণগোচরে
শ্ৰুতিকটু হয়ে ওঠে৷
এখানটায়ই
বোধ করি মুকুন্দদাসের কৃতিত্ব৷ তিনি শুধু এ নাচটি সংগ্ৰহ করেননি, এটিকে তিনি
আকৰ্ষণীয় করে তুলেছেন তাঁর প্ৰধান বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে৷ পোষাকে এনেছেন সামান্য
পরিবৰ্তন৷ আলতো গোলাপি আভার পোষাক পরিয়ে দেখেছেন; এর মধ্যে জড়ির কাজ জুড়ে দিয়েছেন৷
ওঝা নৃত্যের মূল সাদা পোশাকেও জড়ির সংযুক্ত করেছেন৷
মুকুন্দদাসের
ইচ্ছে ছিল ওঝানৃত্য ১০০-২০০ ছেলে-মেয়েদের দিয়ে তিনি করাবেন৷ দিল্লিতে প্ৰজাতন্ত্ৰ
দিবসে এটি করানোর আকাঙক্ষা তাঁর ছিল৷ (এ বিষয়ে ‘নৃত্যগু মুকুন্দদাস ভট্টাচাৰ্য,
বাঙালিত্ব, সত্তা ও স্বীকৃতি’ দ্ৰষ্টব্য৷ সাময়িক প্ৰসঙ্গ, আগ ১৯, ২০০৭
ধামাইল
: ‘বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’ সঞ্জীবচন্দ্ৰ চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত এই
উক্তি সব ক্ষেত্ৰে হয়ে গ্ৰহণীয় হয়ে ওঠে না৷ বনে নানান ফুল অবিন্যস্ত অবস্থানে গাছে
পড়ে থাকে৷ অবিন্যস্ত কেন? আমরা নগর সভ্যতার লোক, আমাদের জানা সৌন্দৰ্যের শৃঙ্খলায়
ফুলের অবস্থান দেখতে পাই না বলে৷ এই ফুল গাছ আমরা ঘরে এনে যখন রোপন করি তখন আমাদের
মনের জ্যামিতিক শৃঙ্খলায় তা করি৷ যে কোন গাছ-গাছড়ার ব্যাপারেও এরকম৷ ফুলদানিতে ফুল
সাজানোর ব্যাপারও আমরা আমাদের নন্দন চেতনার নিরিখে করে থাকি৷ এত কথা বললাম এই
কারণে যে, গ্ৰামে ধামাইল যারা করেনএক, তাদের পোশাক অতি সাধারণ এবং অধিক পরিধানে
এতে দীনদশা এসে যায়৷ এটির কারণ মনে করি রুচির চেয়েও দারিদ্ৰ৷ দুই, যৌথ নৃত্যে
সমানুপাতিকতা বজায় থাকতে হয়; কিন্তু এখানে তা থাকছে না, যে কেউ এতে যোগ দিতে
পারছেন৷ এতে যোগ দিতে সুন্দর অসুন্দর নারীর বালাই নেই৷ তিন, যার কণ্ঠে সুর নেই
তিনিও গীত করছেন এবং কারো গলা সাধা থাকে না৷ আসলে গীত গাওয়া নিয়ে কোন প্ৰশিক্ষণও
তারা পান না৷ ধামাইল নৃত্য মঞ্চস্থ করতে গেলে এদিকগুলো দেখে নেওয়ার রয়েছে এবং তা
পাঠ্যক্রমে অন্তৰ্ভুক্ত করা চাই৷ মুকুন্দদাস শোধন করলেন নৃত্যটি; নিপুণ রচনাবৰ্তের
পরম্পরা রক্ষা করে সৃষ্টি করলেন তাঁর উপলব্ধির রূপময়তা৷ গীতে আনলেন সুর, সংগীত ও
সমতানের রসরঞ্জনা৷
বাঙালির
কোন জাতীয় নৃত্য নেই৷ এই দৃষ্টিকোণ থেকে ধামাইল বাঙালির জাতীয় নৃত্য হয়ে উঠতে পারে
কি না এনিয়ে মুকুন্দদাস ভাবনা চিন্তা করেন
(দৈনিক যুগশঙ্খ, শিলচর ১৭ আগস্ট, ২০০৭, ‘বাঙালির সমবেত জাতীয় নৃত্যের সন্ধানে এক
অক্লান্ত রানার’)
বৌনাচ
: এই নৃত্যের পুরস্পরাগত আনুষ্ঠানিক প্ৰচলন আজ আর নেই বললেই চলে৷ এর কারণ এ অঞ্চলে এখন আর কম বয়সি
অথাৎ ঋতুমতি হয়েছে মাত্ৰ এমন তরি বিয়ে হয় না৷ তা প্ৰায় ৬০৭০ বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে
গেছে৷ মুকুন্দদাস এই নৃত্য প্ৰথম বাঙালি-অবাঙালি মিশ্ৰ দৰ্শকের সমক্ষে তুলে ধরেন
১৯৫৩ সালের ৯ সেম্বের টিটাবরে অনুষ্ঠিত সৰ্বভারতীয় বুনিয়াদি শিক্ষা সলিনীতে৷ নাচটি
করেন রেবা নাথ৷ অনুষ্ঠানটি উপস্থাপন করে শিলচর সংগীত বিদ্যালয়৷ এর পরের বছর
নৃত্যগুরু এটি উপস্থাপন করেন নওগাঁ-এ সংগীত নাটক একাডেমির সলেনে ৫ মে, ১৯২৪ সালে৷
রেবা নাথকে দিয়েই এ নাচটি পরিবেশন করান তিনি৷ দৰ্শক আসনে বসা নৃত্যলোকের রাজপুত্ৰ
উদয়শঙ্কর৷ তিনি এই নৃত্য দেখে অভিভূত হন এবং শিলচর সংগীত বিদ্যালয়ের রিমাৰ্ক বই-এ
তিনি তার উজ্জ্বল মন্তব্য রেখে যান৷ উদয়শঙ্কর এই নাচটি মুকুন্দদাসের কাছ থেকে তুলে
নেন৷ আজ মুকুন্দদাসকৃত সংস্কৃত বধুনৃত্য মঞ্চস্থ হলে পাইশরীরী হয়ে ওঠা সংহত ছবি ও
স্থাপত্যের সুষমব্যঞ্জনা৷ সংগীত, নৃত্য ও ছন্দের বিশিষ্ট বিভঙ্গে অনন্য এক
রূপভাবনা৷ বাংলার রূপ ও লাবণ্য মনে হয় এই পল্লীবধূ-বালায় ফুটে ওঠে৷ বধূনৃত্যের এত লাবণ্যস্নিগ্ধ
ব্যঞ্জনা আর কোন লোকনৃত্যে দৃষ্ট হয় নাঅন্তত এই নিবন্ধকারের গোচরে আসেনি৷
সৃজনশীল
নৃত্য : সৃজনশীল নৃত্যের সম্ভারে বোধ করি প্ৰথমেই উল্লেখ করতে হয় রানার৷ জনমানসে
নৃত্যগুরু মুকুন্দদাস ভট্টাচাৰ্য ও রানার একাত্ম হয়ে আছে৷ কবি সুকান্ত
ভট্টাচাৰ্যের ‘রানার’ কবিতা অবলম্বনে এই নাচটি করতেন মুকুন্দদাস৷ কবিতাটিতে
সুরারোপ করেন সলিল চৌধুরী৷
গানটি
প্ৰথম যন্ত্ৰস্থ হয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে৷ আইপিটিএ-আন্দোলনের সঙ্গে
সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকার সময় মুকুন্দদাস এই নাচটি তোলেন কলকাতার শম্ভু ভট্টাচাৰ্যের
কাছ থেকে৷ তারপর ক্রমায়ে এতে তাঁর নিজস্বতা গড়ে তোলেন৷ ফুটে ওঠে সুকান্তের কবিতার
চিত্ৰকপ্ল দেহভঙ্গির হিল্লোলে, অঙ্গ সঞ্চালনে৷ দেহের বিচিত্ৰ বিভঙ্গে শিপ্লায়িত
করেন মুকুন্দদাস৷
রানারের
সরাসরি কোন প্ৰাসঙ্গিকতা আজ আছে কি? রানার বা ডাকহরকরার প্ৰচলন আজ নেই৷ যোগাযোগ
ব্যবস্থা নানাভাবে উন্নত হওয়ায় ডাকহরকরার প্ৰয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে৷ দুৰ্গম অঞ্চলে
ডাকহরকরা নিজের ও তার পরিবারের জীবন ধারণের প্ৰয়োজনে এ কাজটি করত৷ অনেক সময়
বিপদসংকুল অবস্থার মোকাবিলাও তাকে করতে হত৷ এতে তার প্ৰাণ যাবার সম্ভানা থাকত৷
মানুষের অৰ্থ বহন করতসে অথচ সে কাজ করত অতি অপ্ল অৰ্থের বিনিময়ে৷ মানুষের
সুখ-দুঃখের চিঠির বোঝা সে বহন করে নিতঅথচ তার সুখ-দুঃখের খবর থাকত আড়ালে৷ গানটির
এসমস্ত ভাব-অৰ্থ মুকুন্দদাস তার নৃত্যে এমনভাবে ফুটিয়ে তুলতেন যে এর ব্যঞ্জনা যে
কোনো শোষিত বঞ্চিত মানুষের বঞ্চনার প্ৰতীক হয়ে দাঁড়াত৷ প্ৰায় এক হাজার বার
মুকুন্দদাস তাঁর এই রানার নৃত্য প্ৰদৰ্শন করে গেছেন৷ এর কয়েকটি ভিডিও ও সিডি
সংগৃহীত রয়েছে৷
মুকুন্দদাস
নানা ধ্বনের অজস্ৰ গানে নৃত্যরূপ দিয়েছেন৷ তার সৃজন নৃত্যে তিনি নৃত্য
নন্দনতত্ত্বকে কখনও বোধ করি তাঁর সমাজ তত্ত্ব থেকে বিযুক্ত করেননি৷ তার সৃজনশীল
নৃত্যের সকল ধারায় পাই লোকনৃত্য৷ এতে করে জনমানসে স্থিত পরম্পরায় পাওয়া কপ্লচিত্ৰ
মুকুন্দদাসের কপ্লনার ভাস্কৰ্যে বিচ্ছুরিত হয়েছে প্ৰতিটি নৃত্য সৃজনীতে৷ এতে
নাচগুলি হয়েছে সরলজীবন্ত ও জীবনীশক্তির প্ৰাচুৰ্যে দীপ্ত৷ তাঁর ছিল ইতিবাচক
দৃষ্টি৷ ব্যথাবেদনার মুৰ্ছনা তার শিয়ে শিপ্লিত হত ন্যুব্জতায় নয়অন্য ব্যঞ্জনায়৷
আলোর প্ৰয়োজনে একটু আধটু আঁধারের প্ৰয়োজনএভাবেই প্ৰোথিত ব্যথা-শোক তাঁর নৃত্যে৷
রবীন্দ্ৰনৃত্য
: মুকুন্দদাস রবিঠাকুরের শতাধিক গানের চেহারা ফুটিয়ে উঠিয়েছেন৷ রবীন্দ্ৰনৃত্য
সৃজনে প্ৰায় প্ৰতি বাঁকে লোকনৃত্যের দেহভঙ্গির সুষম সৌন্দৰ্য প্ৰস্ফুটিত হয়ে
রয়েছে, বোধ করি, এ-ই তার রবীন্দ্ৰ নৃত্যশৈলীর প্ৰধান বৈশিষ্ট৷ এ ছাড়া মণিপুরি
নৃত্যের ছাপও তার নৃত্যরূপায়ণে ফুটে ওঠে৷ ‘মণিপুরী নৃত্যের সহজ সাবলীল ছন্দ,
স্বচ্ছ বিন্যাস ও মনোরম মৃদু ললিত সৌন্দৰ্যের সঙ্গে কবিকপ্লনার একাত্মতাই এর কারণ৷
কথক নৃত্যপদ্ধতি শান্তিনিকেতনে তার স্কুল আঙ্গিক সৰ্বস্বতার জন্য বিশেষ সমাদৃত
হয়নি৷ কবিগুরু নৃত্য প্ৰযোজনা কালে সৌন্দৰ্যরসের উদ্বোধন সম্পৰ্কে বিশেষ সতৰ্কতা
অবলম্বন করতেন বলে অনেকক্ষেত্ৰে শাস্ত্ৰীয় নৃত্যের বাহুল্য ও কলা-কৌশল বাদ দিতেন’৷
মণিপুরি
নৃত্যের প্ৰতি বিশেষ আকৰ্ষণের বশবৰ্তী হয়ে রবীন্দ্ৰনাথ এ অঞ্চল থেকে নিয়ে গেছেন
দুই তাবড় মণিপুরি নৃত্যশিপ্লীগুরু রাজকুমার সেনারিক সিংহ ও গুরু বিহারী সিংহ৷ এরা
দুজনই শিলচর শহরের অদূরে অবস্থিত সিংগারী বস্তির বাসিন্দা ছিলেন৷ প্ৰসঙ্গত
রাজকুমার সেনারিক সিংহ শান্তিনিকেতনের অধ্যাপনা থেকে অবসর নিয়ে শিলচর সংগীত
বিদ্যালয়ে মণিপুরি নৃত্য শেখানোর কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন৷ মুকুন্দদাস গুরু
রাজকুমার সেনারিক সিংহের কাছ থেকে মণিপুরি নৃত্য শেখেন৷
মণিপুরি
নৃত্যে স্বাভাবিক কারণে শ্ৰীচৈতন্যের ভাবধারা পরিস্ফুট হয়৷ বঙ্গভূমিতে বৈষব
আন্দোলনের প্ৰভাব অতি গভীরে৷ বাংলার সংস্কৃতি, সভ্যতা, বাংলার মেজাজ আপাত নরম ও
স্নিগ্ধ৷ শ্ৰীচৈতন্যের বৈষবধৰ্মের জন্ম বাংলার নরম মাটি, অজস্ৰ নদী-খাল-বিল-দীঘি
শ্যামলিমার পূৰ্ণ আবহে সৃষ্ট হয়েছিল৷ এই আবহের সঙ্গে যুক্ত প্ৰতিটি বাঙালি৷
রবীন্দ্ৰনাথও এর বাইরে নন৷ মণিপুরি নৃত্যের বৰ্তমানরূপ বাংলার শ্ৰীগৌরাঙ্গসৃষ্ট
বৈষবধৰ্ম অবলম্বনে৷ প্ৰতিটি নৃত্য রাধা-কৃষে সমৰ্পিত৷ আর সেই সম্পৰ্কটা হবে
প্ৰেমাশ্ৰিত৷ সে প্ৰেম জৈবিক হোক অথবা আত্মিক বা আধ্যাত্মিক৷ ‘প্ৰেম’ কঠিন হতে
পারে কি? ‘প্ৰেম’ স্বভাবত স্নিগ্ধ৷ ‘প্ৰেম’ দেহাভঙ্গে প্ৰকাশ পায় লীলায়িত রূপে৷ এ
সমস্ত কারণে, মুকুন্দদাস তার রবীন্দ্ৰনৃত্য রূপায়ণে, নৃত্যাঙ্গিক প্ৰয়োগ করেন৷
এককথায়, রবীন্দ্ৰমনন ধরে রেখেছেন তাঁর নৃত্য রচনায়৷ আজকাল প্ৰায়ই দেখা যায় এই মনন
রবীন্দ্ৰনৃত্য রচনায় আংশিক প্ৰয়োগ করা রবীন্দ্ৰধারা থেকে বিচ্যুত হয়
রবীন্দ্ৰনৃত্য৷ অনেক সাজ-পোশাকও রাবীন্দ্ৰিক হয় না৷ মুকুন্দদাসের এই আধুনিক
বিপৰ্যয়ে আক্ষেপ ছিল৷
মুুকুন্দদাস
রবীন্দ্ৰনৃত্য সৃজনে বা রাবীন্দ্ৰিক বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে এতে এনে দিয়েছেন এক
টান-টান ভাব, অৰ্থাৎ বিগলিত করুণা’র মত তার সৃষ্ট রবীন্দ্ৰনৃত্য নয়৷ একজন পুরুষও
যদি তার সৃষ্ট রবীন্দ্ৰনৃত্য করেন তাহলে তার ‘পুরুষ’ শব্দে এতোটুকুও খামতি থাকে
না৷ অথচ দেখা যায় স্ত্ৰী-পুরুষ নিৰ্বিশেষে রবীন্দ্ৰনৃত্য সচরাচর হয়ে ওঠে অবলা
নারীর মূৰ্ত প্ৰতীকের মত৷ এই সৰ্বস্ব বিগলিত ভাবের, অতি বিনয়ের৷ বৈপরীত্বে ছিলেন
মুকুন্দদাস৷
মুকুন্দদাস
আঙ্গিক অভিনয়েও জোর দেন৷ শুধুমাত্ৰ সঠিক মুদ্ৰা, অঙ্গ সঞ্চালনা, ভঙ্গিমাতে আবদ্ধ
থাকতেন না৷ তিনিসাৰ্বিক প্ৰাণ প্ৰকাশে, আকৰ্ষণ ও দৃশ্যনন্দন করে তোলার জন্য শরীরী
ছন্দে ‘রসনিষ্পত্তি’রও সংযুক্তি রয়েছে৷ তাঁর রচিত রবীন্দ্ৰনৃত্যে৷ এ ক্ষেত্ৰে আমরা
পাই বরাক-সুরমার লোকনৃত্যের ছটা৷ এইভাবে রবীন্দ্ৰনৃত্যেও তিনি এক স্বতন্ত্ৰ ঘরানা
তৈরি করে ফেলেছেন বলা যায়৷ এখন তা গবেষণাসাপেক্ষ৷
নৃত্যালেখ্য
: মুকুন্দদাসের ‘তবু রঙ্গে ভরা’ সম্পৰ্কে পূৰ্বেই আলোচনা করা গেছে৷ ভারতের নানা
লোকনৃত্য সম্বলিত নৃত্যালেখ্য পরিক্রমাও মুকুন্দদাসের আর এক মাইলস্টোন৷ হাসিনা
বিবির কথা, অরুণ বরুণ কিরণমালা, সিংহ আউর শশক (হিন্দি), পানৈর পনা খান (অসমিয়া),
কলস্টু ড্ৰাম, ব্ৰহ্মপুত্ৰ এ্যাটোমিক এ্যনাব্জি ফর পিস্, শ্ৰমসংগীত-ছন্দ, সুর ও
ছন্দ পাক-মাৰ্কিন মিলিটারি এলায়েন্স, মহুয়া ইত্যাদি বেলে তার সৃষ্ট৷
রবীন্দ্ৰনাথের
প্ৰায় প্ৰতিটি নৃত্যনাট্যকে তিনি নৃত্যরূপ দিয়েছেন৷ মঞ্চ রূপায়ণেও তিন ছিলেন
সিদ্ধহস্ত৷ এ সমস্ত নৃত্যালেখ্য ও
নৃত্যনাটকে তিনি নৃত্য নিৰ্দেশ দিয়েই থেমে থাকেননি, সামগ্ৰিক উপস্থাপনেও তাঁর
কৃতিত্ব রয়েছে৷
রবীন্দ্ৰ
নৃত্যনাট্যে মুকুন্দদাস রবীন্দ্ৰধারা অনুসরণ করে গেলেও যেহেতু রবিঠাকুর সৃজনশীলতায়
স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন কয়েকটি শৰ্তে, যে শৰ্তগুলি মেনে চললে আমরা একে রাবীন্দ্ৰিক
বলি, লোক আঙ্গিকও তিনি তাতে অতি করেছেন৷ আজো তাঁর সৃষ্ট রবিঠাকুর রচিত চণ্ডালিকা,
রক্তকরবী, শ্যামা, তাসের দেশ, চিত্ৰাঙ্গদা, বাল্মিকী প্ৰতিভা, নটির পূজা ইত্যাদি
শুধু দৰ্শক নয় বিশিষ্ট সমালোচকদেরও প্ৰশংসা কুড়োয়৷
উল্লেখ্য
যে, মুকুন্দদাস কখনও ব্যক্তিগত দক্ষতা প্ৰদৰ্শনের আতিশয্য করে যাননি তাঁর করা
নৃত্যালেখ্য ও নৃত্যনাটকে এবং এই দোষে তিনি দুষ্ট নন তাঁর অন্যান্য একক বা
সমষ্টিগত নৃত্যরূপেও৷ তিনি নিশ্চিত বিশ্বাস করতেন রবীন্দ্ৰনাথের এই উক্তিতে ‘এক রকমের
গায়ে পড়া সৌন্দৰ্য আছে যা ইন্দ্ৰিয়তৃপ্তির সঙ্গে যোগ দিয়ে অতি লালিত্যগুণে সহজে
আমাদের মন ভোলায়৷ চোর যেমন দ্বারীকে ঘুষ দিয়ে চুরি করতে ঘরে ঢোকে৷ সেই জন্যে যে
আৰ্ট আভিজাত্যের গৌরব করে সে আৰ্ট এই সৌন্দৰ্যকে আমল দিতেই চায় না৷
কোন
রচনার মৰ্মকথাকে উপেক্ষা করে চোখ ধাঁধানো দৃশ্য, মনমাতানো নৃত্যভঙ্গিমা, ভেতর না
বুঝে শুধুমাত্ৰ বাহিরিয়ানার প্ৰদৰ্শন মুকুন্দদাসের সৃষ্টিতে মেলে না৷
শেষ
টানতে একথা বলতেই হয়, নৃত্যগুরু মুকুন্দদাস ভট্টাচাৰ্যের সংস্কৃতি-নৃত্য জীবনের
বিশাল অবয়ব নিয়ে আলোচনা একটি সাময়িকের কয়েকটি পৃষ্ঠায় ধরে রাখা দুষ্কর এবং এই
নিবন্ধকারের পক্ষে দুঃসাধ্যওএ বিনয় নয়, বাস্তব৷ সুতরাং এখানে এই বিশাল শিপ্লীর
রূপরেখা রচনার প্ৰয়াস মাত্ৰ করা গেল৷
অনামি
শিল্পী
সমর
বিজয় চক্রবৰ্তী
শাস্ত্ৰীয়
সঙ্গীত অথবা যে কোন পরিশ্ৰুত সঙ্গীত একদিনে পরিস্ৰুত হয়ে ওঠেনি৷ শূন্য থেকে সৃষ্টি
হয়নি৷ এসবের মূল পোঁতা লোকসঙ্গীতে৷ মানুষ তাতে তাঁর ইচ্ছেমতো ‘উৎকৰ্ষ’ রূপ দিয়ে
চলেছে৷ কালে কালে পাছে রূপ-রস-রঙ৷ বনে কত ফুল ফোটে৷ আমাদের মত করে আমাদের শৃঙ্খলিত
চোখে বনের ফুলকে আমরা সাজাই আমাদের বাগানে৷ অথবা বলা যায় আমরা বিন্যস্ত করি বনের
ফুল বাগানে আমাদের মত করে৷ ‘সভ্য’ মানুষের শৃঙ্খলাবোধ্বে সঙ্গে প্ৰকৃতির শৃঙ্খলায়
ফারাক প্ৰায়ই বিস্তর৷
মানুষ
পরিমাৰ্জন করে, উৎকৰ্ষ সাধন করে প্ৰকৃতিজাত উৎপাদন তার নিজের মতো করে গড়ে তোলে৷
কিন্তু কে বলবে এটা ঠিক আর ওটা বেঠিক৷ বোঝার মাপকাঠি কী৷ সংশুদ্ধির কি শেষ আছে?
‘শেষ নাই যার শেষ কথা কে বলিবে?’
হয়তো
মানুষকেই ন্যস্ত করেছে প্ৰকৃতি, প্ৰকৃতিকে খেয়াল খুশি মত পা েনিজের ইচ্ছেমতো
ব্যবহার করতে৷ দৈহিক ও নান্দনিক তৃপ্তি সাধনে মানুষ আজও অনিবার ব্যস্ত৷
ছোটবেলা
গ্ৰামের বাড়িতে শুনতাম প্ৰভাতি৷ শীতকালে গাওয়া হতো৷ সম্ভবত কাৰ্তিক মাসে৷ প্ৰায়ই
আমাদের ঘুম ভাঙতো প্ৰভাতি শুনে৷ গাইয়েদের বেশিরভাগই ওপার বাঙলার হবিগঞ্জের লোক৷
কৃষি ও মৎস্যজীবী৷ কিন্তু কী অপূৰ্ব সেই গায়ন৷ দলের মূল শিপ্লী, তাঁর নাম জানি না,
জানার প্ৰয়োজনও বোধ করিনি তখন, বিশেষ করে তাঁর গান আমার মনে গেঁথে আছে৷ এরকম কত
শিপ্লী না জানি মঞ্চের বাইরে গান গেয়ে চলেছেন, গণমাধ্যমের বাইরে তাঁদের অবস্থান,
এদের বেশিরভাগই থাকেন গ্ৰামে৷ কিছু শিপ্লী ঘষেমেজে মোটামুটি গলা ঠিক করতে পারেন,
মঞ্চে গান করেন, টিভিতে, রেডিওতে গান করেন কিন্তু জন্মসূত্ৰে পাওয়া গানের কণ্ঠ ও
প্ৰতিভা ঠিক ততটা নেই তাঁদের৷ যাঁরা বাইরে পড়ে রইলেন বিশেষ গুণীজন তাঁরা নিশ্চয়ই
জানেন না কিংবা প্ৰবৃত্তি নেই তাঁদের শিপ্ল বাজারজাত করার৷ তাঁরা সুযোগসন্ধানী নন
কিংবা পৃষ্ঠপোষকতা করার মত কারোর নজরেও পড়েননা৷ সাধারণ দৃষ্টিতে তাঁরা ভাগ্যবান
নন৷ আকবরের দরবারে না এলে হয়তো তানসেনকে আমরা জানতামই না৷ ওস্তাদ আলা উদ্দিন খাঁ
হয়তো সারাজীবন যাত্ৰাগানে সরোদ, এস্ৰাজ বাজিয়ে কিংবা নিজের গাঁয়ে নীরবে অনামি জীবন
কাটিয়ে যেতেন যদি তিনি মাহেরে রাজন্য সংসৰ্গে না আসতেন৷
সঙ্গীত
ছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্ৰেও এ ব্যাপারটা রয়েছে৷ বিংশ শতকের ভারতীয় কলাকৃতি জানতে
গেলে আজ আমাদের জানতে হবে রামকিঙ্করকেও৷ রবীন্দ্ৰনাথের নজরে না এলে রামকিঙ্কর বি
আজ কলাশিপ্লে নন্দিত হতে পারতেন? প্ৰেক্ষাপট রচনায় এসব অনুষঙ্গ নিয়ে আসতে হলো৷
১৯৮৬
সাল৷ বেশ ক’মাস বন্যায় গিলেছিলো এ উপত্যকা৷ আমি আমার মাসতুতো দিদিকে সঙ্গে করে
ডিমাপুর থেকে আসছিলাম৷ লামডিং থেকে কাছাড় এক্সপ্ৰেস ধ্বলাম৷ সে কি ভিড়, পা রাখার
জায়গা ছিল না, রিজাৰ্ভেশনের বালাইই নেই৷ কাতারে কাতারে মানুষ, সেই মানুষঢলে আমরাও
সামিল৷ দাঁড়ানো মানে দাঁড়ানো নয়, কোনরকম নিজকে ধরে রাখা৷ তবে ভাগ্য বেশিক্ষণ
অপ্ৰসন্ন ছিল না৷ আমার দিদির কোনক্রমে বসার জায়গা মিললো৷ বসার মত করে নয়, কোনক্রমে
ঠেকিয়ে রাখা৷ আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো প্ৰায় দেড়-দু ঘণ্টা, ঠায়৷ জানালার পাশে এক
ভদ্ৰলোক, ছিপছিপে লম্বাটে৷ উজ্জ্বলশ্যাম গায়ের রঙ৷ পাহাড়ি চোখমুখের আদল৷ তবে চোখ
ততটা পাহাড়ি নয়৷ বিবৰ্তনে চোখ যেন খুলেছে৷ তৃপ্তিমাখা মুখ তাঁর৷ ভদ্ৰলোককে দেখেই
ভাল লেগে গেল৷ এমনটা আমার হয়৷ কথা না বললেও কোন কোন মানুষ আমার কাছে আপন৷ এই
ভদ্ৰলোকও সেরকম৷ তিনি আমাকে ইশারা করে ডেকে নিয়ে তাঁর পাশে বসালেন৷ আমি হাঁফ
ছাড়লাম৷
পাহাড়িয়া
পথ বেয়ে এক্কা দুক্কা দোলনে রেলগাড়ি চলছে৷ এমনিতেই হিল সেকশনে রেলগাড়ি প্ৰতিটি
স্টেশনে থামে, এবং প্ৰায়ই থামে অনেকক্ষণ৷ দুই স্টেশনের মাঝখানেও কোথাও থেমে যায়৷
কিন্তু এ যাত্ৰায় থামাটা ঢের বেশি৷ যাত্ৰী ধৈৰ্যহারা৷ চেহারায় বিরক্তি ও ক্লান্তির
ছাপ৷ খাওয়া-দাওয়া কিংবা ন্যূনতম পরিচ্ছন্ন থাকার জো নেই৷ অনেক লোক এখনো দাঁড়িয়ে
অথবা বাক্স পেটরার উপর বসে৷ এই অভব্য ক্লান্তিকর পরিস্থিতিতে তারা, আবার তাদের
কতজনার বাড়িতে হয়তো জল ঢুকেছে৷ এই মরুভূমি সদৃশ যাত্ৰাতে সবাই উট৷ শুধু একজন
যাত্ৰী বেমালুম নিরস্ত৷ অনাবিষ্ট চোখমুখে দিব্যি হাসি৷ গাড়ি ছাড়লেই তাঁর মুখ থেকে
কি জানি আওয়াজ বেরোয়৷ আমার পাশেই বসা তিনি, অথচ মনে হলো অনেক দূরে৷ মুখ জানালার
দিকে ক’রে তিনি গান করছিলেন৷ ধরে ফেললাম৷ একবার গাড়ি থামলে জাপটে ধ্বলাম৷ দাদা,
আপনি গান করছেন? ভাল গান তো৷ একটুখানি অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিলাম তাঁকে৷ ঢোক গিলে
বললেন, আপনি বোঝেন অন্যরা শুনলে কি করবে? আমি বললাম আস্তে আস্তে কিছুই না- গান তো
গানই৷ বললেন, আমার বাড়িতে জল৷ ছেলেপিলেরা কোথায় গেছে কিছুই জানি না৷ আমি গৌহাটি
গেছিলাম কাজে৷ জানলাম তাঁর বাড়ি পাথারকান্দির ওদিকে৷
আমি
বললামপাথারকান্দি আমি চিনি, আমি গেছি৷ একবার নয়, বেশ ক’বার৷
আমি
তাঁর নাম ঠিকানা জানার জন্য তত আগ্ৰহী ছিলাম না৷ তাঁর নাম অবশ্য জেনে গেলাম গান
শোনা ও এক আধটু কথা বলার ফাকে৷ মনে হলো গানসৰ্বস্ব এই লোকটি৷ নাম ধামের ঊৰ্ধ্বে
তাঁর অবস্থান৷ তাঁর গান ভাল ক’রে শোনা চাই, সময় ভারি ঠেকবে না৷ আমার মনে কৌতূহল, এ
কী গান যে তাঁকে ভুলিয়ে রাখে দারা- পুত্ৰ-পরিবার? তিনি যেন সবার মধ্যে থেকেও নেই৷
পণ্ডিতজন হয়তো ‘স্থিতপ্ৰজ্ঞ’ অভিধা জুড়ে দিতেন তাঁর বেলা৷
মনে
হলো নিরোর কথা৷ রোম পুড়ছে, নিরো বাজিয়েই চলেছেন তাঁর লায়ার (একধ্বণের বেহালা)৷
টাইটানিকে দেখেছিলাম, টাইটানিক ডুবছে, তবে কয়েকজন বাদক বেহালায় সুর ঘষেই চলেছেন৷
ডুবে যাবেন৷ মৃত্যু হবে তাদের বরফজলে৷ মনে হলো ভ্ৰূক্ষেপ নেই৷ অন্তত দলকৰ্তাকে মোটেই
বিচলিত মনে হলো না৷
সঙ্গীত
কি এরকমই যা মৃত্যুকেও জয় করতে পারে? সমস্ত মায়াজাল ছেদ করে অন্য মায়ায় নিয়ে চলে৷
তা মায়া বলবো না অন্যকিছু এ বিষয়ের
পণ্ডিতজন জানেন ভাল৷
আমি
জানি বিশ্বজিৎবাবু অৰ্থাৎ বিশ্বজিৎ সিনহা ভাল গাইয়ে৷ কি রাগ গাইছিলেন? বললেন ‘মেঘ মল্লার’৷
বাপরে, ওদিকে বন্যা এদিকে মেঘমল্লার৷ কারণ? তিনি বললেন, গাড়ি চলার তালে তালে এটি
মানায় ভাল৷ তিনি সুবিধে করে দিলেন৷ যাতে করে আমি তাঁর গান শুনতে পারি৷ গোটাটা
রাস্তা তাঁর গান- শুনে এলাম৷ ক্লান্তি আমাকে ছুঁল না৷ বিরামবিহীন আনন্দের ঢেউ আমার
উপর উপচে পড়ল৷ অজস্ৰ ধারায় বৃষ্টি পড়লো,’ বাস্তবে নয়৷ আকাশ তবে সময় সময় মেঘলা
ছিলো৷
শুনেছি
তানসেন মেঘমল্লার গেয়ে নাকি আকবরের রাজ্যে খরা থেকে মানুষকে রক্ষা করেছিলেন৷
মেঘমল্লারের যাদুকথা অনেকবার শুনেছি৷ বিশ্বজিৎ এর গান বৃষ্টি ঝরালো না৷ বৃষ্টি
থেমে থাকলো আকাশে৷ মেঘে৷ এই পরিবেশই মনে হলো মেঘমল্লারের পরিবেশ৷ তাহলে বিশ্বজিৎই
কি এই পরিবেশ সৃষ্টি করলেন? মেঘকে বৃষ্টিতে রূপান্তরিত হতে দিলেন না? মেঘমল্লার- এ
এই সংজ্ঞাও জুড়ে দেওয়া যায় না কি? বিশ্বজিৎ বললেন, তিনি রোজই দু’তিন ঘণ্টা তাঁর
বাড়িতে তানপুরা সহযোগে গান করেন৷
গানে
গানে এলাম বদরপুর জংশন৷ কখন এসে পৌছালাম বুঝতেই পারলাম না৷ মনে হলো ট্ৰেন আরও
কতদূর এগোলে ভাল হত৷ দিদির দিকে তাকালাম৷ দিদি ক্লান্ত৷ যাত্ৰীদের সোরগোল
চেঁচামেচি৷ নেমে পড়ার হুড়মুড় অবস্থা৷ কমপাৰ্টমেন্ট প্ৰায় খালি হয়ে যাওয়ার পর
বিশ্বজিৎ উঠলেন৷ সেই অবিকল চেহারা৷ যাবেন কেমন করে? বললেন ঈশ্বর জানেন৷ তিনি
চালান, তিনিই চালাবেন৷ আমরাও নেমে পড়লাম তাঁরই সঙ্গে৷ ক্রমে চোখের আড়ালে চলে গেলেন
বিশ্বজিৎ৷ আমরা চললাম আমাদের পথে৷ প্লেটফৰ্মে মানুষের ঢেউ এ মিলিয়ে গেলেন তিনি৷
আমরা গেলাম অন্যপথে৷
কালিকা
প্ৰসাদ ভট্টাচাৰ্য সম্পৰ্কে দু-এক কথা
সমরবিজয়
চক্রবৰ্তী
কালিকা
কে? এ প্ৰ করাটা বোধ হয় বেখাপ্পা, কারণ তার নাম যে আমরা জানি৷ কিন্তু শুধুমাত্ৰ
তাঁর নাম জানলে তো হয় না, তিনি কী করে গেছেন যার জন্য তাঁর এতো নাম, এতো লোক তাঁকে
ভালোবাসে৷ বিশেষ করে বাংলাভাষী মানুষের কাছে তিনি সুপরিচিত, নয় কি? আমরা যারা ছোট,
আমরা যতোটুকু জানি তা হয়তো আবছা৷ যতদিন যাবে, আমরা আরও বড় হবো তখন তাকে আরো ভালো
করে জানতে পারবো৷ যাক শিলচরে তিনি প্ৰসাদ আর সৰ্বত্ৰ তিনি কালিকা নামে পরিচিত৷
কালিকা
একজন শিপ্লী৷ শিপ্লী বলে তিনি বিশেষ পরিচিত৷ তাঁর জন্ম হয় ১৯৭০ খ্ৰিস্টাব্দের ১১
সেম্বের, শিলচর সেন্ট্ৰাল রোডে কালীজয় ন্যায় পঞ্চাননের বাড়িতে এক একান্নবৰ্তী
পরিবারে৷ তাঁর বাবা রামচন্দ্ৰ ভট্টাচাৰ্য আর মা গীতাঞ্জলী৷ কালিকার একজন ছোট বোন
আছেন, নাম তাঁর ইন্দ্ৰানী৷ পরিবার এবং শিলচর সংগীত বিদ্যালয় তাকে সঙ্গীত শিক্ষা
দেয় এবং ক্রমে তিনি সঙ্গীতের বিশাল পরিসরে পরিচিত হতে লাগলেন, ঋদ্ধ হতে লাগলেন৷
তাঁর উপর তাঁর পিসি আনন্দময়ী ভট্টাচাৰ্য আর কাকা অনন্ত কুমার ভট্টাচাৰ্যের অবদান
যথেষ্ট৷ লোকগানে অনন্ত কুমার ভট্টাচাৰ্য, তাঁর ছোট কাকা, তাঁর মূল গুরু৷ তাঁর
ধনকাকু নৃত্যগুরু ড. মুকুন্দদাস ভট্টাচাৰ্যের প্ৰভাবও রয়েছে তার উপর, বিশেষ করে
নৃত্যের সঙ্গে লোকগানের সংযোগের পাঠ নেন কালিকা তার কাছে৷ কালিকাদের একান্নবৰ্তী
বাড়ির সকল সদস্যই কোনও না কোনও ভাবে সংগীতে জড়িত আর এ হেলাফেলায় জড়িত নয়, এক একজন
একেবারে ছুপারুস্তম৷
ভারতে
কলকাতাকে সংস্কৃতির পীঠস্থান বলা হয়৷ কালিকার ছোটকাকু অৰ্থাৎ অনন্ত কুমার
ভট্টাচাৰ্য তাঁকে বলতেনপ্ৰসাদ তুমি কলকাতায় গিয়ে আমাদের এ অঞ্চলের লোকগানের পরিচয়
করিয়ে দাও, নইলে এতো সমৃদ্ধ সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে পারে৷
অনন্ত
কুমার ভট্টাচাৰ্য জানতেন কলকাতার মানুষ শ্ৰীহট্ৰীয় সংগীতের অতি আংশিক পরিচিতি
পেয়েছেন নিৰ্মলেন্দু চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও অমর পালের মাধ্যমে৷ আসলে কালিকার
আগে এই অঞ্চলের লোকগান ও সংস্কৃতির বিপুল সম্ভারের বিন্দুমাত্ৰ খবর শুধু পৌছেছে
কলকাতায় তথা বৃহত্তর বাংলা ভূমণ্ডলে৷ কালিকা ধাপে ধাপে গোটা বিশ্বে বাংলাভাষীর
কাছে শ্ৰীহট্টীয় লোক-সংস্কৃতির সাৰ্বিক পরিচয় তুলে ধরেছিলেন, শুধু তাই নয়, বাংলা
লোকসঙ্গীত ও সংস্কৃতির উপস্থাপনের মাধ্যমে তিনি অবাঙালিদেরও আকৰ্ষণ করতে
পেরেছিলেন৷ ব্যাপারটা দিলের মেহেন্দীর মতোআমরা পাঞ্জাবী বুঝি না অথচ তাঁর গান
আমাদের ভালো লাগে৷ কালিকা এভাবেই ভারতীয় অবাঙালি ও ভারতের বাইরে ভিনভাষী মানুষের
কাছে বাংলা গান পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন৷
লোকসংগীত
এখন আর পল্লী সংগীত হয়ে রইল না, পল্লীর বাইরে নাগরিক জীবনের সঙ্গেও লোকসঙ্গীতের
সখ্য প্ৰায় হয়ে গেছে একতা করতে গিয়ে কালিকার অবদান অনস্বীকাৰ্য৷ ১৯৯৯-এর সাত
আগস্টের এক৷ অনুষ্ঠানে ‘দোহার’-এর জন্ম৷ কালিকার মৃত্যু হয় সাত মাৰ্চ ২০১৭-তে এক
পথ দুৰ্ঘটনায়৷ কিন্তু দোহার থেমে যায় নিদোহার সচল, শুধু সচল বললে পুরো বলা হলো না,
কালিকার মৃত্যুর পর এবং এই দুৰ্ঘটনায় দোহারের সব চাইতে ছোটো সদস্যের গুরুতর আহত
হওয়ার পর খানিক সময় লেগেছে প্ৰায় মাস
দু’একের মধ্যেই দোহার ক্রমে পূৰ্ণ উদ্যমে অনুষ্ঠান করে চলেছে৷ ইতিমধ্যে দোহার
যুক্তরাষ্ট্ৰে অনুষ্ঠান করে এলো আর এসব হচ্ছে কালিকার নিৰ্দেশিত পথে৷ তাঁর আদৰ্শ,
তাঁর চিন্তা-ভাবনা, তাঁর নীতিদোহারের ভিত এবং এই ভিতই দোহার-এর সঞ্জীবনী বলে জানি৷
কালিকার
দোহার’ (অবশ্য কালিকা কখনো বলতেন না তাঁর একার গানের দল ‘দোহার’৷ তিনি এই সংগীত
দলের সকল সদস্যদের জড়িয়ে কথা বলতেন, তিনি বলতেন
আমাদের ‘দোহার’) মাত্ৰ কয়েক বছরের মধ্যে বাংলার সংগীত জগতে জায়গা করে নেয়৷
টিভি চ্যানেল, বিশেষ করে জি-বাংলার মাধ্যমে কালিকার পরিচিতি গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে
পড়ে৷ কখনো সখনো কালিকা গানের আগে পরে কিছু কথা বলতেন, অনেক সময় তাকে দিয়ে বলানো
হতো আর তার এই কথা বলা গানের অংগস্বরূপ হয়ে উঠেছিল৷
কালিকার
মৰ্মান্তিক মৃত্যু, অকালে চলে যাওয়া আমরা এখনও কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না৷ মাত্ৰ
৪৬ বছর বয়সে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন৷ আমাদের তাঁর কাছ থেকে লোকসংগীত তথা লোক
বিষয়ক আরও বিপুল কিছু পাবার কথা ছিল৷ তাঁর জন্যে আজ লোক-সংগীত ও লোক-সংস্কৃতি
শহুরে শিক্ষিত মানুষের কাছেও আদৃত৷ লোকসংস্কৃতি মানব সভ্যতার মূল ভিত৷ নিশ্চিত
একথা মনে রেখে কালিকার সংগীত জগতে পথ চলা শুরু হয়েছিল৷ কালিকা বুঝিয়ে দিলেন
লোকসংগীত ও লোকসংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে বাংলা চলতে পারে না, মানব সভ্যতা এগোতে পারে
না৷ আমাদের মূলকে বাদ দেওয়া যায় না, একথা কালিকা আমাদের কাছে পৌছাতে পেরেছিলেন,
আমাদের বোঝাতে পেরেছিলেন যে লোকগান শুধু খেটে খাওয়া মানুষের জন্য নয়, সংগীত মাত্ৰই
সান্ত, লোকগানও৷ তাইতো আজ আমরা দেখছি, রবীন্দ্ৰসংগীত, নজরুলগীতি, ক্লাসিক্যালের
একই মঞ্চেই লোকসংগীতও হচ্ছে৷ এ কালিকার অবদান৷ অবশ্য একথা বললেই শেষ হয় না, তার
পূৰ্বসূরীর কাজকে তিনি শহুরে মানুষের মনের মতো করে পরিবেশন করে বাংলা লোকসংগীতকে
মৰ্যাদাপূৰ্ণ স্থানে নিয়ে এলেন৷ তা করতে গিয়ে তিনি লোকগানের মূলে এতোটুকুও
বিচ্যুতি ঘটাননি৷ কালিকা তাঁর গানে লোকজ বাদ্যযন্ত্ৰ ব্যবহার করতেন৷
কালিকার
অকালে চলে যাওয়া আমাদের বিরাট ক্ষতি৷ তার পথে গিয়ে লোকগান ও সংস্কৃতিকে আমাদের
জীবনের সঙ্গে ওতপ্ৰোতভাবে মিলিয়ে নিতে পারলেই মনে করি, কালিকার প্ৰতি আমাদের
ভালোবাসা ও সান হৃদয়ে পোষণ করা সাৰ্থক হবে৷
সিলেটি নৃত্য, সিলেটি
সংস্কৃতি ও বাঙালির জাতীয় নৃত্য
সমরবিজয় চক্রবৰ্তী
বরাক
ও সুরমা অঞ্চলকে অৰ্থাৎ এক কথায় সিলেটাঞ্চলকে বাংলার গ্ৰামীণ নৃত্য কলার তীৰ্থ
ক্ষেত্ৰ বলা যেতে পারে৷ একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ‘নৃত্য’ সংস্কৃতির একটি
বিশেষ অঙ্গ৷ আবার সঙ্গীতের সঙ্গে সন্নিবিষ্টও নৃত্য৷ স্বতন্ত্ৰ ধারার সঙ্গীতে
পরিপুষ্ট এ অঞ্চলের সংস্কৃতি৷ প্ৰসঙ্গত সংস্কৃতিতে সন্নিবেশিত
সাহিত্য-কলা-নৃত্য-গীত আরও যা কিছু তা জীবনকে সুন্দর করে তোলে৷ বরাক-সুরমা
সংস্কৃতির একটি বিশেষ দিক হলো বরাক-সুরমার নিজস্ব নৃত্যধারা যা বাংলার কোথাও
মেলেনা৷ আজও এ সিলেটি নৃত্যগুলির বেশিরভাগই বাঙালির সাৰ্বিক নৃত্য হয়ে ওঠেনি৷ এর
কারণ কিছুটা বিশ্লেষণ করার প্ৰয়োজন আছে বলে মনে করি৷ যে দু-একটা সিলেটি নৃত্য
বৃহত্তর বাঙালির কাছে স্থান পেয়েছে তা কিন্তু বাঙালি সমাজে আজও সম্পৃক্ত হয়নি৷ যা
কিছু আমরা টিভির মাধ্যমে দেখতে পাই, তা কিন্তু মূল থেকে সরে যায়, অনেকাংশে
নান্দনিকতাও হারায়৷ ‘সোয়াগ চান্দ বদনি ধনি’ গানের সঙ্গে টিভিতে সচরাচর যে নৃত্য
দেখি- তা না হয় বোঁনাচ, না হয় ধামাইল৷ বোধকরি, উদ্দেশ্য বোধহয় বৌনাচ ও ধামাইল করার
জন্যে নয়৷ গানটি শুধু নিলাম আর যা কিছু নাচলাম৷ এ করেতো গানটির নৃত্য চরিত্ৰায়ন
ক্ষুণ্ণ আছে, নয় কি? এভাবে একটি পরম্পরাগত সংস্কৃতির অবমাননা করা হচ্ছে৷ লুঙ্গি
পরে ক্রিকেট খেলা কি মানায়? খাপ-খাওয়া বলতো একটি ব্যাপার রয়েছে৷ মানানসই তখনই হবে,
যখন এ গানের নৃত্যরূপটিও গানের সঙ্গে উপস্থাপিত হবে৷ এ তো শুধু বিকৃতির একটি মাত্ৰ
নমুনা৷
বৃহত্তর
বাঙালি সমাজে সিলেটি নৃত্য যথাযথ না পৌঁছানোর কিছু কারণের মধ্যে একটি হলো প্ৰচার ও
প্ৰসারে প্ৰতিবন্ধকতা৷ বরাক উপত্যকার অবস্থান আসাম প্ৰদেশে, আর একজোটে লক্ষ লক্ষ
সিলেটির বাসও এই বরাক উপত্যকাই৷ অসমীয়া অসহিষুতা সিলেটি নৃত্য শুধু নয় সিলেটির
যেকোন সংস্কৃতি উপস্থাপনার আঙিনায় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়৷ সরকারি অনুমোদন ও স্বীকৃতি
ছাড়া এ সংস্কৃতি এগোবে কী করে৷ রাজশক্তি যার পেছনে সেইতো এগোয়৷ সিলেটি গ্ৰামীণ
পরম্পরাগত সংস্কৃতির গবেষণার সুযোগ সরকারি পক্ষে নেই৷ আজকের ব্যাপক আৰ্থিক মন্দার
যুগে, টেলিভিশনের হুজ্জুতি, বেজ্জতি সংস্কৃতি’র সামনে চাঁদার উপর নিৰ্ভর করে কি
সংস্কৃতি টেকে?তাও আবার লোক সংস্কৃতি যার সৌকৰ্য্য বাইরের জৌলসে ঢাকা পড়ে৷
এমতাবস্থায় বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতার প্ৰয়োজন, রাজ্যিক-রাষ্ট্ৰিয় পৃষ্ঠপোষকতা শ্ৰেয়৷
প্ৰসঙ্গত, আসামে বাঙালি দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী হওয়া সত্ত্বেও বাঙালিকে
অনেক খেসারত পোহাতে হচ্ছে বাঙালি সত্তা টিকিয়ে রাখতেই, গান-বাজনা- নৃত্য তথা
সংস্কৃতির অন্যান্য দিকতো অনেক দূরের কথা৷ অথচ বাঙালির অবদান আসামে প্ৰতুল৷
আসাম
কেন গোটা উত্তর পূৰ্বাঞ্চলে অন্ততঃ শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্ৰে বাঙালির অবদান
অনস্বীকাৰ্য৷ নাগাভূমি ছাড়া নানা ভাষিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে কথা বলার মাধ্যম হিসাবে
একসময় বাংলার স্থান ছিল৷ আজও ত্ৰিপুরা, মিজোরামের চাকমা ও রিয়াং অঞ্চলে বাংলায়
কথোপকথন করা যায়৷ ব্ৰহ্মপুত্ৰ উপত্যকায় অসমীয়াদের বেশিরভাগই বাংলায় কথা বলতে
পারেন, কিন্তু তাঁরা বাংলায় কথা বলতে আগ্ৰহী নন বরং বিদ্বেষ পোষন করেন৷ বরাক
উপত্যকায় যাঁরা আসেন তাঁদের কথা স্বতন্ত্ৰ৷ এক কথায় উত্তর পূৰ্বাঞ্চলের সবকটি
জনজাতি বাংলা অন্ততঃ একটি বিষয় হিসেবে একসময় পড়ত৷ শিক্ষিত জনেরা বিশেষ করে
রবীন্দ্ৰসঙ্গীত শুনতে গাইতে ভালবাসতেন৷ শিলঙে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে
অধ্যাপিকা লাপিংসাই সিয়েম রবীন্দ্ৰসঙ্গীত শিপ্লী, বয়স মাত্ৰ ত্ৰিশঊৰ্দ্ধ৷ এই
শিপ্লীর শিপ্লী হিসেবে সুনাম আছে অবশ্য বাঙালির মূল পীঠস্থান কলকাতার ত্ৰুটিআজও
তাঁকে কোন সম্বৰ্ধনা জানায়নি কলকাতা৷ উত্তর পূৰ্বাঞ্চলের অবাঙালিদের মধ্যে
রবীন্দ্ৰসঙ্গীত গাইয়ে বিরল নন, তবে তাঁরা প্ৰচারের আলোতে আসছেন নাএ অন্যদিক, অন্য
বিষয়৷
যে
বিষয় নিয়ে কথা শুরু হয়েছিল, এতে কেন্দ্ৰায়িত করি৷ এটা সত্য, আৰ্থিক অনুদান না পেলে
আজকাল এ বিশ্বায়নের যুগে কোনও সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখা মুসকিল৷ এর মধ্যে বরাক উপত্যকা
ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক কারণে বাংলার মূল ভূখণ্ড থেকে দূরে৷ এরজন্যই বোধহয় বরাক অঞ্চল
বাঙালি প্ৰধান হওয়া সত্ত্বেও মূল বাঙালি ভূখণ্ডের প্ৰেক্ষিতে স্বাতন্ত্ৰে ভরা৷
বৰ্তমানে পরম্পরাগত সংস্কৃতি চৰ্চা এখানে কিছুটা দম ধরে আছে৷ এখানকার কিছু লৌকিক
সংস্কৃতি গৰ্ব করার মত শিপ্লীত অথচ এগুলোর চৰ্চা তেমন হচ্ছে না, আর কিছু কিছু
প্ৰায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে, যেমন ‘মাঘবৰ্ত’ (ব্ৰত)৷ এটি নিয়ে গবেষণার একান্ত প্ৰয়োজন৷
‘সূৰ্যবৰ্ত’ (ব্ৰত) আজকাল হয়ই না৷ সূৰ্যবৰ্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গীত ও ধামাইল হয়তঃ
একদিন বিলুপ্ত হয়ে যাবে৷ সূৰ্যবৰ্তে অঙ্কন শিপ্লও লক্ষণীয়৷ প্ৰসংগতআসাম সরকারের
পক্ষপাতিত্ব থাকবেইএকথা মনে রেখে বরাকের মানুষের অন্য পথ বের করা চাই৷ বোধহয়
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সহায়তায় সিলেটি সংস্কৃতি রক্ষা পেতে পারে৷ বাংলা সংস্কৃতির
স্বাৰ্থে এ করা প্ৰয়োজন৷
বাঙালি
জাতির কোন জাতীয় নৃত্য নেই, কিন্তু সিলেটি বাঙালি গোষ্ঠীর রয়েছে৷ বাঙালির কোন
জাতীয় নৃত্য না থাকার ফলে বাঙালি ঐক্যেও এ-এক বিরাট বাধা৷ সৰ্বভারতীয় ক্ষেত্ৰে
বাংলার নাচ বলতে যে সমস্ত নাচ উপস্থাপন করা হয় তা আমরা টিভির মাধ্যমে দেশের এই
প্ৰান্তীয় অঞ্চলে বসেও দেখতে পাই৷ খাঁটি পশ্চিম বঙ্গীয় গ্ৰামীণ নৃত্যের মাপকাঠি
এখানে বিবেচ্য নয়, বিবেচ্য এখানে অন্যকিছু৷ বাংলার নাচ বলে যে সমস্ত নাচ প্ৰায় সময়
আমরা দেখি, এগুলোতো অন্য প্ৰদেশেরও নাচ৷ যেমন ছৌনৃত্য৷ ছৌনৃত্য ওড়িষ্যা এবং
ঝাড়খণ্ডেও রয়েছে৷ সুতরাং ছৌনাচ বাঙালির একার গৰ্বের নয়৷ ‘রায়বেঁশে’ নৃত্য অবশ্যই
বাংলার, এ নৃত্য মাৰ্শাল আৰ্টের অন্তৰ্গত বলে এটাকে পূৰ্ণ নৃত্য বলা যায় না৷ কাঠি
নৃত্য বাংলার একার নয়৷ বাংলার কিছু উপজাতির নৃত্য রয়েছে তবে জাতীয় স্তরে এগুলোর
একটিও উঠে আসেনি, অৰ্থাৎ বাংলার কোন জাতীয় নৃত্য নেই৷
রবীন্দ্ৰনৃত্য
বলতে যে নৃত্য বোঝায় তা সৃজনশীল নৃত্য৷ আজকাল তো রবীন্দ্ৰসঙ্গীত শুনে বুঝতে হয় যে
এটি রবীন্দ্ৰনৃত্য, নৃত্যে রাবীন্দ্ৰিক কোনো সংকেত, স্বাক্ষর আজকাল থাকেই না৷
অবশ্য যাঁরা রবীন্দ্ৰ অনুসারী, তাঁরা রবীন্দ্ৰনাথ ঠাকুরের নিৰ্দেশিত পথে
রবীন্দ্ৰনৃত্য সৃজন করেন৷ রবীন্দ্ৰনৃত্য বাংলার একার নয়, নানা অঞ্চলের নৃত্যের
সমাহারে রবীন্দ্ৰ নৃত্য সৃজিত হয়এখানেই বাংলার নিজস্বতা হারায়৷
অপর
পক্ষে, বাংলার কোন শাস্ত্ৰীয় নৃত্য নেই বলে আমরা জানি৷ নৃত্যগুরু ড. মুকুন্দদাস
ভট্টাচাৰ্য সিলেটির ওঝা নৃত্যে পেয়েছেন শাস্ত্ৰীয় নৃত্যের বৈশিষ্ট্য৷ কিন্তু ওঝা
নৃত্য নিয়ে গবেষণা, ওঝা নৃত্যকে শাস্ত্ৰীয় নৃত্যরূপে স্বীকৃতি পাওয়ার ক্ষেত্ৰেও বরাক
অঞ্চলের অবস্থান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ ড. মহুয়া মুখাৰ্জি শিলং এর সিলেটি মেয়ে,
দাবি করছেন তাঁর আবিষ্কৃত ‘গৌরীয়নৃত্য’ বাংলার শাস্ত্ৰীয় নৃত্য বলে৷ তিনি বাংলার
মন্দির গাত্ৰে পেয়েছেন যে সমস্ত শরীরী ভংগিমা, এ সমস্ত সন্নিবেশে ও চলমান কিছু
বাংলার নৃত্য, বিশেষ করে সিলেটি ওঝা নৃত্যের কিছু ভঙ্গিমা-বিভংগও জুড়ে দিয়েছেন এ
নৃত্যে৷ কিন্তু নৃত্য পণ্ডিতদের কাছে আজও এটির পূৰ্ণসমৰ্থন পাওয়া যায় নি বলে
বাংলার মানুষ দাবি করতে পারে না বাংলারও রয়েছে একটি শাস্ত্ৰীয় নৃত্য৷ একথা বিবেচ্য
যে, আশাকরা যায়, প্ৰাদেশিক, ব্যক্তিগত, প্ৰাতিষ্ঠানিক তোড়জোড়ে সংগীত-নাটক অকাদেমি
ওঝানৃত্যকে বাংলার শাস্ত্ৰীয় নৃত্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে দিতে পারে৷ এক্ষেত্ৰে
অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গ ও ত্ৰিপুরা সরকারের ভূমিকার প্ৰয়োজন৷ সিলেটিয় ওঝানৃত্যের পক্ষে
বাংলার শাস্ত্ৰীয়নৃত্যের স্বীকৃতি আদায় করা যত সহজ, গৌরীয়নৃত্যের পক্ষে তা নয়৷ তবে
পশ্চিমবঙ্গের স্বীকৃতি ও চেষ্টা ছাড়া সিলেটি ওঝানৃত্য বাঙালির শাস্ত্ৰীয়নৃত্য
হিসেবে স্বীকৃতি না পাবারই কথা৷
নৃত্য
মানুষের আনন্দ প্ৰকাশের অন্যতম মাধ্যম৷ একটি জাতির চরিত্ৰও বেশ কিছু প্ৰতিফলিত হয়
তাঁর নিজস্ব নৃত্য-গানে৷ আসামে বিহু, পাঞ্জাবে ভাংড়া, গুজরাটে গোরবা নৃত্যের
মাধ্যমে এই জনগোষ্ঠীগুলি তাঁদের নিজস্ব পরিচয়ে বিশেষ সান নিয়ে দাঁড়াতে পারছেন৷
মণিপুরি
নৃত্যের পুরোধা ব্যক্তিত্ব গুরু বিপিন সিংহ, বাঙালির জাতীয় নৃত্য সম্পৰ্কে তাঁর
নিজস্ব মত পোষণ করেন৷ তিনি এ বিষয় নিয়ে এ নিবন্ধকের শিলচরস্থ বাড়িতে গুরু মুকুন্দদাস
ভট্টাচাৰ্যের সঙ্গে আলোচনাও করেন৷ গুরু বিপিন সিংহ ধামাইল’কে বাঙালির জাতীয়
নৃত্যের অনুমোদন দিয়ে যান৷ গুরু মুকুন্দদাস ভট্টাচাৰ্যের তখন খানিক উা ছিল, কারণ
এটি মূলত মহিলাদের নৃত্য৷ নানা মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে ধামাইল নাচ করা হয়৷ বরাক
অঞ্চলের ঘরে ঘরে এটি প্ৰচলিত৷ আজকাল অবশ্য পুরুষরাও এনৃত্যে যোগ দিচ্ছেন৷
স্ফূৰ্তির যেকোন বাহানায় ধামাইল নাচ হতে পারে, যেমন হয় ভাংড়া, বিহু৷ বলাবাহুল্য
গুরু মুকুন্দদাস ভট্টাচাৰ্য তাঁর মৃত্যুর কয়েকবছর আগে ধামাইলকে বাঙালির জাতীয়
নৃত্য হিসেবে গ্ৰহণীয় বলে তাঁর মত ব্যক্ত করে গেছেন৷
এখন
চাই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বীকৃতি৷ তখন দেখবেন ধামাইল অনুষ্ঠিত হবে বাংলার প্ৰতি
পৰ্বে, অনুষ্ঠানে, উৎসবে৷ দৰ্শক আসন থেকেও মঞ্চে এসে দৰ্শকরা ধামাইল করবেন৷ দৰ্শক
আসনের পাশে জায়গা করেও ধামাইল করবেন দৰ্শকরা৷ মাঠে ঘাটে সৰ্বত্ৰ আনন্দ প্ৰকাশের
অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ধামাইল হবে৷ আশাকরা যায়, অচিরেই ধামাইল এ পৰ্যায়ে পৌঁছবে৷
শুধু সিলেটির হয়ে থাকবে না ধামাইল, ধামাইল হবে বাঙালি জাতির জাতীয় নৃত্য৷
মহাত্মা
গান্ধি ও নেতাজি সুভাষঃ তুলনামূলক বিশ্লেষণ
সমরবিজয়
চক্রবর্তী
ভারতের
স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে প্রথমে যে
দু’জনার নাম অনায়াসে আমাদের মনে উঠে আসে, এঁরা হলেন মহাত্মা মোহনদাসকরমচাঁদ
গান্ধি ও নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু।উনবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে গান্ধি ও নেতাজি
মতাদর্শের দিক থেকে দুই মেরুতে থেকেও ভারতবাসীর মনে অতি উচ্চ আসনে রয়েছেন।এ শুধু ইংরেজ শাসন বিলুপ্ত করে দেশ
স্বাধীন করার জন্য নয়,স্বাধীনতা
যুদ্ধে তাঁদের অভিনব পন্থা,নির্ভীকতা,ত্যাগ,তিতিখ্যা,সার্বিক
জনকল্যাণ ও জীবনযাপন মানুষকে অভিভূত করে,মানুষের
মনে প্রশ্ন জাগে, পরম
শ্রদ্ধাও জাগে।অবশ্য আপামর বাঙালি নেতাজিকে যে উচ্চাসনে রেখেছেন,তার
সমান্তরালে মহাত্মা নন।বলাবাহুল্য, এই বাঙালিই সময় কালে নেতাজির ডাকে তেমন সাড়া
দেননি বরং কেউ কেউ নেতাজির বিরুদ্ধে কাঠি নেড়েছেন।নেতাজির আত্মগোপন করে দেশ ছেড়ে
চলে যাওয়া ও অত্যন্ত কম সময়ের মধ্যে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আজাদহিন্দ ফৌজকে শক্তপোক্ত
করে গড়েতুলে আক্রমণ করার লক্ষ্যে অবাঙালিদের মদত লক্ষণীয়।দেখা যায়,
কোনও
বাঙালি তাঁর কৃতকর্মে অতি উচ্চকোটির
সাফল্য পেলে বাঙালির কাছে প্রশংসা পায় কিন্তু সাফল্যে পুঁছোনর আগ অবধি নয়,
বরং
সাফল্যের পথে বাঙালিই অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।আবার এও দেখা যায় বিশ্বময় খ্যাত
হলেও,বাঙালির কুমন্তব্য কোনও মহাপুরুষের পিছু ছাড়ে না।রামমোহন রায়,বিদ্যাসাগর,বিবেকানন্দ,রবীন্দ্রনাথের
মতো মহামানবরাও রেহাই পাননি। তাইতো বিতর্কিত লেখক নীরদ চন্দ্র চৌধুরী বলে গেছেন,বাঙালি
আত্মঘাতী।
রবীন্দ্রনাথ
গান্ধিকে ‘মহাত্মা’ আখ্যা দেন আর নেতাজিকে ‘দেশনায়ক’।প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক,গান্ধি
যদি এতোই শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে থাকেন, তাহলে
তাঁর আততায়ীর গুলিতে মৃত্যু হ’ল কেন?আর পন্ডিত জওহরলাল নেহরু স্পষ্টত নেতাজির চরম
শত্রু হয়ে দাঁড়ালেন কেন?যুক্তরাষ্ট্রের
এক সময়ের জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতি কেনেডির আততায়ীর গুলিতে মৃত্যু হয়।যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ
করে হত্যা করা হয়।গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুকেও হত্যা করা হয় বলে জানি।ইতিহাস এ রকম প্রভুত উদাহরণের সাক্ষী।সুতরাং নিজ দেশেও মহামানবের শত্রু থাকা
অমূলক নয়।গান্ধি ও সুভাষ—দুজনারই জীবনাবসান স্বাভাবিক নয়, এক জনার আততায়ীর হাতে
মৃত্যু আর আর একজনার শেষ তো আজও রহস্যাবৃত।কোন এক বড় মাপের রাজনৈতিক দলনেতা তাঁর
মৃত্যু ঘটিয়েছেন বলেও জানা যায়, সুতরাং
সেই ব্যক্তি বড় ধরণের আততায়ী বলে বলা যেতে পারে কি-না?স্বাধীনতার
লক্ষ্যে মহাত্মা ও নেতাজি, এই
দুজন
দুই পন্থায় সংগ্রাম করে গেছেন এবং দু’জনার
নামই স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে উজ্জ্বলতম হয়ে রয়েছে।তাঁদের নেতৃত্বে লক্ষ লক্ষ ভারতীয় বিনা
দ্বিধায় স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।উল্লেখ্য, এই
ভারতীয়েরা সামাজিক ও সাম্রাজ্যিক শোষণ-পেষণে
নুব্জ ছিল।দাসত্ব তাদের মজ্জায় ঢুকে গিয়েছিল যা আজও এ দেশের কোনও কোনও অঞ্চলের
মানুষের মধ্যে রয়েছে এবং মানুষের মধ্যে জাতপাত-জনিত
বিভেদের বীভৎসতা এই একুশ শতকেও বিলুপ্ত
হয়নি।
স্বাধীনোত্তর
ভারত নির্মাণের পরিকল্পনাও নেতাজি ও গান্ধি উভয়েই করে গেছেন।শুধু আবেগ সর্বস্ব
অবৈজ্ঞানিক ধারণা যেমন নব ভারত নির্মাণে বিপরীত ক্রিয়া করতে পারে, তেমনই
বিজ্ঞানভিত্তিক প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনা উত্তরোত্তর প্রগতির সোপানে স্বাধীনোত্তর
ভারতকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম—এ’কথা
খোলাগোপন,যদি সততার সঙ্গে যথার্থভাবে যৌক্তিক পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা যেতো তা
হলে এ’দেশ উন্নয়নের
দৃষ্টিতে এতো দিনে পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ আসন পেয়ে যেত,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অতিক্রম
করে যেতে পারতো বলে এই নিবন্ধক মনে করেন।এ’কথা
অনস্বীকার্য যে মহাত্মা ও নেতাজি উভয়ই স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশাপাশি দেশ ও সমাজ গড়ার কাজও করে
গেছেন।তাঁদের নির্দেশিত স্বাধীনতা আন্দোলন শুধুমাত্র দেশকে ইংরেজ মুক্ত করা
নয়,দেশের জাতীয় পরিচয় মজবুত করার সাথে সাথে দেশের অত্যুঙ্গ সমৃদ্ধি সাধন করা এবং
তা শুধু আর্থিক নয়, নৈতিকও।উন্নত
জীবন মানে তো শুধু বাইরের সমবৃদ্ধি নয়, চাকচিক্য নয়, ভেতরের সমবৃদ্ধিও,
যাতে মানুষ সুখ ও শান্তিতে জীবন যাপন করতে পারে।
মহাত্মার
জন্ম বৈষ্ণব পরিবারে,জৈনদের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা
ছিল।স্বভাবত,জৈন
ধর্ম দ্বারাও তিনি প্রভাবিত।জৈন
আদ্যোপান্ত অহিংস, বৈষ্ণব ততটা নয়,কারণ বৈষ্ণব কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধের স্বীকৃতি
দেয়।আবার উপোস গুজরাটি জৈন ও বৈষ্ণবদের
একান্ত পালনীয়।উপোসে
তাঁরা ধাতস্থ।কোনও আন্দোলনে উপোস যে কাজে লাগতে পারে তা সর্বপ্রথম মহাত্মা প্রয়োগ
করে দেখান।দেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামে উপোসকে হাতিয়ার করায় গোটা বিশ্ব চমকে ওঠে।ভোগি
ইংরেজ হয় হতবাক।অনারম্বর
জীবন ইংরেজের কাছে ভাবনার অতীত। এরমধ্যে
আবার মহাত্মা যোগ করেছেন অসহযোগিতা এবং উভয়ের মিলনের নামাঙ্কন করেছেন ‘সত্যাগ্রহ’।হাজার বছর ধরে সামাজিক নিষ্পেষন ও
পরাধীনতার ফলে মানুষ হয়ে ওঠে করতাভজা, তোষামোদ মজ্যাগত হয়ে ওঠে, স্বাধীন ভারতেও এর
ব্যত্যয় নয়।সামন্ততান্ত্রিক
পেষণে অভ্যস্ত মানুষ বিদ্রোহী হতে পারছিল না, গড্ডালিকা প্রবাহে ভাগ্যনির্ভর জীবন,
তাই মহাত্মার অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন তাদের স্বভাবের অনুকূলে—মার
খাও আর সহ্য করে যাও, এতেই কার্য্য হাসিল হলে হবে।জীবন ও সামাজিক সংগ্রামে ‘সত্যাগ্রহ’
হোক অবলম্বন, সত্যাগ্রহ অবলম্বন হোক স্বাধীনতা সংগ্রামেও।এ ব্যাপারটা অতিশয় মিস্টিক বলে মনে
হওয়া অস্বাভাবিক নয় বলে এই নিবন্ধক মনে করেন।নেতাজি এই পন্থা মেনে নিতে পারছিলেন
না।তিনি সেই সময়ের আপামর ভারতবাসীর অপৌরুষেয় জীবনের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সংগ্রামী জীবন
বেছে নিয়েছিলেন।স্বামী বিবেকানন্দের
জীবনবোধ তাঁকে অনুপ্রাণিত করে। এই জীবনবোধ তিনি শুধু স্বাধীনতা অর্জনের
ব্যাপারে প্রয়োগ করেননি, ব্যক্তিজীবন এবং সামাজিক জীবনেও কার্যকরী করার আপ্রাণ
চেষ্টা করে গেছেন।
নেতাজি
বুঝে ছিলেন ইংরেজ শাসন বিলুপ্ত করতে গেলে“শঠে
শাঠ্যং সমাচরেৎ”, সত্যাগ্রহে কাজ
হবে না এবং তা-ই হল। ইংরেজ গান্ধিজির সত্যাগ্রহের ফলে দেশ ত্যাগ করেনি, ভারত
ছেড়েছে সুভাষ চন্দ্রের ভয়ে।এ কথা লর্ড মাউন্টব্যাটেন এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার
করেছেন।ব্রিটেনের তৎ কানীন প্রধান মন্ত্রী ক্লিম্যান্ট রিচারড এটলিও অকপটে স্বীকার
করেছেন যে ব্রিটেন কিছুতেই ভারত ছাড়ত না।নেতাজি-নেতৃত্বাধীন আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারতে
ব্রিটিশ কলোনির ভীত ভালোভাবে নেড়ে দিয়ে ছিল বলে ব্রিটিশকে ভারত ছাড়তে হয়।এটলি এও বলেন,গান্ধির অহিংস আন্দোলন
ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে কোনও ভূমিকা রাখেনি, যদি রাখেও তা ধর্তব্যের মধ্যে
নয়—এর ফলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভারত-ছাড়া হত না।(Bose:
an Indian Samurai by GD Bakshi/ The Indian National Army and the war of India’s
Liberation by Ranjan Borra, published by the Institute of historical Review in
1982)
১৯৪৫
সালে লাল কেল্লায় আজাদ হিন্দ ফৌজের সদস্যদের রাজদ্রোহী হিসাবে বিচার হয়,ফলস্বরূপ মেজর জেনারেল শাহ
নাওাজ খান, করনেল প্রেম সাহগল এবং করনেল গুরবক্স সিংহ ধিলনের কোর্ট মারশেলের রায়
শোনানো হয়।এই রায়ের বিরুদ্ধে গোটা দেশ
খেপে ওঠে।এই
উত্তাল দ্রোহীতায় ব্রিটিশ শাসক বিশেষ অস্বস্তিতে পড়ে।আন্দোলন শুধু সাধারণে আঁটকে
থাকেনি। ১৯৪৬এর ফেব্রুয়ারি মাসে
বোম্বেতে রয়েল ইন্ডিয়ান নেভি হরতাল করে
বসে।এরপর হরতাল হয় কলকাতা আর করাচিতেও।সর্বমোট৮০টি
রণতরীর ২০,০০০কর্মী হরতাল করে।হরতাল দমনে ব্রিটিশ রয়েল নেভিকে নামানো হয়। সাতজন হরতালকারির মৃত্যু
হয়।ইংরেজ বুঝে নিল যে এ দেশে রাজত্ব চলবে না।ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট
এটলি(যিনি চরম ভারত বিদ্বেষী,
চারচিলের স্থলাভিষিক্ত)আশংকা প্রকাশ করেন,প্রতিরক্ষা বাহিনীর ভারতীয় সৈনিকরা
অচিরেই বিদ্রোহ করে বসতে পারে, এতে টাল সামলানো তো দূরের কথা, নিজেদের জীবনই তো
রক্ষা পাবে না।
স্বদেশের
প্রতি নেতাজির অগাধ টান তাঁর ছাত্রাবস্থায়ই প্রকাশ পায়।অন্যায়ের প্রতিবাদে তিনি তখনই
আপোষহীন।এর একটি উদাহরণ—প্রেসিডেন্সি
কলেজে একবার ইএফ অটেন নামে এক অধ্যাপক ভারতীয়ের নামে কটু মন্তব্য করে বসেন।নেতাজি কড়া প্রতিবাদ জানান। এতে অটেন সাহেব খুব্দ হন,
ফলে
নেতাজিকে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হতে হয়।
মহাত্মা
তাঁর ছাত্রাবস্থায় ভারতীয় সম্পর্কিত সাজাত্যাভিমানে আঘাত পেয়ে নরম কিম্বা গরম কোনও
প্রতিবাদ করেছিলেন কি-না জানা নেই।
যাক,১৯৪৬
সালের মে মাসে আজাদ হিন্দ ফৌজের ট্রায়েলের সমাপ্তি হয়। এর ১৪ মাস পরেই ভারত
স্বাধীন হয় দ্বিখণ্ডিত হয়ে।উল্লেখ্য,গান্ধি বোম্বের নৌ বিদ্রোহ মেনেনিতে পারেননি
বরং তিরস্কার করেন।তবে গান্ধি দেশভাগ মেনে নেননি।নেতাজি আগাম বুঝতে পেরেছিলেন দেশভাগ যে
হতে পারে, তিনি পূর্ণ ভারতের স্বাধীনতা
চেয়েছিলেন। জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে দেশ ভাগ হয়।পৃথিবীর ইতিহাসে ধর্মের নামে নিষ্পাপ মানুষ হত্যা, নারী ধর্ষণ, শিশু হত্যা ও
বাস্তুচ্যুত-দেশ্চ্যুত-সহায় সম্বলহীনতার এমন নিদর্শন আর নেই, এমনকী তা হিটলারের
ইহুদি নির্যাতন ও নিধনকেও হার মানিয়েছে।পূর্ববঙ্গ
সম্পর্কে বলব, একই ভাষিক লোক কীভাবে ভিন্ন ধর্ম-হেতু এমনটা করতে
পারে,পৈশাচিকতার এমন নজীর আর একটিও নেই বলে জানি। মহাত্মা দেশভাগ চাননি।তিনি বলেছেন, দেশভাগ না করে বরং তাঁর
শরীরকে দুভাগ করে দেওয়া হোক।তিনি মুহাম্মদ আলি জিন্নাকে ডেকে এনে বললেন, জিন্না যেন দেশ ভাগ না চান, এর বদলে তাঁকে অবিভক্ত
ভারতের প্রধান মন্ত্রীর আসন দেওয়া
হবে।জিন্না রাজী হননি।জওহরলাল দেশভাগের সিদ্ধান্তে অনড় রইলেন।/////
অবস্থার
প্রেক্ষিতে নেতাজিকে সালে শুধু
কংগ্রেসের সভাপতির পদ নয়, কংগ্রেস থেকেও বিদায় নিতে হয়েছিল।মহাত্মাকেও কংগ্রেস
থেকে বিদায় নিতে হয়, সে ১৯৩৪-এর অক্টোবর
মাসে।গান্ধি কংগ্রেস ছেড়েছিলেন ঠিক, কিন্তু তিনি
রাজনীতি থেকে সন্ন্যাস নেননি।জওহরলালের
সমাজতন্ত্রে তাঁর সায় ছিল না। কোনও কোনও ক্ষেত্রে মতবিরোধ হলেও জওহরলালের প্রতি
তাঁর দুর্বলতা ছিল।নেতাজিও চেয়েছিলেন দেশকে সমাজতান্ত্রিক ধারায় গড়তে।/////
১৯২০
অবধি লাল-বাল-পাল(লালা লাজপাত রাই, বাল গাঙ্গাধার তিলক ও বিপিন চন্দ্র পাল)ভারতের
স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন।এই সংগ্রামে তীব্রতা ছিল তবে ভূভারতে
আনাচে-কানাচে বিস্তৃত হয়নি এই সংগ্রাম।গান্ধির আমলে গোটা ভারতের আমজনতার মধ্যেও
স্বাদেশিকতার উপলব্ধি আসতে শুরু হয়।বিভাজিত ভারতভূখণ্ড এক ইউনিটে রূপান্তরিত
হয়।গান্ধির প্রভাব খেটেছে ১৯৩০ থেকে ১৯৪০ অবধি আর ৪০এর দশক ছিল নেতাজির অধ্যায়।দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশবাসি দেশ
অত্যাগ্রহে নেতাজির প্রত্যাগমনের অপেক্ষায়।নেহেরু জানতেন স্বাধীন ভারতেও নেতাজির
সাথে তিনি কোনও কিছুতেই পেরে ওঠবেন না এবং
নির্বাচনে তাঁর হার নিশ্চিত।
নেহরু
যারপর নাই চেষ্টা করে গেছেন নেতাজি যাতে দেশে না ফেরেন।বস্তুত, নিরুদ্দেশ নেতাজির
প্রতি নেহেরুর চরম বৈরী আচরণ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এক অন্যতম কলংকিত
অধ্যায়।বলতে
দ্বিধা নেই,নেহেরুর দেশভক্তির জায়গায় দেশদ্রোহিতার চরম পরিচয় মেলে— ইংরেজ শাসন বিলুপ্তির উদ্দেশ্যে নেতাজির
সশস্ত্র-আক্রমণের প্রতিবাদে ইংরেজের কাছেই আন্তর্জাতিক-আদালতে নেতাজির
সাজা-প্রাপ্তির তিনি আবেদন রাখেন।নেহরু এও বলেন, নেতাজি যদি দিল্লি আসেন তাঁকে তিনি তরোয়াল দ্বারা
হত্যা করবেন।তিনি সকল সইনিক ছাউনি থেকে নেতাজির ফোটো তুলে নেওয়ার জন্য নির্দেশ
প্রদান করেন। সকল সরকারি অফিস থেকেও নেতাজির ছবি সরানোর কড়া নির্দেশ দেন। শুধু তাই নয় নেহরু-গান্ধির
নামাঙ্কিত অনেকগুলি প্রতিষ্ঠান করা হয়।আজদ হিন্দ ফৌজের একটি সৈনিককেও স্বাধীন ভারতের
সৈন্য বাহিনীতে নিযুক্তি দেওয়া হয়নি,তাঁরা স্বাধীনতা সংগ্রামী ভাতাও পাননি।নেহেরুর পরও এই লিগেসি বজায় থাকে যতদিন
কংগ্রেস দেশ শাসন করেছে।
একথা
আগেই বলা হয়ে গেছে যে,গুজরাটে মানুষ উপোসে অভ্যস্ত।চরম দারিদ্রতা তাদেরে উপোস করতে শেখায়
এবং উপোস তাদের কাছে এক আধাত্মিক মার্গ, উপোসে বুঝি চিত্তশুদ্ধি হয়,মানুষকে
সংশোধিত করার অন্যতম অবলম্বন বুঝি উপোস করা।যে যত দিন উপোস করতে পারে ততই সে ব্যক্তি সমাজের কাছে
পরম শ্রদ্ধাভাজন হয়ে ওঠেন।একুশ
দিন অবধি উপোসের খবর মেলে গুজরাট আর রাজস্থানের জৈন সম্রদায়েরর মধ্যে।এক সময়ের
দারিদ্রক্লিষ্ট মানুষ আজ তেমন নয়, তবুও তারা উপোস চালিয়ে যাচ্ছে, আজ উপোসের হার
কমেছে তবে এখনো তা চলছে বিশেষ করে মহিলারা করছেন।
বাঙালি
বছরে এক দুদিন উপোস করে, সে আপামর বাঙালি নয়, অঙ্গুলিমেয়, তাও আবার কাষ্ঠা উপোস
নয়,গড় কাষ্ঠা উপোস বাংলায় কখনো ছিল না।দারিদ্রতার
কবলে পড়ে কাষ্ঠা উপোস করা এক, আর ধর্মের কারণে উপোস আর এক।নেতাজি উপোস
সামাজিক-রাষ্ট্রীয় ও স্বাধীনতা অর্জনের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ঐকান্তিকভাবে মেনে
নিতে পারেননি।
দক্ষিণ
আফ্রিকাতে সত্যাগ্রহ আন্দোলনের অনুকূল পরিনামের পর, মহাত্মা সেখানকার পাঠ চুকিয়ে
ভারতে চলে আসেন, তিনি প্রথমেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে গিয়ে
দেখা করেন(১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৫খ্রিঃ)।রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে
গান্ধিজির এ-ই প্রথম দেখা বলে জানা যায়। প্রথম দর্শনেই গান্ধি রবীন্দ্রনাথকে ‘গুরুদেব’ সম্বোধন করেন আর রবীন্দ্রনাথ ‘মহাত্মা’।এরপর গোপাল কৃষ্ণ গোখলের
পরামর্শে একটা বছর মহাত্মা ভারতের আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়ান।কোনও আন্দোলন নয়,শুধুমাত্র
প্রকৃত ভারতকে জানার চেষ্টা।গান্ধি অশিক্ষিত, দারিদ্র
পীড়িত,অনুজ্জীবীত, ক্লান্ত-নুব্জ ভারতীয়দের নিজ চক্ষে দেখে তাদের দশা মর্মেমর্মে
উপলব্ধি করেন এবং এর থেকে মুক্তি পাবার পথ খুঁজতে লেগে যান।তৎকালীন বিহারের
চম্পারনে গান্ধি এক দলিত ঘরের দাওয়ায় গিয়ে
উপস্থিত হন তৃষ্ণা মেটানর লক্ষ্যে।জীর্ণ
কুটীরের ভেতরে এক মহিলা ছাড়া আর কেউ ছিল না তখন।মহাত্মার সঙ্গে যে কয়েক সঙ্গী ছিলেন এঁদের মধ্যে একজন বললেন, মহিলাটি
প্রায় বিবস্ত্র কারণ তার পরার কোনও কাপড় নেই,সুতরাং সে বেরোতে পারছে না।জলের মতো
স্পষ্ট,এতোটাই দারিদ্রক্লিষ্ট লজ্জা নিবারণের জন্যে কাপড় কেনার পয়সা নেই।খাবারই
সংকুলান করতে পারছে না, কাপড় কেনা তো দূরের কথা।এই ঘটনার পর মহাত্মা তাঁর পরনের
বস্ত্র নদীর জলে ভাসিয়ে দিলেন, শধুমাত্র কটিবস্ত্র ধারণ করে সারাটা জীবন কাটালেন।এতে তাঁর কোনও সংকোচ ছিল
না, কারণ তিনি যে আমজনতার একজন বলে নিজেকে মনে করতেন।তখনকার কোনও দলিতের ঘরে জল
খাওয়া মানে সামাজিক বিধি লঙ্ঘন করা, সমাজের চোখে চক্ষুশূল হওয়া। গান্ধি এই অসাড়
সমাজের তুয়াক্কা করেননি,তিনি সমাজকে ছোয়াছুতের থাবা থেকে মুক্ত করতে
চেয়েছিলেন।উল্লেখ্য, মহাত্মার কটিবস্ত্র পরিধান প্রসঙ্গে তৎকালীন ব্রিটিশ
প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল তাঁকে ‘অর্ধ
নগ্ন ফকির’ বলে উপহাস করেন।মহাত্মার মানসিক স্তর এ’সমস্ত উপহাসের উর্ধে।
মহাত্মা ভারতের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত করতে
ইচ্ছুক ছিলেন না।স্বাধীনতা তখন তাঁর কাছে প্রাথমিকতা পায়নি, জাতপাত মুক্ত,
দারিদ্রমুক্ত,কুসংস্কার ও কুশিক্ষা মুক্ত ভারত গড়া তাঁর প্রাধান্যতা এবং তা তিনি
শাসক ইংরেজের সহায়তায় করতে চেয়ে ছিলেন।তিনি উপলব্ধি করতেন, রাজনৈতিক
স্বাধীনতা প্রকৃত স্বাধীনতা নয়। দেশ
স্বাধীন হলেও সামাজিক কুপ্রথার বন্ধন থেকে মুক্ত না হলে কেহ স্বাধীনতার মূল্য
বুঝবে না, বরং স্বাধীনতার অপব্যহার করবে, এতে দেশ রসাতলে যাবে।
অপর
পক্ষে, নেতাজির ধ্যানধারণা সম্পূর্ণ বিপরীত। নেতাজি দেশের আজাদির উপর বিশেষ গুরুত্ব
দেন।ইংরেজের সহায়তা ছাড়াই স্বাধীন ভারতের নাগরিকই দেশ গড়বে—এই ছিল তাঁর দৃঢ় সংকল্প এবং তা সম্ভব তখনই হবে ভারত যদি রক্ত দিয়ে
দেশের স্বাধীনতা অর্জন করে, কোনও প্রকার আপোষে নেতাজি রাজি ছিলেন না।চরম
বাধাবিপত্তির মধ্যেও জনসাধারণকে স্বাধীনতার পক্ষে জাগিয়ে তোলার কাজে তিনি সক্রিয়
ছিলেন।কয়েক
লক্ষ ইংরেজকে শাসন ক্ষমতা-চ্যুত তৎকালীন ত্রিশ কোটির উপরে ভারতবাসীর পক্ষে মোটেই
কঠিন কাজ নয় বলে নেতাজির ধারণা।কিন্তু মহাত্মা রক্তাক্ষয়ি সংগ্রামের পক্ষে ছিলেন
না।তিনি বাদসাধলেন।নেতাজির আক্রমণাত্মক নীতি তাই সর্বাত্মক সার্থক হয়ে ওঠেনি।কয়েকটি বিপ্লবী ঘটনা প্রবল
পরাক্রমশালী ইংরেকজে হটিয়ে দেশের ভেতর থেকে ইংরেজকে শাসন-চ্যুত করা সম্ভব নয় বলে
যখন নেতাজি বুঝলেন, তখনই দেশের বাইরে থেকে আক্রমণের সংকল্প নিলেন।এ কথা স্পষ্ট যে
মহাত্মার ‘সত্যাগ্রহ’
বিপ্লবী আন্দোলনের পুরোপুরি বিপরীতে।ত্রিপুরি কংগ্রেসে(১৯৩৯খ্রিঃ)সভাপতি হিসেবে
যদি নেতাজি বহাল থেকে যেতে পারতেন তা হলে হয়তো ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম অন্যখাতে
বইত,দেশে থেকেই নেতাজি সংগ্রাম চালিয়ে যেতে পারতেন।
নেতাজিকে বাইরে যেতে হলও।জাপানের সহায়তায়
আজাদহিন্দ ফৌজের মাধ্যমে নেতাজির আক্রমণ, আন্দামানকে ইংরেজ শাসন মুক্তকরা এবং ফলে
নৌ-বিদ্রোহ ও ভারতীয় সৈনিকদের মধ্যে স্বদেশীয়দের বিরুদ্ধে কোনরকম
আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ করতে অনিচ্ছা গান্ধিজিকে ১৮ অগাস্ট,১৯৪২-তে ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন’-এর নাড়া দিতে বাধ্য করে। তিনি বুঝে নিলেন ভারতবাসী
আর অপেক্ষায় থাকতে পারছে না, যত শীঘ্র পারা যায় তাদের স্বাধীনতা চাই।অবশ্য
মহাত্মার প্রতিটি অহিংস আন্দোলন বাস্তবে অহিংস থাকেনি, কোনও না কোনও ভাবে সহিংস
হয়ে ওঠে আর তখনই তিনি উপোসের মাধ্যমে সহিংসতার প্রতিবাদে বসতেন।
একটা
ব্যাপারে মহাত্মার সঙ্গে নেতাজির ব্যাপক মিল খুঁজে পাই—উভয়ই দেশের মানুষের নৈতিক চরিত্রের উপর গুরুত্ত দেন।ভ্রষ্টাচার তাঁদের
উভয়কেই অতিশয় ক্ষুব্দ করত।এঁরা দুজনই স্বাধীনত্তোর দেশ গড়ার কাজে নিজেদের নিয়োজিত
করতে পারেননি—আততায়ীর গুলিতে গান্ধি মৃত্যু বরণ করেন আর
নেতাজি রহস্যজনকভাবে আজও নিরুদ্দেশ।
মহাত্মা
তাঁর বই “ মাই ড্রিম ফর ইন্ডিয়া” (আমার স্বপনের ভারত)-তে লিখেছেন,
“ভারত
মুখ্যত কর্মভূমি, ভোগভূমি নয়...পৃথিবীতে ধর্মের( নৈতিক-আধ্যাত্মিক ও মানবিক মূল্য
বোধ)শ্রেষ্ঠত্ব স্থাপন করার কাজে ভারতই উপযুক্ত...এমন এক ভারত হবে যেখানে কোনও
দাসত্ব থাকবে না,দরিদ্রতম ব্যক্তিও অনুভব করবে যে এ তারই দেশ এবং এর উন্নতির জন্যে
যথাযোগ্য মর্যাদা সে পেয়ে যাবে।উচ্চ-নীচ, ধনী-দরিদ্র,
নারী-পুরুষে কোনও ভেদাভেদ থাকবে না, সকলেই সমান অধিকার পাবেন, সকল সম্প্রদায়
সৌহার্দের পরিবেশে বাস করবেন,অস্পৃশ্যতার অভিশাপ এবং সুরা ইত্যাদি মাদক দ্রব্যের
কোনও স্থান থাকবে না এবং বিশ্বের অপরাপর দেশের সংগে ভারতের সম্পর্ক হবে
শান্তিপূর্ণ।ভারত কাউকে শোষণ করবে না ও নিজেও কাউকে শোষণ করার সুযোগ দেবে না।সৈন্য
বাহিনী যথাসম্ভব খুদ্র হবে এবং ভারতের জনসাধারণের কল্যাণের পরিপন্থী না হলে
অভারতীয় স্বার্থসমুহকে সততার সংগে যোগ্য মর্যাদা দেওয়া হবে”।মহাত্মা
যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামর পক্ষে ছিলেন।
গ্রাম ভিত্তিক ভারত চেয়ে ছিলেন মহাত্মা।বড় শিল্প রাষ্ট্রয়াত্ত হওয়া চাই আর বাকিসব কুটির
শিল্প।কৃষিকার্যের ওপর জোর দিয়েছেন মহাত্মা।সর্বক্ষেত্রে যন্ত্র নির্ভরতা তাঁর
পছন্দের নয়। যন্ত্র যেন কোনও ক্রমেও মানুষের শ্রম কেড়ে নিয়ে বেকারত্ত সৃষ্টি না
করে, এ দিকে লক্ষ্য রাখতে বলেছেন মহাত্মা।তিনি
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণকামী দিকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তবে প্রযুক্তির
প্রয়োগ যেন মানুষের বেঁচে থাকার প্রয়োজনে হয়, বাহুল্য হয়ে না দাঁড়ায়।জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যাপারে তিনি সংযমকেই গুরুত্ব দিয়েছেন,
কোনো ওষুধ নয়, কোনো কৃত্রিম উপায় নয়।এ’ব্যাপারে
রবীন্দ্রনাথের সংগে তাঁর মতবিনিময় হয়—কবি গান্ধির এই
মনোভাব মানতে পারেননি।এই বিষয়ে উভয়ের
পত্র বিনিময় বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ১৩৩৫ খ্রিঃ খ্যাত মার্কিন সাংবাদিক স্যাঙ্গারের
সংগে মহাত্মার সাক্ষাৎকারে তাঁর জন্ম নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে মতামত বিশ্ববাসীর সম্মুখে
আসে।মোদ্দা কথা, স্বামী-স্ত্রীর যৌন সংযম দ্বারা
জন্মনিয়ন্ত্রণ চেয়েছিলেন মহাত্মা।
সার কথা,মহাত্মা এমন একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থার কথা চিন্তা
করেছিলেন যেখানে অমানবিক কাজকর্মের কোনও সুযোগ থাকবে না।দেশে ‘রাম
রাজ্য’ প্রতিষ্ঠা পাবে।গোটা বিশ্ব যেন ভারতের কাছে এক অনুকরণীয়
দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারে সেই লক্ষ্যে ভারতকে উন্নীত করা।
অপর পক্ষে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ত্রিপুরি
কংরেসে(১৯৩৮) যে বক্তৃতা প্রদান করেন তা থেকে স্বাধীন ভারত ও তাঁর সরকার কীরূপ
হবে, বিভিন্ন নীতি ও কার্যক্রম কী গ্রহণ করবে তাঁর একটি সম্যক রূপরেখা পাওয়া
যায়।ভারত যে বিভক্ত হতে পারে তা ব্রিটিশ নীতি থেকে তিনি আগাম বুঝতে পেরে ছিলেন এবং
কোনও মূল্যেও দেশ বিভাজন যাতে না হয় এর জন্য সতর্কীকরণ করে গেছেন। এই জন্যেই
সংখ্যা লঘুদের আশ্বস্ত করে বলে ছিলেন তাদের সহযোগিতা ও শুভেচ্ছা ছাড়া ভারতীয়
জনগণের ভালকরা যাবে না।
একথা উল্লেখ্য
যে,নেতাজি মহাত্মার মতাদর্শের পূর্ণ সমর্থক ছিলেন না।যেটাকে ভুল মনে করতেন তা
মানিয়ে নেবার পাত্র তিনি নন।কিন্তু এটা স্পষ্ট নেহেরু তাঁর ব্যক্তিগত অভিলাষ পূর্ণ
করার জন্য মতের মিল না থাকা স্বত্বেও গান্ধির পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলছিলেন।দেশের
প্রধান মন্ত্রী হওয়ার পর অবশ্য গান্ধির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ তেমন ছিল না বললেই
চলে।কংগ্রেস চাইছিল বল্লভভাই পেটেল হবেন স্বাধীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী, কিন্তু গান্ধির মধ্যস্থতায় প্রধানমন্ত্রী হলেন জওহরলাল নেহেরু।
বিবিসির এক সাক্ষ্যাতকারে ভিমরাও রামজি আম্বেদকর, যাকে ভারতের সংবিধান
তৈরীর প্রধান কারিগর বলা হয়, গান্ধির যে ছবি তুলে ধরেন তা মহাত্মা চরিত্রের বিপরীত।গান্ধিকে
তিনি মহাত্মা বলে সম্বোধন করেননি, বাপুজিও নয়,বললেন মিস্টার গান্ধি।তাঁর কাছে
গান্ধি নিছক এক
রাজনৈতিক নেতা।গান্ধি দুটি পত্রিকা চালাতেন - একটি গুজরাটি এবং অন্যটি ইংরেজি। কেউ
যদি উভয় পত্রিকা পড়েন তবে তিনি জানতে পারবেন যে তিনি উভয় পত্রিকায় একই বিষয়
কীভাবে আলাদাভাবে চিত্রিত করতেন। ইংরেজি পত্রিকায়
তিনি জাতপাতের ঊরদ্ধে এক আন্তর্জাতিক স্তরের মানব হিসাবে নিজেকে প্রতিপন্ন করতেন,
আর তাঁর আসল রূপ প্রকাশ পেত গুজরাটি পত্রিকায়—কোনও রাকঢাক না করে তিনি যে আসলে
জাত-পাতের সমর্থক, উচ্চ-নিচু ভেদাভেদ মানতেন তা প্রকাশ পায়।
সুভাষ বোস কখনই সাম্যবাদের সমর্থক ছিলেন না
বরং তিনি রাশিয়ান বলশেভিক মুভমেন্ট থেকে অনুপ্রাণিত, ভারতে সমাজতন্ত্রের ধারণা পোষণকারী
কয়েকজনের মধ্যে একজন। তিনি জয়প্রকাশ নারায়ণ প্রভৃতি সমাজতান্ত্রিক নেতাদের তীব্র সমর্থন করেন যারা
কংগ্রেসে সভাপতি নির্বাচনের সময় তাকে ভোট দিয়েছিলেন।উল্লেখ্য, নেতাজির
ফরোয়ার্ড ব্লক একটি সমাজতান্ত্রিক দল ছিল।তিনি ভারতে কমিউনিজমের ধারণাগুলি
প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তবে কমিউনিজম এবং ফ্যাসিবাদের সেই ভাল গুণাবলীকে শক্তিশালী
ভারত গঠনের পক্ষে অন্তর্ভুক্ত করতে সম্মত হন।
নেতাজি সর্বতোভাবে
সাম্প্রদায়িকতার উরধে ছিলেন।তিনি যেমন মুসলিম লিগের ঘোর বিরধি ছিলেন, ছিলেন ঘোর
বিরোধী হিন্দু মহাসভারও—নিরপেক্ষ, দ্বিচারিতাবিহীন মন এবং সে অনুযায়ী কার্যকারিতা
আজ কোথায়? তিনি ১৯৪০ সালের ৪ মে 'ফরওয়ার্ড ব্লক' সাপ্তাহিকের 'কংগ্রেস এবং সাম্প্রদায়িক সংগঠন'
শিরোনামে স্বাক্ষরিত সম্পাদকীয়তে, হিন্দু
মহাসভা ও মুসলিম লীগ উভয়ই "সাম্প্রদায়িক সংগঠন" হিসাবে অভিহিত করেন।
“There was a time not long ago when
prominent leaders of the Congress could be members and leaders of the
communal organizations like the Hindu Mahasabha and the Muslim League. In
those days the communalism of such communal organizations was of a subdued
character. Hence Lala Lajpat Rai could be a leader of the Hindu Mahasabha and
the Ali Brothers could be the leaders of Muslim League……… But in recent times,
the circumstances have changed. These communal organizations have become more
communal than before. As a reaction to this, the Indian National Congress has
put into its Constitution a clause to the effect that no member of a communal
organization like the Hindu Mahasabha or the Muslim League can be a member of
an elective committee of the Congress.”
“অনেক দিন আগে কংগ্রেসের
বিশিষ্ট নেতারা হিন্দু মহাসভা এবং মুসলিম লীগের মতো সাম্প্রদায়িক সংগঠনের সদস্য ও
নেতা হতে পারতেন। সেই দিনগুলিতে এই জাতীয় সাম্প্রদায়িক সংগঠনের সাম্প্রদায়িকতা
ছিল পরাধীন চরিত্রের। তাই লালা লাজপত রায় হিন্দু মহাসভার একজন নেতা হতে পারেন এবং
আলী ব্রাদার্স মুসলিম লীগের নেতা হতে পারেন ………
তবে
সাম্প্রতিক সময়ে পরিস্থিতি বদলে গেছে।এই সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলি পূর্বের চেয়ে
আরও সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠেছে। এর প্রতিক্রিয়া হিসাবে,
ভারতীয়
জাতীয় কংগ্রেস তার সংবিধানে এই ধারার একটি ধারা দিয়েছে যে হিন্দু মহাসভা বা
মুসলিম লীগের মতো সাম্প্রদায়িক সংগঠনের কোনও সদস্য কংগ্রেসের কোনও নির্বাচনী কমিটির
সদস্য হতে পারবেন না। ”
(Reference : Netaji Collected Works, Volume 10, Pg 98)
১৯৪২
সালের ৩১ আগস্ট জার্মানির আজাদ হিন্দ রেডিওর একটি সম্প্রচারে নেতাজি মহাত্মার নেতৃত্বে ভারত ছাড়ো আন্দোলন সম্পর্কে
উচ্চ ধারণা পোষণ করেন, ভারতবাসীকে
সংগ্রাম চালিয়ে যেতে আহ্বান জানান, কীভাবে
এটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, এর কিছু ধারণাও তিনি দিয়েছিলেন যা শুনে
সাম্রাজ্যপন্থী মিডিয়া (বিবিসি)শেষমেশ বিষয়টি সম্প্রচার করতে বাধ্য হয় বলেও
উল্লেখ করেন।
সেই
ভাষণে নেতাজি জিন্না ও সাভারকরের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশের সাথে সমঝতায় না যেতে আহ্বান
জানিয়েছিলেন।
“… I would
request Mr. Jinnah, Mr.Savarkar, and all those leaders who still think of a
compromise with the British, to realize once for all that in the world of
tomorrow, there will be no British Empire. All those individuals, groups or parties
who now participate in the fight for freedom will have an honoured place in the
India of tomorrow.
The supporters of British imperialism will naturally become
non-entities in a free India…”
“…
আমি
জনাব জিন্নাহ, মিঃ সাভারকর এবং
সেই সমস্ত নেতাদের অনুরোধ করব যারা এখনও ব্রিটিশদের সাথে সমঝোতার কথা ভাবেন,
আগামীকাল
বিশ্বে একবারে বুঝতে হবে যে কোনও ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থাকবে না। এই সমস্ত ব্যক্তি,
গোষ্ঠী
বা দল যারা এখন স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছে আগামীকালকের ভারতে এটি একটি
সম্মানজনক স্থান পাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সমর্থকরা স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীন
ভারতে অ-সত্তা হয়ে উঠবে… ”
Reference:
1. Selected Speeches of Subhas Chandra Bose, Pg 116–117,
Publications Division, IB Ministry)
2. Netaji Collected Works, Volume 11, Pg 144 )
গান্ধিজি চেয়ে ছিলেন দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কংগ্রেসকে এক
সেচ্ছাসেবি দল হিসেবে রূপান্তর করা কারণ কংগ্রেসের যা কিছু মন্দ রয়েছে রাজনৈতিক দল
হিসেবে, এ গুলি যাতে স্বাধীন ভারতে সংক্রামিত না হয়।এই মন্দ বলতে তিনি কি তাঁর
প্রণীত অসহযোগ আন্দোলনের কথা বললেন? দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য অসহযোগ আন্দোলন
কাজে লাগানো যেতে পারে, তবে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরে এ’হবে
হীতে বিপরীত—মানুষ কর্মে শৈথিল্য দেবে এবং বিনা পরিশ্রমে প্রাপ্তির
আশায় থাকবে, অর্থাৎ অসহযোগ কর্মরত মানুষের স্বভাবজাত এ-যে দেশ-দশের হীতের পরিপন্থী।নেতাজি মহাত্মার সংগে এক মত হতে পারেননি।তিনি চেয়েছিলেন
কংগ্রেস রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বাধীনোত্তর ভারতে সক্রিয় ভাবে কাজ করবে।যেহেতু স্বাধীনতা আন্দোলনে এই দলের
গুরুত্ব অসামান্য, এই দল
রাজনৈতিক দল হিসেবেই থাকবে, অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি কংগ্রেসকে স্বৈরাচারী হতে
দেবে না। কিন্তু তাঁর এই ধারণা পাল্টে যায় ১৯৩৮তে কংগ্রেস সভাপতি পদ থেকে ইস্তফা
দেবার পর।হয়তো এর আগেই কংগ্রেস সম্পর্কে তাঁর বিপরীত চিন্তা দানা বাঁধতে থাকে।তিন
২২ জুন ১৯৩৯খ্রিঃ কংগ্রেস ছেড়ে ফরওয়ার্ড ব্লক নামে রাজনৈতিক দল গঠন করেন।প্রসঙ্গত,
দুর্ভাগ্যবশত তাঁর উত্তরসূরি দলটাকে দেশের কাজে লাগাতে পারেননি—কংগ্রেসের
বিকল্প হিসেবে ফরওয়ার্ড ব্লক দাঁড়াতে পারতো, কারণ নেতাজির আদর্শ নিহিত এই দলের
ইস্তাহারে।
স্বাধীন ভারতে দেশের মূল সমস্যাগুলি কী ও কীভাবে তা দূর
করা যাবে বলতে গিয়ে নেতাজি জাতীয় পরিকল্পনার কথা বলেন।এই অনুসঙ্গে সর্বাগ্রে একটি
জাতীয় কমিশন গড়া চাই যার মাধ্যমে নীতি
নির্ধারণ করা যাবে এবং যথারীতি কার্যক্রম বাস্তবায়িত করা সম্ভব হবে। নেতাজি সমাজবাদের পক্ষে ছিলেন।এছাড়া,স্বাধীন ভারতের একটি জাতীয় ভাষা ও লিপির ওপর তিনি
জোর দেন, যা জাতীয় ঐক্যকে সুদৃঢ় করবে বলে তিনি ত্রিপুরি কংগ্রেসের এক সভায় তাঁর
বক্তব্যে তুলে ধরেন।সেই ভাষা হবে হিন্দুস্তানি আর লিপি রোমান।
মহাত্মা গান্ধি ও নেতাজি সুভাষ-এর বৈশিষ্টপূর্ণ
পর্যালোচনা, এই দুই মহা মানব সম্পর্কে তুলনামূলক বিশ্লেষণ একটি স্মরণিকার পাতায়
তুলেধরা সিন্ধুতে বিন্দুমাত্র।এখানে শুধুমাত্র এক চামচ পরিলেখ সৃষ্টিকরার চেষ্টা
করা হলও।